আরো একটা ৬ ডিসেম্বর চলে গেল। তারিখটিকে বিশেষভাবে 'স্মরণ' করার তিনটি দশক অতিক্রম করতে করতে মনে এল কিছু সংশয়, দুশ্চিন্তাও। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরে যেভাবে জেগে উঠেছিলেন অসাম্প্রদায়িক মানুষেরা, তার অভিঘাত কি ফিকে হয়ে গেছে? এ কথা সত্য, যাঁদের মনন ও সুযোগ্য নেতৃত্ব সেদিন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে আমাদের প্রধান সহায় ছিল, তাঁরা প্রায় কেউই আর ইহলোকে নেই। কেউ আবার বয়সের ভারে ন্যুব্জ। পরবর্তী প্রজন্মের যাঁরা হতে পারতেন এই কাজের দিশা নির্দেশক তাঁরা দলীয় রাজনীতির যে কোনো একটা পক্ষে ঢুকে পড়ে বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছেন। জল মেপে কথা বলা তাঁদের প্রতিবাদকে নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে নিরলস কাজে যাঁরা এখন ব্রতী, তাঁরা কেউ সেলিব্রিটি নন। তবুও তাঁদের আন্তরিক প্রয়াস কিছুদিন আগে পর্যন্ত যতটা বেগবান ছিল, ২০২৩-এর ৬ ডিসেম্বর বিকেলে তাঁদের কথা শুনে মনে হল সেই বেগ গতি হারাচ্ছে। উল্লিখিত সংশয় এবং দুশ্চিন্তা তাই যেন কোথাও একটা সমর্থন পেয়ে গেল অজান্তে।
এবারের ৬ ডিসেম্বরের আকাশ সকাল থেকেই ছিল মুখভার করে। নিম্নচাপের ভ্রূকুটি পূর্বাভাসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিকেলে যখন বৃষ্টি নামিয়ে আনল, কলেজ স্ট্রিটে প্রতিক্ষণ বই-চা ঘরে সাকুল্যে উপস্থিত বারো জন মতো সংবেদী মানুষ। আসন সংখ্যা কুড়ি, সে টুকুও ভরেনি দেখে মন খারাপ হলে মনের দোষ নেই। অতি নবীন প্রজন্মের প্রতিনিধি একজনই। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের দিনটিকে মনে রেখে শুভেন্দু দাশগুপ্ত সংকলিত 'আলাপচারি মুসলমান-হিন্দু: আড্ডা তর্ক প্রশ্ন' বইটির পুনঃপ্রকাশ উপলক্ষে এই বিষয়ে কথা বললেন মিলন দত্ত ও সাবির আহমেদ। উল্লিখিত বইটির আগের প্রকাশক ছিল 'এবং আলাপ'। এবারে প্রকাশ করল 'ঠিকঠিকানা', সভাটির আয়োজকও তারাই।
সভা শুরু করলেন প্রতিক্ষণের পক্ষে শুদ্ধব্রত দেব । তাঁর সুচিন্তিত গ্রন্থনা অনুষ্ঠানের অভিমুখ তৈরি করে দিল। বিশেষ করে 'বাঙালি মিষ্টি' বলতে আমরা যে আসলে হিন্দু বাঙালির মিষ্টিকেই বুঝি, বাঙালি মুসলমানের মিষ্টির ঘরানার সঙ্গে আমাদের উদাসীন অপরিচয়ের বয়ান এই গ্রন্থনাকে দিতে পেরেছিল ভিন্ন মাত্রা। তারপর তিনি ডেকে নিলেন সেদিনের দুই আলোচককে।
ত্রিশ বছর ধরে সাংবাদিক ও মুসলিম সংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ মিলন দত্ত নাগাড়ে কাজ করে চলেছেন এ দেশে সংহতির পরিবেশকে অক্ষুন্ন রাখতে। প্রবন্ধ, ফিচার, সাক্ষাৎকার, গ্রন্থ এবং মাঠে নেমে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করার অনন্য অভিজ্ঞতায় তিনি এই সময়ের অন্যতম পথ প্রদর্শক। সেদিন তাঁর কথাতে উঠে এল স্পষ্ট হতাশার সুর। 