পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

সিভিক নিয়ে একচক্ষু আদালতের রোগ কি তবে অসাম্য?

  • 19 October, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 424 view(s)
  • লিখেছেন : বর্নালী মুখার্জী
কিছুদিন আগে তিলোত্তমার বিচারের শুনানি চলাকালীন, দেশের সর্বোচ্চ আদালত হাসপাতালে সুরক্ষার জন্য সিভিক ভলেন্টিয়ার নিয়োগ নিয়ে কটাক্ষ করেছিল। গতকাল দিল্লি এইমসে এক বেসরকারি নিরাপত্তা রক্ষীর হাতে ঐ হাসপাতালের এক মহিলা কর্মীর শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটেছে। যাঁরা সিভিক ভলেন্টিয়ার নিয়ে এতো নাক কুঁচকেছিলেন, তাঁদের এবার কী বক্তব্য হবে?

এক অভূতপূর্ব অসাম্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে ভারত। আয়কর দাতা এখনও ৭ শতাংশের এর কোঠায়। অর্থাৎ ১৪০ কোটির এই দেশে বছরে তিন লাখ টাকার উপরে রোজগার করে মাত্র ১০ কোটি মানুষ। ১৫ কোটি টাকার সম্পদশালী মানুষের সংখ্যা পৌনে দুই কোটি আর ৩০ কোটি টাকার সম্পদশালী মানুষের সংখ্যা ২৫ হাজার। পাঠক ভুলেও ভাববেন না এই লেখা অর্থনীতি নিয়ে। এই লেখা আরজিকর নিয়ে, সর্বোচ্চ আদালত এবং তার নির্দেশ নিয়ে। আদালত সঞ্জয় রাই-এর অপরাধ সনাক্ত করে জানিয়েছে যে সিভিক ভলান্টিয়ারদের আর ইস্কুল, হাসপতালে নিয়োগ করা যাবে না। আসলে এই নির্দেশের সাথেই সরাসরি যুক্ত ভারতের উপরোক্ত অসাম্যের চিত্রটি।

এই বেকারত্বের আর অসাম্যের দেশে, যুবক যুবতীদের বড় কাজের জায়গা হল বেসরকারি নিরাপত্তা ক্ষেত্র। প্রাইভেট এজেন্সির মাধ্যমে এরা নিরাপত্তা রক্ষী হিসেবে নিযুক্ত হয় এবং যে বিশেষ পরিবেশে তারা কাজ পাবে তার চরিত্র অনুযায়ী তাদের নাম ভিন্ন হয়। রেস্তোরাঁ বা বারে তাদের একাংশের নাম হয় বাউন্সার। এটিএম কাউন্টারে তারা দারোয়ান বা টাকা বহন করা সশস্ত্র রক্ষী। বেসরকারি কর্পোরেট হাসপাতালে তাদের একই অঙ্গে বহু রূপ। একদিকে তারা দারোয়ান, অন্যদিকে তাদের একাংশ অপারেশন থিয়েটারে রুগী ডাক্তারদের মধ্যেকার সেতু অথবা কেউ কেউ ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে চিকিৎসা সংক্রান্ত যাবতীয় সরঞ্জাম বহন করা কর্মী। আবার এরাই কখনও দীপিকা পাড়ুকোনের ব্যক্তিগত বডি গার্ড। এটিএমের বাইরে বসে থাকলে মাস গেলে বড় জোর রোজগার হয় ৭/৮ হাজার টাকা, আবার দীপিকা পাড়ুকোনের বডি গার্ড হলে সে মাস গেলে ১০ লাখ পায়। তবে নিরাপত্তা এজেন্সি গুলো হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করে। বহুজাতিক সিকিউরিটি কোম্পানিও এদেশে ব্যবসা করে।

