‘পানিতে হেল, পানিতে খেল
পানিতে তোমার কে আছে?
ভাল করে দেখ লো মেয়ে
পানিতে শউর ঘর আছে।’
পানি দেখছে সায়রা। বামুনঘাট ছাড়িয়ে এই দক্ষিণে ভাঙা বাঁধের উপরে বসে নদী দেখতে সে বরাবর ভালবাসে। দ্বীপের তিন দিক জুড়েই নদী ঠাকুরান, আর এক দিকে শিবুয়া। তবে দুজনে মিলে পড়বে গিয়ে দক্ষিণের বড় গাঙেই। বড় গাঙ মানে ওই যাকে চোখের সীমানায় আকাশের সঙ্গে থাকতে দেখছে সে, সাগর।
সায়রার বাঁ দিকে জঙ্গল, ডানে ‘কে’ প্লটের মতোই আর এক দ্বীপ, ‘এল’ প্লট। এখন এই সকালবেলা পাশের বাড়ির ভাবি মমতাজকে নিয়ে হয়ত শেষ বারের জন্যই ভাঙা বাঁধের গা বেয়ে নদীর পানিতে নামতে যাওয়া। শেষ বারের জন্যই তো! সেই রাক্ষসখালি থেকে বাপের বাড়ি আবার কবে আসার সুযোগ পাবে সায়রা তার ঠিক আছে? আর সুযোগ পেলেও সেই লোক এই নদীর পানিতে কি তাকে নামতে দেবে? বাঁধের গা লাগোয়া জঙ্গলে বাইন, শিরীষ, গেঁওয়া। জোয়ার শুরু হয়েছে সবে। এখনও কিছুটা সময় বাঁধ বেয়ে নিচে নেমে পানি পর্যন্ত হাঁটার জায়গা পাবে সায়রা। দেখতে পাবে লাল পিঁপড়ের মতো পিলপিল ঘুরে বেড়ানো কাঁকড়াদেরও। আর পাবে শোঁ শোঁ শব্দ। একেবারে শব্দ করে জোয়ারের পানির আছড়ে পড়া। সায়রার পায়ের উপর ঝাঁপিয়ে সেই পানি যেন সায়রাকে বারণ করবে, যেন বলবে ‘আর না, আর না।’ সায়রাকে সুতরাং পিছনে ফিরতে হবে।
আজ ওর আইবুড়ো ভাত, কাল বিয়ে। আইবুড়ো ভাত সাধারণত তিন-চারদিন আগে হওয়াই রীতি, কিন্তু এই ক’দিনের ঝামেলা কে টানবে? ঝামেলা মানে খরচ। এতগুলো মানুষকে তিন-চারদিন টানা। তার চেয়ে আজ আইবুড়ো ভাত কাল বিদায়, ব্যস। গরিব ঘরের এই এক অসুবিধে। আবার সুবিধেও। গোটা চারেক মুরগী জবাই দিলেই খুশি সবাই। গরিবির কারণেই উৎসব হবে সংক্ষিপ্ত আর অনাড়ম্বর।
মোটামুটি ভাবে ১০৩টি দ্বীপ নিয়ে যদি পশ্চিমবাংলার সুন্দরবন হয়ে থাকে, তার মধ্যে জনবসতি ৫৫টিতে। বাকি ৪৮টিতে জঙ্গল অর্থাৎ সংরক্ষিত অরণ্য। জনবসতিপূর্ণ দ্বীপগুলি জোয়ারের জল আটকাবার জন্য এই ‘কে’ প্লটের মতোই বাঁধ দিয়ে ঘেরা। সায়রাদের আর সবার মতোই এক-ফসলি জমি। বর্ষার জলে চাষ। মানচিত্রে বিন্দুর চেয়েও বিন্দু মোহনার এই দ্বীপটিতে জীবিকা বলতে চাষ, মাছ ধরা আর কাঠ। ‘ফরেস্টার’-এর দাপটে জঙ্গলের কাঠ বলতে গেলে এখন শুন্যের ঘরে। আর বাগদার মীনেরও চাহিদা নেই আগের