পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

বিজেপিকে ভোট নয় কেন এটাই হওয়া উচিত একুশের ডাক?

  • 27 February, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 1851 view(s)
  • লিখেছেন : কুশল দেবনাথ
অনেকে বলছেন ‘নো ভোট টু বিজেপি’ একটি নেতিবাচক শ্লোগান। প্রসঙ্গত আমরা বলতে চাই, স্পেনে ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ে জেনারেল ফ্রাঙ্কোর বিরুদ্ধে বামপন্থী নেত্রী ডোলোরেস ইবারুরির বিখ্যাত স্লোগান ছিল ‘নো প্যাসারন’ অর্থাৎ পিছোব না, যা আজও প্রতিবাদী মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে আছে। তাই না মানে নেতিবাচক নয়, ইতিবাচকও বটে।

পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের প্রেক্ষিতে আমরা একটি রাজনৈতিক কর্মসূচী নিয়েছি, সেটা হল ‘নো ভোট টু বিজেপি’, অর্থাৎ বিজেপিকে একটিও ভোট নয়। আমরা মানে এ রাজ্যের শ্রমিক আন্দোলন, নারী আন্দোলন, মানবাধিকার আন্দোলনসহ বিভিন্ন গণ আন্দোলনের কর্মীরা গত ৪ঠা জানুয়ারি ভারতসভা হলে একটি কনভেনশনের মাধ্যমে ‘ফ্যাসিস্ট আরএসএস – বিজেপি-র বিরুদ্ধে বাংলা’ নামে একটি মঞ্চ গঠন করি। ওই মঞ্চ থেকে একটি বক্তব্য উঠে আসে — বিজেপিকে হারাও পআমরা মনে করি, শ্রেণীবিভক্ত ভারতে শাসকশ্রেণীর বহু দল আছে। বিভিন্ন শাসকদল তাদের রাজত্বকালে সাধারণ মানুষের উপর নানাবিধ আক্রমণ নামিয়ে এনেছে। কিন্তু এদের কারোরই ফ্যাসিবাদী কর্মসূচী নেই। আর এস এস – বিজেপির ফ্যাসিবাদী কর্মসূচী আছে। সেই কর্মসূচী বাস্তবায়িত করার জন্য তারা গোটা দেশে ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন চালাচ্ছে। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক —সব ক্ষেত্রেই এই আগ্রাসন চলছে।

এছাড়াও ফ্যাসিবাদের একটি নির্দিষ্ট প্রতিক্রিয়াশীল দর্শন থাকে। বহু বৈচিত্র‍্যের দেশ ভারতে এরা একটি একনায়কতন্ত্রী হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে সমস্ত কর্মসূচী গ্রহণ করছে। একদিকে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন, অন্যদিকে বিদ্বেষ বিভাজনের রাজনীতিকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, উগ্র জাতীয়তাবাদকে ভিত্তি করে জনগণকে বিভক্ত করাই এদের উদ্দেশ্য। আমাদের দেশে মুসলমানসহ বিভিন্ন ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষের উপর ভয়ানক আক্রমণ নামিয়ে এনেছে। আদিবাসী, দলিত, ছাত্র এবং নারীরাও এদের আক্রমণের লক্ষ্য। আমাদের দেশে বিভিন্ন রাজ্যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। কিন্তু ধর্ষকদের নিয়ে মিছিল একমাত্র এই দলটিই করে। ২০১৯ এ দ্বিতীয়বার লোকসভা নির্বাচনে জেতার পর নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৯ পাশ করে, যার মধ্য দিয়ে ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দেওয়াকে আইনী করা হয়। এনপিআর, এন আর সি-র মাধ্যমে বহু মানুষকে না-মানুষ করার চক্রান্ত করেছে। ৪৪টি শ্রম আইনকে চারটি শ্রম কোডে রূপান্তরিত করে শ্রমিকদের মৌলিক অধিকার তারা কেড়ে নিয়েছে। তিনটি কৃষি আইন এনে কৃষিক্ষেত্রে কর্পোরেট পুঁজির একাধিপত্যকে নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছে। কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপ করে গোটা কাশ্মীরকে কার্যত কারাগারে পরিণত করেছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলিকে কুক্ষিগত করেছে। এক কথায় ফ্যাসিবাদী কর্মসূচী রূপায়ণ করার জন্য গোটা দেশের জনগণের উপর ভয়ঙ্কর আক্রমণ নামিয়ে এনেছে। রেলসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প বেচে দিচ্ছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক খাতে ব্যয়বরাদ্দ কমাচ্ছে। মানুষ প্রতিবাদ করলেই তার উপর নানা ধরনের রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন নামিয়ে আনছে। কার্যত দেশে অঘোষিত জরুরী অবস্থা চলছে। এই প্রেক্ষাপটেই আমাদের পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনকে দেখতে হবে।

