এ এক নতুন উপদ্রব শুরু হয়েছে। বিজেপিকে ভোট দিয়ো না বলার সঙ্গে সঙ্গে, বলতেই হবে সতি-বামকে এবং তাদের পালিত বামকে (পাতি-বামকে) ভোট দাও। বুঝতেই পারছি না গত ১০ বছরে (মতান্তরে ৪৪ বছরে), এমন কোন পুণ্য কাজ করেছে সিপিএম (অর্থাৎ সতি-বাম এবং তাদের পালিত পাতি-বাম,অর্থাৎ বাম ফ্রন্ট অর্থাৎ সংযুক্ত মোর্চা), যাতে তাদের ভোট দিতে না বললে বাক্যটি অসম্পূর্ণ থেকে যায়? আরে যদিআমার ইচ্ছে হয়, তবে আমি, বিজেপিকে ভোট দিও না, বলতে পারব না? বলে থেমে যেতে পারবো না? কাকে ভোট দেবেন না এই আবেদনের সঙ্গে, এটা বলা যাবে না যে, অন্য যাকে পছন্দ ভোট দিন? এই শর্ত কবে আবশ্যিক হলো?
সিপিএম নিজেরটা নিজে বলুন, কেউ তো আপত্তি করছে না। সংযুক্ত মোর্চার প্রত্যেকে বলুন। যদিও বামফ্রন্টের অন্য পাতি-বামদের কোনদিনই ক্ষমতা ছিল না বিগ ব্রাদার সিপিএমের বিরুদ্ধে গলা তোলার। এদের সিপিএম পোষে। পোষা বাম। সে তাঁরা স্বেচ্ছায় সিপিএমের কথার প্রতিধ্বনি করছেন, করুন। কিন্তু ক্ষমতা পুণর্দখল করার আগেই কেউ যদি নির্ধারিত করে দিতে শুরু করে, অন্যদের কী কী বলিতে হইবে, সেটা গণতন্ত্রের পক্ষে খুবই বিপজ্জনক। বিজেপিকে ভোট দিয়ো না বলা মাত্র, চালচোর, চটিচাটা, বিজেপি-তৈরীর কারখানা, কাটমানিখোর, তোলাবাজ, দুর্নীতিগ্রস্ত, বলে আক্রমণ শানানো হবে কেন? এই শব্দগুলিতো বাম রাজত্বে, বা কংগ্রেস রাজত্বেও মানুষ শুনেছে। বিজেপি বলতে পারবে, আমাকে ভোট দাও। তৃণমূল বলতে পারবে, আমাকে ভোট দাও। এমনকি সিপিএম-কংগ্রেস-আব্বাসও বলতে পারবে, আমাদের ভোট দাও। কিন্তু অন্যেরা বলতে পারবে না, বিজেপিকে ভোট দিয়ো না। বললেই স্বঘোষিত বিজেপি বিরোধী শক্তির আক্রমণের মুখোমুখি হতে হবে কেন? বিজেপি নিজে তো আমাকে ভোট দাও তারস্বরে বলে চলেছে। অন্তর্লীন সাম্প্রদায়িক প্রচারে দীর্ণ করছে বাংলাকে। নাগরিকত্ব, বেসরকারীকরণ থেকে শুরু করে, করোনার অনচ্ছতা, লকডাউনের তাণ্ডব, ধ্বস্ত অর্থনীতি, কর্পোরেট প্রভুত্ব, গণতন্ত্রের পায়ুধর্ষণ, অন্ধকারের রাজত্ব কায়েমের সুবন্দোবস্ত করছে। নমো নমো করে, লোক দেখানো বিরোধিতা ছাড়া, তার বিরুদ্ধে সিপিএমের কোন ভূমিকা নেই। সে না থাকুক। যারা সিপিএম ভাষ্যে অতি-বাম, তাদের কেউ কেউ আসামে তো সতি-বাম, পাতি-বামদের সঙ্গেই মহাজোটে রয়েছে। আপত্তি একটাই , সিপিএম-এর প্রচার না করলেই সেটা তৃণমূলের প্রচার হয়ে যাবে কেন? অবশ্য চার দফা ভোট তো হয়েই গেল, মিথ্যে নোংরামি আর হত্যার নির্বাচন।
