১৯৭৭, ইউনাইটেড নেশনসে প্রস্তাব পাশ হলো বিশ্বজুড়ে ৮ই মার্চে নারী দিবস ঘোষনার। আন্তর্জাতিক শ্রমজীবি নারী দিবস হয়ে গেলো আন্তর্জাতিক নারী দিবস। বিশ্বায়নী রঙ লেগে আস্তে আস্তে ফিকে হলো লড়াইয়ে স্মৃতি। নারী দিবস হয়ে উঠলো কর্পোরেটদের বিপণন কৌশল। মেক আপ , পরিধান বিশিষ্ট 'নারীসত্ত্বার' উদযাপনে ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা চলল রক্ত-ঘাম দিয়ে শ্রমজীবি নারীর এই অর্জন। ‘নারী সত্ত্বা’ কেমন হবে, নারী'র সংজ্ঞা কী হবে তা ঠিক করতে মাঠে নেমে পড়লো লগ্নিপুঁজীর দালালরা। L'Oreal, Burberry, Fair and Lovely জাতীয় কর্পোরেটরা গিলে খেতে চাইল বিশেষ এই দিনটির তাৎপর্য। প্রোডাক্ট কেনার জন্য বিজ্ঞাপনে ছেয়ে গেল। সোশাল মিডিয়া ছেয়ে গেল পণ্যায়নের জোয়ারে। নারী হিসেবে তোমাদের প্রাথমিক পরিচয় তুমি উপভোক্তা। নারী দিবসে আমরা তাই ডিসকাউন্ট দিচ্ছি! সেই সাথে সাথে নারীবাদও সংজ্ঞায়িত হতে লাগল ওদেরই দেখানো পথে।
মোটামুটি ৯০- এর দশকে আমরা দেখব নয়া উদারবাদের হাত ধরে পশ্চিমা নারীবাদ দেশে দেশে আধিপত্য বিস্তার করছে। একের পর এক নারীবাদের ঢেউ উদ্ভুত হয়েছে পশ্চিমা দুনিয়ায় যার রেশ পড়েছে এখানকার নারীবাদী আন্দোলনেও। যদিও এই ঢেউগুলির তাৎপর্য যেভাবে পশ্চিমা দুনিয়ায় রয়েছে সেভাবে আমাদের উপমহাদেশে নেই। কারণ এখানে পরিপ্রেক্ষিতটাই আলাদা। এখানে পিতৃতন্ত্রের ভিত্তিই ব্রাহ্মণ্যবাদী কাঠামো। কেন বলছি সে কথায় আসব যথাসময়। তবে এখানে এই ঢেউ গুলি এসেছে বারে বারেই উপনিবেশিক শাসকদের হাত ধরে আধা খ্যাঁচড়া ভাবেই। নারীবাদের ঢেউয়ের পাশাপাশি এল 'স্বাধীন' নারী সংগঠনের আবহাওয়া। এই আবহাওয়ায় গা ভাসালেন এক সময়ের তথাকথিত বাম দলের অনেক চেনা মুখ। কারণও নিশ্চই ছিল। বাম পরিমন্ডলে নীতি পুলিশগিরি, ব্রাহ্মন্যবাদী পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার আস্ফালনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেই বেরিয়ে গেছেন অনেক নারী কর্মী। একটা উদাহরণ দিই এই প্রসঙ্গে। নব্বইয়ের দশকে বিরাটিতে বস্তিতে থাকা একজন মহিলা ধর্ষিতা হন। তার প্রেক্ষিতে মহিলা সমিতির সম্পাদক তাঁর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এমনকি তিনি বস্তিতে থাকেন সেটাকেও ছোটো করে দেখান। স্বভাবতই এর বিরুদ্ধে ব্যপক ক্ষোভ জমা হয়। কিন্তু রাজনীতির এই এনজিও করণ প্রতিরোধকে একটি সুশৃঙ্খল, সুসজ্জিত, বেতনভোগী, ১০টা-৫টার চাকরিতে পরিণত করে কিছু সুযোগ-সুবিধা দিয়ে। বাস্তব প্রতিরোধের বাস্তব পরিণতি আছে। ঝুঁকি আছে। আছে প্রতিদিনকার লড়াই, চ্যালেঞ্জ এবং অনেক কিছু হারানোর ভয়। এদিকে বেতনও নেই, দৃশ্যমানতাও নেই ততটা। ফলে আন্দোলনের মধ্যে থাকা সুবিধাবাদী অংশ এনজিও-র দিকেই ঝোঁকে। বর্তমানেও দেখা যাচ্ছে আন্দোলনের মধ্যে যে রাজনৈতিক ভাষ্যের অভাব এবং উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়ানোর ভাষ্য, গ্ল্যামারের পিছনে ছোটা বা 'অরাজনৈতিক' চরিত্র বজায় রাখার দিকে জোর পড়ছে, সেটা একটা কর্পোরেট স্পেক্টাকেল হয়ে থাকার ঝোঁককেই প্রোমোট করছে।