মতো। সুতরাং চাষের দিনে সেই বাপ ব্যাটায় চাষ চাই/ তার অভাবে সহোদর ভাই। কিন্তু সেই বাপ-ব্যাটাও এখন কোথায়? ব্যাটা গেছে কেরল, হরিয়ানা, দিল্লী, মহারাষ্ট্র। আসবে বছরে একবার ছুটি পেলে কোনও উৎসবে আয়োজনে, এই যেমন আলাউদ্দিন এসেছে সেই দূরের গুরগাঁও থেকে মেজবু সায়রার বিয়ের জন্য। নিমন্ত্রণ করেছে আমাকে। বলেছে, ‘সঙ্গে আরও কেউ আসতে চাইলে আনবেন কিন্তু।’
কথায় আছে, ‘এক অঘ্রানে ধান/ তিন শাওনে পান।’ আর অঘ্রানে ধান মানে, ‘অঘ্রানে পৌটি, পৌষে ছেউটি/ মাঘে নাড়া, ফাল্গুনে ফাঁড়া।’ ধানে ষোল আনা লাভ করতে হলে কাটতে হবে অঘ্রানেই । অঘ্রানে ধান, অঘ্রানে পয়সা। এই একটা মাস সুন্দরবনের মানুষের সুখের মাস, উৎসবের মাস। সুন্দরবনের মানুষের কাছে তা হিন্দুই হোক আর মুসলমান, এই একটা মাসে যত বিয়ে হবে, বছরের বাকি অংশ জুড়ে তত নয়।
আইবুড়ো ভাতের জন্য বড়বু সুফিয়া বা বোনাই মজফফর চলে এসেছে দুর্বাচটি থেকে। ভাবি আর সব বু আর বোনাই মিলে বাড়ি ভরপুর। আর বাইরে থেকে আমরা। ওদের ভাষায় ‘কলকাতার লোক’। হিন্দু বিয়েতে বড় জামাইবাবুর মতো এখানকার মুসলমান বিয়েতেও বোনাইদের গুরুত্ব খুব। বড় বোনাই মজফফরকে পানি ভরে নিয়ে আসতে হবে কলসে করে।
ছেলে সেই রাক্ষসখালির। সায়রা শুনেছে সেই দ্বীপ আরও আরও পশ্চিমে। তাদের এই ‘কে’ প্লটের পশ্চিম পাড়ের গঙ্গার ঘাটের ভোরের সাড়ে পাঁচটার ভটভটি ধরলে রামগঙ্গায় ভটভটি পাল্টে সেখানে যেতে সময় লাগবে অন্তত তিন ঘন্টা। এত দূরের শ্বশুরঘর থেকে আর কি চাইলেই বাপের বাড়ি আসতে পারবে?
বিয়ের আগে গায়ে হলুদের প্রথা হিন্দু-মুসলমান সবার। সায়রার বিয়েতে কুটুম হয়ে এসেছে পুবের মৈপীঠে সায়রার চাচাত ভাই রসিদের শ্বশুরবাড়ির লোকেরাও। আলাউদ্দিনের কথা ধরলে মৈপীঠ পড়বে রায়দিঘী থেকে ভটভটিতে ‘কে’ প্লট আসার পথেই। একেবারে শেষ মুহূর্তে ভটভটি যেখানে মূল নদী থেকে ডানদিকে বামুনঘাটের দিকে বেঁকছে ঠিক সেখানে ডান দিকে না ঢুকে সোজা দক্ষিণে জঙ্গলের ভিতরের পথ ধরবে। আর জঙ্গলের ভিতরের সেই পথে ডানবাম-ডানবাম করে আরও একটি ঘন্টা। আর তারপর আসবে ১০ নম্বর ঘাট। অর্থাৎ মৈপীঠ। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ওই শেষ এক ঘন্টার নদীপথের কথা শুনেই গা শিউরে ওঠে। আলাউদ্দিনের কাছে জানতে চাই, যাওয়া যাবে না ওখানে?
