পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

মুসলমান জনসংখ্যা ছাপিয়ে যাবে হিন্দু জনসংখ্যা কে - মোদিজীর বকওয়াস

  • 22 May, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 997 view(s)
  • লিখেছেন : অনিকেত চট্টোপাধ্যায়
সার্বজনিক জীবনে তিনি কোনোদিনও সাম্প্রদায়িক বিভাজন করেননি বলে প্রধানমন্ত্রী বিষয়টিকে গুলিয়ে দিতে চাইছেন, ভুল বোঝাতে চাইছেন, কিন্তু কেন? আর এস এস – বিজেপি, নরেন্দ্র মোদী – অমিত শাহ, আসলে মানুষকে ভুল বোঝাতে চায়, জনসংখ্যা, উন্নয়ন বিকাশ তাঁদের চিন্তা ভাবনার মধ্যে নেই, আছে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা, এক চরম অন্যায়, মিথ্যে অস্ত্র নিয়েই তারা মানুষের ভোট পেতে চায়, একথা আজ প্রত্যেক কে বুঝতে হবে, বোঝাতে হবে।

বহু প্রাচীন এক জুমলা, এক ডাহা মিথ্যে, এক শয়তানি হল মাঝে মধ্যেই বলা যে মুসলমানেদের জনসংখ্যা এমন বাড়ছে যে তা নাকি আর কিছুদিনের মধ্যেই হিন্দু জনসংখ্যাকে ছাপিয়ে যাবে। মাঝে মধ্যেই এই ন্যারেটিভ এ ধোঁয়া দেওয়া হয়। তলার সারির কিছু বিজেপি কর্মী নেতা, বজরং দল, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ইত্যাদির মত কিছু সংগঠনের নেতা এই কথাগুলো বারবার বলেন, প্রকাশ্যেই বলেন আর অবশ্যই বিজেপির আইটি সেল থেকে নিয়মিত এই কথা বলা হয়। দেশের হিন্দু জনসংখ্যা কমছে আর মুসলমান জনসংখ্যা বাড়ছে এরকম এক অর্ধসত্যও কি কখনও দীন দয়াল উপাধ্যায় বা অটল বিহারি বাজপেয়ি বা লাল কৃষ্ণ আদবানির মুখে শুনেছেন? কখনও শুনেছেন? না শোনেন নি। ওনাদের জনসভার আগে পরে ঐ একই মঞ্চ থেকে এইসব কথা বলা হয়েছে, ওনারা বলেন নি বার এসব বলতে বাধাও দেন নি, এটাও সত্যি। কিন্তু মোদি জামানা সব অর্থেই এক অন্য জামানা, সমস্ত সভ্যতা ভব্যতা, পদমর্যাদা ভুলেই এই মিথ্যে এখন দেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, আর প্রধানমন্ত্রী বললে তো বিষয়টা এক ধরণের লেজিটিমেসি বা মান্যতা পেয়ে যায় অতএব বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা বলছেন, ক্যাবিনেট মন্ত্রী, রাজ্য কেন্দ্র স্তরের নেতারা অবলীলায় বলছেন, সেই দুর্দিন আগত যেদিন আমাদের জনগণনা জানিয়ে দেবে হিন্দু পপুলেশনকে ছাপিয়ে গেছে মুসলমান জনসংখ্যা। হিন্দু খতরে মে হ্যায়। সেদিন ঐ যে মঙ্গল সূত্র কেড়ে নেওয়া হবে, শেখ শাহজাহানের দল রাতে পিঠেপুলি বানাতে নিয়ে আসবে জোর করেই, দুটো মোষ থাকলে তো কথাই নেই, একটা চলে যাবে ঐ ওদের ঘরে। আপাতত এটাই হল নির্বাচনী ইস্যু। আপনি যখন মূল্যবৃদ্ধির জ্বালায় পাগল হয়ে যাচ্ছেন তখন আপনাকে মনে করিয়ে দেওয়া হবে আপনার মঙ্গল কামনায় যে মঙ্গলসূত্র তাই যদি লুঠ হয়ে যায় তাহলে জিনিষপত্রের দাম নিয়ে ভেবে কিই বা হবে? অতএব আপনি চাকরি নিয়ে, বেকারত্ব নিয়ে, আয়ের বৈষম্য নিয়ে, স্বচ্ছ পানীয় জল নিয়ে, ছেলে মেয়ের শিক্ষার ব্যবস্থা নিয়ে, ক্রমাগত বাড়তে থাকা মেডিকেল বিল নিয়ে ভাববেন না। ভেবে লাভও নেই কারণ আপনার চিন্তা হল, ঐ যে ‘ওদের’ জনসংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। কিভাবে বাড়ছে?