অর্থাৎ আন্দোলনও আজ বিক্রি হচ্ছে, চোখের সামনে বিক্রি হচ্ছে আন্দোলনের মুখেরা, আরও একঝাঁক এলিট মুখ নিজের দিকে আলো ফেলার আপ্রাণ চেষ্টায় হাঁসফাঁস করতে করতে, ইঁদুর দৌড়ে জয়ী হতে না পেরে বিপর্যস্ত। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে লিঙ্গ সাম্যের প্রশ্ন নিয়ে নতুন করে ভেবে দেখা বোধহয় সত্যিই খুব জরুরি। বাংলার সর্বোচ্চ কর্পোরেট মিডিয়া আজ শিলমোহর দিচ্ছে আন্দোলনকে, আলোর সেই মুখকে সেরার সেরা ঘোষণা করে। দুর্ভাগ্যের বিষয় আন্দোলনের মূল আশু লক্ষ তিলোত্তমার ন্যায়বিচার এবং দীর্ঘস্থায়ী লিঙ্গ সাম্যের প্রশ্ন যেন এই ইঁদুর দৌড়ের মাঝে পড়ে ক্রমশ আরো বিলীন হওয়ার দিকে। ৭ মাস কেটে গেল, আজও বিচার পেল না অভয়া। এদিকে আমরা নানান বিভাজনে জর্জরিত। এই পথ হারিয়ে যাওয়া, ফোকাস থেকে অনেক অনেক দূরে গ্ল্যামারের আশেপাশে ঘুরে ঘুরে বেড়ানো আরো দিন দিন বাড়ছে আন্দোলনের ময়দানে। সমস্ত লক্ষ-উদ্দেশ্য-রাজনৈতিক নীতি-আদর্শ তাদের কাছে অপ্রধান কেবল নিজেকে জাহির করাই বড়। এ কিন্তু বিশেষ একটা শ্রেণীর রোগ, যা থেকে গণআন্দোলনকে বের করতে না পারলে ঐ কর্পোরেট আর শাসকদেরই সুবিধে। তারা তাদের মতো করে নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে বেঁধে ফেলতে পারবে গোটা আন্দোলনকে- আন্দোলন সেফটি ভাল্ভের কাজ করবে, মানুষের ক্ষোভ একটা খাল দিয়ে বয়ে গিয়ে উঠবে সেই কর্পোরেট সাগরে।
বিগত দিনে অকুপাই ওয়াল স্ট্রীট থেকে শুরু করে আরব স্প্রিং প্রত্যেকটি আন্দোলনের ক্ষেত্রে এই ছবিটা বারবার ফিরে এসেছে। ফলে ছবিটা খুব চেনা । নয়া উদারনীতি একদিকে যেমন নিজেদের গণতন্ত্র, নারী স্বাধীনতা, ব্যক্তি স্বাধীনতার পরাকাষ্ঠা হিসেবে দেখিয়ে দেশে দেশে গণতন্ত্র রপ্তানি করার খেলায় নামে, গণতন্ত্রের নামে উপনিবেশ তৈরি করে নতুন নতুন চেহারায়, তেমনই সারা দুনিয়া জুড়ে দক্ষিণপন্থি ফ্যাসিস্ত শক্তির উত্থানও কিন্তু আজকের অন্যতম বৈশিষ্ট। বিশ্বায়নী হাওয়ায় ভেসে আমরা যেন না ভুলি এই মাটি কিন্তু প্রীতিলতার রক্তে শিক্ত, এই মাটিতে ঘাম ঝরিয়েছেন লক্ষী সায়গল, ইলা মিত্র আর মেইলি ছাত্রীরা। আমাদের মনে রাখতে হবে এ যুগেও এই মাটিতেই জন্ম নিয়েছেন সোনি সোরি, ইরম শর্মিলা চানু এবং অনুরাধা গান্ধী। দিল্লির কৃষক আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় নারীরা এগিয়ে এসেছিলেন। তাই বার বার সোচ্চারে ঘোষণা করতে হবে ৮ মার্চ নারী দিবস নয়, আন্তর্জাতিক শ্রমজীবি নারী দিবস। আর সেই প্রেক্ষিত থেকেই আসুন আমরা ফিরে যাই শ্রমজীবি নারীর সংগ্রামের ইতিহাসে।
