এনআরসি নিয়ে আমরা সকলেই উদ্বিগ্ন, ক্ষুব্ধ। আমার দু একজন বন্ধু যাঁরা মূলধারার মানবাধিকার কর্মী তাঁরা সোচ্চার হচ্ছেন সোশাল মিডিয়ায় এবং তার বাইরেও। জমায়েত হচ্ছে, মিটিং হচ্ছে, তার মাঝে মানুষের মৃত্যর খবর এসেই যাচ্ছে, তা আসামে হোক বা বাংলায়। আমার এক মানবাধিকার কর্মী বন্ধুর পোস্টে লিখেছিলাম, আজ আপনারা এন আর সি নিয়ে এতো সরব হচ্ছেন, মৌলিক অধিকার লংঘন নিয়ে চিন্তিত হচ্ছেন কিন্তু ধারাবাহিকভাবে, ঐতিহাসিকভাবে কিছু গোষ্ঠীর মানুষ রাষ্ট্রহীন অবস্হায় রয়ে গিয়েছেন, এমন কি মানুষের স্মৃতি থেকেও মুছে যাচ্ছেন, তা নিয়ে কখনো কোন শব্দ ব্যায় করেননি। খানিকটা ঈর্ষা থেকে, আর খানিকটা, ‘দেখ কেমন লাগে’, নাগরিকত্ব চলে যেতে পারে এই আশংকায় দেখে ভাইকারিয়স প্লেসার ও পাচ্ছিলাম। কারণ, আমি যাঁদের সাথে কাজ করি, অর্থাৎ যাঁদের মনোরোগের তকমা রয়েছে, যাঁরা হাসপাতালে বন্দী বা রাস্তার ভবঘুরে তাঁরা কোনও লিস্টেই জায়গা পান না। আমাদেরই মানসিকতার জন্য। তো তিনি অনেস্টলি জবাব দেন, তিনি ‘এভাবে ভাবেন নি’।
আমি যেহেতু মানসিক রুগিদের জন্য কাজ করি, আমার একটা দায় আছে বোঝানোর যে, এনআরসি কেবল একটি একক বিচ্ছিন্ন ইসু নয়। এটি একটি দুধার বিশিষ্ট তলোয়ার যা আমাদের সকলকেই ফালা ফালা করে কেটে দিতে পারে। মানসিক স্বাস্হ্যের ইন্টারসেকসনালিটির নিরীক্ষে এনআরসির বিশ্লেষণ প্রয়োজন। বিভিন্ন পোস্ট পড়ে জানতে পারছি প্রায় ১২ জন আমাদেরই রাজ্যে আত্মহত্যা করেছেন, অথবা হার্টফেল করে মারা গেছেন।আসামে এই মৃত্যুর সংখ্যা বাদই দিলাম। এনআরসি তালিকায় নাম নথিভূক্ত না হলে, নাম কেটে গেলে, ভিটে মাটি চ্যূত হওয়ার জ্বালা, এতটাই চরম যে তা মনকে আঘাত করতে বাধ্য। মানসিক বিপন্নতা বোধ স্বাভাবিক। এবং তার ফল স্বরূপ মানুষ প্রাণ দিয়ে দিচ্ছেন। নাগরিক হিসাবে স্বীকৃতি না পাওয়ার যন্ত্রণা ভীষন। মা মাসিমারা আতি পাতি করে প্রামান্য তথ্য খুঁজে চলেছেন, আর হায়হায় করছেন। ভয় হচ্ছে এই যদি ডিসপ্লেসট হয়ে যাই। শীকড়হীন হবার অনুভব বড় ভয়ানক।
উল্টোদিকে, মনোরোগের কারণে যাঁরা হাসপাতালে আছেন, বা পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তাঁরা আরও গভীর সংকটে। সামাজিক চিত্র বা বাস্তব হল মনোরোগির তকমা একবার জুটে গেলে, কিম্বা রোগের সন্দেহে, পরিবার, রাষ্ট্র তাঁদের ব্রাত্য করে দেয়। তাঁদের তো কোনও পরিচয় পত্রই নেই। হাসপাতালে নামের জায়গায় লেখা থাকে, আন-নোন মেল - অজানা পুরুষ, বা আন-নোন ফিমেল – অজানা নারী। তাঁদের সম্বন্ধে তথ্য পাওয়ার কোন চান্সই নেই। তাই তাঁরা কোনো লিস্টেই থাকবেন না, বিশেষ করে এন আর সি লিস্টে। সম্পূর্ণ ইরেসড। এটা উপলব্ধি করা কি খুব কঠিন?
অতএব বৃহত্তর ছবিটি সামনে রেখে মানবাধিকার কর্মীদের কাছে আবেদন যে তারা যেন এনআরসি-র মতো গুরুত্ব পূর্ণ বিষয়টিকে খন্ডচিত্র হিসাবে না দেখেন। এই দৈন্যতা কোথাও ফ্যাসিবাদকেপ্রশ্রয় দেয়,ঠিক যেটার বিরুদ্ধে আমরা সরব হচ্ছি।
নাগরিক হয়ে ওঠার অধিকার কেবল মাত্র সবল, সক্ষম মানুষের জন্য—এই ভাবনা ফ্যাসিবাদী, এ ভাবনা অবিলম্বে দূর করা দরকার। তাই এনআরসি নিয়ে যে টুকুনি কথা হচ্ছে জনপরিসরে, মানবাধিকার কর্মী হিসাবে কর্তব্য সামগ্রিক সামাজিক ইন্টারসেক্সানাল প্রেক্ষাপট কেন্দ্রে রেখে বিচার করা, নচেৎ মানবাধিকারের বিষয়টা লঘু হয়ে যায়। বাদ পড়ে যাওয়া বড়ই করুণ।