পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

হিডমা হত্যা, উল্লাসের রঙ্গমঞ্চ, গোয়েঙ্কা স্মারক বক্তৃতা ইত্যাদি

  • 01 January, 1970
  • 0 Comment(s)
  • 205 view(s)
  • লিখেছেন : অশোক চট্টোপাধ্যায়
মনমোহন সিং-চিদাম্বরমদের নকশাল তথা মাওবাদীদের সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির কথা তো মোদির অজানা নয়। মনমোহন সিং তো বলেই দিয়েছিলেন : নকশালপন্থীরা দেশের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সবচাইতে বড়ো বিপদ (দ্য হিন্দু, নভেম্বর ১৭, ২০২১)। একদা দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা বর্তমান অমিত শাহের পূর্বসূরী চিদম্বরম তো স্পষ্টতই বলেছিলেন যে দেশের সন্ত্রাসবাদ দমনের চাইতেই বড়ো চালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে নকশালপন্থীরা (দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া, সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১১)!

‘তোমার সমগ্র নিয়ে আলোচনা হয় না কখনো
হতেও পারে না বলে মনে হয়, হতে পারে নাকি ?
মৃত্যুর দুদিন আগে তোমাকে কী সুন্দর দেখালো!’

                                       —শক্তি চট্টোপাধ্যায়

 

মাওবাদী নেতা হিডমাকে তথাকথিত ‘এনকাউন্টার’-করে হত্যা করার এবং রাষ্ট্রের তরফে তার উল্লাসের রেশ কাটতে না কাটতেই আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একটি সর্বভারতীয় ইংরেজি দৈনিকের পুরো পৃষ্ঠা আলোকিত করে বেশকিছু কথা লিখেছেন, তাঁর গণতন্ত্রপ্রেমের পতাকা বারবার এই কার্তিক মাসের শীতল হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়েছেন এবং নিজের মহত্বের গুণকীর্তন করেছেন। তবে তাঁর বক্তৃতার মুদ্রণ ভাষ্যে তথা এই লেখায় তিনি এমন কিছু তথ্য দিয়েছেন যা সম্ভবত আমাদের মতো অনেকেরই অজানা ছিল। জরুরি অবস্থা জারির পঞ্চাশ বছর উপলক্ষে সেই সময়ে জনসংঘ (ভারতীয় জনতা পার্টির পূর্ব নাম) এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের প্রকৃত ভূমিকা আড়াল করে নিজেদের পত্রিকার আক্রান্ত হওয়া, প্রতিবাদে সম্পাদকীয় কলম সাদা রেখে প্রকাশ করা ইত্যাকার অনেক সংবাদ এই ইংরেজি দৈনিক পত্রিকাটি পাঠকসমক্ষে এনেছিলেন।

এই পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রামনাথ গোয়েঙ্কা। তিনি ১৯৩১ থেকে ১৯৩৬-এর অন্তর্বর্তী পর্যায়ে ব্রিটিশ ট্রেডিং কোম্পানির মুখ্য সেলসম্যান-এর পদে অভিষিক্ত ছিলেন। এই পত্রিকায় উল্লেখিত হয়ে থাকে যে তিনি ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে এই পত্রিকাটি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। অর্থাৎ ব্রিটিশ ট্রেডিং কোম্পানির মুখ্য সেলসম্যান-এর পদে অভিষিক্ত থাকার সময়েই তিনি এই পত্রিকাটি প্রথম প্রকাশ করেন। আসলে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দেও এই পত্রিকাটির অস্তিত্ব বর্তমান ছিল। এই পত্রিকাটির মোট মূলধনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের অধিকারী ছিলেন রামনাথ  গোয়েঙ্কা স্বয়ং। পরবর্তীতে তিনি কিছু ইংরেজি এবং আঞ্চলিক পত্রিকার সমন্বয়ে এই পত্রিকার একটি সম্মিলিত গ্রুপ তৈরি করেছিলেন। উত্তরকালে তাঁর নামেই ‘রামনাথ গোয়েঙ্কা একসেলেন্স অব জর্নালিজম অ্যাওয়ার্ডস’ প্রচলিত হয়েছিল। তাঁর স্মরণে এই পত্রিকা আয়োজিত স্মারক বক্তৃতা দিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অনুরুদ্ধ এবং যথারীতি বিজ্ঞাপিত হয়েছিলেন। আর এই স্মারক বক্তৃতার মুদ্রিত ভাষ্য পত্রিকাটির ২০ নভেম্বর-এর পৃষ্ঠা আলোকিত করে প্রকাশিত হয়েছে।

