বাংলার নদীর ইতিহাস আর বাংলার ইতিহাস প্রায় সমার্থক। ঐতিহাসিক নিহাররঞ্জন রায়ের ভাষায় ‘বাংলারর ইতিহাস রচনা করিয়াছে বাংলার অসংখ্য ছোটবড় নদনদী, এই নদী গুলিই বাংলার প্রান,ইহাই বাংলাকে গড়িয়াছে, বাংলার আকৃতি-প্রকৃতি নির্ণয় করিয়াছে’।‘নদীজীবীর নোটবুক’ শীর্ষক সুপ্রতিম কর্মকারের বাংলায় লেখা বইটি নদীর ইতিহাস-ভূগোলের কথা বলেই থেমে থাকেনি, পাশাপাশি তুলে ধরেছেন নদীকে কেন্দ্র করে মানুষের জীবন ধারণ, জীবন যাপন, কৃষিজীবী মৎস্যজীবীর সুখ দুঃখের নিত্যদিনের কথা।বাংলার নদীকেন্দ্রিক লোকায়ত সংস্কৃতির দিনযাপনের দিনলিপি লিখছেন।বইটি পড়তে ভালো লাগবে কারণ সুপ্রতিমের নদী নিয়ে ভালোবাসা-ক্ষোভ- যন্ত্রণা পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে গোটা বইটির পাঁচটি অধ্যায়ে। বইটির শুরুতে নদীজীবীর লেখক লিখছেন, সাহেবরা বাণিজ্যিক স্বার্থেই বাংলার নদীকে বুঝেছিলেন, কথাটা পুরোপুরি ঠিক নয়। তবে তারা বাংলার নদীকে বোঝার চেষ্টা করেছিলেন। যদিও তাদের মূল লক্ষ ছিল বাণিজ্য।
বাংলার নদীগুলির ‘সিস্টেমেটিক সার্ভে’র কারণে রেনেল সাহেব ও তাঁর তৈরি মানচিত্র একটি প্রামাণ্য দলিল হয়ে থাকল।আধুনিক ধারনায় নদী কেবল দুই পাড়ের মধ্যে বহমান জলধারা মাত্র নয়।সমগ্র অববাহিকাই নদী। দুই ধারের জমি, সেখানকার গাছপালা কীট পতঙ্গ, মাছ ও অন্যান্য প্রাণী সব মিলিয়ে নদী। নদীকে গাছের পাতার শিরা-উপশিরার মত ভাবা যায়। আরো সঠিকভাবে পুরো পাতাটাই নদী মনে করা যায়।একথা বলেছেন ভৌগোলিক মরিস ডেভিস তাঁর ‘ওয়াটার আর্থ অ্যান্ড ম্যান’ গ্রন্থে। সেচ বিজ্ঞানী স্যার উইলিয়াম উইলকক্স উত্তর ভারতে খালের ধারে এক তাঁবুতে জন্ম নিয়েছিলেন। যিনি বাংলাদেশের নদ নদীর গতিপ্রকৃতি ও তার পরিবেশীয় ভূমিকা বুঝতে চেষ্টা করেছিলেন। তিনি সারা জীবনই ছিলেন এক বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব। উইলকক্স সাহেব গ্রাম্য চাষীদের সঙ্গে থাকতে ভালবাসতেন। তাদের মতামত শ্রদ্ধার সঙ্গে শুনতেন ও শেখার চেষ্টা করতেন। কৃষিকাজের স্বার্থই তাঁর কাছে বড় ছিল। নদীজীবীর নোটবুক-এ লেখকের এই বক্তব্যের সায় দিয়ে তার বিশ্বাসের কথা বলছেন।যা তাঁকে নদীচর্চায় আরো অনেকের থেকে আলাদা করে তুলছে। লেখক লিখছেন, চার দশকে বাংলার ভূপ্রকৃতি ও নদনদীর আমূল পরিবর্তন হয়ে গেছে। কিন্তু সেই পরিবর্তনকে ধরার জন্য ইংরেজি ভাষায় তৈরি হয়েছে গবেষণাপত্র। সেখানে কিছুটা চর্বিতচর্বণ।