ব্যস্ত শহরের প্রাণকেন্দ্র। অফিসযাত্রীদের ভিড়, প্রচুর গাড়িঘোড়া, বাজারে হাঁকাহাঁকি, পর্যটকদের আনাগোনা।এবং এক আশ্চর্য মন্দির।
লাক্সর শহরের মাঝখানটা চার বেলাই জমজমাট, সেখানে পৌঁছে গাড়ি থেকে নেমে লাক্সর মন্দিরে ঢোকার লাইন। প্রাচীন মিশরের যে কোনও কীর্তিই হাঁ করে দেখতে হয়, এতে আলাদা করে অবাক হওয়ার তেমন কিছু নেই,কিন্তু লাইন পেরিয়ে এই মন্দিরে ঢুকে তাকে চিনতে-জানতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে বিস্ময়ের অনন্যতা বোঝা যায়।
সে প্রসঙ্গে আসার আগে মন্দিরের ইতিহাসটা বলি। খ্রিস্টপূর্ব ১৪০০ অব্দ। লাক্সরের নাম তখন থিবস। ‘ইপেত রেসাইত’ নামে এক মন্দির তৈরি হল, মিশরীয় ভাষায় যার অর্থ দক্ষিণের পবিত্রস্থল বা ‘দ্য সাদার্ন স্যাঙ্কচুয়ারি’। নীলনদের দু’পার জুড়ে ছড়িয়ে লাক্সর শহর। পূর্ব, পশ্চিম দুই তীরেই অনেকগুলো অসামান্য মন্দির। পূর্ব তীরে যে দু’টো মন্দির ধর্মের কারণে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিল তার একটা লাক্সর। এই মন্দিরের বৈশিষ্ট্য— বিশেষ কোনও দেবতার উদ্দেশে নিবেদিত নয়, কিংবা মৃত্যুর পর কোনও ফারাওর ওপর দেবত্বও আরোপ করা হয়নি।এই মন্দির রাজতন্ত্রের নবজীবনে উৎসর্গীকৃত। মনে করা হয়, অনেক ফারাওর অভিষেক হয়েছিল এখানে। সব অবশ্য সত্যি নয়। যেমন গ্রিক রাজা আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট দাবি করতেন, এই মন্দিরে নাকি তাঁরও রাজ্যাভিষেক হয়েছিল, অথচ তিনি কোনও দিন কায়রোর দক্ষিণেই যাননি।
দুই ফারাও তৃতীয় আমেনহোটেপ ও দ্বিতীয় রামসেস-এর শাসনকাল জুড়ে তৈরি হয়েছিল এই মন্দির।প্রাচীন মিশরের দ্বিতীয় চান্দ্রমাসে ‘ওপেত’ নামে এক জমকালো উৎসব হতো। থিবস এবং মিশরের সবচেয়ে বড়ো এই ধর্মীয় উৎসবের কেন্দ্রে থাকতেন সূর্য ও বায়ুর দেবতা আমুন। মূলত ওপেত উদ্যাপনের জন্যই মন্দির বানানো হয়েছিল। উৎসবের দিনগুলোতেথিবস-ত্রয়ী আমুন, মুত ও খোনসুর-এর নৌকা-মন্দিরগুলো কার্নাক মন্দির থেকে লাক্সর মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হতো। প্লাবনের সময় তিন দেবতার পুনর্মিলন ঘটত।এই মিলন ছিল উর্বরতা আর নবজীবনের প্রতীক।