মোদি তাঁর বক্তৃতা প্রসঙ্গে বারবার রামনাথ গোয়েঙ্কার কৃতিত্বের কথা স্মরণ করেছেন। তবে এর পাশাপাশি তিনি জানিয়েছেন যে আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়  রামনাথ গোয়েঙ্কা  সমর্থন করেছিলেন তৎকালীন জাতীয় কংগ্রেসকে এবং উত্তরকালে তিনি তাঁর সমর্থন কংগ্রেস থেকে প্রত্যাহার করে নিয়ে জনতা পার্টির পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি এমনকি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের অনুগামী জনসংঘের টিকিটে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। মোদি এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ব্যাপারে সন-তারিখের উল্লেখ না করলেও তিনি  সম্ভবত ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনের কথা বলতে চেয়েছেন। কেননা এই একাত্তরেই রামনাথ গোয়েঙ্কা বিদিশা লোকসভা কেন্দ্র থেকে ভারতীয় জনসংঘ-এর প্রার্থী হিসেবে সাংসদ হয়েছিলেন। 

মোদির এই বক্তৃতার ভাষ্য থেকে আরও জানা যায় যে সাতচল্লিশ-উত্তর পর্যায়ে যখন রাজাকার দমনের নামে রাষ্ট্রের তীব্র অত্যাচার চলছিল,  রামনাথ তখন এই দমন অভিযানের নায়ক বল্লভভাই প্যাটেলকে সমর্থন করে তাঁর দিকে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছিলেন। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে যখন বিহারে ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্বদানের প্রশ্ন সামনে চলে আসে, তখন রামনাথ নানাজি দেশমুখের সহযোগে জয়প্রকাশ নারায়ণকে এই আন্দোলনের হাল ধরার জন্যে রাজি করিয়েছিলেন। ইন্দিরা গান্ধির উদ্যোগে জারি করা জরুরি অবস্থার সময় ইন্দিরার জনৈক অনুগামী নেতা রামনাথকে ইন্দিরা-বিরোধিতার জন্যে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠিয়ে দেওয়ার হুঁশিয়ারি পর্যন্ত দিয়েছিলেন। রামনাথ সবসময় সত্যের এবং ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন, আর এজন্যেই মোদি  তাঁকে সশ্রদ্ধায় স্মরণ করেছেন, তাঁর কৃতিত্বের কীর্তনগাথা রচনা করেছেন। কারণ, মোদি স্বয়ং সত্য এবং ন্যায়ের পক্ষে অবিচল অবস্থান নিয়ে থাকেন!

আসলে সাতচল্লিশ-উত্তর ভারতে রামনাথ গোয়েঙ্কা ছিলেন সংঘপরিবারের ঘনিষ্ঠ স্বজন, স্বভাবতই তিনি তাঁর সংঘপারিবারিক রাজনৈতিক দর্শনের নিরিখেই ইন্দিরা গান্ধির রাজনৈতিক বিরুদ্ধতায় সোচ্চার হয়েছিলেন। কিন্তু জরুরি অবস্থার সময় সংঘপরিবারের বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ কীভাবে ইন্দিরা গান্ধির কাছে আত্মসমর্পন করেছিলেন সে ব্যাপারে যেমন মোদি নীরব তেমনই রামনাথ-প্রতিষ্ঠিত পত্রিকাপাঠে তার হদিশ মেলে না। আর এজন্যেই মোদিকে যেমন সেই পত্রিকাটি রামনাথ গোয়েঙ্কা স্মারক বক্তৃতা দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন, অন্যদিকে মোদিও তাঁদের সংঘপরিবারের বিশ্বস্ত এবং ঘনিষ্ঠ রামনাথকে বারবার স্মরণ করেছেন তাঁর প্রদত্ত বক্তৃতায়। এই পত্রিকার সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার শিরোদেশে এখনও শোভা পায় : সাহসের সাংবাদিকতা!