এক) ঐ 'ওদের' প্রচুর বাচ্চা হয়, এটা নাকি 'ওরা' মসজিদের নির্দেশেই করে, এটা নাকি এক পরিকল্পনা।

দুই) ধর্মান্তরণ করে, ওদের ধর্মে ৩/৪ টে বিয়ে করার অধিকার আছে, এসব বুঝিয়ে ধর্মান্তরণ করে ঐ ওরা ওদের জনসংখ্যা বাড়াচ্ছে।

তিন) লাভ জেহাদ। ঐ 'ওদের' মেয়েরা বেছে বেছে হিন্দু সচ্ছল পরিবারের ছেলে বা ঐ 'ওদের' ছেলেরা হিন্দু বড়লোক পরিবারের মেয়েদের প্রেমের জ্বালে ফাঁসায়, তারপরে ধর্মান্তরণ করে, ঐ 'ওদের' সংখ্যা বেড়ে যায় আর সেই সব ধর্মান্তরিতদের আইসিস বানানো হয়, তারপরে জানতে হলে দেখুন কেরালা স্টোরি। 

এইমূহুর্তে দেশের জনসংখ্যা কত? সৌজন্যে মোদি সরকার, কেউ জানে না। কেন? কারণ আমাদের জনগণনা হবার কথা ছিল ২০২১, অনেক কিছু হয়েছে, সেন্সাস বা জনগণনা হয়নি, অতএব জানাই যায়নি যে এই মূহুর্তে আমাদের দেশের জনসংখ্যা কত? হিন্দু জনসংখ্যাই বা কত? আর মুসলমান জনসংখ্যাই বা কত বেড়েছে। না আমরা জানি না, ২০২২ এও এই কাজ হয়নি, ২০২৩ এও হয় নি। করলে তো এই বিষয় নিয়ে রাজনীতি করা যাবে না। কারণ মোদি সরকার কিছু তথ্য আমাদের কাছ থেকে লুকোতে চাইছেন। জনগণনা তো কেবল মাথা গোনে না, আরও অনেক কিছুই গোনে। বাসস্থানের হিসেব আসবে, আসবে বেসিক নিডস এর বিষয় গুলো। আসবে গ্রাম শহরের হিসেব, আসবে পরিযায়ী মানুষদের হিসেব, শিক্ষার হিসেব সব মিলিয়ে এমন কিছু তথ্য এসে হাজির হবে যা বিজেপি সরকারের কাছে এমব্যারাসিং, সরকারের কাছে অস্বস্তিকর। এবং জনগণনা করলেই দাবি উঠবেই জাতিগত জনগণনার, তার থেকে সংরক্ষণের প্রশ্ন নিয়ে নতুন তথ্য বার হয়ে আসবে। এসব অস্বস্তি থেকে বাঁচার জন্যি মোদি সরকার জনগণনাকে অ্যাভয়েড করেই চলেছেন। আসলে বোকা আর ভিতুরা পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে ভয় পায়, আর এই মূহুর্তে বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্বের চেয়ে বোকা আর ভীতু আর কাউকে পাবেনই না। কাজেই জনগণনা হয় নি। এই মূহুর্তে হিন্দু মুসলমান জনসংখ্যার প্রকৃত তথ্য জানা নেই। এই জায়গাতে এসেই অনেকে বলতেই পারেন, বেশ তো ২০২১ এ হয় নি, ২০১১ র হিসেব তো আছে? সেটা নিয়েই আলোচনা শুরু হোক। অবশ্যই, আর উপায় কি। কিন্তু ২০১১ র জনসংখ্যার ভিত্তিতে আলোচনা করার আগে একটা কথা বলে রাখা দরকার, একটা ক্যাভিয়েট দেওয়া রইল। সমাজ বিজ্ঞানে অগ্রগতি কিন্তু এক গতিতে হয় না, তার বিভিন্ন পরিবর্তন সমাজ যত বিকশিত হয়, বিজ্ঞান, চিকিৎসা শাস্ত্র, শিক্ষা এবং আবিস্কার যত বিকশিত হয় তার চেয়ে হাজারগুন গতিতে, সমাজের বিভিন্ন ছোট বড় স্তরে পরিবর্তন আসে রকেট গতিতে। একটা ছোট মাপকাঠিই দেখা যাক উদাহরণ হিসেবে, মোবাইল আসার আগের যুগ আর মোবাইল আসার পরের যুগ, এই দুই সময়কালে চমকে দেবার মত পরিবর্তন হয়েছে, এটা তো মানবেন।  ১৯৫০ থেকে ১৯৬১ র সেন্সাস রিপোর্টে যে পরিবর্তন দেখা গেছে তারচেয়ে হাজার গুণ পালটে গেছে ২০০১ থেকে ২০১১র জনগণনা। ১৯৫০ এ মানুষের ইনফর্মেশনের সোর্শ ছিল খবরের কাগজ আর কিছু শিক্ষিত মানুষের কথাবার্তা। ১৯৮১ তে এসে গেছে টিভি কিন্তু একটা দূরদর্শন, ২০০১ এ বহু চ্যানেল এবং মোবাইল আসছে, ২০১১ তে অজস্র চ্যানেল, মোবাইল আসতে শুরু করেছে সর্বত্র আর ২০২০? ২০২১? কার কাছে নেই মোবাইল? সরকার ১৯৭১ এ বিজ্ঞাপন দিয়েছে হাম দো হামারে দো, আজ তা দিতেই হয় না কেন? কারণ ঐ সোর্স অফ ইনফরমেশন, তার থেকে জন্ম নেওয়া সচ্ছলতার চাহিদা আর উপায়, জন্ম নেওয়া ছোট পরিবারের আকাংখ্যা। সব মিলিয়ে হু হু করে এক বদলে যাওয়া সমাজ। কাজেই ২০১১ র পরিসংখ্যান নিয়ে আলোচনার আগেই বলে দেওয়া উচিত যে এরপরের জনগণনা এক আমূল বদলে যাওয়া ছবি হলে অবাক হবেন না। তার কিছু কিছু ইঙ্গিত তো আমাদের কাছে আছে। কারণ জনগণনা নাই বা হল আমাদের ন্যাশন্যাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে কিন্তু নিয়মিত হয়েছে, আমাদের যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের উদ্যোগেই এই সার্ভে হয়, তার রিপোর্ট আসে। বিশেষ করে জনসংখ্যার বৃদ্ধি, বিভিন্ন ধর্মের মানুষজনদের সেই বৃদ্ধির হার ইত্যাদি জানা যায়। তো সেই এনএইছএফএস রিপোর্ট বলছে ১৯৯৩ সালে জনসংখ্যার ৪৪% মানুষ কোনও না কোন এক জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন, ২০১৬ সালে সেটাই ৫৩,৫% আর ২০২১ এ ৬৬.৭%। অর্থাৎ এই জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহারের হার ১৯৯৩ থেকে ২০১৬ তে বেড়েছে ১০ পার্সেন্টেজ পয়েন্টের মত, কিন্তু ২০১৬ থেকে ২০২১ এর মধ্যে বেড়েছে ১৩.২%। কাজেই ২০১১ সালে হিন্দু জনসংখ্যার বৃদ্ধি, মুসলমান জনসংখ্যার বৃদ্ধি এবং তাদের ফারাক একরকম হবে না, ড্রাস্টিক্যালি আলাদা হবে। এবার আসুন ঐ মিথটাকে নিয়ে বসা যাক যে মুসলমান জনসংখ্যা হিন্দু জনসংখ্যা কে ছাপিয়ে যাবে আর কবছরের মধ্যেই, কথাটার সত্যতা কতটা? তাহলে ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী হিন্দু আর মুসলমান জনসংখ্যা কত সেটা দেখে নেওয়া যাক। ৭৯.৮% হিন্দু, মুসলমান ১৪.