পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

বাংলাদেশকে দমিয়ে রাখা যায়না

  • 07 August, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 1029 view(s)
  • লিখেছেন : সৌমিত্র দস্তিদার
বাংলাদেশের অধিকাংশ লোক আবেগপ্রবণ। সাহসী। চির বিদ্রোহী। তারা দাবি আদায়ের জন্য পথে নামতে জানেন। গুলির মুখে বুক পেতে দাঁড়াতে জানেন। ফের একই স্বৈরতন্ত্র নতুন নামে ফিরে এলে, নিশ্চিত থাকুন, আমি যেটুকু বাংলাদেশ কে চিনি, সে নিশ্চেষ্ট না থেকে ফের রাস্তায় নামবে। আবার একবার ট্যাঙ্কের সামনে বুক পেতে দাঁড়াবে। শহীদ হবে। তবুও নতুন ভোরের স্বপ্ন দেখবে। বাংলাদেশ কখনও হার মানতে জানে না।

বাংলাদেশের ঘটনা নিয়ে কিছু লেখা এখন যথেষ্ট কঠিন। ঘন্টায় ঘন্টায় অবস্থা পাল্টে যাচ্ছে। এখনও নতুন অস্থায়ী মন্ত্রী সভা গড়ে ওঠেনি। দেশজুড়ে অরাজকতা চলছে। লুঠতরাজ, আগুন দেওয়া থামেনি। সেই সঙ্গে চলছে আওয়ামী লীগ অনুসারীদের বাড়ি, পার্টি অফিসে হামলা। এসব বিরক্তিকর ঘটনা মোটেও কাঙ্ক্ষিত নয়। সমস্যা হচ্ছে আমার আপনার চাওয়া পাওয়ার ওপর সমাজ দাঁড়িয়ে থাকে না। একটা বদল যখন আসে তখন এমন অনেক ঘটনা ঘটে তা হয়ত কেউ কখনও কল্পনাও করেননি। কিন্তু যেটুকু যা ওই দেশটাকে চিনেছি তাতে এই পরিস্থিতি হবারই ছিল । অনেক বার লোকজন কে বলেওছি যে ঢাকা বড় জীবন্ত শহর। কয়েকবছর ধরে আপাত দৃষ্টিতে ঢাকা কে খুব শান্ত মনে হতো। থমথমে। তখনও বন্ধু বান্ধব কে বলেছি, এ যেন ঝড়ের পূর্বাভাস। গত কয়েকবছর ধরে আওয়ামী লীগের শাসনে মানুষ তিতি বিরক্ত ছিল। ওপর ওপর উন্নত শহরের সব লক্ষণ থাকলেও মনে হতো দমবন্ধ এই পরিবেশ ভালো নয়। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এক প্রবন্ধের শিরোনাম দিয়েছিলেন-- আগ্নেয়গিরির শিকড়ে পিকনিক। বলেছিলেন, “সময় হলে এই শখের ভোজসভা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাবে।" মেট্রো রেল, পদ্মা সেতু, ঝা চকচকে স্কাইস্ক্র্যাপার এসব সত্ত্বেও, ঠিক তাই হলো। সখের ভোজসভা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল । কলকাতার অনেকের কাছেই এটা আকস্মিক বলেই তারা অধিকাংশ গেল গেল রব তুলে হাহাকার করছেন। দুই বঙ্গের বাঙ্গালীর ভাষা এক হলেও অনেক ব্যাপারে তারা আলাদা।


বাংলাদেশের অধিকাংশ লোক আবেগপ্রবণ। সাহসী। চির বিদ্রোহী। তারা দাবি আদায়ের জন্য পথে নামতে জানেন। গুলির মুখে বুক পেতে দাঁড়াতে জানেন।


এইবারের কোটা সংস্কারের দাবি এবং তার পরবর্তীতে ছাত্ররা যে একরোখা মনোভাব দেখালো এবং তার মধ্যে দিয়ে স্বৈরতন্ত্রের পতন ঘটাল, তা হাজার সমালোচনা করলেও পৃথিবীর ইতিহাসে নিশ্চিত পাকাপাকিভাবে ইতিমধ্যেই স্থায়ীভাবে জায়গা করে নিয়েছে। ৫২ র ভাষা আন্দোলন, ৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠন, ১৯৫৯ এ আয়ুব বিরোধী সংগ্রাম, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ-- সবসময় বুকের রক্ত দিয়ে তারা প্রমাণ করেছে যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে তারা লড়তে জানে। কোন শক্তি নেই তাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে।


