পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

চটাদার সঙ্গে পেঁয়াজ গবেষণা

  • 15 October, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 496 view(s)
  • লিখেছেন : অশোক মুখোপাধ্যায়
খবরটা শুনেই সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য চটাদার আশ্রম। আশ্রম মানে একটা পাতা হাফ পোল। দুদিকে পাঁচ সারি ইটের স্তুপের উপরে শোয়ানো। বসে চা খাওয়া যায়। চপ বা বেগুনি খেতেও অসুবিধা হয় না। আর পোলটা বিদ্যুৎ দপ্তরের বেহাত বা বেওয়ারিশ মাল বলে একবার ওর উপরে বসার জায়গা পেলে আড্ডা ছেড়ে ওঠার কোনো তাড়া থাকে না।

তারুকাকাও ওদিকে নজর দেয় না। সময়ে সময়ে চাহিদা মতো জিনিস সরবরাহ করে যায়। নেহাত ভ্রামকদেরই নতুন কেউ এসে যদি খুব করে অনুরোধ টনুরোধ করে তখন লজ্জার মাথা খেয়ে উঠতেই হয়।

তবে হ্যাঁ, চটাদাকে উঠতে হয় না। কেন না, সব সময়ই চটাদার পাশে এক বা একাধিক পরামর্শগ্রহীতা বসে থাকেই এবং চা নিরিমিস চপ বেগুনি সিঙ্গারা ইত্যাদি চক্রবৎ অর্ডার এবং সাপ্লাই হতেই থাকে। মতামত গ্রহণের সামান্য শুল্কও বলা যায়। কাউকে কখনও রাগ করতে দেখিনি। ফলে দুপাশ থেকে ওঠাউঠি হয়। মাঝখানে চটাদার বসাসন বজায় থাকে। চটাদা যে খুশি মনে যে যা খাওয়ায় নিয়ে নেন, এবং পুনরাবৃত্তির কোনো পরিসংখ্যাতেই কখনও কাউকে প্রত্যাখ্যান করেন না, এটা জ্ঞানার্থীরা খুব উঁচু দরের উদারতা বলে মনে করে।

আমিও করি। সাইকেল থেকে আমাকে নামতে দেখেই চটাদা বলে উঠলেন, এই যে বাবু এসে গেছে। নিশ্চয়ই কিছু প্রশ্ন নিয়ে এসেছে। যদি অবশ্য আমার কাছে এসে থাকে।

আমি এক গাল হেসে বললাম, হ্যাঁ আপনার কাছেই এলাম।

চটাদার ডান পাশে বসে কলতাপাড়ার হালকাদা কিছু একটা জানতে চেষ্টা করছিল। আমি এসে পড়ায় বোধ হয় সেটাতে বাধা পড়েছে। হালকাদা বেশ ঘনভাবে বিরক্ত হয়েছে। বোঝা গেল তার কথাতে—আপনি বলছেন, দুদিনের মধ্যেই পেঁয়াজের দাম আবার কমে যাবে? কী করে বুঝলেন?

— তাহলে তো তুই জানিসই সব। আমাকে আর প্রশ্ন করে লজ্জা দিচ্ছিস কেন?

— না, মানে আমি জানি কোথায়? জানার জন্যই তো আপনার কাছে রাখছি।

চটাদা আমাকে দেখিয়ে বললেন, এই যে ঝটকে এল, ওকে জিগ্যেস কর, সব জেনে যাবি। আজকালকার ছেলে-ছোকড়াদের কাছে অনেক বেশি খবর থাকে। হাতের যন্ত্রটাতে দুচার বার আঙুল দিয়ে পুচপুচ করবে, আর ভেতর থেকে সমস্ত তথ্য বের করে আনবে। তার পর আমার দিকে তাকিয়ে বলে বসলেন, এই ঝটকে, বল তো, পেঁয়াজের দাম আগামী কদিন বাড়বে, নাকি, এবার নেবে যাবে?

