ধর্ম বনাম বিজ্ঞান? নাকি বিজ্ঞান বনাম রাজনীতি?
'ইনহেরিট দ্য উইন্ড' নামের বিখ্যাত নাটক তথা সিনেমা থেকে ছবি করতে গিয়ে এটাই পরিচালক শৈবাল মিত্রের মূল উপজীব্য। এ ছবি নিছক বঙ্গীকরণ নয় বা মৌলবাদ কতটা বিপজ্জনক কিংবা মৌলবাদ কীভাবে ক্ষতিকরে তা আরেক বার দেখানো নয়। বরং মৌলবাদের শক্তি সঞ্চয় হয় কোথা থেকে সেই উৎসে যাওয়ার চেষ্টা। শৈবাল মিত্র দ্রোণাচার্য-এর মতো টেলিফিল্ম বানিয়েছেন। সম্প্রতি বানিয়েছেন 'তখন কুয়াশা ছিল'। ধারাবাহিকভাবে তিনি রাজনীতিকে চিত্রনাট্যের বিষয় করে চলেছেন।
এবারের ছবিতে মুখোমুখি দুটো ভারতবর্ষ। এক,ওপরতলার ভারতবর্ষ— যেখানে লড়াই চলেছে ধর্মান্ধতার সঙ্গে সেকুলারিজমের। এরই পাশে অন্য এক প্রান্তিক ভারতবর্ষ— সেখানে আগ্রাসনের শিকার দেশের আদিবাসিরা। তাদের সংস্কৃতি, ভাষা, ধর্ম। 'তখন কুয়াশা ছিল'তে শৈবাল দেখিয়েছিলেন ব্যক্তি মানুষের অজান্তে ফ্যাসিবাদের খপ্পরে পড়া। 'এ হোলি কন্সপিরেসি'-তে শৈবাল দেখালেন কৌশলে গোটা সমাজের ফ্যাসিবাদের থাবার তলায় চলে যাওয়া। যে এর বিরুদ্ধে লড়াই চালাচ্ছে সেও অসহায়। যে এর পক্ষ নিয়ে এসেছে আদালতে সওয়াল করতে সেও অসহায়! নিছক কোর্টরুম থ্রিলারের সাদা-কালো মেজাজে ছবি শুরু বা শেষ হয় না।
পলাশডাঙ্গার এক চার্চ নিয়ন্ত্রিত স্কুলে জীবন বিজ্ঞানের ক্লাসে ডারউইন পড়ানোর আগে বাইবেলের 'জেনেসিস' অধ্যায়টি পড়ানোর রীতি। স্কুলের জীববিজ্ঞানের শিক্ষক একজন আদিবাসী, কুণাল বাস্কে। তিনি এই ভাবনাকে বিজ্ঞানের পরিপন্থী ভেবে তা পড়ান না। এর থেকে জন্ম নেয় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা। কুণালকে পুলিশ গ্রেফতার ক'রে আদালতে তোলে। এই মামলায় খ্রিস্টান সমাজের পক্ষ নিতে পলাশডাঙ্গা আসেন আইনজীবী তথা সাংসদ বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়। তিনি খ্রিষ্টান সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। মামলার খবর তুলে ধরতে দিল্লি থেকে আসে এক সাংবাদিক হ্যারি। আর তারই উদ্যোগে এই মামলায় কুণালের পক্ষে সওয়াল করতে আসেন বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী তথা আইনজীবী অ্যান্থনি ডি'সুজা। তাঁর সওয়ালে জানা যায় যত-দোষ সব 'ডারউইন'-এর নয়। এর মধ্যেই লুকোনো আছে