পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

দ্যাখ কেমন লাগে!

  • 10 August, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 658 view(s)
  • লিখেছেন : আকাশ উপাধ্যায়
দেশের যে বিভিন্ন নাট্যদলকে আর্থিক অনুদান দেয় কেন্দ্রীয় সরকার, সেই তালিকা থেকে বাংলার কয়েকটি নাট্যদলের নাম বাদ দিয়েছে কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রক। যথারীতি শুরু হয়ে গেছে ভুক্তভোগীদের প্রতিক্রিয়া। এঁদের কেউ-কেউ বলতে শুরু করেছেন, এমন করলে বাংলা নাটক শেষ হয়ে যাবে। তাই নাকি? অনুদান না পেলে বাংলা নাটক শেষ হবে? আলোচনা করেছেন আকাশ উপাধ্যায়।

জানা গেল, ‘গুরু-শিষ্য পরম্পরা’ প্রকল্পে দেশের যে বিভিন্ন নাট্যদলকে আর্থিক অনুদান দেয় কেন্দ্রীয় সরকার, সেই তালিকা থেকে বাংলার কয়েকটি নাট্যদলের নাম বাদ দিয়েছে কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রক। ফলত, যথারীতি শুরু হয়ে গেছে ভুক্তভোগীদের প্রতিক্রিয়া। এক বরিষ্ঠ বাঙালি পরিচালক আর্তনাদ করলেন, আমরা তো বিজেপি’র বিরুদ্ধে কোনও নাটক করিনি, তৃণমূলের বিরুদ্ধেও করিনি, কারওরই বিরুদ্ধে করিনি, আমরা তো সামাজিক নাটক করি, তবে কেন? ইত্যাদি ইত্যাদি। অন্য এক পরিচালক, তাঁর দুর্বোধ্য প্রযোজনার মতই, জটিল করে বোঝাবার চেষ্টা করলেন, এ সরকারের ভারী অন্যায়, সারা পৃথিবীতে অন্যান্য দেশে সরকার নাটকের দলকে সমর্থন করে অনুদান দেয়, রাজনীতির খেলা, ইত্যাদি ইত্যাদি। বিশ্বের অন্যত্র কোথায় বাংলার মতো গ্রুপ থিয়েটার আছে, এবং সরকার তাদের কীরকম সাহায্য দেয়, তার উল্লেখ অবশ্য তিনি করেননি। এদের তালে তাল মিলিয়ে কিছু আমোদলোভী বলতে শুরু করে দিয়েছে, এমন করলে বাংলা নাটক শেষ হয়ে যাবে। ‘কান্নাকাটির সংস্কৃতি’র প্রচারকরা যদি না জেনে থাকেন যে, বিজেপি সরকার তথা রাষ্ট্র আনুগত্য চায়, প্রশ্নহীন আনুগত্য, তাদের কাছে নিরপেক্ষতার সীমানা-চিহ্নে দাঁড়ান মানুষও বিরোধী পক্ষের, তাহলে এ তাদের মূর্খতা ছাড়া আর কী-ই বলবার।

অনুদান না পেলে বাংলা নাটক শেষ হবে? স্বাধীনতার পর প্রথম তিনটি দশকের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যাবে, যে-যে বাংলা নাটকের প্রযোজনা নিয়ে, তার অভিনয়শৈলী নিয়ে, পরিচালনা নিয়ে, মঞ্চ-আলোকসম্পাত নিয়ে আমরা এখনও গর্ব করি, তা উপস্থাপিত হয়েছে, কোনও গুরু-শিষ্য প্রকল্পের অনুদান ছাড়াই। উপস্থাপিত হয়েছে, পুলিশের বন্দুকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে (উদাহরণ: অসমের নালিয়াপুল)। ১৯৪৮ সালে যখন অশোক মজুমদার ও সম্প্রদায় (যা পরে বহুরূপী হবে) নবান্ন মঞ্চস্থ করছেন, কিংবা পরবর্তীতে ছেঁড়াতার-রক্তকরবী-চার অধ্যায়-পুতুলখেলা থেকে অঙ্গার-তীর-কল্লোল-অজেয় ভিয়েৎনাম হয়ে, বিজন ভট্টাচার্যের দেবীগর্জন-এ আপ্লুত হচ্ছি তখন কোথায় কেন্দ্রের অনুদান? এমনকী নান্দীকার যখন আমাদের সামনে বিদেশী নাটকের দিগন্ত উন্মোচন করছেন, তখনই বা আর্থিক সাহায্য কোথায়? ওঁরা পেরেছিলেন, কারণ ওদের জেদ ছিল। শম্ভু মিত্র যখন সেণ্ট জেভিয়ার্স কলেজ ছেড়ে শিশির ভাদুড়ির দলে নাম লেখান, কে অনুদান জুগিয়েছিল তাঁকে? বহুরূপী’র অমর গঙ্গোপাধ্যায় যখন বাড়ি থেকে কলকাতায় এসেছিলেন নাটকের টানে, ফুটপাতেও শুতে হয়েছিল দু-দিন, অনুদান পাননি, তবু নাটকটা করেছিলেন। রক্তকরবীতে সর্দারের ভূমিকায়, দশচক্র-তে পূর্ণেন্দু গুহ-রূপী শম্ভু মিত্রের বিপরীতে দাদা অমলেন্দু গুহ’র ভূমিকায় তাঁর অভিনয় যাঁরা দেখেছেন, তারাই জানেন, কি পরাক্রম তাঁর। নাটক শেষে অশোক সেন সাজঘরে দাঁড়িয়ে বলছেন, শম্ভু তো ভালো কিন্তু অমর আজ দুর্দান্ত, একইরকমের কথা একটু নিচু গলায় উচ্চারণ করছেন বিষ্ণু দে। তখন কোথায় অনুদান? মিনার্ভা থিয়েটারে উৎপল দত্তের অঙ্গার দেখে মানুষ যখন খনিশ্রমিকদের দিকে শ্রদ্ধা-সহানুভূতি নিয়ে ফিরে তাকাচ্ছে কিংবা তীর নাটকের একটি বিশেষ উপস্থাপনা দেখে চারু মজুমদার সিটের উপর দাঁড়িয়ে জোতদারের দিকে আঙুল তুলে চিৎকার করছেন, মার শালাকে, কোথায় অনুদান? ইডেন গার্ডেন্স-এ রাতভোর যুব-উৎসবে দেবীগর্জন দেখে নাট্যমোদীরা যখন আবেগে উত্তেজনায় ফুটছেন, তখন কোথায় অনুদান?