মোদি তাঁর বক্তব্য প্রদানের সময় সাধারণত ধান ভানতে শিবের গীত করে থাকেন। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। এই বক্তৃতা প্রসঙ্গে মোদি তাঁর নেতৃত্বে আমাদের দেশের  অনাগত উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দৃশ্যমান আলোকরেখার কথা বলেছেন। তিনি একজন মহান গণতান্ত্রিকের ভান করে বলেছেন যে, তিনি সবিনয়ে জানাতে চান—আমাদের দেশের বিভিন্ন প্রদেশের রাজ্য সরকারগুলি, তা সে বাম, ডান বা মধ্যপন্থী যাই-ই হোক না কেন, তারা যেন মনে রাখেন যে, বিহারে ভোটের সাম্প্রতিক ফলাফল কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে তাঁদের রাজ্যেরও ভাগ্য নির্ধারণ করবে। আসলে এই মহান গণতান্ত্রিকের ভান করে তিনি অন্যান্য বিরোধী রাজ্যগুলিকে হুঁশিয়ারি দিলেন! তিনি জানিয়ে দিয়েছেন যে বিহারের জনসাধারণ দীর্ঘ দেড় দশক তথা পনেরো বছর সময় দিয়েছিলেন আরজেডি-কে তাঁদের রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণের সুযোগ সদব্যবহার করার জন্যে, কিন্তু তারা সেখানকার জনসাধারণকে সুশাসনের বিপরীতে ‘জঙ্গলের রাজত্ব’ উপহার দিয়েছিলেন! ফলে সেখানকার জনসাধারণ এই বিশ্বাসঘাতকতাকে আর প্রশ্রয় দেন নি। আর এসবের পরিণতিতে এবারের নির্বাচনে বিজেপি বিহারে অভূতপূর্ব সাফল্যলাভে সমর্থ হয়েছে।

মোদি জানিয়েছেন যে, আজ দেশের প্রায় চুরানব্বুই কোটি মানুষ সুরক্ষা বলয়ের মধ্যে চলে এসেছেন, যেখানে মাত্র দশ বছর আগেও দেশের মাত্র পঁচিশ কোটি মানুষ এই সুরক্ষার অধীনে এসেছিলেন! আজ দেশের একশ’ কোটির কাছাকাছি মানুষ জানতে পারছেন সামাজিক ন্যায়বিচার ঠিক কী! সুরক্ষা বলয়, সামাজিক সুরক্ষা জাতিয় শব্দাবলি সতত বাদ্যময়, তা কোনও ব্যাখার ধার ধারে না।

এরপরেই তিনি আসল প্রসঙ্গে এসেছেন : সাংবাদিকদের অনেকের কাছেই তো ছত্তিশগড়ের বস্তার একটি জীবন্ত চর্চার বিষয়। একটা সময় তো ছিলো যখন সেখানে যেতে গেলে কেবলমাত্র প্রশাসনিক অনুমতি নয়, অন্যান্য বিভিন্ন সংগঠনের অনুমতি ছিল আবশ্যিক। কিন্তু এখন সেদিন আর নেই। এখন সেখানে উন্নয়নের জোয়ার বইছে! এই প্রসঙ্গেই তিনি তাঁর মূল বক্তব্যে চলে আসেন। ‘আমাকে’ (অর্থাৎ মোদিকে) নকশাল তথা মাওবাদীদের কথা কিছু তো বলতে হবে। এখন তো সারা দেশেই মাওবাদীদের হাল শোচনীয় অবস্থায় এসে পৌছেছে। একথা তো দেশবাসী জানেন—মোদির ভাষ্যে—আজ থেকে পাঁচ দশক আগে মাওবাদ আসলে সারাদেশেই বিস্তারলাভ করেছিল। এখন দেশ সেই মাওবাদীদের হাত থেকে নিস্তার পেতে চলেছে, ভয়মুক্ত হয়ে এক নিশ্চিন্ত জীবনযাপনের পথে এগিয়ে চলেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, কংগ্রেসই তো নিরবচ্ছিন্নভাবে মাওবাদীদের মদত করে গিয়েছে, আর এই অপকর্মের মাধ্যমে তারা দেশের সংবিধানকে কার্যত প্রত্যাখ্যান করেছে! কংগ্রেস তো শহুরে নকশালদেরও পৃষ্ঠপোষক! আর, এই শহুরে নকশাল ও মাওবাদীরা কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগের সমর্থনপুষ্টতায় বেড়ে উঠেছে!

