পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

অশান্ত কাশ্মীর

  • 01 May, 2019
  • 3 Comment(s)
  • 5103 view(s)
  • লিখেছেন : মহুয়া বৈদ্য
ফি বছর সংখ্যক পুণ্যার্থীর অমরনাথের কঠিন পথ পাড়ি দেওয়া কাশ্মীরি মুসলমানদের সাহায্য ছাড়া প্রায় অসম্ভব। অশান্ত কাশ্মীর থেকে জম্মু পৌঁছনো মতো অসম্ভবকে সম্ভব করেন এক কাশ্মীরি ড্রাইভার।কাশ্মীরিয়াতের প্রাণছোঁয়া আখ্যান শোনালেন মহুয়া বৈদ্য।

সন্ধ্যেবেলা বসে গল্প জুড়েছিলাম হোটেল মালিকের সাথে। বাঙালি ভদ্রলোক, বর্তমান ঠিকানা কাশ্মীর। হোটেলটি লিজ নিয়ে চালান। সঙ্গে খাবার ব্যবস্থাটিও বেশ। বেশ কয়েক বছর ধরে ব্যবসা করছেন এখানে, অফ সিজিনে বাড়ি ফিরে আসেন, তারপর সারা বছরই কাশ্মীর। সদ্য অমরনাথ যাত্রা শেষে সেদিন আমরা শ্রীনগর। কথা হচ্ছিল অমরনাথ প্রসঙ্গে। বলছিলেন তাঁর নানা অভিজ্ঞতার কথা। প্রায় প্রতিবছর অমরনাথ যান এরকম পুণ্যার্থী অনেক আছেন। পরপর আট বার অমরনাথ গেছেন এমন পুণ্যর্থীও এসেছেন তাঁর হোটেলে। অমরনাথের এই কঠিন পথ প্রতি বছর এত সংখ্যক পুণ্যার্থীর পাড়ি দেওয়া কাশ্মীরি মুসলমানদের সাহায্য ছাড়া প্রায় অসম্ভব। শুধু ঘোড়ায় পৌঁছে দেওয়া নয়, খাদ্য সামগ্রী থেকে প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় জিনিস পৌঁছে দিচ্ছে এই কাশ্মীরি মুসলমানেরা। এত সুন্দর সহাবস্থান। তাও অশান্ত হয় কাশ্মীর। প্রসঙ্গক্রমে এসেছিল পাকিস্থান, ভারত ভাগ, নানা রাজনৈতিক আলোচনা। হোটেল মালিকও সেই আমাদের দলের মানুষ যারা প্রতিনিয়ত চাইছি কাশ্মীর থাক আমাদের কাছে। কিন্তু তার আমার মধ্যে রয়েছে উপলদ্ধির তফাৎ। সে দেখছে কাশ্মীরকে কাছ থেকে। দেখছে প্রতি আনাচে কানাচে বুটের খটখটানি। প্রতিদিনের প্রাইভেসিহীন জীবন। দূর থেকে দেখা এক আর প্রতিদিনের জীবনে ঘটমান বর্তমানকে মেনে নেওয়া আর এক। ভদ্রলোক বারবার বোঝাতে চাইছিলেন সে কথা। আমার সাথে চারজন সিনিয়র সিটিজেন। দিনটা ৮ জুলাই, ২০১৬। দুদিন আগে আমরা অমরনাথ দর্শন সেরে ফিরেছি। দুদিন শ্রীনগরে বিশ্রাম, পরের দিন রাতে ট্রেন জম্মু থেকে। গাড়ি বুক করা, সকাল বেলা বেরিয়ে যাব। মোটামুটি নিশ্চিন্ত, ট্যুর শেষের পথে। কিন্তু এত কঠিন পথ অতিক্রম করার পরেও এত সহজ সুন্দর পথ কিভাবে কঠিন হয়ে উঠতে পারে তা বোধহয় একমাত্র দেখাতে পারে কাশ্মীরই। পরের দিন সকাল সকাল বেরোনো তাই রাত ৮ টা নাগাদ ডিনার করতে নেমে শুরু হল প্রথম বিপত্তি। হোটেল মালিক জানালেন কাশ্মীর আজ অশান্ত হয়ে উঠেছে। কোন এক কাশ্মীরি যুবক সেনার গুলিতে মারা গেছে। চারদিকে গন্ডগোল। ড্রাইভার বেরোতে নারাজ। কিন্তু আগামীকাল আমাদের বেরোতেই হবে। ডেকে পাঠালাম ড্রাইভারকে। দ্বিগুণের বেশি টাকায় সে রাজি হল। সকালে কারফু শুরু হয়ে যাবে। তখন সম্ভব নয়। এতএব সারাদিনের উন্মত্তার পরে কাশ্মীর যখন বিছানা নেবে। সেই সময় বেরব আমরা। রাত ১২টায় যাত্রা শুরু হল। চারিদিকে অসম্ভব থমথমে, নিস্তব্ধ। কিন্তু ঘন্টাখানেক আগেও পরিস্থিতি কি ছিল তা আন্দাজ করতে পারি। রাস্তার ধারে জ্বলছে গাছের গুঁড়ি। কোথাও বা তা পথের মাঝে। ইতিউতি জ্বলছে গাড়ির টায়ার। রাস্তার মাঝে কোথাও বা বড় পাথর। রাস্তা জুড়ে ভাঙা কাচ, পথের পাশে ভাঙা গাড়ি। পাথর ছোঁড়ার চিহ্ন চারিদিকে বিদ্যমান। কোনো কোনো মোড়ে সেনা, পুলিশ। এ পথ আমাদের কাছে অজানা