— বন্যার জল নেমে গেলেই মনে হয় দাম কমবে। শুধু পেঁয়াজ নয়, সব সবজিরই। সে যাক গে যাক, চটাদা, আম---

হালকাদা আমার কথা মাঝপথে কেড়ে নিয়ে বলল, শুধু বন্যার জন্য এত দাম হয়? কালোবাজারিদের কোনো ভূমিকা নেই বলছিস?

চটাদা হাতের সিগারেটটা পায়ের কাছে ফেলে দিয়ে বললেন, ও, তোদের এই এক কালোবাজারিদের গপ্প আর থামে না! তোদের কথা শুনলে মনে হবে, দেশের সাদা বাজারে সব জিনিস কম দামে পাওয়া যাচ্ছিল, গত কাল থেকে কালো বাজার এসে গোলমাল করে দিল। কোথায় পাস এরকম ধ্যান ধারণা?

— মানে, মানে? আপনি কী বলতে চাইছেন? হালকাদা মনে হচ্ছে বেশ রেগে গেছে। দেশে কালোবাজারি নেই বলছেন? মজুতদার আড়তদার এসব নেই বলছেন?

— মরেছে! চটাদা চটে গিয়ে বললেন, এই ঝটকে, দুটো সিঙ্গারা বল, নইলে তোদের এই সব বুরবাকিয়ানা থামানো যাবে না!

আমার খুব রাগ হয়ে গেল। যার প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, সিঙ্গারা তো তার কোটায় আসবে। আমি কেন অন্যের হয়ে বেগার খাটতে — ইয়ে মানে — বেগার পয়সা ফেলতে যাব! একটু দ্বিধাদ্বন্দ্ব জেগে উঠল ভেতরে। হালকাদার দিকে তাকিয়ে চোখ মারতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু ও আমার দিকে দেখছেই না! অতঃপর একটু চেঁচিয়ে বললাম, হালকাদা, তুমিও খাবে? আনব নাকি?

এবার ওর নজর পড়ল আমার দিকে। তবে চটাদার সঙ্গে থেকে থেকে বুদ্ধি খানিক খুলে গেছে। নিজে থেকেই বলল, হ্যাঁ নিয়ে আয় চারটে সামোসা, চা-ও তিনটে বলে দে তারুকাকাকে—সব আমার অ্যাকাউন্টেই যাবে। ভয় পাসনে।

গরম সিঙ্গারার ঠোঙাটা হাতে ধরে চটাদা হালকাদার দিকে কৃপা দৃষ্টি মেলে ধরলেন, শোন, ব্রিটিশ আমলের শেষ দিকে আর দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে পরে বিশ বছর খানেক কালোবাজারি একটা আলাদা ব্যাপার ছিল। কেন না, সাদা বাজারও বেশ বড় আকারেই ছিল সেকালে। ১৯৮০-র পরে দেশে যে অবস্থাটা তৈরি হয়েছে, সেখানে এখন একটাই বাজার। পুরোটাই কালো। সাদা প্রায় নেই বললেই চলে। বুঝলি কিছু?

— পুরোটাই কালো? বলেন কী?

— হ্যাঁ, পুরোটাই কালো। কালো মানে যে সে কালো নয়, শ্যামা মায়ের কালো নয়। একেবারে মিসমিসে কালো। সরকারকে কর না দিয়ে আয় করলে সেটা কালো উপার্জন। জানিস নিশ্চয়ই। আয় করের তালিকায় দেখে আয়, কটা বড়ে হুজুরের নাম উপর দিকে আছে। এ এশিয়ার সর্বোচ্চ ধনী, ও বিশ্বের তিন নম্বর ধনী। আয়করের তালিকায় দশ নম্বরেও নেই ওদের এক ব্যাটাও। এর মানে বুঝিস? এরা ধনী হচ্ছে আয়কর ফাঁকি দিয়ে। এদের ধন সম্পদ বাড়ছে ব্যাঙ্কের থেকে নেওয়া ধার শোধ না করে এবং সেই ধার আবার ব্যাঙ্কের খাতা থেকে গায়েব করে দিয়ে। এদের তুই সাদা বলবি?