২%। এটা বললে কিছুই বোঝা যায় না, বরং দেখে নেওয়া যাক হিন্দু আর মুসলমান জনসংখ্যা প্রতি ১০ বছরে কেমন করে বেড়েছে বা কমেছে। ১৯৫১-৬১ তে হিন্দু জনসংখ্যা বেড়েছে ২০.৭% হারে, মুসলিম জনসংখ্যা ৩২.৭% হারে বেড়েছিল। ১৯৬১ ৭১ এ ২৩.৭% হারে হিন্দু আর ৩০.৯% হারে মু্সলমান জনসংখ্যা বেড়েছিল। এটাই ১৯৯১ - ২০০১ এর জনগণনা রিপোর্ট অনুযায়ী হিন্দুদের ১৯.৯% হারে, মুসলমানদের ২৯.৪% হারে বেড়েছে, ২০০১ – ২০১১ তে হিন্দুদের ১৬.৭% মুসলমানদের ২৪.৭% হারে জনসংখ্যা বেড়েছে। মানে জনসংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু সেই বৃদ্ধির হারও কমছে, হিন্দুরও কমছে, মুসলমানদেরও কমছে, কিন্তু এই কমার হার মুসলমানদের ক্ষেত্রে বেশি, কতটা বেশি? ২০০০ সাল থেকে, সারা দেশে মুসলমান জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার কমছে ৫%, তুলনায় হিন্দু জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার কমছে ১.৫%। এই বাংলায় ফার্টিলিটি রেট দুই জনসমুদায়েরই প্রায় সমান। জনসংখ্যার বৃদ্ধি কী দিয়ে মাপা যায়? ফার্টিলিটি রেট দিয়ে, একজন নারীর সারা জীবনে কটা সন্তান হচ্ছে, তার পরিসংখ্যান দিয়ে। তো উত্তর প্রদেশের ফার্টিলিটি রেট কত? ৩.১, মানে উত্তর প্রদেশের তিনজন মহিলা প্রায় ৯ টি সন্তানের জন্ম দেয়, আর বাংলায়? আমাদের রাজ্যে ফার্টিলিটি রেট ১.৬, মানে উত্তর প্রদেশের অর্ধেক র ও কম। সারা দেশের গড় ফার্টিলিটি রেট ২.২, অর্থাৎ আমাদের বাংলা সারা দেশের চেয়ে অনেক, অনেক ভাল জায়গায় আছে, এবং তথ্য বলছে এ রাজ্যে ফার্টিলিটি রেট যে ভাবে কমছে তাতে আগামী ১০/১৫ বছরে এই ফার্টিলিটি রেট ১.১ এ পৌঁছে যাবে।  উত্তরপ্রদেশে মুসলমান জনসংখ্যা ১৩/১৪ %, বাকি হিন্দু। ওখানে ফার্টিলিটি রেট ৩.১। আর বাংলায় মুসলমান জনসংখ্যা ৩৩% এর বেশী, ফার্টিলিটি রেট ১.৬। ভারতবর্ষে বিহার, মধ্য প্রদেশ, হরিয়ানা, রাজস্থান, অন্ধ্র প্রদেশ ইত্যাদি বহু রাজ্যের থেকে কম, এমন কি কেরালার থেকেও কম, দেশের সবচেয়ে বেশী ফার্টিলিটি রেট কোথায়? পুরো হিসেবটা পাচ্ছি ২০১৬ সালের, উত্তর প্রদেশ ৩.১, বিহার ৩.৩, মধ্য প্রদেশ ২.৮, ঝাড়খন্ড ২.৬, গুজরাট ২.২, আসাম ২.৩ আর বাংলা ১.৬। অর্থাৎ হিন্দি গোবলয় আমাদের দেশের জনসংখ্যা বিস্ফোরণের জন্য দায়ী। এবং সেই সব রাজ্য, যেখানে মুসলমান জনসংখ্যা অপেক্ষাকৃত বেশী, সেইরাজ্যগুলোতে ফার্টিলিটি রেট কম, যেমন পশ্চিম বঙ্গ, এমন কি অধুনা বিজেপি শাসিত অসমেও অপেক্ষাকৃত কম। আমাদের দেশে, জনসংখ্যা নিয়ে এই চিল চীৎকার, আগেও হয়েছে। জরুরি অবস্থার সময় নসবন্দি অভিযান চলেছিল, ফলাফল কী? ল্যান্সেটের তথ্য বলছে, ১৯৭৫-৮০ তে ফার্টিলিটি রেট ছিল ৪.