কুণালের আরও একটি বই না-পড়ানোর সিদ্ধান্ত। যেখানে দেখানো হয়েছে বেদ'-এর যুগেই নাকি আধুনিক বিজ্ঞানের সব উপকরণ ও আবিষ্কারগুলি ছিল! এই তৃতীয় মাত্রাটিকে এনে শৈবাল দেখান কেমনভাবে এ'দেশে সংখ্যাগুরু মৌলবাদ এখন অক্সিজেন সংগ্রহ করতে চাইছে সংখ্যালঘু মৌলবাদ থেকে। আর সেখানে অনুঘটক হয়ে উঠছে রাজনীতি। এই বাড়তি মাত্রাটুকুতেই শৈবাল মূল ছবি বা নাটক'কে ছাপিয়ে গেছেন, বলতে দ্বিধা নেই।
এই ছবির সবচেয়ে বড় আকর্ষণ আদালতের সওয়াল যুদ্ধে ভারতীয় আর্ট সিনেমার দুই তরঙ্গের দুই প্রধানতম অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও নাসিরউদ্দিন শাহ'কে মুখোমুখি পাওয়া। প্রথমবার ও শেষবার। সৌমিত্র বসন্তকুমার। নাসির ডি'সুজা। দু'জনেই তীক্ষ্ণ সংলাপের দাপুটে কারিগর। কিন্তু এর পাশাপাশি যেন 'ক্লাসরুম' খুলেছেন নীরব অভিব্যক্তিরও। সাম্প্রতিককালে কিছুটা উচ্চকিত নাসির এখানে অদ্ভুত 'আন্ডার অ্যাকটেড'। আর সৌমিত্র চিত্রনাট্য মেনে যেন খাঁচায় বদ্ধ অসহায় সিংহ। সুযোগ পেয়েও 'গ্যালারি শো' নয় দুজনেই 'কপিবুক প্লে' করেছেন। এই দুজনের মাঝখানে পড়েও হারিয়ে যান নি যে দুই মঞ্চাভিনেতা নবীন শ্রমণ চট্টোপাধ্যায় ও প্রবীণ জগন্নাথ গুহ যথাক্রমে কুণাল ও বিচারকের চরিত্রে তা তাঁদের অভিনয়-সামর্থ্যের পরিচয়। কুণালের প্রেমিকার চরিত্রে অমৃতা চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয় এই ছবিতে সেরা কোমল মুহূর্তগুলোর জন্ম দিয়েছে। ধূর্ত বসন্তকুমারকে পিতৃপ্রতীম ভেবে ঠকে যাবার মুহুর্তে তার যন্ত্রণা বা কুণালের অবস্থান নিয়ে তার সমর্থন ও দ্বিধার জটিল মানসিক মুহুর্তগুলি যেভাবে তুলে ধরেছেন অমৃতা, তা এই ছবিতে আদালত দৃশ্যের 'কাউন্টার পয়েন্ট' হয়ে উঠেছে। অনুসূয়া মজুমদারের (বসন্তকুমারের স্ত্রী) সঙ্গে তাঁর তর্কের দৃশ্যটিও দৃঢ়তা ভরা। সাংবাদিক কৌশিক সেন, সহকর্মী শুভ্রজিৎ, প্রিন্সিপাল প্রদীপ রায় প্রত্যেকেই অনবদ্যভাবে চরিত্র হয়ে উঠেছেন ছবিতে।
আর এই ছবিতে এক চরিত্র 'রাম'। কখনও সে হিন্দুত্ববাদীদের মিছিলে এক মডেল। কখনও সে এক আদালত চত্বরের বহুরূপী। প্রতিবারই সে নীরবে আসে। আর প্রতিবারই তার আগমন এক ঢেউ তোলে পর্দায়। ভারতীয় সিনেমায় এমন নীরব রূপকের ব্যবহার বহুদিন পরে দেখলাম!