একদিকে অনৃতভাষণে প্রশ্নাতীত দক্ষতার পরিচয় যেমন রাখতে অভ্যস্ত আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, তেমনই তাঁর এবং তাঁর দল ও সরকারের ‘কংগ্রেসমুক্ত’ ভারত গঠনের এবং মুসলিমবিরোধী জেহাদ এখানে একসূত্রে গ্রথিত হয়েছে। এতথ্য তো প্রায় প্রত্যেকেরই জানা যে বিগত সত্তরের দশকে নকশালনিধনে কংগ্রেস সারাদেশ জুড়ে কী নির্মম ভূমিকা গ্রহণ করেছিল, হাজার হাজার নকশালপন্থী যুবক-যুবতীদের তারা প্রকাশ্যে এবং জেলখানায় গুলি করে হত্যা করেছিল। কবি সরোজ দত্ত, সুব্বারাও পানিগ্রাহী, অমিয় চট্টোপাধ্যায়, দ্রোণাচার্য ঘোষ প্রমুখ অসংখ্য কবি-লেখক-বুদ্ধিজীবীদের তারা প্রকাশ্যে হত্যা করেছিল, নকশালপন্থী সন্দেহে দেশের জেলখানা সেসময় উপচে পড়েছিল। নকশাল নেতা চারু মজুমদারকে পুলিশি হেফাজতে হত্যা করা হয়েছিল। সেসব অপরাধের কোনও বিচার করতে উত্তরকালে কোনও সরকার উদ্যোগী হয় নি। এই প্রসঙ্গে কিন্তু মোদি নীরব থাকেন!

মনমোহন সিং-চিদাম্বরমদের নকশাল তথা মাওবাদীদের সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির কথা তো মোদির অজানা নয়। মনমোহন সিং তো বলেই দিয়েছিলেন : নকশালপন্থীরা দেশের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সবচাইতে বড়ো বিপদ (দ্য হিন্দু, নভেম্বর ১৭, ২০২১)। একদা দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা বর্তমান অমিত শাহের পূর্বসূরী চিদম্বরম তো স্পষ্টতই বলেছিলেন যে দেশের সন্ত্রাসবাদ দমনের চাইতেই বড়ো চালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে নকশালপন্থীরা (দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া, সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১১)! 

তথ্য বিকৃত করতে অনেকেই পারঙ্গমতা প্রদর্শন করে থাকেন। পঁচাত্তরের জরুরি অবস্থার সময়ে ইন্দিরা গান্ধির সঙ্গে সংঘপরিবারের অনেক নেতৃবর্গের গোপন শলার কথা গত জুন মাসে মোদি তাঁর কথাবার্তায় একদম গোপন করে গিয়েছিলেন। তেমনই নকশালনিধনে কংগ্রেসের ভূমিকাকে স্মরণ করলে তাঁদের মাওবাদনিকেশের কৃতিত্ব যে ম্লান হয়ে যায়! ফলে তথ্যবিকৃতি এক্ষেত্রে প্রচারের মোক্ষম অস্ত্র হয়ে ওঠে! শারজিল, ওমর খলিদ, গুলফিসা প্রমুখ ‘মুসলিম’ ছাত্র-গবেষক-সাংবাদিক-কবি-সমাজকর্মীদের দীর্ঘদিন ‘মাওবাদী’ ‘সন্ত্রাসবাদী’ তকমাভূষিত করে কারান্তরালে রেখে তাঁরা যে কীর্তিস্থাপন করে চলেছেন তাকে বৈধতাদানের সঙ্গে এই অনৃতভাষণের সুগভীর সম্পর্কে রয়ে গিয়েছে।

