‘I can doubt everything, except one thing, and that is the very fact
that I doubt. Simply put – I think, therefore I am.’
লেনিন তাঁর ‘পোলিটিকাল সিগনিফিক্যান্স অব ভিটুপারেশান’ শীর্ষক আলোচনায় নিজেই প্রশ্ন তুলেছিলেন যে গালাগালির ভাষা কি আদৌ কোনও রাজনৈতিক গুরুত্বের প্রতিফলক হতে পারে? এরপর নিজেই এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে লিখেছিলেন যে, নিশ্চয়ই পারে। কীভাবে পারে, সে প্রসঙ্গে তিনি জানিয়েছিলেন যে, ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের মার্চ এবং ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে প্লেখানভ, ট্রটস্কি এবং বিলোপবাদীরা ঐক্যবদ্ধভাবে এবং সমস্বরে লেনিন এবং প্রাভদাপন্থীদের আক্রমণ করতে গিয়ে ‘বেআইনি দখলদার হয়’ বলে অভিহিত করেছিলেন। কেন তাঁদের আক্রমণের এই ভাষা? কারণ লেনিনের নেতৃত্বে জনসাধারণ ‘বেআইনিভাবে ক্ষমতা দখল’ করেছিলেন। ক্ষমতা দখল আইনিভাবে (এখন অবশ্য আইনিভাবেই রাতদখল, ভোরদখল হয়, রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের কথা একবারও আসেনা, কেননা তা আইনি পদ্ধতি স্মভব নয়) হয় না কি? অবিশ্রান্তভাবে এইসব ভাষাপ্রয়োগের মধ্যে দিয়ে প্লেখানভ-ট্রটস্কি-বিলোপবাদীরা আসলে অলস বকবকানির মধ্যে দিয়ে সময় অতিবাহিত করতেন। স্বভাবতই তাঁরা বিপ্লবের প্রতিপক্ষতা করেছিলেন। আক্রমণের লক্ষ্যে এইসব গালাগালির ভাষা প্রয়োগ করে তাঁরা রুশ বিপ্লবের গতিরোধ করতে পারেন নি। লক্ষণীয় লেনিন কিন্তু এই গালাগালির প্রতিপক্ষে পালটা গালাগালির পক্ষে সওয়াল করেন নি।
লেনিনের এই লেখাটি প্রকাশের ১১০ বছর পরে (লেখাটি ‘প্রাভদা’য় প্রকাশিত হয়েছিল ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জুন) আমাদের এই পশ্চিমবাংলায় এখন আক্রমণের ভাষা হিসেবে বিভিন্নমাত্রিক গালাগালি তথা অপ কিম্বা অবিহিত ভাষার ফুলঝুরি ছুটছে। কারও মতের বিপক্ষতা করলেই ধেয়ে আসছে আক্রমণের ভাষা হিসেবে অশ্লীল, অশিষ্ট, অবিহিত কিম্বা অপশব্দের তুফান। এই ভাষিক আক্রমণ অনেক সময় থ্রেট কালচারের সঙ্গে যুগলবন্দিত্বে ধেয়ে আসছে। অমিত শাহ যেমন পা গাছে বেঁধে ঝুলিয়ে ‘সোজা’ করার অনিন্দাযোগ্য নিদান দেন, কিম্বা আগামি ২০২৬-এর ফেব্রুয়ারির মধ্যেই বস্তার তথা সারা দেশ থেকে মাওবাদকে নিকেশ করার জন্যে নির্মমতম পদ্ধতি অনুশীলনের কথা সগর্বে ঘোষণা করেন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবেই, তেমনই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিরোধীদের প্রায় একইরকমভাবে হুমকি দিয়ে চলেছেন অশ্রাব্য ভাষার বিস্ফোরণ সহকারেই। আরজিকর-এর ঘটনার পরে তো ‘আরজিকর করে দেবো’ একইসঙ্গে হুমকি ও থ্রেট কালচারের নতুন নমুনা হিসেবে বিভিন্ন স্থানে ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব এখন আর নিন্দাযোগ্য বলে বিবেচিত হয়না, আমরা এসবে