তার ওপরে লেখা গুলো সাধারণের নাগালের বাইরে। কারণ সে গুলি খুবই তাত্বিক ও বিষয়ভিত্তিক। নদীতো সবার জন্য। নদীর বিজ্ঞানকে বোঝার অধিকার তো সাধারণ মানুষেরো আছে। কিন্তু তারা বঞ্চিত হয়, কারণ তাদের মতো করে কিছু লেখা হয় না বাংলা ভাষায়। যে টুকিটাকি লেখা হয় তাতে থাকে তথ্যের অনেক ভুল ও ভ্রান্ত বিশ্লেষণ। ফলে বিভ্রান্ত হয় সাধারণ পাঠক। তাই এই বই একটা প্রচেষ্টা। যেখানে বাংলার নদীর ঘটে চলা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
বাংলা ভাষায় নদী নিয়ে প্রথম বই লেখেন কপিল ভট্টাচার্য। বাংলাদেশের নদনদী ও পরিকল্পনা গ্রন্থের প্রথম সংস্করণের (সেপ্টেম্বর.১৯৫৪)ভূমিকাতে কপিল বাবু লেখেন আজ বাঙালী মাত্রই আগ্রহশীল হয়ে উঠেছেন নদনদীর কথা শোনবার জন্য। সরকারি বেসরকারি নান বক্তব্য সংবাদপথে ও রেডিওতে নিত্য পরিবেশন করা হচ্ছে নদনদীর পরিকল্পনা সম্বন্ধে। কিন্তু সাধারণ মানুষ সব কথা বুঝে উঠতে পারছেন না। তার মানে হচ্ছে নদনদী পরিকল্পনা সম্বন্ধে যে সব বৈজ্ঞানিক কথা জানার প্রয়োজন হয়, তা জানা থাকলে যাচাই করে নেওয়া যায়। সেই জ্ঞান নেবার মতো বাংলাতে কোন বই নেই। কাজেই তিনি লিখে ফেললেন বাংলার প্রথম নদী নিয়ে বই।আসলে তিনি চেয়েছিলেন মানুষকে সঙ্গী করে নদী রক্ষার আন্দলন গড়তে। তাতে আদেও কতটা কি করতে পেরেছেন, তার ইতিহাস হয়ে আছে ফারাক্কা ব্যারেজ বাঁধ বিরোধী আন্দোলন,নিম্ন দামোদরের দুপাশে মানুষের ভিটেমাটি রক্ষার আন্দোলন। এই সবের সঙ্গে ‘সরাসরি যুক্ত থাকায়’ বাংলায় বই রচনাতে তিনি সচেষ্ট হয়েছিলেন। কপিলবাবুর সঙ্গে মদন বড়াল লেনে তাঁর বাড়িতে বসে কথা বলতে বলতে বলতে জেনেছিলাম তিনি নদীকে ও তার গতিপ্রকৃতিকে জানবার জন্য জেলে ও নৌকার মাঝিদের সঙ্গে মেশবার তাগিদে বাগনান শহরে একটা মাটির বাসনপত্রের দোকান করেছিলেন। জেলরা যখন সেই দোকানে ‘চারি’ বা গামলা কেনার জন্য আসতেন, তখন তিনি তাদের সঙ্গে নানা ভাবে কথা বলে জানতেন নদীর কথা, তাদের নদীর সঙ্গে জীবন যাপনের কথা। কপিল ভট্টাচার্য প্রথম যিনি পাঁচশো মৎস্যজীবী নিয়ে ষাটের দশকে রাজভবন অভিযান করেছিলেন। এর প্রায় তিন দশক পর সবুজ মঞ্চ রাজ্য নদী বাঁচাও কমিটির উদ্যোগে কলকাতায় হয়েছিল একটি জনসমাবেশ, যেখানে মৎস্যজীবী কৃষিজীবী থেকে পরিবেশকর্মীরা সকলেই ছিলেন।নদী নিয়ে লেখালেখির কথা উঠলে খুবই অস্বস্তিকর স্বীকারোক্তি বাংলায় মেঘনাদ সাহা ও কপিল ভট্টাচার্য কল্যান রুদ্রের পর বাংলার নদী নিয়ে তেমন কেউ ভাবেননি।ধন্যবাদ সুপ্রতিমকে, তিনি বাংলায় লিখছেন শুধু তাই নয়,বাংলার নদীমাতৃক জীবন ধারণকে এক সঙ্গে লৌকিক চারণের বেশে নদীজীবী হয়ে নদীর সুখ দুঃখের পরিক্রমা করেছেন।