এই দিবস আমরা পেলাম কিকরে? শিল্প বিপ্লবের সময় থেকেই ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ও আমেরিকাতে বেশী মুনাফার লালসায় শিল্পপতিরা সস্তা শ্রমের জোগানদার হিসাবে নারী শ্রমিকদের কাজে লাগাতো। এই শোষণের বিরুদ্ধে নারী শ্রমিকরা উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে মাঝে মাঝেই নিজেদের সংগঠিত করে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ফ্রান্সের বস্ত্র শিল্প, দর্জিশিল্প, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প প্রভৃতি ক্ষেত্রের শ্রমজীবি মহিলারা আন্দোলন ও ধর্মঘট করেছেন বিভিন্ন দাবী আদায়ের জন্য। ১৮৮৯ সালে ক্লারা জেটকিন প্যারী শহরে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে নারী পুরুষের সমঅধিকারের দাবী উত্থাপন করেন। এরপরে ১৯০৭ সালে জার্মাণীর স্টুটগার্টে অনুষ্ঠিত প্রথম আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক নারী সম্মেলনে নারীর ভোটাধিকারের দাবিও উত্থাপিত হয়।
১৯১০ সালে কোপেনহেগেন-এ দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমজীবি নারী সম্মেলনে প্রতি বছর মার্চ মাসের কোনো এক দিন আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। ক্লারা জেটকিন সেই প্রস্তাব রাখেন। অবশ্য এর আগে নিউইয়র্কের নারী দর্জি শ্রমিকরা ১৯০৮ সালের ৮ই মার্চ এক বিশাল সমাবেশে মিলিত হয়ে মজুরি বৃদ্ধি, কাজের সময় কমানো প্রভৃতি দাবী উত্থাপন করেন। এই আন্দোলনকে স্বীকৃতি দিয়ে ১৯১৪ সালে কোপেনহেগেন এ অনুষ্ঠিত তৃতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন প্রতি বছর ৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৯১১ সালে ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে ১৯ মার্চ গোটা ইউরোপ জুড়ে মহিলারা রাস্তায় বেরিয়ে এলো। মহিলাদের ভোট দেওয়ার অধিকার, জনপ্রতিনিধি হওয়ার অধিকার এবং একই কাজের একই মজুরির দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠলো ইউরোপের শহরগুলো। তারপর কেটে গেলো ৬ বছর। ১৯১৭, পেত্রোগ্রাদ, ৮ই মার্চ শহর জুড়ে মহিলারা রাস্তায় বেরিয়ে এলো সাধারন ধর্মঘটের ডাকে। তাদের দাবি - রুটি আর শান্তি। যুদ্ধের অবসান হোক। রাশিয়ার জার নিপাত যাক। সূচনা হলো ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের। সূচনা হলো International Working Womens' Day. মঞ্চে উঠলেন আলেক্সান্দ্রা কোলোনতাই। উঠলেন এম্মা গোল্ডম্যান, রোজা লাক্সেমবার্গ সহ বিশিষ্ট নেতৃত্বরা। দুনিয়া কাপানো দশদিনের সমাপ্তির পর সোভিয়েতে