এ-বারঅনেকখানি এগিয়ে চলে আসি খ্রিস্টপূর্ব ৩০ অব্দে। তখন রোমান টলেমাইক রাজবংশ মিশর দখল করে। দখল হয় লাক্সর মন্দিরও। ফারাওদের এই মন্দিরে হাঁটতে হাঁটতে উত্তর-পূর্ব কোণে পৌঁছলেই চোখে পড়বে একটা ব্যাসিলিকা— রোমান ক্যাথলিক গির্জা। প্রথমে ৩৯৫ খ্রিস্টাব্দে সেখানে খ্রিস্টানদের বিশেষ প্রার্থনাসভাটেট্রার্কি কাল্ট চ্যাপেল তৈরি করা হয়েছিল। পরে তা পাল্টে বানানো হয় চার্চটি। অবশ্য লাক্সরকে ধর্মের চেয়ে সেনাঘাঁটি হিসেবে গড়ে তুলতেই বেশি করতেই তৎপর ছিল রোমানরা। ওই এলাকায় দুর্গ বানিয়েছিল তারা, যেখানে ১৫০০ সৈন্য থাকত। ধর্মীয় অনুষ্ঠান হলেও বাহিনীর কার্যকলাপই ছিল মূল। সেনাবাহিনীর বাড়ি তৈরির কাজে মন্দিরের কিছু স্থাপত্যও ব্যবহার করা হয়েছিল। তবু মন্দিরের ভেতরে গির্জাটিইকেবল আজ স্বমহিমায় বিরাজমান।
শেষ অবধি অবশ্য মিশর আর কব্জায় রাখতে পারেনি রোমানরা।হাতে থাকেনি লাক্সর মন্দিরও।৬৪০ খ্রিস্টাব্দে তার থামের ওপরেই আবু হাগ্গাগ মসজিদের ইমারত খাড়া করা হয়।প্রত্যেক বছর শেখ ইউসুফ আবু এল হাগ্গাগ নামে এক সন্তের ‘মৌলিদ’ বা জন্মদিন উদ্যাপন করেন লাক্সরবাসী।নবি মহম্মদের বংশধর মনে করা হয় তাঁকে। জন্ম দামাস্কাসে, পরে চলে যান মক্কায়, এবং শেষ অবধি পাকাপাকি ভাবে ঠাঁই নেন এই লাক্সরে। তাঁকে তাই ‘তীর্থযাত্রার জনক’ বলা হয়। কিংবদন্তি অনুসারে, লাক্সর শহরে ইসলাম ধর্ম নিয়ে এসেছিলেন তিনিই। তিনি কোনও মসজিদ তৈরি না করলেও একটামসজিদকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন। তারই নাম আবু হাগ্গাগ।
এটাই লাক্সরের বৈশিষ্ট্য। একটা মন্দির চত্বর, তার থামের ওপর মসজিদ, আর এক কোণায় গির্জা। তিনটেই একসঙ্গে দিব্যি রয়েছে। মসজিদে চলছে উপাসনা। আর প্রতি দিন টিকিট কেটে মন্দির চত্বরে ঢুকছেন হাজার হাজার পর্যটক।দেখছেন গির্জাটাও।
ওপেত উৎসবের কথা হচ্ছিল। প্রাচীন যুগে লাক্সরে এই উৎসবই সবচেয়ে জাঁক করে হতো। গ্রীষ্মকালে দুই থেকে চার সপ্তাহ— নীলনদের বন্যার দ্বিতীয় মাসের হিসেবে— এই উদ্যাপন চলত। ফারাও শাসনের তৃতীয় যুগ, নব্য রাজত্ব বা ‘নিউ কিংডম’-এর আমলে এই উৎসব বড়ো চেহারা পায়। থিবসের পূর্ব তীরের দুই বিরাট মন্দির লাক্সর ও কার্নাকের দূরত্ব আড়াই কিলোমিটার, দুইয়ের মধ্যে যোগাযোগের জন্য একটা সরণি ছিল, কেবল উৎসবের সময় ব্যবহৃত হতো। সেই রাস্তা দিয়েই দেবতাদের কাঁধে করে বয়ে আনতেন পুরোহিতেরা। মাঝে মাঝে আচার-অনুষ্ঠানের জন্য থামতেন, পথে পড়ত ছ’খানা নৌকা-মন্দির। এই উৎসবে ফারাও-র ক্ষমতা তো প্রমাণিত হতোই, দেবতার আমুনের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতাও প্রতিষ্ঠিত হতো। ফারাওকেও যে পৃথিবীর মাটিতে দেবতা হোরাসের জীবন্ত প্রতিমূর্তি বলে মনে করতেন প্রাচীন মিশরীয়রা।