ক্রমশই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। উত্তরপ্রদেশের এক বিজেপি নেতা তো কবর থেকে মুসলিম মেয়েদের তুলে এনে ‘রেপ’ করার ঐতিহাসিক নিদান দিয়েছিলেন! আমাদের স্মৃতিশক্তির তারল্য সেসব ভুলিয়ে দিয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের সরকারি ক্ষমতাচ্যূত এবং আকাশচুম্বী ক্ষমতালোভী ‘বাম’পন্থী দলটি তো তাঁদের বিরুদ্ধবাদীদের আক্রমণ করতে গিয়ে এখন প্রায়শই ‘চটিচাটা’ বলে থাকেন। বুটচাটা বা জুতোচাটা শব্দ তাঁদের মনে ধরেনি কারণ তাঁদের এই শব্দপ্রীতির উৎস তো এরাজ্যের মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর হাওয়াই চটি পরার নজির (এই শব্দবন্ধের মধ্যে কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যবাদী মনোভঙ্গি পুরোমাত্রায় রয়ে গিয়েছে)। তাঁর দলীয় কিম্বা তাঁর সমর্থক কিম্বা তাঁর মতামতের সান্নিধ্যে চলে আসা কারও বক্তব্যের সরল সমীকরণকে আক্রমণের জুতসই শব্দআস্ত্র হিসেবে এই চতুর্বর্ণ-টিকে বেছে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এই তথাকথিত ‘বাম’পন্থী দলটির এই চর্চিত শব্দটি আমাদের বিপ্লবী বামপন্থী মহলেও সাদরে এবং অবাধে গৃহীত হয়ে গিয়েছে! ভাষিক আক্রমণের জুতসই শব্দ হিসেবে এই চতুর্বর্ণ-টিকে এখানেও নির্দ্বিধ এবং প্রশ্নহীন মান্যতা দেওয়া হচ্ছে! জুনিঅর ডাক্তারদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে কেউ কোন প্রশ্ন তুললে এই আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা প্রশ্নকর্তাকে ‘চটিচাটা’ বলে ভাষিক আক্রমণ করে বসছেন। এমনকি এমন সংবাদও পাওয়া গিয়েছে যে এই আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি নিয়ে প্রশ্ন তুলে কিম্বা এই আন্দোলনের বর্তমান পর্যায় নিয়ে অন্যমত পোষণ করে বিপ্লবী বামমহলেও পার্টি কর্মী কার্যত থ্রেট কালচারের শিকার হচ্ছেন, তাঁর প্রশ্ন-করার প্রবণতাকে ছাড়পত্র দেওয়া হচ্ছে না। অথচ রেনে দেকার্ত-এর অনুসরণেই মার্কস সবকিছুকেই সন্দেহের মধ্যে দিয়ে বিচারের পক্ষপাতী ছিলেন। সন্দেহের মধ্যে থাকে প্রশ্ন, আর প্রশ্নের উত্তর সন্ধানের মধ্যেই ঘটে বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনার স্ফূরণ। স্বভাবতই প্রশ্ন করা সবসময় সঙ্গত। প্রশ্ন করা, প্রশ্ন তোলা মার্কসবাদসম্মত। প্রশ্ন-করাকে হুমকির মধ্যে দিয়ে অবদমিত করার প্রক্রিয়ায় মার্কসবাদের অস্তিত্ব নেই। অন্যদিকে মাও তো ‘শত ফুল প্রস্ফুটন’ এবং ‘শত মতের প্রতিদ্বন্দ্বিতা’র পক্ষে সওয়াল করেছিলেন ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে। আর মুখে মাও-এর উদ্ধৃতি-দিতে-অভ্যস্ত পার্টি কর্মীরা যখন এই শত ফুল প্রস্ফুটনের এবং শত মতের প্রতিদ্বন্দ্বিতার বাস্তবায়নে ভীত, আশঙ্কিত হয়ে সহযোদ্ধাকে মুখ বন্ধ রাখার ভাষিক হুমকি দেন, তখন এই মতাদর্শিক অবনমনে বিপন্ন হতে হয় বই কি। মনে রাখতে হবে এই জুনিয়ার ডাক্তারদের এই আন্দোলনের পথ ও পদ্ধতি নিয়ে যাঁরা প্রশ্ন তুলছেন কিম্বা একটু অন্যসুরে কথা বলছেন তাঁরা কিন্তু বুদ্ধিজীবী, চিন্তক শ্রেণীভূক্ত। মাও বলেছিলেন : ‘সমস্ত পার্টি কর্মীকেই উপলব্ধি করতে হবে যে বিপ্লব জয়যুক্ত করার অন্যতম শর্ত হচ্ছে বুদ্ধিজীবীদের সম্পরেকে নির্ভুল নীতি নির্ধারণ।’