এপারের অধিকাংশ জনগণ সাধারণভাবে যে কোন অচলায়তন ভাঙ্গার বিপক্ষে। বিপ্লবী, প্রগতিশীল হবার ভান করেন কিন্তু আদতে অসম্ভব রক্ষনশীল। নতুন কে স্বাগত জানাতে তাদের ভারী কুন্ঠা। এই জায়গা থেকেই আজ তারা বাংলাদেশ আন্দোলন কে ইতিবাচক দিক দিয়ে না দেখে, নানা জ্ঞানগর্ভ বাণী দিয়ে আসর গরম করে চলেছেন। দিনের পর দিন শেখ হাসিনা বাংলাদেশে চরম স্বৈরাচারী শাসন চালিয়ে গেলেও এই বঙ্গের বাঙালী একটি কথা বলা দূরে থাক, ওদেশের সমাজ, নতুন প্রজন্মের মধ্যে যে পরিবর্তন আসছে তা তারা বুঝতেই পারেন নি । বছরের পর বছর আওয়ামী লীগ, তাদের ধামা ধরা বুদ্ধিজীবীর চোখ দিয়ে তারা বাংলাদেশ কে দেখে এসেছেন। কেউ কেউ মাঝে মধ্যে ও পারে গেছেন। ফিরে এসে ইলিশ মাছ, কাচ্চি বিরিয়ানি বা বড়জোর পুরনো ঢাকার বাকরখানির গল্প করেছেন। বাংলাদেশ চিনতে হলে শুধু ঢাকা ঘুরলে চলবে না। জেলায় জেলায় যেতে হবে। গ্রাম, শহর, মফস্বলে জনগণের সঙ্গে মিশতে হবে। সেটা সবার পক্ষে সম্ভব না হলে চুপ করে থাকুন। অন্তত কিছুদিন। ওই গল্প শোনাবেন না, জানি জানি, কি হচ্ছে, সব জানি। আমারও বন্ধু কম নেই ওপারে। এই তো কাল অমুক বলছিল ইত্যাদি ইত্যাদি বলে ইসলাম ফোবিয়া চারিয়ে দেবেন না। আগে বলুন, আপনি হাসিনার স্বৈরতান্ত্রিক কাহিনী কতটুকু জানেন!!  আওয়ামী লীগ একাই দেশ স্বাধীন করেছিল, এ তথ্য কোথায় পেলেন! মুজিব বাহিনী ও রক্ষীবাহিনীর ভুমিকা বাংলাদেশের জন্মের পর থেকে ঠিক কি ছিল!  আপনি হাসিনা বিদায়ের পর থেকে হিন্দু নির্যাতনের কথা বলছেন। ঠিক করছেন। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের ওপর হামলা হলে, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না করাটাই মানবতা বিরোধী। কিন্তু খতিয়ে দেখুন, যা শুনছেন তার সবটুকু সত্যি না গুজব! খোঁজ নিন তাদের কেউ কেউ আওয়ামী লীগের হয়ে লুঠপাট, গুন্ডামির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কিনা! খোঁজ নিন আওয়ামী জমানায় কত শত দাঙ্গা ঘটেছে! কত জমি লুঠ হয়েছে!  শ্রীলঙ্কায় শাসকদের আবাস জনতার দখলে চলে গেলে তান্ডবের দৃশ্য টিভিতে দেখতে দেখতে আপনি বলবেন, জনরোষে কি ভয়ঙ্কর হলে এ রকম হলে কি হতে পারে বা জনরোষ কাউকে রেয়াত করে না। বাংলাদেশে এক ঘটনা ঘটলে আপনি ছি ছি করে ওঠেন। এই দ্বিচারিতা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি বৈশিষ্ট্য। একটা বড় পরিবর্তন হবার পর কিছুদিন অরাজকতা চলবে। ধীরে ধীরে সব শান্ত হবে। যদি না হয়। ফের একই স্বৈরতন্ত্র নতুন নামে ফিরে এলে, নিশ্চিত থাকুন, আমি যেটুকু বাংলাদেশ কে চিনি, সে নিশ্চেষ্ট না থেকে ফের রাস্তায় নামবে। আবার একবার ট্যাঙ্কের সামনে বুক পেতে দাঁড়াবে। শহীদ হবে। তবুও নতুন ভোরের স্বপ্ন দেখবে। বাংলাদেশ কখনও হার মানতে জানে না।