৯৭, আর ১৯৮০-৮৫ তে সেই হার কমে দাঁড়ায় ৪.৬৮, অর্থৎ সেরকম কোনও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন নেই। অথচ ১৯৯৫-২০০০ ফার্টিলিটি রেট ছিল ৩.৪৮, ২০১০- ২০১৫ তে তা কমে দাঁড়াল ২.৪, কেন? এই সময়ের মধ্যে তো কোনও জনসংখ্যার আইন আনা হয় নি, তাহলে? আসলে খেয়াল করুন, এই সময়ের মধ্যে দেশের অর্থনীতি অনেকটা ভালো হয়েছিল, জিডিপি বেড়েছিল, গড় আয় বেড়েছিল, মানুষের হাতে কিছু টাকা এসেছিল, বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানোর জন্য মিড ডে মিল দেবার ফলে বাচ্চারা স্কুলে যাচ্ছিল, ১০০ দিনের কাজের টাকা পাচ্ছিল গরীব মানুষেরা, অর্থনীতির উন্নয়ন জনসংখ্যা হ্রাসের প্রথম শর্ত, মানুষের জীবন যাত্রার মানের উন্নতি হলেই তারা সন্তান কে আরও বেশি সুযোগ দিতে চায়, স্কুলে পাঠাতে চায়, ভাল করে মানুষ করতে চায়। তারা নিজেরাই চায় কম সন্তান হোক, উন্নত দেশের জনসংখ্যা কম, বা কমেছে এই কারণেই। নির্বাচন এসেছে আর মোদি অ্যান্ড কোম্পানির হিন্দু মুসলিম কার্ড ফেলা শুরু হয়েছে সম্ভবত সেই আগুনের উত্তাপ আরও বাড়াতে এক রিপোর্ট বার করা হল মাত্র কদিন আগেই, যার হেড লাইন বিজেপির আইটি সেল এ ঘুরে বেড়াচ্ছে। বলা হচ্ছে ১৯৫০ থেকে ২০১১ র মধ্যে হিন্দু জনসংখ্যা ৮৪.৬৮% থেকে ৭৮.০৬% এ এসেছে, মুসলমান জনসংখ্যা ৯.৮৪% থেকে ১৪.৪৯% বেড়েছে। ব্যস, অশ্বথমা হত ইতি গজ নিয়ে রে রে করে প্রচার চলছে সোশ্যাল মিডিয়ায় আর একথা তো সত্যি যে আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে আর যাই বলা যাক শিক্ষিত তো বলা যায় না, আর অশিক্ষিতের বা অর্ধশিক্ষিতের প্রথম কাজ হল এক অর্ধসত্য, অর্ধ মিথ্যেকে নিজের ফায়দার জন্য কাজে লাগানো, উনি সেটা মন দিয়ে করছেন। করুন। আসুন সত্যিটা জেনে নিই। তথ্য হিসেবে এটা সত্যি। এই তথ্য নিয়ে একটা ৬৭ পাতার রিপোর্ট প্রাইম মিনিস্টার গ্রুপ অফ অ্যাডভাইজরি কমিটি থেকে প্রকাশ করা হয়েছে, এবং এতে বিরাট পন্ডিত মানুষজন আছেন। রিপোর্টটির নাম হল শেয়ার অফ রিলিজিয়াস মাইনরিটিজ, অ্যা ক্রস কন্ট্রি অ্যানালিসিস। দুনিয়ার ১৬৭ টা দেশের বিভিন্ন তথ্য আর আমাদের দেশের তথ্য মিলিয়ে এই রিপোর্ট তৈরি করে নির্বাচনের বাজারে ছেড়ে দেবার পেছনে কারণ আছে বৈকি। এর হেডলাইন কে কাজে লাগানো হবে, পুরোটা কেউ পড়বেই না। এই রিপোর্টে বলা হচ্ছে এই ১৬৭ টা দেশের মেজর রিলিজিওন, সবচেয়ে বড় ধর্মের মানুষদের জনসংখ্যা ২১.