আমি ভাবলাম, এই সুযোগে আরও একটু জেনে নিই। তাহলে পেঁয়াজের দাম যে হুহু করে বেড়ে যাচ্ছে, এর জন্য কালোবাজারি কারবার দায়ী নয় বলছ?

— আজকে যারা কোট আনকোট কালোবাজারি করছে বলে দাম বেড়ে গেল, কাল বন্যার জল সরে গেলে যখন দাম কমে যাবে, তখন তাদের কী বলবি? সব ফরসা বাজারে ব্যাক করেছে? বোঝা আমাকে!

মাথা খারাপ! চটাদাকে বোঝাতে যাব! বোবা হয়ে থাকব বরং। হালকাদাও দেখলাম একই রণকৌশল নিয়েছে। আর কিছু বলছে না। বেশ খানিক ক্ষণ চুপচাপ থেকে সিঙ্গারাটাকে উদরায়ন করে নিয়ে বলল, এরাই কি পেঁয়াজের ব্যবসা করছে? দাম্বানি কিংবা আবানিরাই?

— দেখে আয় এরা কিসের ব্যবসা করছে না। তেল নুন আলু পেয়াজ টম্যাটো আদা রসুন লঙ্কা বেগুন ফুলকপি বাঁধাকপি ক্যাপসিকাম—কোনটা এদের হাতে নেই দেখে বল আমাকে! কুঁদরি আর কুমড়ো—এই দুটো সবজির দিকে বোধ হয় এদের এখনও নজর পড়েনি তাই রক্ষে।

হালকাদা আবার প্রশ্ন করল, তাহলে যখন দাম কম থাকে তখনও কালোবাজারি চলে?

— শোনো কথা। কালোবাজারিই চলে। চলে আসছে। চাষির কাছ থেকে কম দামে কেনে। তোকে কম দামে দেয়। কী রকম কম জানিস? নাসিকের গ্রাম থেকে দুটাকা কিলো দরে লক্ষ লক্ষ কুইন্টাল পেঁয়াজ কিনে রাখে। তোকে দেয় তিরিশ টাকায়। তুই খুশি। তার পর বন্যা খরা বাংলাদেশ পাকিস্তান নানা কারণে দাম বেড়ে গেল। আশি টাকা হয়ে গেল। কদিন পরে আবার কমতে কমতে এসে চল্লিশে দাঁড়াল। তুই তখনও খুশি। বুঝলি কিছু?

হঠাৎ আমার মাথায় একটা দুস্ট বুদ্ধি এল। জিগ্যেস করলাম, আচ্ছা চটাদা, তারুকাকা পেঁয়াজির দাম বাড়াল না কেন? এত দামে পেঁয়াজ কিনে এখনও পার পিস সেই ছ-টাকাতেই দিচ্ছে কী করে?

—তারুদাকেই জিগ্যেস করে জেনে নে। আমি তো আর পেঁয়াজি ভাজি না।

—তারুকাকাকে বললে খালি হাসে। উত্তর দেয় না। তুমি নিশ্চয়ই রহস্যটা জানো!

—তা জানি। কিন্তু সেটা তোদের বলাটা ঠিক হবে না। ওর ট্রেড সেক্রেট বলে কথা! ফাঁস হয়ে গেলে ও খাবে কী করে?

—বেশ বেশ। বোলো না। কিন্তু আমারও একটা কথা জানার ছিল।

চটাদা এক ধমক লাগাল। যা যা, বাড়ি যা। কটা বাজে দেখেছিস? কাল আবার আসিস।

নাঃ, কালকে আসতেই হবে।  

0 Comments

Post Comment