আজ থেকে ১৯০ বছর আগে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ২ ফেব্রুআরি জেনারেল কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশান-এর সভাপতি টমাস বেবিংটন ম্যাকলে বিদেশি ব্রিটিশ শাসনাধীন ঔপনিবেশিক ভারতে শিক্ষা প্রসঙ্গে একটি প্রতিবেদন বা মিনিটস পেশ করেছিলেন। সেই প্রতিবেদনে তিনি এদেশে ইংরেজি একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী তৈরি করার পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে তাঁরা হয়ে উঠবেন জন্মগতভাবে ভারতীয়, কিন্তু রুচি, আদর্শ ও নৈতিক আদর্শের দিক থেকে তাঁরা হয়ে উঠবেন ইংরেজ। তিনি এদেশে সংস্কৃত কলেজকে বিলুপ্ত করার প্রস্তাবও তিনি দিয়েছিলেন। ভারতীয় ভাষায় শিক্ষাচর্চাকারীরা সরকারি অনুদান বা সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হবে বলেও জানিয়েছিলেন।

গত ২০ নভেম্বর পূর্বোক্ত পত্রিকায় প্রকাশিত মোদির বক্তৃতার মুদ্রিত ভাষ্যে মোদি সহসা এই প্রসঙ্গটির অবতারণা করে মেকলেকে ‘ব্রিটিশ পার্লিয়ামেন্টারিয়ান’ বলে উল্লেখ করেছেন! কিন্তু বাস্তবে মেকলে ছিলেন একজন ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ, কবি এবং হুইগপন্থী রাজনীতিবিদ যিনি ১৮৩৯ থেকে ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দের অন্তর্বর্তী সময়ে জারি থাকা যুদ্ধের সচিবের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি ভারতকে তার মূল অধিক্ষেত্র থেকে উৎখাত করার পক্ষে প্রচারে সামিল হয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন এদেশীয়রা দৃশ্যত ভারতীয় থাকলেও তাঁরা মানসিকগত দিক দিয়ে ইংরেজ হয়ে উঠবেন। আর একারণেই তিনি এদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে তার শিকড় থেকে উচ্ছেদ করতে চেয়েছিলেন। আর সেই ঘটনার দীর্ঘ ১৯০ বছর পরে এসে মোদি তাঁর এই বক্তৃতায় বলেছেন যে আজ থেকে প্রায় দুশো বছর আগে এই ক্ষমাহীন অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল। আর এখন তিনি অর্থাৎ মোদি দেশের জাতি এবং জনসাধারণের কাছে আবেদন রেখেছেন এই মর্মে যে আমরা যেন মেকলে-নির্ধারিত মানসিকতা থেকে মুক্ত হওয়ার শপথ গ্রহণ করি এবং আগামী দশ বছরের মধ্যে আমরা যেন এই ঔপনিবেশিক দাসত্বের মানসিকতা থেকে মুক্ত হতে পারি।—মোদি সহসা কেন এই ঔনিবেশিক দাসত্বের মানসিকতা থেকে মুক্ত হওয়ার কথা কেন বললেন তা ব্যাখ্যাত নয়। তিনি এবং তাঁর রাজনৈতিক দিশা প্রদর্শনকারীরা তো আমাদের দেশে ঔপনিবেশিক শাসকদের অনুগত ছিলেন, তাঁরা নানাভাবে এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরুদ্ধতা করে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের শিকড়ে অনবরত জলসিঞ্চন করেছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশ্বাসঘাতকের ভূমিকা পালন করে এখন তাঁরাই দেশপ্রেমিক সেজে প্রকৃত স্বাধীনতার পূজারীদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে থাকেন। তিনি সহসা তাঁর এই বক্তৃতায় মেকলের মিনিটস-এর কথা, তাও অযথার্থভাবে, উত্থাপিত করে কী বার্তা দিতে চাইলেন? তাঁরাই তো এখন দেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার ধ্বংসসাধন করে হিন্দুত্ববাদী ভাবধারাকে নতুনভাবে প্রচলিত করতে চাইছেন। তাঁরা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস বদলে দিয়ে হিন্দুত্ববাদী ইতিহাস লিখতে এবং প্রচলিত করতে উঠেপড়ে লেগেছেন। মেকলের বার্তাকে তো তাঁরা অন্যভাবে প্রয়োগ করে চলেছেন এদেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেওয়ার মাধ্যমে।