'প্রাতিষ্ঠানিক অপশক্তির সংঘবদ্ধ ষড়যন্ত্রের সঙ্গে ইতস্তত কিছু শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের অসম লড়াই এটা'- বললেন মিলন। তাই নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা বেশিদিন চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তাছাড়া শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি হিন্দুর মনে প্রতিবেশী বাঙালি মুসলমানের প্রতি বিদ্বেষ এমন শিকড় গাঁথা তাকে উপড়ে ফেলা কার্যত অসম্ভব বলেই তাঁর মনে হয়েছে। এই অকারণ দ্বেষের জন্য দায়ী আসলে অপরিচয়- কিন্তু পরিচয়ের পরিবেশ তৈরি করে দিলেও হিন্দু বাঙালি তাতে আগ্রহ দেখায় না। বরং বাধা দেয়। এমন অভিজ্ঞতার সাক্ষী তিনি নিজেই। এরপরও মিলন দত্ত আনন্দ প্রকাশ করলেন সাম্প্রতিক সময়ে মুসলমান সমাজের দ্রুত উত্থান দেখে: চিকিৎসক, পুলিশ, অধ্যাপক, শিক্ষক এবং আরও কিছু ক্ষেত্রে মুসলমান সমাজের ছেলে মেয়েদের এখন যথেষ্ট দেখা যাচ্ছে। শতাংশের হিসেবে তা হয়তো আহামরি কিছু নয়, তবু দেখা যে যাচ্ছে সেটুকুর জন্য মিলন দৃশ্যত খুশি। সেই সঙ্গে জানালেন, নির্দিষ্ট কিছু সময়োচিত প্রকল্পের কারণেই এই সুফল এত দ্রুত দেখা গেছে।
মিলন দত্তের এই উচ্ছ্বাস-কথনের রেশ টেনে সাবির আহমেদ একটি সরল সত্যকে সামনে আনলেন তাঁর বক্তব্যে। পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান যুব সমাজের এই 'ভিসিবিলিটি' শতাংশের নিরিখে যত নগণ্য হোক, বাঙালি হিন্দুর রাগ তাতে বেড়ে গেছে। তারা আশঙ্কা করছেন মুসলিম সমাজ এইভাবে ওবিসি কোটায় সর্বত্র দখলদারি চালাবে। এই আশঙ্কা থেকে তাদের ঘৃণাজাত উক্তির বহর ক্রমশ বাড়ছে। সাবিরের নিজের পুত্র কলকাতা শহরে একটি অভিজাত স্কুলে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। সেই নিষ্পাপ বাচ্চাটিকে পর্যন্ত শুনতে হয়, সে কেন বাংলা ক্লাসে এসেছে, তার তো উর্দু ক্লাসে যাবার কথা! শিক্ষার্থীদের অভিভাবক মূলত তাদের মায়েরা; মায়েদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে মুসলমান সমাজ সম্পর্কে যে ধরনের কথা উঠে আসে তাতে বোঝা যায় আমিষ, নিরামিষ, বিফ, রোজা, বোরখা ইত্যাদি সব বিষয়েই শিক্ষিত বাঙালি হিন্দু মহিলাদের আক্রমণের সহজ জায়গা 'মুসলমান' শব্দটি। এর থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে 'প্রতিবেশীকে চিনুন' কার্যক্রম, তার অন্যতম পরিকল্পক সাবির আহমেদ। সেই অভিজ্ঞতায় তাঁর বক্তব্য: এখনও আশার আলো আছে। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের অ্যজেণ্ডা ভিত্তিক বিভিন্ন 'সমস্যার সমাধান' হয়তো কিছু সাম্প্রদায়িক মানুষকে উৎসাহিত করছে, কিন্তু তারপরেও আশা করা যাচ্ছে এই প্রবনতা রুখে দেওয়া যাবে। শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের এগিয়ে আসার উপরে আস্থা রেখে সাবির যখন তাঁর কথা শেষ করলেন, বাইরে তখন অঝোরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে।