পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

এই গরমে মুখোশ পরে থাকা সত্যিই অসম্ভব!

  • 06 May, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 1058 view(s)
  • লিখেছেন : অশোক মুখোপাধ্যায়
সাইকেল থেকে নেমে হাতের সামনে পেয়েই চটাদাকে যখন প্রশ্ন করলাম, আমাদের বিকাশ পিএম এখন এত ঘন ঘন সাম্প্রদায়িক হুঙ্কার দিচ্ছেন কেন, ওনার সাফ জবাব, কেন আবার? এই গরমে কারও পক্ষে টানা মুখোশ পরে থাকা সম্ভব? মুখোশ মানে? কোনটাকে মুখোশ বলছেন আপনি?

কেন, এই যে বিকাশ, উন্নয়ন, তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি, চান্দ্রেয় অভিযান, গ্যারান্টি, ব্লা ব্লা ব্লা . .
 

এগুলো মুখোশ?

তা নয়ত কী? তুই কি ভাবছিস, দেশের বিকাশ হয়েছে, বা হচ্ছে?

না, তা ভাবছি না, আমাকে মানতেই হল, তেমন কিছু বিকাশ আর হল কই? বুলেট ট্রেনের কথা বলে নিয়ে এল বন্দে ট্রেন। শুধু সামনেটা দেখতেই ---

বুলেট ট্রেনের ইঞ্জিনের মতো। চটাদা আমার মুখ থেকে কথাটা প্রায় উপড়িয়ে তুলে নিলেন! কিন্তু স্পিড সেই আগের মতোই।

না, এটা তুমি বলতে পারবে না, আমি বাধা দিলাম, বন্দে আধ ঘন্টা কম সময়েই তো হাওড়া থেকে শিলিগুড়ি পৌঁছে দিচ্ছে।

দেবেই তো, স্টপেজ কম যে! শোন, যে দেশগুলো বুলেট ট্রেন চালায়, ওদের সমস্ত ট্রেনই সময় মতো চলে। একমাত্র এই একটি দেশ তুই খুঁজে পাবি, যেখানে একটা ট্রেনকে আধা ঘন্টা কমে চালানোর জন্য বাকি সমস্ত ট্রেনকে গড়ে এক ঘন্টা করে দেরিতে চলতে হয়। বিকাশের মুখোশে এমনটা হবেই।

আমি তাড়াতাড়ি তারুকাকার দোকান থেকে দুটো গরম বেগুনি আর দু কাপ লাল চা নিয়ে এলাম। এগুলো ছাড়া চটাদার মুখ খুলতে চায় না। অথবা খুললেও খালি তেতো আওয়াজ বেরয়। একটা বেগুনির পলেস্তারা খানিকটা খসিয়ে নিয়ে মুখে পুড়ে চটাদা বললেন, তোদের এই পিএম লোকটা বেশ গাড্ডায় পড়েছে, বুঝলি?

গাড্ডায়? কীরকম?

অনেক দিন পরে কংগ্রেস একটা লাইন নিয়েছে যেটা নরেন্দ্রদামোদরের হালের পানি অনেকটা খেয়ে নিয়েছে। এটা বোধ হয় তোরা লক্ষ করিসনি, তাই না?

আমি আন্দাজ করে ঢিল ছুঁড়লাম, আপনি কি কংগ্রেসের নির্বাচনী ইস্তাহারের কথা বলছেন? যেটাকে ওরা ন্যায়পত্র বলে বাজারে ছেড়েছে?

চটাদা খুশি হলেন। অ্যাদ্দিনে তোর আমার কাছে আসার খানিক সুফল দেখতে পাচ্ছি। ঠিক ধরেছিস।

কিন্তু নির্বাচনী ইস্তাহার তো প্রত্যেক বারই হয়। সব দলই করে। নানা রকম ভালো ভালো আশ্বাস বাণী দেয়। এর মধ্যে আর নতুন কী আছে? আমি বললাম বেশ একটা রাজনৈতিক গাম্ভীর্যের ভাব এনে, দুটোই বুর্জোয়া দল। ওদের ইস্তাহারে আর আলাদা বিশেষ কী থাকবে?

আছে, আছে, দুচারটে এমন নতুন প্রস্তাব ওতে আছে যাতেই তোদের ওই বুকনিবাজ লোকটার কিঞ্চিৎ অসুবিধার কারণ ঘটেছে। গদি হারানোর ভয় পাচ্ছে! তোরা তোদের ভোট পার্টনারের কাজ কারবার সম্পর্কে খবর না রাখলেও যার এতে যায় আসে সে ঠিক রেখেছে।

আমার হাত থেকে চটাদা চায়ের কাপটা নিলেন। ফলে আমিও চায়ে চুমুক দেবার একটা সুযোগ পেলাম। বললাম, একটু বিশদে বলবে? জানই তো আমাদের ---

মাথায় গোবর পোরা। তাই বলছিস তো? যাক, নিজের মূল্যায়ন সঠিক ভাবে করতে পেরেছিস! আর আমার কাজ হচ্ছে তোদের মগজ মাঝে মাঝে সাফ করে দেওয়া। তাই না?

একদম।

তবে শোন, এই যে তোদের দোস্ত রাহুল গান্ধী, লোকটাকে অ্যাদ্দিন ছেলেমানুষ বলে মনে হচ্ছিল। ইদানীং যেভাবেই হোক, বেশ অনেকটা ম্যাচিওরিটি এসেছে ওনারা মধ্যে। দেশের রাজনীতিটা ধরতে পারছে। আম জনতার নাড়ির হালচাল সবটা না হলেও খানিক আন্দাজ পেয়েছে। সেটা ওদের ইস্তাহারে অনেকটা প্রকাশ পেয়েছে।

আমি জানতে চাইলাম, যথা?

এই যেমন ধর, চটাদা গম্ভীর মুখে বললেন, উদার অর্থনীতির মূল্যায়নের কথা বলেছে। চুক্তিপ্রথা বাতিল করে সরকারি ক্ষেত্রে নিয়মিত শ্রমিক কর্মচারি নিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। মানেটা বুঝতে পারছিস? পিছিয়ে আসতে চাইছে। মনে হয় বুঝেছে, মনমোহনের সেই নয়া শিল্পনীতি দেশের কী সাড়ে সর্বনাশ ঘটিয়ে দিয়েছে।

কিন্তু সেকথা তো কোথাও স্বীকার করেনি!

করে নাকি কেউ? পাগল? ইসারায় বুঝিয়ে দিচ্ছে। আর সেটা দেখেই সফেদ দাড়িওয়ালার ঘুম চটকে গেছে। এর আমলে তো সমস্ত সরকারি ক্ষেত্র হয় বেচে দিচ্ছে না হলে চুক্তি ভিত্তিক লোক নিয়োগ করছে, কিংবা আউট সোর্সিং করে ফেলছে। বেকার সমস্যা সর্বকালের রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে। বছরে দুকোটি বেকারকে কাজ দেবে বলেছিল, এখন বছরে দুকোটি করে লোক কাজ হারাচ্ছে।

আচ্ছা, পিএমও যদি কাল থেকে বলতে শুরু করে যে ---

আমাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে চটাদা বলে উঠলেন, ওর যারা মূলতরফদার – বানি আর দানি – ছেড়ে দেবে বলে ভেবেছিস? ও কি নিজেকে এমনি এমনি চৌকিদার বলে?চৌকি পাহারা দেবে বলেই ওকে বানি দানিরা তুলে এনেছে আরব সাগরের ভাগাড় থেকে। একটু বেয়াড়াপনা দেখলেই কান ধরে ছুঁড়ে ফেলে দেবে।

এবার বুঝতে পারছি – আমি বললাম – হঠাৎ করে মুসলমানদের নিয়ে পড়েছেন কেন।

কেন, বল তোর কী মনে হচ্ছে।

বিকাশ টিকাশের কথা বলতে পারছেন না, অথচ কংগ্রেসের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলির একটা মুখ ফাটানো জবাব তো দিতেই হবে। হয়ত সেই কারণেই এখন উনি লাইন ঘোরাতে চাইছেন। সাম্প্রদায়িক ভাবনার দিকে সংখ্যাগুরু ভোটারদের ঠেলে দিতে চেষ্টা করছেন।

ও মাই তারুদা! তোর তো মগজ অনেকটা সাফাই হয়ে গেছে দেখছি! প্রায় ঠিক ধরে ফেলেছিলি আর কি!!

কেন, এতেও ভুল আছে বলছেন? আমার খুব রাগ হয়ে গেল।

ভুল নয় রে বাচ্চু, ভুল নয়। ইনকমপ্লিট। সেও এক রকমের ভুলই। তবে অত খারাপ নয়। যা, আর এক দফা চা বলে আয়। তার পর বুঝিয়ে দিচ্ছি বাকিটা।

চটাদাকে শুধু চা যে কখনই দেওয়া যায় না, সেটা ধনেশ চক্কোত্তি স্ট্রিটের আড্ডাবাজদের সকলেই জানেন। সুতরাং বলা বাহুল্য যে আমি চায়ের সঙ্গে দুটো সিঙ্গারাও দিতে বলে এলাম। চটাদা আমার প্রশিক্ষণ দেখে মনে হল খুশিই হলেন। বললেন, এই সিঙ্গারার মতোই উনিজির সমস্যাটা। কংগ্রেস বলে রেখেছে, ওরা ক্ষমতায় ফিরলে কারও খাদ্য বস্ত্রের রুচিতে হানা দেবে না। নাগরিকদের ধর্ম চর্চা খাদ্যাভ্যাস পোশাক আশাক নিয়ে মাথা ঘামাবে না। এরকম কথা এই মুহূর্তে যে রাহুল গান্ধীর পার্টি সাহস করে বলতে পেরেছে, এটা বেশ বড় ব্যাপার। সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের অনেকের মধ্যেই যে ‘ওদের’ টাইট দেবার মানসিকতা কাজ করে এবং যেটার উপরই আরএসএস এবং বিজেপি নির্ভর করে সবচাইতে বেশি, সেটাকে জেনেও কংগ্রেস যে বেরিয়ে আসতে পেরেছে – এতে বিরাট ঝামেলা হয়ে গেছে। এতে সংখ্যালঘুদের আস্থা তো ওদের দিকে যাবেই, তার সঙ্গে হিন্দুদেরও যে অংশটা দিন রাত মন্দির মসজিদ গরু গোবর হনুমান নিয়ে পড়ে থাকতে পছন্দ করে না, আলি আকবরের সেতার বিসমিল্লার সানাই বড়ে গোলাম আলির ঠুংরি সুযোগ পেলেই শোনে – তারাও যে খানিক খুশি এবং আশ্বস্ত হবে, এটা উনিজির বুঝতে দেরি হয়নি।

সঠিক সময়ে তারুকাকা এসে সিঙ্গারার ঠোঙা আর চায়ের কাপ ধরিয়ে দেওয়ায় আমি একটু হাঁফ ছাড়ার অবকাশ পেলাম। জিগ্যেস করলাম, কিন্তু উনি তো অন্য সব আওয়াজ তুলছেন। শ্রাবণ মাসে মাছ মাংস খাওয়াকে মোগল রুচি বলছেন, বলছেন ওদের অনেক বিবি আর বাচ্চা হয়, ওরা দেশের সম্পদ বেশি করে খেয়ে নিচ্ছে, ওরা দেশটাকে বড় পাকিস্তান বানিয়ে ছাড়বে, ইত্যাদি।

চটাদা সিঙ্গারার গরমটাকে খুব একটা গ্রাহ্যের মধ্যে না এনে তিনটে কোনা ভেঙে মুখে পুরে দিলেন। তার পর চায়ের কাপে একটা লম্বা চুমুক দিলেন। এই সব লক্ষণ আমি বিলক্ষণ চিনি। আরও একটা লম্বা উজ্জ্বল আলোকরশ্মি আসছে। অগ্রিম পুলকিত হয়ে অপেক্ষা করতে রইলাম।

এগুলো ঠিকই শুনেছিস। কিন্তু এসব হচ্ছে ওদের পুরনো কথা। আমরাও সেই ছেলেবেলা থেকে এই সব শুনে আসছি। বেশিরভাগই ফাটা রেকর্ডের মতো। ও, থুরি, ফাটা রেকর্ড তুই আবার দেখিসনি। ভুলেই গেস্‌লাম।

আমি তাড়াতাড়ি বাধা দিলাম, না না, চটাদা। বড়দের কাছে অনেক বার শুনে শুনে এখন আমিও জানি ফাটা রেকর্ডের ব্যাপারটা। আপনি নিশ্চিন্তে বলে যেতে পারেন।

যাক, তাহলে বাঁচা গেল। তো, মুসলিমদের অনেকগুলি বাচ্চা পয়দা হয়, ওরা দশ বছরের মধ্যেই হিন্দুদের সংখ্যায় ছাড়িয়ে যাবে – এ আমি ১৯৬৮ সালে শুনেছি, ১৯৮২ সালেও শুনেছি, আবার বাবরি মসজিদ ভাঙার হট্টরোলের সময়েও শুনতে পেয়েছি। আমার বয়সের সকলেই বার বার শুনেছে। ফলে এসব কথার ধার এখন কমে গেছে। আর মাছ মাংস ডিম খাওয়ার ব্যাপারটা একটা অদ্ভুত থিসিস। লোকটা যে গুজরাতের বাইরে নিজের দেশটাকে চেনেই না, এই কথাতে একেবারে ছবির মতো চিনিয়ে দিল। আরে বাপু, যারা মাছ ফাছ খায় তারা দুচারটে বিশেষ তিথি বাদে সারা বছরই খায়। আর যারা খায় না, তারা বছরের কোনো মাসেই খায় না। এই সব না জেনে একটা পিএম যে এতটা উজবেকের মতো কথা বলতে পারে, এ আমার ধারণাতেই ছিল না। ইন্দিরা গান্ধী একবার একজন এরকম লোককে রাষ্ট্রপতি বানিয়েছিলেন। সেই জৈল সিং-এর কথাটা আমার মনে পড়ে গেল। বুঝলি তো?

তা উনিজি কি না জেনেই এসব বলছেন?

না, একেবারে না জেনে নয়। উপায় নেই বলে। এখন ওনাকে এক গুচ্ছ নতুন মিথ্যা কথা ইনিয়ে বিনিয়ে বলতেই হবে। কংগ্রেসের ইস্তাহার নাকি মুসলিম লিগের দাবি সনদ। কংগ্রেস নাকি দেশের সমস্ত ধন দৌলত মুসলমানদের মধ্যে বিলিয়ে দেবে। মুসলমানরা হিন্দু মহিলাদের মঙ্গলসূত্র কেড়ে নেবে! একটা তীব্র মুসলিম বিদ্বেষ জাগিয়ে তুলে কংগ্রেসকে তার সঙ্গে মিলিয়ে দিলে ভাবছে হিন্দু ভোট আবার ওর দিকে ঘুরে যেতে পারে! আসল লক্ষ্য হল কংগ্রেসের নির্বাচনী ইস্তাহার সম্পর্কে সাধারণ ভোটারদের মনকে বিষিয়ে দেওয়া। বুঝতে পারছিস?

হ্যাঁ, এখন খানিকটা বুঝতে পারা যাচ্ছে।

চটাদা খুশি হলেন। বললেন, মোদীর প্রচার থেকেই তুই ধরতে পারবি, ওরা কতটা ভরসা পাচ্ছে আর কতটা ভয় পেয়েছে। এতগুলো এজেন্সি, এতগুলো কোলেপড়া মিডিয়া, এদিকে ইলেকশন কমিশন – সব মিলিয়েও দেড়শর বেশি আসন দেখতে পাচ্ছে না। আর একটা পুলওয়ামা ঘটানোরও সাহস পাচ্ছে না। ফলে মরিয়া হয়ে এখন এই রাস্তায় নেমেছে। ভেতরে ভেতরে এত ঘামছে যে এই গরমে আর মুখোশ পরে থাকতে পারছে না!

বললাম, বাই চটাদা। এখন আসি। কজনকে কথাটা বোঝাতে হবে। সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিলাম।

 

 

 

 

 

 

 

0 Comments

Post Comment