৯% কমেছে। কটা দেশে হিন্দু জনসংখ্যা মেজরিটি? নেপাল আর ভারত। বাকি বেশিরভাগ দেশেই খ্রিস্টানিটি। আর বহু দেশে বিশেষত আফ্রিকার বহু দেশে আগে ধর্ম ছিল অ্যানিমিজম, পশু পাখি আকাশ, পাথর, নদী পুজো করা, সে ধর্ম প্রায় পুরোটাই উবে গিয়ে সেখানে খ্রিস্টানিটি এসেছে। ঠিক যেমন আমাদের আদিবাসীরা আপাতত হিন্দু ব্রাকেটে এসে গেছেন, ১৯৫১ তেই তাঁদের হিন্দু করে দেওয়া হয়েছে এক ঝটকায়। তো এই রিপোর্ট বলছে এই গরিষ্ঠাংশ ধর্ম এর জনসংখ্যা সবচেয়ে বেশি কমলো কোথায়? ওইসিডি দেশগুলোতে, মানে পৃথিবীর সবথেকে বিকশিত দেশগুলোর ৩৮ টা দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্ম এর জনসংখ্যা ৩৩% কমেছে। যারা পৃথিবীর অর্ধেক এনার্জি ফুয়েল ব্যবহার করে, যাদের মোট জিডিপি গ্লোবাল জিডিপির ৩/৫ ভাগ, যারা পৃথিবীর ৭৫% বাণিজ্য করে এবং যাদের জনসংখ্যা পৃথিবীর মাত্র ১৮%। হ্যাঁ তাঁদের মেজরিটি ধর্ম মানেন, অধিকাংশই খ্রিস্টান, এমন জনসংখ্যার ৩৩% কমেছে এবং তাতে তাঁদের একটি লোমও ছেঁড়া যায় না। কারণ তাঁরা বাণিজ্য, শিল্প, সংস্কৃতি, ছবি, সিনেমা, কবিতা, সাহিত্য শিক্ষা, গবেষণা নিয়ে মগ্ন, তাঁরা এ প্লাস বি হোল স্কোয়ারে এক্সট্রা টু এ বি খুঁজে পান নি, তাঁদের দিন কাটে না ধর্মের তাস খেলে, তাঁদের দেশে উগ্রপন্থা আঘাত হানে, ইসলামিক টেররিস্ট রা সমস্যা, কিন্তু দেশের মুসলমানরা সুরক্ষিত, মুসলমান দেখলেই তাঁদের টেররিস্ট মনে হয় না। আবার এটাও ঘটনা যে এই ১৬৭ টা দেশের ৩৮ টা ইসলামিক কান্ট্রির মধ্যে ২৫ টা দেশে মুসলমান জনসংখ্যা বেড়েছে, ১৩ টার কমেছে। তার একটা কারণ হলো বহু ইসলামিক দেশেই আপনাকে চাকরির জন্য থাকতে দেওয়া হয়, কিন্তু নাগরিকত্ব দেওয়া হয় না, এবং অবশ্যই বহু ইসলামিক দেশ অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া, কাজেই জনসংখ্যার সাধারণ সূত্র ধরেই সেখানে জনসংখ্যা বাড়ছে। আমাদের প্রতিবেশীদের দিকে তাকানো যাক। বাংলাদেশ এ ১৮.৫৫% সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান, ভূটান এ ১৭.৬৭% সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ,  শ্রীলংকা য় ৫.২৫% বৌদ্ধ, পাকিস্তানে ৩.৭৫% মুসলমান, আফগানিস্তানে .২৯% মুসলমান, যাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাঁদের জনসংখ্যা বেড়েছে। অন্যদিকে মালদ্বীপ এর ১.৪৭% মুসলমান,নেপালে ৩.৬১% হিন্দু, ভারতে ৭.৮২% হিন্দু আর মায়নামারে ৯.