পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

লকডাউনের সুযোগে সস্তা শ্রমিক

  • 31 May, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 1949 view(s)
  • লিখেছেন : মনসুর মণ্ডল
মাইলের পর মাইল অনন্ত হেঁটে চলেছে ভারতের শ্রমিকেরা। তারা ভারত গড়ার কারিগর। ঘরে ফেরার অসহায় আর্তি নিয়ে আজ তারা পদাতিক। কারও নিথর দেহে ঘরে ফেরা। কেউ লাশকাটা ঘরে বেওয়ারিশ। আর অবশেষে দেহে প্রাণ নিয়ে ঘর অবধি পৌঁছনো, সে যেন ভাঙচুর হয়ে যাওয়া দেহ-মনের পরম ক্ষান্তি।


মাইলের পর মাইল অনন্ত হেঁটে চলেছে ভারতের শ্রমিকেরা।
তারা ভারত গড়ার কারিগর। ঘরে ফেরার অসহায় আর্তি নিয়ে আজ তারা পদাতিক। কারও নিথর দেহে ঘরে ফেরা। কেউ লাশকাটা ঘরে বেওয়ারিশ। আর অবশেষে দেহে প্রাণ নিয়ে ঘর অবধি পৌঁছনো, সে যেন ভাঙচুর হয়ে যাওয়া দেহ-মনের পরম ক্ষান্তি।
লকডাউনের দিনগুলিতে তাদের ক্ষুন্নিবৃত্তিতে, তাদের নিরাপত্তায় রাষ্ট্র সহায় থাকেনি। অর্ধাহার-অনাহার সত্ত্বেও তাদের গৃহবন্দি থাকতে হয়েছে। যাদের শেষ কপর্দকটুকু অন্তত ছিল, তারাও খাবার জোগাড় করতে পারেনি। ঘরের বাইরে ছিল পুলিশের তীক্ষ্ম নজরদারি। মরিয়া হয়ে খাবারের সন্ধানে কেউ যদি বা বাইরে বের হয়েছে, জুটেছে পুলিশের লাঠি। সব সহ্য করেছে। ঘেরাটোপের মধ্যে হাপিত্যেশ করেছে। কারণ অকরুণ তত্ত্বনির্ণয়ে পরিযায়ী শ্রমিক তারা। আজ আছে, কাল নেই। রাষ্ট্রের যেন কোনো দায় নেই। অবশেষে তাই কৃচ্ছ্রসাধন আর জীবনীশক্তির ক্ষয়ের মূল্যে শুরু হ’ল তাদের ঘরের পথে দলে দলে দুর্গম পথ পাড়ি দেওয়া। এ তাদের অসহায়তা। এ তাদের প্রতিবাদও; অবহেলা ও লাঞ্ছনাকে নীরবে অস্বীকার করা।
এই সংকটে রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা ও মানবিক জায়গা থেকে প্রতিবাদ অনেক হয়েছে, হচ্ছে বটে; সে ‘প্রকৃতই সামাজিক দূরত্বের’ ওপার থেকে। এখন চাপের মুখে শ্রমিক স্পেশাল ট্রেন ছুটছে। বন্দোবস্ত অপর্যাপ্ত। অবাঞ্ছিতভাবে ভাড়া গুনেও তাদের নরক-যন্ত্রণা ভোগ করতে হচ্ছে। অগত্যা অনেকের দশ-বিশ গুণ বেশি ভাড়া গুনে ট্রাক বোঝাই হয়ে রওনা দেওয়া। যারা কপর্দকশূন্য, তাদের পায়ে পায়ে দুঃস্বপ্নের পাড়িই নিয়তি। সংখ্যায় এরাই সবচেয়ে বেশি। যেদিন থেকে হাঁটা শুরু, তার হিসেব নিলে যানবাহন-যোগের হিসেব বড়ই কমজোর। আর পথদুর্ঘটনায় শ্রমিক মরছে। হাঁটতে হাঁটতে ক্ষিদে-তেষ্টা-ক্লান্তিতে মরছে। এমনকি ট্রেনেও মরছে খাবার-পানীয় জলের অভাবে। এভাবে লকডাউনের বলি অন্তত আড়াইশো জন।
লকডাউনের দিনগুলিতে অভিবাসী শ্রমিকদের এই দুর্দশা, উদ্বাস্তুর মতো জনস্রোত, অসম্ভব মৃত্যু, এ হ’ল লকডাউনের খারাপ দৃষ্টান্তগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রতারণামূলক ও নির্মম। তাদের জীবনে এই পীড়ন নামিয়ে আনা হ’ল কেন? কেন তাদের জীবনীশক্তির এই ক্ষয়?