একদিকে গণতন্ত্রের প্রকীর্তন এবং অন্যদিকে হিডমা সহ মাওবাদী নেতা নিকেশকরণ ও কর্পোরেট দানবদের হাতে দেশের জল-জঙ্গল-জমিন তুলে দিয়ে প্রতিবাদী আদিবাসী নিধনযজ্ঞ সমানে সমান্তরালভাবে জারি রয়েছে মোদিতান্ত্রিক ভারতবর্ষে। এখানে দিনক্ষণ বেঁধে দিয়ে হত্যার পাশবিক উৎসব কার্যকরী হয়। দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সহ অন্যান্যরা রীতিমতো সমাজবিরোধীদের ভাষায় মাওবাদীদের উদ্দেশে হুঁশিয়ারি দেন, পাকিস্তানের মতো প্রতিবেশীদের মধ্যে ভয়ের বীজ বপন করেন আবার এসবের পাশাপাশি আমেরিকার মদতপুষ্ট জায়নবাদী ইজরায়েলের প্যালেস্তাইন ধ্বংসকরণকে অনুমোদন দেন, আবার দেশের মহান গণতন্ত্রের ঢক্কানিনাদী প্রচারে অক্লান্ত থাকেন। রাষ্ট্রের পুলিশের কর্তারা একদিকে মাওবাদী আদিবাসী সম্প্রদায়ের নেতা হিডমার গেরিলাযুদ্ধের রীতি প্রকরণের প্রশংসা করেন, আদিবাসী জনসাধারণের মধ্যে তাঁর তুমুল জনপ্রিয়তা এবং গ্রহণযোগ্যতা অস্বীকার করতে পারেন না, এই ‘ভয়ংকর’ মাওবাদী নেতা হিডমাকে নিজেদের ‘নিয়তি’ এবং ‘মহাকাব্যিক বীর’ বলে মান্যতা না দিয়েও পারেন না। একইসঙ্গে  ছত্তিশগড় পুলিশের কর্মকর্তারা আগেভাগেই ঘোষণা করে দিয়েছিলেন : হিডমা যদি আত্মসমর্পণ করে, তবুও তাকে হত্যা করা হবে! দেশের কেন্দ্র ও রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ বহু পুলিশ কর্মকর্তা তো মাওবাদী নেতা হিডমাকে নাম করে খুনের হুমকি দিয়েছিলেন।

অবশেষে এই মহাকাব্যিক নায়ক হিডমাকে তথাকথিত এনকাউন্টার করে হত্যা করার সংবাদ প্রচার হতেই বিজেপি এবং কিছু সরকারি ‘বাম’পন্থী কর্মীদের মধ্যে বাঁধভাঙা উল্লাসের বন্যা বয়ে গিয়েছিল, আনন্দে লাড্ডু বিলি হয়েছিল! আর এই উল্লাসের রেশ বজায় থাকতে থাকতেই দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁদের সংঘপারিবারিক বিশ্বস্ত বন্ধু ও রাজনৈতিক সহযোগী রামনাথ গোয়েঙ্কা স্মারক বক্তৃতায় একদিকে যেমন বারবার রামনাথের প্রশংসা করেছেন, তেমনই আগামী হিন্দুভারতের স্বপ্নকাব্যের জাল বুনেছেন, অসত্যের বেসাতি করেছেন, তথ্য গোপনে পারদর্শিতা দেখিয়েছেন এবং দেশজুড়ে প্রতিবাদী মানুষের হত্যাযজ্ঞের রক্তে রঞ্জিত গণতন্ত্রের জয়ধ্বনি দিয়েছেন!