৮৪% হিন্দু পপুলেশন কমেছে। বিভিন্ন দেশে জনসংখ্যা বিভিন্ন কারণে বেড়েছে বা কমেছে, তবে পৃথিবী জুড়ে ধনী, বিকশিত দেশের জনসংখ্যা সবথেকে বেশি কমেছে তা এই রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, যানা যাচ্ছে যে পৃথিবীতে ভারত সহ ১৬৭ টা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মের মানুষজনদের জনসংখ্যা কমেছে, কেবল ভারতে হিন্দুদের নয়। এবং ঐ রিপোর্টেই বলা হচ্ছে আমাদের দেশের মুসলমান মানুষজন, সংখ্যালঘু মানুষজন অন্তত ২০১৫ পর্যন্ত মোটের ওপর ভালো ছিলেন, এক গণতান্ত্রিক পরিবেশেই, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গেই তাদেরও জনসংখ্যা  বৃদ্ধির হার কমছিল। ২০২১ এ জনগণনা হয় নি, ২০২৫ এ হবে আশা করাই যায় এবং নিশ্চিতভাবেই সেদিন যে তথ্য পাওয়া যাবে তা আরও ভাল করেই বুঝিয়ে দেবে যে সংখ্যালঘু মুসলমানদের জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার বাকিদের সঙ্গে তাল মিলিয়েই কমছে, ন্যাশনাল হেলথ সার্ভের সর্বশেষ রিপোর্ট বলছে দেশের ফার্টিলিটি রেটের হিসেবে হিন্দু মহিলাদের ১০ জন ১৯ টি সন্তানের জন্ম দিচ্ছে, মানে ফাররীলিটি রেট ১.৯,  সেখানে মুসলমান সম্প্রদায়ের মহিলাদের ফার্টিলিটি রেট ২.৩, মানে ১০ মহিলা ২৩ জন সন্তানের জন্ম দিচ্ছে।  মানে একসময় যেখানে ফার্টিলিটি রেটের তফাত ছিল ২ এর কাছাকাছি, মানে হিন্দুদের ঠিক দ্বিগুণ সন্তান হতো সংখ্যালঘু  মুসলমান দের তা হু হু করেই নেমেছে। আমাদের প্রাক্তন মুখ্য নির্বাচনী অফিসার, এস ওয়াই কুরেসি, এই নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা করেছেন, তাঁর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, যদি একই অবস্থা চলতে থাকে তাহলেও, ২১০১ সালে দেশের জনসংখ্যা দাঁড়াবে ১৭০ কোটিতে, যার মধ্যে হিন্দু জনসংখ্যা হবে ১২৭ কোটি, মুসলমান জনসংখ্যা হবে ৩২ কোটি, সেই বছরে তাঁর হিসেব অনুযায়ী ফার্টিলিটি রেট দাঁড়াবে ১.৭  এ, হ্যাঁ দুই ধর্মের মানুষজনের। আসলে তার বহু আগেই কমবে চাবিকাঠি ঐ অর্থনৈতিক অগ্রগতির মধ্যে লুকিয়ে আছে।

তাহলে কী দাঁড়ালো? আর এস এস – বিজেপি, নরেন্দ্র মোদী – অমিত শাহ, আসলে মানুষকে ভুল বোঝাতে চায়, জনসংখ্যা, উন্নয়ন বিকাশ তাঁদের চিন্তা ভাবনার মধ্যে নেই, আছে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা, এক চরম অন্যায়, মিথ্যে অস্ত্র নিয়েই তারা মানুষের ভোট পেতে চায়, একথা আজ প্রত্যেক কে বুঝতে হবে, বোঝাতে হবে।     

 

0 Comments

Post Comment