এখন সেই চত্বরে তেমনই ধুমধাম করে পালিত হয় ‘মৌলিদ’। এই ‘সন্তের উৎসব’-এ নানা বিশ্বাসের সুফিরা সইদি সংগীত ও তাহতিব নৃত্য পরিবেশন করেন এবং সমাধিস্থ হওয়ার উদ্দেশ্যে বারবার আল্লার নাম করতে থাকেন। তিনদিনব্যাপী উৎসবে হাজার দর্শনার্থীর ভিড় হয় আবু হাগ্গাগ মসজিদে। সকলের গায়েই রংচঙে নতুন পোশাক। চারপাশের রাস্তায় প্রবল ভিড়।মেলাও বসে। ছোটো ছোটো স্টলে মিষ্টি আর খেলনা বিক্রির ধুম। কোথাও কোথাও ঘোড়দৌড়ের আয়োজন। এই সব কিছুর মধ্যে কিন্তু সবচেয়ে জরুরি হলো নৌকাবিহার।
সেই প্রসঙ্গেই ফেরওপেত উৎসবের কথা চলে আসবে। কার্নাক থেকে লাক্সর মন্দিরে স্ফিংস-সরণি ছাড়াও আসার আর একটা উপায় ছিল জলপথ। নীলনদের ওপর দিয়ে নৌকা করে দেবতাদের এক মন্দির থেকে আর এক মন্দির নিয়ে আসা হতো। মন্দিরের গায়ের কারুকাজ থেকে সেই ইতিহাস জানা যায়। এখনকার তিনদিনব্যাপী উৎসবেও শহরের মধ্যে দিয়ে যে শোভাযাত্রা হয়, তাতে একটা ফেলুকা (মিশরের ঐতিহ্যবাহী পালতোলা নৌকা) টেনে টেনে আনা হয়। প্রাচীন মিশরীয়দের ওপেত উৎসবের এটুকু চিহ্নই আজও বেঁচে আছে। মুসলমানদের মৌলিদ উৎসবের ভেতর দিয়ে।
মজার কথা, লাক্সরের কাছে রাজাগাত নামে এক গ্রামে খ্রিস্টানরাও ‘মৌলিদ’ পালন করেন। ১১ নভেম্বর তারিখ মার গিরগিস-এর— যাঁর খ্রিস্টান নাম সেন্ট জর্জ—স্মরণে উদ্যাপিত হয়।
ধর্মের সহাবস্থানের কথা আমরা বলি। বিশ্বাস করি, সব সময়ই প্রতিটি মানুষ নিজস্ব ভাবনা আর বিশ্বাস নিয়ে একসঙ্গে আনন্দে থাকবেন। কেউ কারও সঙ্গে সংঘাতে জড়াবেন না। সংঘবদ্ধ ভারতে সেই উদাহরণ অসংখ্য, বস্তুত তার জোরেই এত বড়ো দেশটা যুগ যুগ ধরে নিশ্চিন্তে টিকে আছে। আরব দুনিয়াতেও সেই একই ছবি দেখে বিস্মিত, মুগ্ধ হলাম। সমস্ত সম্পর্কই সহজ এবং সম্প্রীতির তা বলছি না। ভারতেও নয়, মিশরেও নয়। কিন্তু একসঙ্গে থাকার ইচ্ছে আছে, চেষ্টা আছে। দেখলে তা বোঝা যায়।
মসজিদে তখন ইশার নামাজের আজান শুরু হয়েছে। সূর্যাস্ত হয়ে গিয়েছে। মন্দিরের গায়ে জ্বলে উঠেছে অসংখ্য নিয়নের আলো, মসজিদের মিনার আধুনিক এলইডি-তে আলোকিত, চার পাশে ঝলমলিয়ে উঠেছে লাক্সর শহরখানাও। এ-বার ফেরার পালা।
দুই মন্দিরের সংযোগকারী রাস্তাটা বছর দশেক আগে পুরাতত্ত্ববিদেরা খুঁজে পেয়েছিলেন। তার দু’ধার ধরে লাইন করে স্ফিংস-এর মূর্তি বসানো। এই আলোয় সেই রাস্তাখানা বড়ো চমৎকার দেখাচ্ছিল।ঢোকার সময় যে সব বিশাল বিশাল বেলেপাথরের মূর্তি আর থাম দেখে চোখে সরাতে পারছিলাম না, তখন যেন তার অন্য এক রূপ। সুন্দর, তবে তার চেয়ে অনেক বেশি মায়াবি। প্রাচীন মিশরের ইতিহাসের মতোই।