বিশ্বে বাজার অর্থনীতির একবগ্গা ঘোড়া ইতিপূর্বে মুনাফা-মান্দ্য রোগে আক্রান্ত। ভারত তার ব্যতিক্রম নয়। কর্পোরেট পুঁজি থেকে বড় উদ্যোগপতি থেকে প্রমোটার সবাই সস্তা শ্রমিক শিকারে নেমেছে। শ্রমিকের গতর দিয়ে মুনাফার ঘাটতি পুষিয়ে নিতে চায়। জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) তৈরির পরিকল্পনার একটা উদ্দেশ্য হ’ল সস্তা শ্রমিক সরবরাহ করা। এনআরসি’র পরিপূরক হিসেবে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) আনা হয়েছে। পুরো পরিকল্পনার মোদ্দা কথা, এনআরসি থেকে বাদ পড়ে যাওয়া কোনো মুসলিমকে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না। বিজেপি নেতাদের মতিগতি অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গেই দু’কোটি মুসলমানকে এনআরসি-ছুট করতে চায়। সিএএ’তে এও স্পষ্ট যে, নিয়মের ফাঁসে এনআরসি-ছুট একাংশ অমুসলিম অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষদেরও বেনাগরিকদের তালিকায় ঠাঁই হবে। এই বিপুল সংখ্যক তথাকথিত বেনাগরিকদের ঠাঁই ডিটেনশন সেন্টার। সেখানে দেশের সরকার তাদের বসিয়ে খাওয়াবে না। তাদেরকে বানানো হবে সস্তা শ্রমিকের মজুত বাহিনী। বহু দেশে উদ্বাস্তুদের জীবনে এই পরিণতি নামিয়ে আনা হয়েছে। মার্কিন আমেরিকায় এমনকি কিশোর-যুবা জেল-কয়েদিদের সস্তার শ্রমিক হিসেবে বড় বড় পুঁজির মালিকদের কাছে পাঠানো হয়। হিন্দুরাষ্ট্রের অনুষঙ্গে পরিকল্পনাটা পুরো করতে যথেষ্ট ঘাম ঝরাচ্ছিল দেশের শাসক। বাধ সেধে বসল নোভেল করোনা। ঝড়ের গতিতে এসে তাদের সব হিসেব ওলটপালট করে দিল। এখন দেশের বিপর্যস্ত জনজীবন ও টালমাটাল অর্থনীতির আবহে এনআরসি করতে যাওয়া দুরূহ ব্যাপার। দেশের অর্থনীতি ও মানুষের মতিগতি, দু’দিক থেকেই ঝুঁকিপূর্ণ। অগত্যা ‘ধীরে চলো’ নীতি। কিন্তু পুঁজির তাতে চলে না। করোনা-পরবর্তী মন্দার জমানায় তার চটজলদি সস্তা শ্রমিক চাই। দেশের শাসকের নজর তাই অভিবাসী শ্রমিকদের দিকে। আপাতত তাদের দিয়েই তৈরি করতে চায় সস্তা শ্রমিকের মজুত বাহিনী।
লকডাউনের নামে অভিবাসী শ্রমিকদের জীবনে দুর্দশা ও পীড়ন নামানো হয়েছে একেবারে পরিকল্পনামাফিক। লকডাউনের নৈরাজ্য ও অমানুষিকতায় তাদের জীবনীশক্তিকে যান্ত্রিক ছাঁচে ঢেলে দাও। তাদের আশা-স্বপ্নকে অদৃষ্টের মোড়কে মুড়ে দাও। রাষ্ট্রের পরিচালকদের প্রতি তাদের নিতান্ত অনুগ্রহপ্রার্থী করে তোলো। অতঃপর এই বাস্তবতার সঙ্গে তাদের লকডাউন পরবর্তী কর্ম-সংকোচনজনিত অস্থিরতাকে অবলীলায় জুড়ে দেওয়া যাবে। লক্ষ্য সস্তা শ্রমিকের বাজারে তাদের যন্ত্রের মতো চক্কর দেওয়ানো।
লকডাউন-তাড়িত অভিবাসী শ্রমিকরা ক্ষুধা-তৃষ্ণা-ক্লান্তি-মৃত্যু সহ্য করে দল বেঁধে হেঁটে চলেছে। দল বেঁধে প্রতিবাদ করতে পারেনি। অর্থনীতি ও রাজনীতির পাকচক্রে তারা পরিযায়ী। তারা বিচ্ছিন্ন অস্তিত্বে গণ্ডিবদ্ধ। সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া তাদের নেতা নেই, সংগঠন নেই। তাই সেই প্রতিবাদ নেই। সামাজিক মাধ্যম থেকে রাজনৈতিক দল থেকে গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, বাদ-প্রতিবাদ অনেক হয়েছে। নিয়ম মেনে ছকে বাঁধা প্রতিবাদ। সেসব মানবিকতার ব্যাপার। কিন্তু সমস্যাটা মানবিকতা ছাপিয়ে মূলত রাজনৈতিক। পরিণাম, সামনের সময়ে অভিবাসী শ্রমিকদের জীবন-সংগ্রাম হবে বড় যন্ত্রণাদায়ক। সময়টা আলোড়ন-মণ্ডিত হবে কিনা, সে সময়ই বলবে।

0 Comments

Post Comment