কিন্তু ড্রাইভার জানে কোথায় বিপদ লুকিয়ে আছে। তাই বারবার থামছে গাড়ি, বিপদে পড়লে। ড্রাইভার গাড়ির মুখ ঘুরিয়ে রেখে নেমে খোঁজ নিতে যাচ্ছে সামনে, রাস্তা কতটা নিরাপদ। সঙ্গে মাথায় রেখেছে সামনে বিপদ আসলেই সোজা উল্টোপথ ধরবে, বিপদ এলে তার গায়ে হাত পড়বে না, কিন্তু আমরা ছাড়া পাব না, সে কারণেই গাড়ির মুখ উল্টোদিকে করে থামানো। বিপরীত দিক থেকে আসা গাড়ি গুলোর কাছে খোঁজ নিতে নিতে আমরা চলে এলাম অনন্তনাগ। বিপদসঙ্কুল এলাকা। ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে ঘুরিয়ে রেখে সামনে নিরাপদ কিনা খোঁজ নিতে গেল। দ্রুত দৌড়তে দৌড়তে ফিরে এসে গাড়িতে স্টার্ট দিল। পিছনে উন্মত্ত জনতা, বিপদ। আমরা হোটেলে ফেরার পথ ধরেছি। পিছনে পাথর ছোঁড়ার শব্দ। ফেরা প্রায় অসম্ভব হয়ে গেল। কতদিনের জন্য অবরুদ্ধ হলাম জানা নেই। ফ্লাইট এর টিকিট কেটে বেরিয়ে যাব ভাবলাম। কিন্তু কিভাবে যাব এয়ারপোর্ট? সেটাও অনিশ্চিত। হোটেলে ফিরলাম। ড্রাইভার যোগযোগ রাখবে এই আশ্বাস দিয়ে ফিরে গেল। হোটেলে আমাদের পাঁচজনের বিনিদ্র আতঙ্কের রাত। রাত যখন শেষের পথে হঠাৎই বেজে উঠল ফোনটা.... ড্রাইভার.... বাস স্ট্যান্ড থেকে কিছু গাড়ি বেরোচ্ছে... একসাথে কয়েকটা গাড়ি এই স্তব্ধ উপত্যকা থেকে বেরোবার চেষ্টা করবে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে উঠে পড়লাম গাড়িতে... রাস্তা এখন শান্ত স্নিগ্ধ। প্রতি মোড়ে সেনা, অনেক পুলিশ। অনেকটা আশ্বস্ত। ড্রাইভার নিজের ছন্দে। গাড়ি দ্রুত ছুটছে। শুরু হল গল্প। তিনিও কাশ্মীরি মুসলমান। মূলত টুরিস্ট ঘোরানোই তাঁর কাজ। এতেই তাঁর সংসার চলে। আগামী দিনগুলো কিরকম হতে চলেছে সে গল্প উঠে এল। উঠে এল তাদের প্রতি দিনের জীবনের গল্প। সেনাবাহিনীর খটখটানি। তাদের বেআব্রু জীবন। তারা মুক্তির আশায়। কিন্তু ভীষণ অসহায়, সহ্য করা ছাড়া কিই বা করার আছে। কিন্তু টগবগে রক্ত, সদ্য তরুণ, নতুন ভোরের আশায় বাধ্য হতে নারাজ। তারই সুযোগ নিচ্ছে আর এক পক্ষ। এদের হাতে আসছে অস্ত্র... যাচ্ছে জীবন। গল্পে গল্পে চলে এসেছি অনন্তনাগ। আবার শুরু টেনশন। সামনেই একটা যাত্রী বোঝাই গাড়ি ভাঙচুর শুরু হল। ওই গাড়িটা টার্গেট হওয়ায় আমরা বেঁচে গেলাম। পেরিয়ে এলাম অনন্তনাগ। সকাল ৭টায় পার হলাম জহর টানেল। সামনে জম্মু। বিপদমুক্ত আমরা। পিছনে কাশ্মীরে শুরু হল কারফু। বাড়ি ফিরে শুনেছিলাম ৮ জুলাই যে কাশ্মীরি যুবক মারা গিয়েছিল তার নাম বুরহান ওয়ানী। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন উত্তপ্ত ছিল কাশ্মীর। আজ আবার নতুন করে উত্তপ্ত কাশ্মীর। প্রেক্ষাপট আলাদা। তার আঁচ এসেছে কলকাতাতেও, কাশ্মীরি ডাক্তার আক্রান্ত। আজ বারবার মনে পড়ছে সেই ড্রাইভারের কথা। কী ভীষন ঝুঁকি নিয়ে তিনি আমাদের নিরাপদে পৌঁছে দিয়েছিলেন। মনে পড়ছে সেই মুসলমান কাশ্মীরি মানুষটির কথা যিনি শেষনাগে আমার মাসির অসুস্থতায় হাত ধরে টেন্টে পৌঁছে দিয়েছিলেন। তোমাদের ঋণ ভোলার নয়। তোমরা আমার প্ৰকৃতই বিপদের বন্ধু।

3 Comments

Amal Pal

13 April, 2019

ভালো লেখা...

মহুয়া বৈদ্য

01 May, 2019

ধন্যবাদ

Esha Mondal

02 May, 2019

সবাই যে সুস্থ ভাবে বাড়ি ফিরতে পেরেছে তার জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ ।লেখা অসাধারণ ।

Post Comment