‘সুবর্ণজয়ন্তী সম্মিলনী’ হল ইএমবাইপাস লাগোয়া পূর্ব কলকাতা উপনগরীর একটি অংশের বাসিন্দাদের তৈরি একটি সংগঠন। পথ চলা শুরু ভারতের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী বছর ১৯৯৭ সালে। বিশেষ ওই বছরটিকে স্মরণে রাখার উদ্দেশ্যে নাম দেওয়া হয় ‘সুবর্ণজয়ন্তী সম্মিলনী’। সহ নাগরিকদের সঙ্গে নিয়ে বিশিষ্ট সাংবাদিক মোশারফ হোসেন ওই সংগঠনটি গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। তিনিই প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। স্থানীয় বাসিন্দাদের নাগরিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে সারা বছরই সক্রিয় থাকে ওই সংগঠন। এমনকী আশপাশের যে বাসিন্দারা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত নন, তাঁদের কল্যাণেও তৎপর থাকে। গত ২০-২১ সালের করোনা-লকডাউন আবহে বেশ কয়েক দফায় দুঃস্থ মানুষদের হাতে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেওয়া থেকে শুরু করে প্রতি বছর একাধিকবার আয়োজিত স্বাস্থ্য শিবির নিম্নআয়ের মানুষদের জন্য অবারিত রাখা হয়। সুবর্ণজয়ন্তী সম্মিলনীর বর্তমান সভাপতি শ্রী বিকাশ চন্দ্র দাস। সাধারণ সম্পাদক কাজল কুমার দে।
আরও নানা ধরনের কর্মসূচির মধ্যে মহাসমারোহে বাৎসরিক দুর্গাপুজোর আয়োজন করা সুবর্ণজয়ন্তী সম্মিলনীর অন্যতম একটি সাফল্য। সংগঠনটি স্থাপনের পরের বছর থেকেই শ্যামাপুজোর আয়োজন হলেও দুর্গাপুজো শুরু হয় তৃতীয় বছর অর্থাৎ ১৯৯৯ তে। সেই হিসেবে এবছর প্রাক রজতজয়ন্তী (২৪তম) দুর্গাপুজো। এলাকাটি কোনও প্রাচীরবেষ্টিত আবাসন কমপ্লেক্স নয়, একটি খোলামেলা পাড়া। সিংহভাগ মানুষ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর। কিন্তু পুজোর ক’দিন গোটা পাড়া একটি বৃহত্তর পরিবারের রূপ নেয়। দুর্গাপুজো পরিচালনার জন্য স্থানীয় মহিলাদের নিয়ে একটি শাখা সংগঠন গড়া হয়েছে। নাম ‘সুবর্ণজয়ন্তী সম্মিলনী মহিলাবৃন্দ’। মূল সংগঠনের ছাতার তলায় থেকে ওই শাখা সংগঠন পুজোর বহু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে। দেবীবন্দনার আনুষ্ঠানিক পর্বটি তো বটেই, তার বাইরেও। উপাচার সংগ্রহ থেকে ভোগরান্না পর্যন্ত হাত লাগান মহিলা সদস্যরাই। এমনকি পাড়ার মধ্যে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সদস্যদের পরিবার থেকে চাঁদা সংগ্রহের প্রধান দায়িত্বও পালন করেন তাঁরাই। পুজোর প্রথম বছর থেকেই এই ব্যবস্থা চালু রয়েছে। সুবর্ণজয়ন্তী সম্মিলনী মহিলাবৃন্দের বর্তমান সভানেত্রী শ্রীমতী রিক্তা সিনহা রায়।