পাশাপাশি আদিবাসী সমাজ থেকে উঠে আসা মাওবাদী নেতা হিডমানিধনে সরকারি উল্লাসের আপাত আলোকোদ্ভাষের নিচেই বিস্তৃত হতে থাকে দেশের আদিবাসী জনজাতি মানুষের জল-জমি-জঙ্গলের দখল বজায় রাখতে এক দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের সস্পর্ধ দামামা, এক অবাধ্য মাদল। শহিদ হওয়ার পরও হিডমারা অবসৃত হন না, তাঁরা বারবার বেঁচে ওঠেন, জেগে ওঠেন তাঁদের জনভিত্তির প্রকীর্ণ রণক্ষেত্রে। সমস্ত অরণ্যভূমি হিডমাকে স্পর্শ করে  আবার জেগে উঠবে ক্রমশ। অমিত শাহ-নরেন্দ্র মোদির এই ফ্যাসিস্ত রাষ্ট্রব্যবস্থা ক্রমাগত মিথ্যের জাল বিস্তার করে দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করার প্রক্রিয়ায় হিডমার মাকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে প্রচার করেছে যে, হিডমা যেন আত্মসমর্পন করে, তাকে রাষ্ট্রের তরফে পুনর্বাসন দিয়ে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হবে। হিডমার মা যেন রাষ্ট্রের এই বার্তা হিডমাকে জানান! তখন তো হিডমা রাষ্ট্রের হেফাজতে পুলিশি অত্যাচারের মুখেও বিদ্রূপের হাসি ছুঁড়ে দিচ্ছে। তারপর তো অমিত শাহের পুলিস কাপুরুষের মতো তাকে কথিত এনকাউন্টারে হত্যা করে উল্লাসে মেতে উঠেছিল। হিডমার সঙ্গেই তারা হত্যা করেছিল হিডমার সহযোদ্ধা তাঁর কমরেড স্ত্রীকেও। হিডমার মা সরকারের এই পরিকল্পিত ফাঁদে পা দেন নি। ফলে ক্রুদ্ধ সরকারি জল্লাদ বাহিনী হিডমার বৃদ্ধা মায়ের ‘কাঁধে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে হিডমার বিপ্লবী রাজনৈতিক মতাদর্শের’ এবং ‘মাওবাদী দলের বিরুদ্ধে বিষবাণ নিক্ষেপ’ করার নির্মম খেলায় মেতে উঠেছিল। কিন্তু পুলিশের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেও হাজার হাজার মানুষ তাঁদের প্রিয় সন্তান হিডমার অন্ত্যেষ্ঠিক্রিয়ায় যোগ দিয়ে কার্যত রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করেছে।

এই ধূমায়িত অগ্নিকুণ্ড নিমীলিত হয় না। বারবার তা নতুনভাবে জেগে ওঠে। প্রখ্যাত গল্পকার এবং অনুবাদক শান্তিরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রয়াণের পর তাঁর স্মৃতির উদ্দেশে লেখা একটি কবিতায় কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন : ‘মৃত্যুর পরেও যেন হেঁটে যেতে পারি’। শহিদ হিডমা-র প্রশংসাও রাষ্ট্রকে সন্ত্রস্থ করছে। একজন আদিবাসী যুবক হিডমার প্রসগসাসূচক ভিডিও নির্মাণের মতো কথিত অপরাধে সম্প্রতি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন!

এই রাষ্ট্রব্যবস্থায়, এই  ফ্যাসিস্ত আগ্রাসনের মুখে প্রতিস্পর্ধায় অসংখ্য হিডমারা মৃত্যুর পরও মাইলের পর মাইল হেঁটে যান যুদ্ধজয়ের লক্ষ্যে। তাঁদের ছায়া ক্রমশই বড়ো হতে থাকে। সন্ত্রস্থ রাষ্ট্রের হাড়ের ভেতর বাসা বাঁধতে থাকে এক ভয়ংকর হিমের তাণ্ডব। 

0 Comments

Post Comment