গতকাল (১৮ অক্টোবর) এক সাধারণ সভা থেকে আন্দোলনকারী জুনিয়ার ডাক্তারদের তরফ থেকে রাজ্যসরকারকে ‘হুঁশিয়ারি’ দিয়ে জানানো হয়েছে যে, তাঁদের দাবিগুলি সোমবারের (২১ অক্টোবর) মধ্যে মেনে না নিলে মঙ্গলবার ২২ অক্টোবর রাজ্যজুড়ে সমস্ত ডাক্তারদের সর্বাত্মক ধর্মঘট হবে এবং যদি ঐদিন চিকিৎসার অভাবে যদি কোনও রোগীর জীবন সংশয় হয় বা মৃত্যু ঘটে তবে তার দায় সরকারকে নিতে হবে। অর্থাৎ নিজেদের ধর্মঘটের কারণে কোনও রোগীর জীবন বিপন্ন হলে সরকার তার দায়িত্ব নেবে! এটা যদি ‘ইনফ্যানটাইল ডিজঅর্ডার’ না হয় তবে সেটা ঠিক কী তা গবেষণার বিষয় হতে পারে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে আন্দোলনরত জুনিঅর ডাক্তারদের পেশ করা দশ দফা দাবির মধ্যে চারটি দাবি সরকার এখনও মেনে নেয়নি, বাকিগুলো মেনে নিয়েছে কিম্বা মান্যতা দিয়ে কাজ চলছে। তাহলে তো দাবির ৬০ শতাংশ সরকার মেনে নিয়েছে। সরকার দাবি মানেনি এই প্রচারের অর্থ তাহলে কী হতে পারে?
একটু (১৯ অক্টোবর) আগে প্রচারিত সংবাদে জানা গিয়েছে সরকার আন্দোলনকারী জুনিয়ার ডাক্তারদের একটি বাদে বাকি দাবিগুলিও মেনে নিচ্ছেন এবং আজ ২১ তারিখ সন্ধ্যে পাঁচটায় নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী আন্দোলনকারীদের ১০জনকে আলোচনার জন্যে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন এবং একইসঙ্গে তাঁদের অনশন ভঙ্গ করে কাজে যোগ দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। জানিনা এই প্রস্তাবে আন্দোলনকারীরা সাড়া দেবেন কি না, আলোচনায় সুরাহা হবে কি না। যদি এই অচলাবস্থার অবসান হয় তো ভালো, আর যদি আন্দোলনকারীরা অনড় থেকে ২২ অক্টোবর সারা রাজ্যে সমস্ত হাসপাতালে সর্বাত্মক ধর্মঘট করেন তবে তা এক ভয়াবহ সমস্যাকে অবধারিত করে তুলতে পারে।
একটা কথা বলা দরকার যে, ডাক্তারদের এই আন্দোলনে একদিকে যেমন বিপুল জনসমর্থন রয়েছে, তেমনই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের তরফে এই আন্দোলনকে নিজেদের স্বার্থাভিমুখী করে তুলতে আপ্রাণ প্রয়াস জারি আছে। যে কোনও মূল্যে এই আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে যেতে তাঁরা প্রভাব বিস্তার করে চলেছেন অবশ্যই আগামী ছাব্বিশের নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে। ‘অরাজনৈতিক আন্দোলন’কে সব বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিই তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করে চলেছে অনলসভাবে। স্বভাবতই এই