কোচবিহার জেলার মাথাভাঙ্গা বিধানসভা কেন্দ্রের শীতলকুচির ঘটনায় আমাদের ট্রিগার হ্যাপি আর্মড ফোর্স চারজন ভোটারকে পায়ে নয়, সটান বুকে গুলি করে। তারা গুলি করার আগে লাঠি-টিয়ার গ্যাস-জলকামান-রাবার বুলেট না ছুঁড়েই আসল বুলেট বর্ষণ করেছে, একথা বলা চলবে না। বলতে হবে গুলি চালানো অন্যায়, কিন্তু উস্কানি দেওয়া আরও বড় অন্যায়। বলতে হবে যারা গুলি করলো তাদের জেল হোক, কিন্তু উস্কানীদাত্রীর ফাঁসি হোক। যদি বলেন উস্কানিটা আমি শুনেছি। মমতা তো বলেছিল,“কেন্দ্রীয় বাহিনী ভোট দিতে না দিলে, মহিলারা একদল তাঁদের ঘেরাও করে রাখুন, অন্য দল গিয়ে ভোট দিন।” তাহলে আপনি অবশ্যই তৃণমূলের দালাল। প্রথমে প্রমাণ করতে হবে আপনি সতি-বাম পক্ষে, তারপর আপনার অধিকার জন্মাবে বিজেপি বিরোধিতার। ক্ষমতায় নেই, তাতেই এই দাপট। ক্ষমতায় এলে কী করবে? শীতলকুচির ঘটনার পর গোবলয়ের দল বিজেপি হমকি দিচ্ছে শীতলকুচির ঘটনা আরও ঘটবে।আর সংযুক্ত মোর্চা দায়মুক্ত বিবৃতি দিচ্ছে, তৃণমূল খারাপ, কারণ মমতা প্ররোচনা দিয়েছে। তবে বিজেপিও খারাপ, তাদের কেন্দ্রীয় বাহিনী গুলি চালিয়েছে। মমতা এবং তার দল মহিলা জনতাকে প্ররোচনা দিয়ে সিআরপিএফের আগ্নেয়াস্ত্র ছিনতাই এ উদ্বুদ্ধ করেছিল (কখন? কোথায়?) লাশের রাজনীতি করবে বলে। আর্মড ফোর্স আত্মরক্ষার্থে বাধ্য হয় সরাসরি বুকে গুলি করতে। আর সে গুলি এঁকে বেঁকে ভোটার কার্ড দেখে, শুধু মুসলিম পুরুষদের বুকে বিঁধলো। তার মানে শুধু জঙ্গী এবং জিহাদীরা ভোট দিতে এসেছিল। কেরালা থেকে ভোট দেবার নাম করে বাংলায় এসে আগ্নেয়াস্ত্র লুঠ করতে গিয়েছিল। বিজেপি এই ঘটনায় দিদির প্ররোচনা, জিহাদী পরিযায়ী শ্রমিকের জঙ্গীপনা, আর সাম্প্রদায়িক সংবেদনাকে দায়ী করেছে। আর শীতলকুচি একভাবে মমতাকেও স্বস্তি দিল, কারণ বেপাড়ার মাস্তান কেন্দ্রীয় বাহিনী গুলি চালাবে যথেচ্ছ, এটা বাঙালীর সেন্টিমেন্টে ঘা দিতেই পারে। রইলো বাকি সংযুক্ত মোর্চা। বাহাত্তরে সিদ্ধার্থ বাহিনীর নির্বাচনী হিংসা এবং সিপিএমের বিধানসভা বয়কট, ভারতীয় গণতন্ত্রে ল্যাণ্ডমার্ক। ১১০০ সিপিএম কর্মী যে কংগ্রেসী তাণ্ডবের বলি, আজ সেই কংগ্রেসকে আঁকড়ে ধরেই বামেদের ভেসে থাকতে হচ্ছে। মমতা ব্যানার্জী বাংলার রাজনীতিতে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবার পর, ২০০৭ সালে বুদ্ধদেব এবং ২০০৮ সালে প্রকাশ কারাট তাঁকে রাজনৈতিক পুনর্বাসন দিয়েছেন। বাংলায় নির্বাচনী হিংসা মমতাকালে প্রথম শুরু হয়নি। ২০০৩ সালের বাম রাজত্বে পঞ্চায়েত নির্বাচনে ৭৬ জনের মৃত্যু হয়ে