যে কেন্দ্রীয় শ্লোগান আমরা রেখেছি নো ভোট টু বিজেপি।এই বক্তব্য রাখার পর থেকেই অদ্ভুত ভাবে দেখছি সিপিএমের কর্মী সমর্থকদের একাংশ আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। বলা হলো তৃণমূলের বি টিম। চালচোরদের কাছে কমিশন পেয়েছি ইত্যাদি। এটা খুব দাঁড়ায় নি। কারন তৃণমূল আমলে আমাদের অনেকে জেলে গেছে। তাদের উপর ইউএপিএ লাগানো হয়েছে। বিভিন্ন কারখানায় শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত করতে গিয়ে পুলিশ ও তৃণমূল কর্মীদের হাতে আক্রান্ত হয়েছে।। এখন কেউ কেউ বলছেন বামেদের কেন সমর্থন করছি না আমরা? একটি প্রশ্ন আসে এ রাজ্যে বাম প্রার্থী কই? ওটা তো বাম-কংগ্রেস জোট। আর আব্বাস সিদ্দিকি এলে এই জোট হবে বাম-কংগ্রেস-আব্বাস জোট। এবার প্রশ্ন হলো বাম কে? যদি ধরেই নিই আজকের বিশ্বে বাম হবার ন্যূনতম ভিত্তি হচ্ছে নয়া উদারবাদের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামের অবস্থান গ্রহণ করা।

সেখানে সিপিএমের কার্যক্রম কি এই অবস্থানে পড়ে? সিঙ্গুর,নন্দীগ্রাম তো নয়া উদারবাদ নীতির বাস্তব প্রয়োগ। সিঙ্গুর আন্দোলনের প্রভাবে দেশের জমি অধিগ্রহণ আইন পাল্টে গেলো। তবু সিপিএমের ঘুম ভাঙ্গলো না। টাটার সাধের ন্যানো গুজরাটে মুখ থুবড়ে পড়েছে। এখানে সিপিএম ন্যানো নিয়ে কেঁদেই চলেছে। এখন সিঙ্গুর নিয়ে কাঁদছে মুকুল রায়। সঙ্ঘপরিবারের থাপ্পড় খেয়ে রোজ বলছে সিঙ্গুরে আন্দোলন করে ভুল করেছি। তার সাথে সিপিএম। আমি কিন্তু সেটিং বলছি না।

আর কংগ্রেস। ধরা যাক আজ অধীর চৌধুরীর যদি মমতা ব্যানার্জির লোকবল থাকতো, তিনি কি তৃণমূলের চেয়ে কম অত্যাচার করতেন। যেখানে বাম জমানাতেই অধীর চৌধুরী মুর্শিদাবাদে বাম কর্মীদের পিটিয়ে দল বাড়িয়েছে। ক্ষমতায় না থেকেই যে এই কাজ করতে পারে,ক্ষমতায় গেলে রাজ্যে কি তান্ডবই না চালাতো।

আর আব্বাস সিদ্দিকি!!! ফ্রান্সে মৌলবাদীরা একজনের গলা কেটেছে। বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড়। আব্বাস তখন ওই গলাকাটাকে জলসায় উচ্চস্বরে সমর্থন করছে। কিংবা নারীদের সম্পর্কে কুৎসিত মন্তব্য করছেন চিৎকার করে। ক্ষমতায় যাবার দিবাস্বপ্ন দেখে জোট করছেন করুন। কিন্তু দয়া করে ধর্মনিরপেক্ষতার শংসাপত্র দেবেন না।

কিন্তু এতদসত্বেও আমরা বলছি সঙ্ঘপরিবার-বিজেপির ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের কাছে তৃণমূল-বাম-কংগ্রেস কেউ ধারে কাছে আসেনা। সঙ্ঘপরিবার ২০২১ সালে এ রাজ্যে ক্ষমতায় যাবার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছে। জানে এখানে জিতলে ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন বাড়াতে পারবে। আর হারলে জোর ধাক্কা পাবে।