আন্তর্জাতিক শ্রমজীবি নারী দিবসকে জাতীয় ছুটির দিন ঘোষনা করা হলো। ৮ ঘন্টা কাজ, মাতৃত্বকালীন সবেতন ছুটি, সম কাজে সম বেতন, শিশুদের জন্য ক্রেশ, কর্মক্ষেত্রে মর্যাদা ও নিরাপত্তার দাবী বরাবরই প্রধান হিসেবে উঠে এসেছে সমগ্র বিশ্বের নারী আন্দোলনে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় শ্রমজীবি নারী আন্দোলনে আওয়াজ উঠেছিল যুদ্ধ চাইনা রুটি চাই। পরবর্তীতে নিপীড়িত লিঙ্গ যৌনতার মানুষের দাবীদাওয়াও এসে মিশেছে নারীবাদী আন্দোলনের ধারায়।
আমাদের দেশে প্রথম এই দিবসটি পালিত হয় ১৯৪৩ সালে। বোম্বেতে ফ্রেন্ডস অফ দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। কিন্তু শুধু উদযাপনে ইতিহাসেই নয় আমরা বরং খুঁজে দেখি সাম্প্রতিকের আন্দোলনে কীভাবে থেকেছে নারী মুক্তির প্রশ্ন। আজকের ৮ ই মার্চের শিক্ষা আমরা একমাত্র পেতে পারি আজকের আন্দোলনের ময়দানে দাঁড়িয়ে, আন্দোলনের বর্শামুখ নিয়ে আলাপ আলোচনার মধ্যে দিয়েই।
বিগত ১৪ অগাস্ট লক্ষ লক্ষ মেয়ে এবং নিপীড়িত লিঙ্গ পরিচয়ের মানুষের পথে নামা নিঃসন্দেহে নারী আন্দোলনের প্রশ্নে এক নতুন সম্ভাবনার হাতছানি দেয়। এতদিনের চার দেওয়ালের বদ্ধকূপ, ‘রাতের ডিউটি কেন মেয়েরা করবে’বা ‘রাতে ও একা কি করছিল’ মার্কা নীতিপুলিশির গালে সপাটে চড় ছিল সেদিনের সেই অবাধ্যতার স্বর। যে সমাজে প্রচলিত সংস্কৃতি মেয়েদের ওপর হিংসাকে প্রমোট করে, বিচার ব্যবস্থা এবং আইন আজও বিবাহিত পুরুষকে ছাড়পত্র দেয় স্ত্রীকে ধর্ষণ করার, যে সমাজে শৈশব থেকে বড় হওয়াটাই নারী-পুরুষের সামাজিক নির্মাণ দ্বারা নির্ধারিত, যেখানে কাশ্মীর থেকে মণিপুর-সিঙ্গুর থেকে আর জি কর সব ক্ষেত্রেই রাষ্ট্র ধর্ষণকে ব্যবহার করে হাতিয়ার হিসেবে প্রতিবাদ দমন করতে সেখানে দাঁড়িয়ে এই বাঁধভাঙা ঢেউ আশার সঞ্চার করে প্রাথমিক ভাবে। আন্দোলনের ময়দানে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন গুলো ওঠে যে মহানগরীর ডাক্তারি পড়ুয়ার ক্ষেত্রে শুধু নয় আমাদের সংবেদনশীলতা যেন বীরভূম, মালদা বা দিনাজপুরের আদিবাসী মেয়েদের ধর্ষণের ঘটনাতেও আমাদের সক্রিয় করে তোলে। তবে প্রশ্নগুলো রয়ে যায় ফুটনোটে, স্লোগানে-স্লোগানে ধ্বনিত হয় কিন্তু রুটিন মাফিক মিছিলে মিছিলে ছুটে চলার স্রোতে হারিয়ে যায় সক্রিয়তা। কর্মস্থলে মর্যাদা এবং ভয়মুক্ত পরিবেশের দাবী, প্রতিটা স্কুল-কলেজ- কর্মস্থলে আইসিসি গঠনের দাবী (আই সি সি বা এল সি সি হল নির্দিষ্ট জেন্ডার সেল যেখানে নির্যাতিতা নির্দ্বিধায় অভিযোগ জানাতে পারে; ২০১৩ সালে পাশ হওয়া POSH আইনের পর এগুলো লাগু হবার কথা), এলাকায় এলাকায় এলসিসি গঠনের দাবী এবং সম কাজে সম বেতন, ঠিকা প্রথা বাতিল করে স্থায়ীকরণ করা, ক্ষেতে কর্মরত মহিলাদের হাতে জমির মালিকানা, ট্রান্স-কুইয়ার মানুষের ক্ষেত্রে গার্হস্থ্য হিংসা, যৌন নিগ্রহ বা নির্যাতনের ক্ষেত্রে উপযুক্ত ন্যায়বিচার সহ বেশ কিছু লিঙ্গ সাম্যের দাবীদাওয়া নিয়ে আজও আন্দোলন চলছে। কিন্তু এই সমস্ত প্রশ্ন আজ কিছুটা হলেও ব্যাকসিটে। আন্দোলনে বার বার এসেছে শ্রমজীবি নারীর অংশগ্রহণের প্রশ্ন। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণ কি নিতান্ত টোকেনিজম হয়েই রয়ে গেছে? গোটা সময়টা জুড়ে কোলকাতার ওপর একের পর এক মিছিল, জমায়েত হয়েছে কিন্তু গ্রাম-গঞ্জ বা মফঃস্বলে ছাপ ফেলা যায় নি তেমন এ কথা তো আজ স্বীকার করাই যায়। অথচ শ্রমজীবিদের একটা বড় অংশই থাকেন গ্রামে-মফস্বলে। পশ্চিম বঙ্গে প্রায় ৬০ শতাংশ মহিলা কৃষিক্ষেত্রে কাজ করেন। আমরা যখন শ্রমজীবি নারীকে উৎসর্গ করি এই দিনটি তখন কি তাদের কাছে পৌঁছনোর কথা ভাবি? আমাদের বাংলার প্রায় ৯৬ শতাংশ মহিলা অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত। শ্রমজীবি মহিলা বলতে কি আমরা তাদের কথা ভাবি? শ্রমজীবি মানুষের কন্ঠস্বর তখনই প্রতিফলিত হবে আন্দোলনের ভাষ্যে যখন বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে এই শ্রমজীবি মহিলাদের নেতৃত্বে পাড়ায় পাড়ায়-গ্রামে-গ্রামে নারী সংগঠন গড়ে তোলা সম্ভব হবে। নইলে অসংগঠিত ক্ষেত্রে নারী শ্রমিকদের সুরক্ষার প্রশ্ন, স্থায়ীকরণ, মাতৃত্বকালীন সুযোগ-সুবিধা বা ন্যায্য মজুরির প্রশ্ন সবই হয়ে যাবে সোনার পাথরবাটি। সেই সঙ্গে মনে রাখা দরকার বাংলায় এই অসংগঠিত শ্রমিকদের একটা বড়ো অংশ নিম্নবর্গের-অর্থাৎ দলিত, আদিবাসী বা গ্রাম বাংলার মুসলিম মেয়েরা। এদের শতকরা ১০ জনেরও হয়ত জমিজমা নেই। তাই নিম্নবর্গের মেয়েদের প্রশ্নকে আলাদা গুরুত্ব দিয়ে দেখা দরকার, তা কখনোই এলিট বর্ণহিন্দু পরিবারের মধ্যে আবদ্ধ থাকা নারীর নিপীড়নের সাথে একই গোত্রে পড়ে না। এনসিআরবির পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৫ থেকে ২০২১ এর মধ্যে দলিত মেয়েদের ওপর ধর্ষণ বেড়েছে ৪৫%। ২০২২ সালে উচ্চবর্ণের পুরুষের দ্বারা দলিত মেয়ের ধর্ষণের ঘটনা ঘটে ২৮৩৯ এবং আদিবাসী মেয়েদের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা ৮২০। এদিকে বলতে বাধা নেই এই উপমহাদেশে পিতৃতান্ত্রিক নিপীড়ন শুরু হয় পরিবার থেকেই। পরিবারের মধ্যে এই নিপীড়নের স্বীকার উচ্চবর্ণের নারীরাও। মেয়েদের চার দেওয়ালের মধ্যে আটকে রাখা হয় তার যৌনতাকে নিয়ন্ত্রণ করার অভিপ্রায়। কখনো তা হয় জবরদস্তি করে কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সম্মতি আদায় করে। পারিবারিক কাঠামোর মধ্যেই গুরুজনের হাতে মনুর পাঠ বা সতী-সাবিত্রী হওয়ার পাঠে হাতে খড়ি হয় মেয়েদের। ঐতিহাসিক উমা চক্রবর্তী