আন্দোলনের ভেসে যাওয়ার বিপরীতে এই আন্দোলন নিয়ে কিছু ভিন্ন সুরে কথা বললেই এই রাজনৈতিক দল এবং তাদের সমর্থকরা রে রে করে তেড়ে আসছেন এবং এই ভিন্নমতের মধ্যে সরকারি মতের সমর্থনের অতিসরলীকরণের প্রক্রিয়ায় তাঁদের অবলীলায় ‘চটিচাটা’ আখ্যা দিয়ে দিচ্ছেন। একদল এই আন্দোলনের সমর্থকদের মধ্যে নকশালপন্থী এবং মাওবাদীদের সন্ধান পেয়ে আঁতকে উঠছেন, অন্যদিকে এই আন্দোলন প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলে, ভিন্নসুরে কথা বললে, সবাই একযোগে তাঁকে বা তাঁদের সর্বদলপ্রিয় ‘চটিচাটা’ বিশেষণে বিশেষিত করে তৃপ্তির উদ্গার তুলছেন।
লেনিন তাঁর ‘ওয়ান স্টেপ ফরওআর্ড টু স্টেপস ব্যাক ওআর্ড’ গ্রন্থে এক জায়গায় বলেছেন : পার্টি সদস্যদের সংকীর্ণ মনোবৃত্তি এবং তাঁদের বিস্ময়কর অজ্ঞতার কারণেই তাঁরা বিতর্কের খোলা হাওয়ায় মুখোমুখি দাঁড়াতে সাহসী হতে পারেন না।—আর পারেন না বলেই এইসব শস্তা ভাষিক আক্রমণের নজির রাখেন, ভিন্ন মতপ্রকাশে বাধা দেন। বস্তুত এঁদের দর্শনগত দারিদ্র্য নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ থেকেই যায়। এই গ্রন্থের অন্য এক জায়গায় লেনিন সমসময়ে ভাষিক আক্রমণের বিভিন্ন শব্দবন্ধ (যেমন স্বৈরতন্ত্রী, আমলাতান্ত্রিক, একচোখো, গোঁয়ার, সংকীর্ণমনা, সন্দেহবাতিকগ্রস্ত, ঝগড়ুটে ইত্যাদি) উল্লেখ করে জানতে চেয়েছিলেন যে তাঁদের (অর্থাৎ ভাষিক আক্রমণকারীদের) ঝুলিতে আর কোনও শব্দ আছে কি না। আর তারপর ব্যঙ্গ করে তাঁদের বলেছিলেন তাঁদের এই স্বল্প ভাঁড়ারের জন্যে তাঁর করুণা হয়। লক্ষণীয় লেনিন কিন্তু একবারও পালটা ভাষিক আক্রমণের পক্ষে সওয়াল করেন নি।
জুনিয়ার ডাক্তারদের এই আন্দোলনের চলমান পর্যায়ে নতুন নতুন পদ্ধতির যে জোয়ার বইছে, আগুপিছু চিন্তা ব্যতিরেকে সেই জোয়ারে ভেসে যাওয়াও যে সঠিক কাজ নয় এর সমর্থন মেলে লেনিন-এর ‘টু ট্যাক্টিস অব সোশ্যাল-ডেমোক্রাসি ইন দ্য ডেমোক্রাটিক রেভোল্যুশান’ গ্রন্থে। সেখানে তিনি এক জায়গায় বলছেন : অতীতকে ভুলে যেও না, এই নতুনের জোয়ারে ভেসে যেও না।—অর্থাৎ চোখ-কান খোলা রেখে কাজ করাই শ্রেয়। আবেগের আতিশয্যে যুক্তি-বিসর্জনের বাজনা বাজতে থাকে। অথচ যুক্তিই মার্কসবাদে গ্রাহ্য। ফ্যাসিস্তরা স্বভাবতই যুক্তিদ্রোহী। তারা উগ্র জাতিয়তাবাদের আবেগি জোয়ারে যুক্তিকে চির-নির্বাসিত করতে চায়। আর একারণেই মার্কসবাদ এবং কমিউনিস্টরা ফ্যাসিবাদের চোখে ঘোরতর শত্রু বলে চিহ্নিত এবং নিকেশযোগ্য বিবেচিত হয়।
কিন্তু এই যুক্তি যদি বাম মতাদর্শিক অঙ্গনে অগ্রহণযোগ্য হয়, প্রশ্ন-করা এবং ভিন্ন মত প্রকাশকে যদি হুমকি দিয়ে দমিয়ে রাখার প্রবণতা জারি থাকে, তবে তা আগামীদিনে আমাদের দেশে ফ্যাসিবিরোধী লড়াইকে বিপন্ন করে তুলবে সন্দেহ নেই। মনে রাখতে হবে, মাও বলেছিলেন : ‘মার্কসবাদ বিজ্ঞানসিদ্ধ সত্য, তাই মার্কসবাদ সমালোচনাকে ভয় করে না।’
অক্টোবর ১৯, ২০২৪