দিল্লীর আন্দোলনরত কৃষকরা যখন বলেন বাংলায় বিজেপি হারলে আমাদের শক্তি বাড়বে। বিজেপিকে বাংলায় জিততে দেবেন না। বুঝি আমাদের দেশে নজিরবিহীন কৃষক আন্দোলনের সাথে বাংলার ভোট সম্পৃক্ত হয়ে গেছে। তাই আরো জোরের সাথে বলি বিজেপিকে হারাও পথে-বিজেপিকে হারাও ভোটে। নো ভোট টু বিজেপি।

সিপিএমের কর্মী, সমর্থকরা ভাবুন বিজেপির ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনকে লঘু করে দিয়ে জনগণকে তপ্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুল্লি তে ফেলছেন না তো? না ভাবলেও ভাবার অভ্যাসটা অন্তত করুন।

আজ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এই ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই চলছে। গত বছর গুজরাটে পেপসি কোম্পানির বিরুদ্ধে কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ জমি লুঠ বন্ধ করার লড়াই সফল হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে এন আরসি- এনপিআর-সিএএ বিরোধী লড়াইয়ের ফলে ওরা জল মাপছে, বেশি এগোতে সাহস পাচ্ছে না। কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে পাঞ্জাব-হরিয়ানা-উত্তরপ্রদেশের কৃষকদের নেতৃত্বে তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে চলছে কৃষক বিদ্রোহ। দিল্লিকে ঘিরে ফেলে জাতীয় সড়ক অবরোধ করেছেন কৃষকরা। কৃষকদের আম্বানি-আদানি-জিও বয়কটের ডাকে সাড়া দিচ্ছে দেশের কোটি কোটি মানুষ। কোম্পানিগুলোর গায়ে জোর ধাক্কা লেগেছে। পাঞ্জাবে বিজেপিকে সামাজিক বয়কট করা হচ্ছে, বিজেপি নেতাদের ঘেরাও করা হচ্ছে। এতে প্রমাণ হচ্ছে যে ফ্যাসিস্ট শক্তিকে জনগণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন দিয়েই প্রতিরোধ করা সম্ভব। আমাদের রাজ্যকেও সেই পথেই এগোতে হবে আজ।

এই লড়াইয়ের অংশ হিসাবে, নির্বাচনেও যাতে ওরা জিততে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের রাজ্যের বিধানসভা ভোটে তাই আমরা বিজেপির বিরুদ্ধে স্পষ্ট ডাক দিচ্ছি। আমরা একদিকে যেমন রাস্তায় নেমে লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে এই ফ্যাসিস্ট শক্তিকে আটকাব, অন্য দিকে তেমনই ভোটেও হারানোর জন্য সাধ্যমত চেষ্টা চালাব। বাংলার সাধারণ মানুষের মঞ্চ গড়ে আমরা তাই আওয়াজ তুলেছি ‘নো ভোট টু বিজেপি। বিজেপি-কে একটি ভোটও নয়’।

আমরা মনে করি পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে বিজেপি জিতলে এই রাজ্য সহ সারা দেশে ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন বাড়বে। এই আগ্রাসন শুধু অর্থনৈতিক রাজনৈতিক পরিসরেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, গোটা বাংলার সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ভাষা ও সম্প্রীতির নানা ঐতিহ্যকেও ধ্বংস করবে। পরাস্ত হলে সেই আগ্রাসন অন্ত কিছু সময়ের জন্য ধাক্কা খাবে।

সবশেষে বলি, অনেকে বলছেন ‘নো ভোট টু বিজেপি’ একটি নেতিবাচক শ্লোগান। প্রসঙ্গত আমরা বলতে চাই, স্পেনে ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ে জেনারেল ফ্রাঙ্কোর বিরুদ্ধে বামপন্থী নেত্রী ডোলোরেস ইবারুরির বিখ্যাত স্লোগান ছিল ‘নো প্যাসারন’ অর্থাৎ পিছোব না, যা আজও প্রতিবাদী মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে আছে। তাই না মানে নেতিবাচক নয়, ইতিবাচকও বটে।

এই লেখাটি নিচের সুত্রের সংযোজিত লেখা।

https://nagorik.net/politics/why-no-vote-to-bjp/

0 Comments

Post Comment