প্রাচীন ভারতে ব্রাহ্মণ্যবাদী পিতৃতন্ত্র নিয়ে তাঁর লেখায় বলছেন- উচ্চবর্ণের মেয়েদের অবদমন বা বন্দি রাখার পিছনে যে মানসিকতা কাজ করে তা কেবল বিশুদ্ধ বংশানুক্রম বজায় রাখার উদ্দেশ্যই না জাত-পাত গত বিশুদ্ধতা বজায় রাখারও উদ্দেশ্যেও। ভিন্ন জাতের মিলনে যে সন্তান তাকে অপবিত্র মনে করে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা সেই মনুসংহিতার সময় থেকে। তাই আসে পতিব্রতার ধারণা, পবিত্রতার ধারণা। অন্যদিকে জমিদার বা এলাকার উঁচু জাতের প্রভাবশালীর হাতেই ধর্ষণ বা নিপীড়নের শিকার হতে হয় দলিত মেয়েদের, ফলে সেখানে নিপীড়ক শুধু পরিবার নয় বরং বৃহত্তর সামাজিক কাঠামো। আন্দোলনের পরিসরেও এই নিয়ে বিস্তর চর্চা হয়। চর্চা হয় ধর্ষণতন্ত্র বা পিতৃতন্ত্রের শিকড়ের সন্ধানে। একদিকে সাম্রাজ্যবাদী শোষণ আর সেই সঙ্গে ব্রাহ্মন্যবাদী এই কাঠামো দুইই জল হাওয়া দিয়ে বড় করে ধর্ষণ তন্ত্র্বের বীজকে।
আন্দোলনের মধ্যে যারা ‘অরাজনীতির’ হাওয়াকে ইন্ধন যুগিয়েছে তাদের কাছে প্রশ্ন এটা কি জনগণের আন্দোলনকে ভুলভাবে চিত্রিত করে জনতাকে দিশাহীনতার দিকে ঠেলে দেওয়ার চক্রান্ত নয়? নারী প্রশ্নের এই ব্যাকফুটে চলে যাওয়ার জন্য দায়ী সংগঠিত চেহারা না দিয়ে দিনের পর দিন স্বতঃস্ফূর্ততার দিকে ঠেলে দেবার প্রবণতা। তাই এই সময় যে সক্রিয়তা দাবী করে তার থেকে বহু দূরেই হারিয়ে যেতে থাকে নারী আন্দোলন। নির্ভয়ার ঘটনার মতোই এই আর জি করের এই ঘটনা আগুন জ্বালিয়েছিল দীর্ঘ দিনের নিস্তরঙ্গতার মাঝে। সম্ভাবনা এনে দিয়েছিল দৈনন্দিন জীবনে পিতৃতান্ত্রিক শোষণের বিরুদ্ধে পাড়ায় পাড়ায় মহিলাদের সংগঠিত করার। আসুন এই নারী দিবসের প্রাক্কালে একটু কাটাছেঁড়া করে দেখি এই আগুনকে কেন আমরা সমস্যা সমাধানের আলোক দিশারী করে তুলতে পারলাম না? সমাজের আনাচে কানাচে যে ব্রাহ্মণ্যবাদী কাঠামো ধর্ষণ সংস্কৃতির বীজ বপন করছে তার বিরুদ্ধে শ্রমজীবি নারীদের সংগঠিত হওয়াই সেই সম্ভাবনার দিকে নিয়ে যেতে পারত। তবে শহুরে আন্দোলনের নানান মারপ্যাঁচ আর সীমাবদ্ধতাকে এক দমকা হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে দেউচা পাচামির আদিবাসী মেয়েরা এক চিলতে আলো জ্বালিয়ে রাখে। ওসি, ডিএনটি তথা সকল প্রশাসনেরও চোখে চোখে রেখে সেই মেয়েরা বলছেন – ‘কয়লা খনি চাই না, কোনো রকম প্যাকেজ চাইনা আমরা। আমাদের গ্রাম থেকে আপনারা বেরিয়ে যান।‘ আজকের জেদী মেয়েদের মুখ মনে করিয়ে দেয় ১৮ বছরের আপোষহীন লড়াকু মেয়ে তাপসী মালিক বা লাঠি- ঝাঁটা হাতে নন্দীগ্রামের রাধারানী আড়ি, নর্মদা শীঠকে। উচ্ছেদ বিরোধী আন্দোলনে গ্রামীন শ্রমজীবি মহিলাদের এই লড়াই আজকের নারী দিবসের স্পিরিট হয়ে অনুপ্রেরণা জোগাক সামগ্রিক শোষণমুক্তির লড়াইয়ে।