সায়রার বর এসে পৌঁছতে দেরি হয়ে গেল খুব। সকাল দশটা-সাড়ে দশটার জায়গায় একেবারে বিকেল। বরের নাম হারেজ শেখ। হারেজ তাঁর তিন বন্ধু ও মাকে নিয়ে সায়রাদের বাড়িতে এসে পৌঁছল বেলা সাড়ে তিনটেয়। কথা ছিল নদীগুলো নৌকায়-নৌকায় পার হয়ে দ্বীপগুলোকে এপার-ওপার করবে মোটর-ভ্যানে। নদীর বেলায় তো খেয়া ছাড়া উপায় নেই, কিন্তু দ্বীপ এপার-ওপারের জন্য আর ভ্যানের উপর ভরসা করেনি ওরা। পাঁচটা লোকের তিন-তিনবার মোটর-ভ্যান ভাড়ার হিসেব করেছে। সুতরাং হাঁটা। আর তাই ভোর চারটেয় রাক্ষসখালির ঘর ছেড়ে তিন-তিনবার নদী পার হয়ে এখানে এই ‘কে’ প্লটে এসে পৌঁছতে বেলা সাড়ে তিনটা বেজে গেল। মৌলবি সাহেবের তাড়া ছিল। জোহরের নামাজের জন্য চলে যাওয়ার আগে তিনি জানিয়ে গেলেন, আসবেন এশার নামাজ ছাড়িয়ে সন্ধে সাতটায়। অর্থাৎ দিনের দিন আর বউ নিয়ে ঘরে ফিরতে পারছে না রাক্ষসখালির হারেজ শেখ। সায়রা সুতরাং শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার আগে ‘কে’ প্লটে থাকার বাড়তি দিন পেয়ে গেল আর একটা।
মজলিস থেকে উকিল আর দুই সাক্ষী এসে পৌঁছল তখন সন্ধেই। খবর পাঠানো হল মৌলবি সাহেবকে। এর মধ্যেই একটা টিনের বাক্স করে বরের সঙ্গে করে নিয়ে আসা শাড়ি আর সাজপোশাক কনের ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। গোটা পাড়ার ভিড় তখন সেখানে। হলুদ-রঙা শাড়ি, ব্লাউজ, পাউডার কৌটা। এর পর যা যা কিছু ঘটবে তার সব কিছুই জানা সায়রার। ক’দিন আগে পাশের বাড়ির আখতারিয়ার বিয়েতেও সে দেখেছে। উকিল সাহেব আর দুই সাক্ষী আসবে তার ঘরে, রাক্ষসখালির সেই লোকের ঠিকানা আর দেনমোহরের কথা বলে বিয়েতে সায় আছে কিনা জানতে চাইবে। আর তাকে পর পর তিনবার সায় জানাতে হবে। বলতে হবে, ‘কবুল, কবুল, কবুল’।’ রাত শেষ হতে না হতেই, সায়রা জানে, কাল ভোরভোর উঠে পড়তে হবে ঘুম থেকে। পাখির ডাক শুরু হতে না হতেই বেরিয়ে পড়তে হবে। নাস্তা তৈরি করে রাখবে ভাবি। সায়রা জানে, সেই ভোররাতেও তার চলে যাওয়া দেখতে জেগে উঠবে আশেপাশের অনেকেই। কেউ কেউ সঙ্গে সঙ্গে যাবেও কিছু দূর। কাল ভোর মানে জোয়ার। জোয়ারের পানি ঠিকই আছড়ে পড়বে বাঁধের গায়ে, আবার শব্দও তুলবে ‘শোঁ-শোঁ’। নদী ঠাকুরান আবার কবে তার দেখা পাবে কে জানে? ভটভটি রওনা হলে পানির কণাগুলি হয়ত এলোমেল উড়ে বাতাসে ভেসে পিছু নেবে তার। নদী হয়ত পেছন থেকে ডাকবেও তাকে। ‘পানিতে হেল, পানিতে খেল/ পানিতে তোমার কে আছে?’
বেরোতে বেরোতে সকাল পার হয়ে গেল। ভটভটি ভাড়া করা হয়েছে একটা। এবার সুতরাং আর নামানামি নেই কোথাও। নেই খেয়া নৌকায় নদী পারাপার বা মোটর-ভ্যানে বা হেঁটে দ্বীপ টপকানোর গল্পও। ভাড়া করা ভটভটিতে একেবারে সোজা রাক্ষসখালি।
‘ভটভট’ শব্দ ওঠামাত্র আজন্ম দেখা দ্বীপটা দুলে ওঠে। ডানদিক-বাঁদিক করে দুলতে দুলতে এক সময় চোখের আড়াল।আলোহীন-শব্দহীন অনুষ্ঠান শেষে এ এক নীরব ভেসে যাওয়া।