ছিল। ২০১৩ তে মৃত্যু সংখ্যা ৩৯, আর ২০১৮ তে নির্বাচনী হিংসায় মৃত ২৯। শীতলকুচিতে একটি গণতন্ত্র হত্যার ঘটনার ফয়দা তুলতে ব্যস্ত সব রাজনৈতিক জোট। লাশের রাজনীতিতে লিপ্ত সব দল। সাম্প্রতিক অতীতে সুদীপ্ত বা মইদুল মিদ্দার লাশও সিপিএমকে পুনরুজ্জীবিত করেছে। কিন্তু এই ইলেকশানের বাজারে চারটি মাইগ্রেটরি লেবারের মৃত্যুতে চোখের জল ফেলার সময় কার আছে? কেউ পক্ষে, কেউ বিপক্ষে, কেউ মাঝখানে। কোন অবস্থান নিলে মুখরক্ষাও হয়, পাশাপাশি আমার ভোট বাড়ে আর বিপক্ষের ভোট কমে, এই তো হিসেব।
বলা হচ্ছে তৃণমূলকে ভোট দিয়ে জেতালেই তারা বিজেপিতে চলে যাবে। অতি-বামেরা (যেমন সিপিআইএমএল, লিবারেশন নো ভোট টু বিজেপি প্রচারের সঙ্গে আছে) টার্গেট। দলদাস নয় এমন নাগরিকেরা টার্গেট। সিদ্দিকীকে সাম্প্রদায়িক বললে টার্গেট। কিন্তু কংগ্রেসকে ভোট দিলে, সিদ্দিকীদেরকে ভোট দিলে, পাতি-বামদের ভোট দিলে, এমনকি সতি-বাম সিপিএম কে ভোট দিয়ে জেতালে, তাদের কেউ দলপাল্টাবে না, এমন গ্যারান্টি কেউ দিচ্ছেনা। কংগ্রেস, সতি-বাম, পাতি-বাম, যাদের কখনও না কখনও মানুষ ঘৃণায় বিতাড়ন করেছে, তারা আগেও দল পাল্টেছে। তৃণমূল সরকারে ছিল, তাই সেখানে গেছে। সেখান থেকে সময় সুযোগ বুঝে বিজেপিতে গেছে। কেউ কেউ সরাসরি গেছে। বিজেপি সরকার গঠনের কিছুটা আগে থেমে গেলে, তৃণমূল ফাঁকা করে সব চলে যাবে। সিপিএম যাবে, পোষা বামেদের কিনে নেবে, সিদ্দিকীর দল ভেঙ্গে যাবে (অবশ্য যদি কেউ জেতে), তবে সবার আগে যাবে কংগ্রেস।কিন্তু তৃণমূল ১৮০-৯০ পেলে বিজেপি ক্ষমতায় আসবে না। তখন তৃণরা কেউ যাবে না। বাংলায় এবং আসামে হারলে বিজেপির মাজা ভেঙ্গে যাবে। অতএব এ ভোট ঐতিহাসিক, যুগসন্ধিকালের চেতনাবাঁক। সারা ভারত বিজেপির পরাজয় দেখতে অপেক্ষা করছে। তাহলে বিজেপিকে ভোট দিতে বারণ করলে সতি-বামদের কী ক্ষতি? নো ভোট টু বিজেপি শুনলেই চিড়বিড়িয়ে উঠে অতিবাম-অতিবাম, চালচোর, চটিচাটা, কাটমানিখোর, তোলাবাজ বলে, ব্যক্তিচরিত্র নির্বিশেষে গাল পাড়ছে কেন? তাহলে কি সিপিএম বিজেপিকে হারানোর চাইতে, অনেক বেশি তৃণমূলের হার চাইছে? বিজেপি জিতলে জিতুক, কিন্তু হে মার্ক্সঠাকুর, মমতার দল যেন হারে। সব মিলিয়ে দাঁড়াচ্ছে, বিজেপিকে ভোট দিতে বারণ করা, আর সংযুক্ত মোর্চার বিরোধিতা করা সমার্থক। সংযুক্ত মোর্চার সাথীরা, সময়ের অভিশাপের জন্য প্রস্তুত থাকুন। আপনাদের জেতা হারায় কিছু এসে যায় না। বিজেপি জিতলে তার সহযোগী হিসেবে ধিক্কৃত হবেন, হারলেও। জিতলেও হারবেন, হারলেও হারবেন।