সুবর্ণজয়ন্তী সম্মিলনীর কর্তাদের বক্তব্য, তাঁদের ওই পুজোয় বহিরঙ্গের চাকচিক্যের চেয়ে আন্তরিকতাকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। বরাবরই সাবেকি ঘরানার একচালের প্রতিমা। দেবী সৌম্যদর্শনা। মণ্ডপের অন্দরের আলোকসজ্জায় উচ্ছ্বলতার চেয়ে যেন গাম্ভীর্যই বেশি ফুটে ওঠে। বাইরেও মানাসই আলোর সমারোহ। মহাসপ্তমী থেকে দশমী- দুর্গাপুজোর প্রধান চারটি দিন পুজোপ্রাঙ্গনেই সবার মধ্যাহ্নভোজনের আয়োজন হয়। চারদিন চার রকমের মেনুকার্ড। প্রতিদিন মধ্যাহ্নভোজের সমাবেশে পাঁচ-ছ’শো বা তারই বেশিসংখ্যক মানুষের অংশগ্রহণ দারুণ এক পরিবেশের সৃষ্টি করে। বেশিরভাগই আমিষাশী হলেও নিরামিষভোজীর সংখ্যাও খুব কম নয়। শিশু থেকে বালক-বালিকা কিশোর-কিশোরীদের পাশাপাশি মধ্যবয়সী ও প্রবীণ মানুষজনও থাকেন। এক আচ্ছাদনের তলায় প্রায় একইসময়ে এত মানুষ! কিন্তু কোনও হুড়োহুড়ি, কাড়াকাড়ি, বিশৃঙ্খলার বালাই নেই। পরস্পরের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়াটাই যেন দস্তুর। সব মিলিয়ে পারিবারিক ভোজসভার আকার নেয়। অঞ্জলিতে অংশগ্রহণ থেকে আরতি দর্শন- প্রতিটি পর্বেই প্রচুর উপস্থিতি। মুসলিম পরিবারগুলির নারী-পুরুষ-শিশুরা পুজোয় অঞ্জলিতে সরাসরি অংশগ্রহণ না করলেও আরতি দর্শনের সমাবেশে অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গেই উপস্থিত থাকেন। ওইসব পরিবারের ছেলেমেয়েদের অনেকেই সাংস্কৃতি অনুষ্ঠানে অংশ নেয়। সবাইকে নিয়ে হওয়া সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ধুনুচি-নৃত্য প্রতিযোগিতা প্রভৃতিতে পুরুষদের চেয়ে নারী অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যাই অনেক বেশি থাকে।
অন্য কোনও সমস্যা না থাকলে বিজয়া দশমীর সন্ধ্যাতেই এখানকার প্রতিমা বিসর্জন পর্ব মিটিয়ে দেওয়া হয়। মহিলাদের সিঁদুর খেলা পর্ব মেটার পর শুরু হয় দেবীবিদায়ের অন্তিম পর্ব। নানা বয়সের কয়েকশো নারী-পুরুষ-শিশুর অংশগ্রহণে মুখরিত বিসর্জন-শোভাযাত্রা কয়েক কিলোমিটার পথ পেরিয়ে নির্দিষ্ট জলাশয়ের সামনে হাজির হয়। যাবতীয় বিধি আচার মেনে নিরঞ্জন পর্ব সেরে সবাই ফিরে আসন পুজোমণ্ডপে। মণ্ডপে দধিকর্মা। মণ্ডপেই প্রণাম, কোলাকুলি প্রভৃতি পর্বের সূচনা হয়। তারপর কারও কারওে স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ে। সবকিছু ঠিকঠাক সম্পন্ন হওয়ার স্বস্তি। যাদের উপর সরাসরি কোনও দায়িত্ব অর্পিত ছিল না, তাদের মনে বিষন্নতাই পাখা মেলে ধরে। বেশ কাটছিল ক’টা দিন! আগামীকাল থেকে ফের সেই…………..।
সঙ্গের ছবির ক্যাপশন: ‘সুবর্ণজয়ন্তী সম্মিলনী’র বর্তমান সাধারণ সম্পাদক কাজল কুমার দে ও প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক মোশারফ হোসেন।