হার মানতে জানেনা বলেই মাত্র এক মাসের মধ্যে শেখ হাসিনার শাসন বদলে দিতে পেরেছে। নিঃসন্দেহে এই মুহূর্তে নানান জেলায় নৈরাজ্য চলছে। তার পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। মুল কারন, দীর্ঘ দিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ ফেটে পড়েছে। শেখ হাসিনা নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না। ওখানে ভোট বলে কিছু ছিল না সামান্যতম বাক, সংবাদ মাধ্যম, আদালত, কোন কিছুর স্বাধীনতা ছিল না । আয়না ঘর বলে এক চোরা কুঠুরিতে বিরোধী সন্দেহে গুম করে সেখানে অত্যাচার চালানো হতো। চোখ বন্ধ করে ইলেকট্রিক শক দেওয়া হতো। উল্টো করে ঝুলিয়ে বেত মারা হতো বন্দীদের পিঠে। আত্মীয় পরিজন জানতে পারতনা তাদের আপনজন আদৌ বেঁচে আছেন কিনা! সেই আয়না ঘরের বন্দীরা এত বছর পরে ছাড়া পেয়ে বাড়িতে ফিরলে কি দৃশ্য হতে পারে সংবেদী মন নিয়ে কল্পনা করুন। তাদের প্রিয়জনের প্রাথমিক আবেগ কেটে গেলে যা হয় না তা শুভ্র ক্রোধ। রাগে ফেটে পড়তে পড়তে সে তখন ব্যাকারণ সম্মত, রুচিশীল প্রতিহিংসার ভাষা ভুলে যেতে বাধ্য । আমাদের বিপ্লবীরা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অন্ধকার কে প্রশ্রয় দিয়ে কম অন্যায় করেন নি। অনেক ক্ষীর খেয়েছেন বলে বোধহয় তারা আজও স্বৈরাচারের ভজনা করে যে কোন ঘটনায় জামাতের ভূত দেখছেন। তারাও তো অনেকে একদিন বলতেন -কান্নাকে ক্রোধে পরিণত করুন, প্রতিটি হত্যার বদলা নাও'। লিখেছিলেন, শোক নয়, ক্রোধ। বলতেন, পুলিশ গুলি করলে, আমরা কী রসগোল্লা ছুঁড়ব!!

ছাত্র আন্দোলনের গৌরবজনক ভূমিকায় কাদা ছেটানো হতেই পারে, অনেক বেনো জল ঢুকে পড়ে নৈরাজ্য তৈরী করছে বলে। হতে পারে আওয়ামী লীগ, অন্য কোন দেশের গোয়েন্দা সংস্থা মিলেমিশে আন্দোলনের বদনাম করতে বেশকিছু বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। আপনারা ৯/১১ এর পেন্টাগন হামলা নিয়ে মাইকেল মূরের তথ্যচিত্র দেখে বাহবা দেবেন অথচ ঘরের পাশের ঘটনা নিয়ে কোন প্রশ্ন না তুলেই একটি সম্প্রদায় কে অভিযুক্ত করবেন এতো হাস্যকর চিন্তা। মনে রাখবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের নাম হাসিনার নামে ছিল। তা বদলে দিয়ে ইতিমধ্যেই নতুন নামকরণ করা হয়েছে ইলা মিত্রের নামে। এরকম আরও কয়েক জায়গায় নাম পাল্টেছে। কোথাও প্রীতিলতা, কোথাও আবার শান্তি সুধা হয়েছে। খুলনায় পুরনো শিববাড়ি মোড়ের কথাও এসেছিল বদলের প্রসঙ্গে। ঠিক হয়েছিল ছাত্র আন্দোলনের শহীদ মুগ্ধর নামে হবে নাম। কিন্তু হিন্দু হৃদয়ে ব্যাথা লাগতে পারে বলে শিবমন্দির চত্বর নাম একই থেকে গেছে। বলুন, সমালোচনা করুন, অন্যায়, সাম্প্রদায়িক ঘটনার। কিন্তু স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র তরুণদের অকুতোভয় লড়াই কে ছোট করবেন না। অন্ধকার শুধু নয়, আলোর কথাও বলতে হবে তো।

0 Comments

Post Comment