বাংলা নাটক অনুদান নির্ভর হওয়ার পরে ক’টা নাটক উপস্থাপিত হয়েছে যা, অতীতের এইসব অনুদান-রহিত নাটকের সমতুল? আর যদি অনুদান না পেলে বাংলা নাটক শেষ হয়ে যায়, সেই ক্ষীণজীবীর যাওয়াই ভালো। মেদ জন্মেছে অনুদান পাওয়া দলের শরীরে। সমালোচকরা বলছেন, এইসব নাট্যপরিচালদের কেউ এক বা একাধিক হোটেলের ব্যবসা শুরু করে দিয়েছেন, কেউ দত্তক নিয়েছেন গ্রাম, মিড-ডে মিল সরবরাহ করা হচ্ছে তাদেরই মাধ্যমে, ফলে  আনুষঙ্গিক দুর্নীতির পাঁক লাগছে তাদের শরীরে।


আর, নাটকের দল যে স্যালারি-গ্রান্ট পায় তা নিয়ে তো অপূর্ব প্রহসন; দলের বাবুর পরিচারিকা, যিনি অবসরে মনিবের গাত্রমর্দন করে থাকেন--নাট্যকর্মী, যিনি গাড়ি চালিয়ে থাকেন--নাট্যকর্মী, যিনি বাবুর একান্ত সচিবের কাজ করেন, তিনি তো অবশ্যই নাট্যকর্মী! বাবুর ছায়ায় থেকে তিনিও দল খুলে বসেছেন, সেই দলও অনুদানের আবেদন করেছে! একই বাড়িতে একই ছাদের তলায় থাকা পিতা-পুত্র উভয়েরই আলাদা-আলাদা নাট্যদল; দুজনেই অনুদানের সুবিধাভোগী, এমনও বলছেন সমালোচকরা!

 

অনেকেরই ধারণা, খুঁড়তে শুরু করলে, ‘সমাজের বিবেক’দের এলাকা থেকেও একাধিক, বড়-না-হলে-ছোট কঙ্কাল তো উঠে আসবেই! এমনকী এ-কথাও উঠে আসছে--আজ নিজের ঘরে আগুন, তাই পৌঁছে যাচ্ছেন প্রেস ক্লাবে বিবৃতি দিতে, কিন্তু যখন দেশে মাত্র ১ শতাংশ বড়লোকের হাতে দেশের ৪০.১ শতাংশ সম্পদ, বেকারত্ব-আত্মহত্যা বাড়ছে লাফিয়ে-লাফিয়ে, এই ভুক্তভোগীদের একজনও একটিও মন্তব্য করেছেন দেশের এই অস্বাভাবিক অসাম্য-বেকারত্বের বিষয়ে? তবে কেন আর্থিকভারে পীড়িত নিম্ন মধ্যবিত্ত-মধ্যবিত্ত, সাধারণ মানুষ, যারা বাংলা থিয়েটারের দর্শক (যে থিয়েটারের প্রথম সারির টিকিট এখন এক হাজার টাকায় বিক্রি হয়), সমর্থন করবে এঁদের? কেন সম্মান করবে তারকা বলে? কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রকের এই অনুদান আসলে জন্ম দিয়েছে একটি বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণির। এই শ্রেণির ভেতরে দক্ষিণপন্থীদের মতো লালসা, কিন্তু চাইছেন বঞ্চিত বামপন্থীদের মতো সম্মান!

0 Comments

Post Comment