২
শৈবাল মিত্র সন্দেহাতীতভাবে এই মুহুর্তে বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রকার। পরপর যিনি 'চিত্রকর', 'তখন কুয়াশা ছিল', 'এ হোলি কন্সপিরেসি'র মতো ছবি বানান, বানিয়ে চলেন। 'বক্স অফিস' নামক বাজার আর 'সমঝোতা' নামক রাজনৈতিক সুবিধাবাদকে না খুঁজেই। তাঁর প্রতিটি ছবি বিষয়ে আলাদা। বানানোর মেজাজেও। নিছক 'পরিচালক' নন, তাঁর মতো কারও-কারও ক্ষেত্রেই 'চলচ্চিত্রকার' শব্দটা খাটে।
'এ হোলি কন্সপিরেসি'। এ হোলি ন্যারেটিভ। এই ছবি সেই ‘বাইরে লেনিন/ভিতরে শিব/বেলেঘাটার গলি’ নয়। সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে বহুশ্রুত কিছু আপ্তবাক্য (যা এখন চর্বিতচর্বণে ও অননুসরণে অসার) বলেই এ ছবি দায় ও দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলেনি। এ ছবি সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে সহজপাচ্য 'যুদ্ধু যুদ্ধু' খেলা নয়। দুধ এবং তামাকে এ'ছবির সমান আগ্রহ নয়। সে বরং প্রবেশ করতে চেয়েছে সাম্প্রদায়িকতার শক্তিসংগ্রহের সেই বিবরে, যেখানে বিপদের বিষ। যেখানে সংখ্যাগুরুর ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে না দাঁড়িয়ে উল্টে নিজের বিচ্ছিন্ন ছোট ছোট মৌলবাদ দিয়ে সেই শক্তিকে সার-জল জুগিয়ে চলেছে সংখ্যালঘুর সাম্প্রদায়িকতা। আর এর মাঝে সুবিধাবাদের খেলা খেলে রাজনৈতিক কিছু উচ্ছিন্ন দল ভোটব্যাঙ্ক বাড়ায়। সত্যিই কুয়াশা ছিল...কুয়াশা আছে।
এই গোটা ক্ষমতা মানচিত্রটাকেই উলঙ্গ করে দেখায় এই ছবি। এ'ছবি 'সুখশ্রাব্য' সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস নয়। অন্তমিলের রূপকথা নয়। কাউকে স্বস্তি দেয় না এ ছবি। ক্ষমতার কোনও সিংহাসনকে দেখায়, সেই সিংহাসনের পাগুলো কোনও না কোনও মৌলবাদে বাঁধানো।
এককালে এমন অস্বস্তি দিত ভারতীয় সিনেমার দ্বিতীয় নবতরঙ্গের রাজনৈতিক পরিচালককূল। গোবিন্দ নিহালনি, প্রকাশ ঝা, কেতন মেহেতা, উৎপলেন্দু চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, গিরিশ কাসারাভেল্লি, জন আব্রাহাম— এইসব পদাতিকেরা। শৈবাল মিত্র বিলুপ্তপ্রায় সেই গাছের বীজ আমাদের সময়ের মাটিতে বপন করেছেন। একটি হারানো অস্ত্রের ফলায় শান দিয়েছেন।
আসুন তাঁকে সমর্থন করি।
সত্য বলা অভ্যাস করি।
জানলাম, সম্প্রতি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এই ছবি নিয়ে এক আলোচনাসভা করেছে। এমন সভা আরও হওয়া উচিত। শৈবাল মিত্রের সব ছবি নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত। সিনে ক্লাবগুলোরও তাদের এই পুরোনো অভ্যাসে অবিলম্বে ফেরা উচিত। মনে রাখতে হবে 'পথের পাঁচালি' বা 'ভুবন সোম' এভাবেই ইস্তেহার হয়েছিল। নাহলে, ভালো ছবি, সাহসী ছবি বাঁচবে কী করে?
শেষমেশ একটি বিধিসম্মত সতর্কীকরণ। অনেকেই এখন জানেন যে একটি বিখ্যাত ইংরেজি নাটক অবলম্বনে এই ছবি। যা থেকে সম্প্রতি একটি অনবদ্য মঞ্চ প্রযোজনা বানিয়েছে 'নাট্য আনন'। যাঁরা নাটকটি দেখেছেন ও ভাবছেন 'আমার-তো-দেখা'— তাঁরা এমনটা না-ভেবে ছবিটা দেখুন। মঞ্চের অনবদ্য প্রযোজনাটিকে সম্পূর্ণ সম্মান জানিয়েও বলি, এ'ছবিতে বাড়তি একটি মাত্রা সংযুক্ত হয়েছে এই দেশকালের সমসংযুক্তিতে। অনেক লুকোনো ভন্ডামির মুখোশ খসে পড়েছে। সত্যিই তো, সবটাই তো লুকোনো 'পবিত্র' চক্রান্তের কাল এখন!