বইটিতে আন্তর্জাতিক নদী হিসেবে তিস্তা-আত্রেয়ীর-ইছামতীর কথা, জল বন্টন প্রসঙ্গে দুই দেশে যৌথ নদী কমিশন গড়ার কথা এসেছে। উত্তরবঙ্গের সাহু, করলা, বালাসন ধ্বংস হয়ে যাওয়া, উত্তরবঙ্গের বন্যা, নদীর দূষণের কথা এই নিয়েও আলোচনা রয়েছে বইটিতে।
আত্রেয়ী সীমান্তের নদী, তাকে নিয়ে সমস্যা ও সমাধানের উদ্যোগ জরুরী। নদীর সমস্যা মেটাবার জন্য নদী নীতি তৈরি করা,নদীর জন্য একটি নদী দপ্তর তৈরি করে নদী সমস্যার সমাধানের পথ খোঁজা হোক। নদীতে অবিরল ও নির্মল জলের ধারা বজায় রাখতে হবে। এই দাবি গুলির সঙ্গে সহমত রেখে বইতে লেখা হচ্ছে ‘তবেই নদী বাঁচবে।আর নদী বাঁচলেই বাঁচব আমরা।এটাই পরিবেশ শিক্ষার প্রাথমিক পাঠ’। বটেই তো। জরুরী প্রয়োজনীয় কথা তো এটাই।
শিলিগুড়ির মহানন্দা, মালদহের নদনদী,ভূতনির চর, গঙ্গা ভাঙন, চরের রাজনীতি, পঞ্চানন্দপুরের ভাঙন সহ নদী নিয়ে নানা বিষয় উঠে এসেছে প্রায় ২০০ পাতার বইটিতে। লেখকের নদীকে জানা বোঝা শুরু নদীর জেলা নদিয়া থেকে। সেই জেলাটা তার নিজের জন্মস্থান।জলঙ্গি, চূর্ণী, মাথাভাঙা,পাগলাচন্ডী,ছোট গঙ্গা,চকাই, যমুনা, মরালী, অঞ্জনা আরো অসখ্য নদীর ভূগোল ইতিহাসের হদিস পাওয়া যাবে নোটবুকে।শুধু নদী নয়,আছে খাল বিলের সঙ্গে জলাভূমির পরিচয়। পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় নয়াচর, চরটার নাম বলাগড় চড়,তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির প্রস্তাব বিপর্যয় ডেকে এনেছিল মৎস্যজীবীদের জীবনে। আবার সুন্দরবনের তেল দূষণে নদী হয়ে উঠেছিল নর্দমা।
সুপ্রতিম কর্মকারের লেখা নিবন্ধ প্রবন্ধ পড়ে ক্রমশ নিজেকে সমৃদ্ধ করি। নদীকে নিয়ে ইতিহাস, সাহিত্য,ভূগোল ও বিজ্ঞানের একটা সম্মেলন দেখতে পাই।‘নদীপাড়ের মানুষদের নদী বাঁচানোর দ্বায়িত্ব নিতে হবে, তবেই বাঁচবে নদী’। লেখকের এই বিশ্বাসের সঙ্গে আমাদের বিশ্বাসের এখানেই মিল খুঁজে পাই। খন্ড খন্ড যে ছবি রাজ্য তথা দেশ জুড়ে তুলে ধরেছেন,সেখানে হয়তো আরো অনেক কিছু সমস্যর কথা বাদ থেকে গেল।তবে নদী যে আমাদের জীবন যাপন ও জীবন ধারণের অন্যতম সোপান,সেট আসলে ধরেছেন লেখক সহজ ভাষায় মন্সিয়ানার সঙ্গে। অবশ্যই সংগ্রহ করতে হবে বইটি ও বার বার পড়তে হবে পথ খুঁজতে-দিশা পেতে।
নদীজীবীর নোটবুক,সুপ্রতিম কর্মকার,ধানসিড়ি,কলকাতা,২০২২, , মূল্য ২৫০/-