আমেরিকাতে বহুদিন ধরেই, সরকারি খরচ কমানোর উদ্দেশ্যে প্রাইভেট নিরাপত্তা রক্ষী বাহিনী জনজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে উপস্থিত । স্কুল, হাসপাতাল, গণপরিবহন সংস্থা, ধর্মীয় ভবন সর্বত্র। সেদেশে সরকারি পুলিশ কর্মীর সংখ্যা ক্রমশ কমে যাচ্ছে। প্রাইভেট রক্ষী আর পুলিশ দেখে তফাৎ করতে পারেনা মার্কিন আম জনতা। কিন্তু এই বিষয়টা নিয়ে উদ্বেগের সাথে চর্চা চলছে সেদেশে। কারণ দেখা যাচ্ছে যে এর ফলে সুরক্ষার বদলে যেন সুরক্ষার অভাব ঘটে যাচ্ছে জনতার। গবেষণায় জানা যাচ্ছে যে আমেরিকাতে সাবেক পুলিশ কর্মী, যাদের নামে ফৌজদারি মামলা আছে বা নির্যাতনের ইতিহাসে যারা জড়িত, তারা সহজেই বেসরকারি নিরাপত্তা ক্ষেত্রে দ্বিতীয় কর্মজীবন শুরু করছেন । বেসরকারি নিরাপত্তা প্রহরীরা পুলিশের তুলনায় অনেক কম তত্ত্বাবধানে থাকে এবং তাদের লাইসেন্সিং ও প্রশিক্ষণের মান কম। ফ্লোরিডায় বেসরকারি নিরাপত্তা প্রহরী হিসেবে কাজ করা প্রায় ৩০% সাবেক পুলিশ কর্মকর্তাদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল বা তারা গুরুতর "নৈতিক চরিত্র লঙ্ঘনের" অপরাধে অভিযুক্ত। অপরাধগুলোর মধ্যে ছিল ফৌজদারি অপরাধ, যৌন হেনস্থা, খুন,  ডাকাতি, চুরি, ছিনতাই, আদালতে মিথ্যা বিবৃতি দেওয়া। অনেক পুলিশ অফিসার, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও আইনগত শাস্তি দেওয়া হয়নি, সহজেই বেসরকারি নিরাপত্তা প্রহরী হিসেবে কাজ শুরু করতে পারেন।

কিন্তু এদেশে দুর্ভাগ্যজনক ভাবে সেটুকু চর্চাও হচ্ছে না। এরাজ্যে বাইপাস সংলগ্ন যে কোনো প্রাইভেট হাসপাতালে গেলেই প্রাইভেট নিরাপত্তা কর্মীদের হরদম দেখা যায়। তারা ভয়ানক কাজের চাপে থাকে, অত্যন্ত কম বেতন তাদের, আর তাদের এমনভাবেই তৈরি করা হয়েছে যেন তারা হাসপাতালের কর্মী নয়, তারা মদের ঠেকের বাউন্সার। অথচ হাসপতালে যে কোনো কর্মীকে সংবেদনশীল হতেই হবে। দোষ তাদের নয়। এগুলোই নির্দেশ। সংবেদনশীলতার তোয়াক্কা না করে এই বেসরকারি নিরাপত্তা কর্মীদের প্রশিক্ষণ এমনই হয় যেন রুগীর পরিবার পরিজন তাদের ভয়ে তটস্থ থাকে। আহ, ঠিক এমনই স্বর্গীয় সুরক্ষা সরকারি হাসপাতালের জুনিয়র ডাক্তার চাইছে না কি? কাদের থেকে সুরক্ষা? বলাই বাহুল্য, রোগী পরিবারের থেকে সুরক্ষা । সরকারি হাসপতালে যেমন রুগী পার্টি এখনও ডাক্তার নার্সদের কাছে যেতে পারে, চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারে, সেই সুযোগ বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রায় নেই। গরিব বেকার ছেলে মেয়ে গুলোকে শাসিয়ে রাখা আছে, রুগী পার্টিকে বেশি মাথায় যেন তোলা না হয়।
এহেন স্বর্গীয় সুরক্ষা না পেয়ে সরকারি জুনিয়র সিনিয়র ডাক্তার আজ খুবই হতাশ এবং মরীয়া। সরকারি সিভিক ভলেন্টিয়ার তাদের এমন সুরক্ষা দিতে পারে না।  সিভিকদের সেই প্রশিক্ষণ বা নির্দেশ দেওয়া সরকারের পক্ষে অসম্ভব। আর তাই সিভিক ভলানটিয়ারদের নাক কুঁচকে দেখাই এদেশের ডাক্তার সহ অন্যান্য সম্পদশালীদের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি।

সরকারি ডাক্তারদের বেতন আর সরকারি হাসপাতালের রুগীদের রোজগারে আজ এমন এক তফাৎ হয়ে গেছে যে সরকারি রক্ষী বাহিনী তে ডাক্তারদের মন আর ভরছে না। সিভিকরা কথায় কথায় সেলাম ঠুকতে অভ্যস্ত নয়। তারা নিজেরা রাজনীতি করে, দল করে। ফলে তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি যত না রোগীদের উপর তার চেয়ে বেশি যেন ডাক্তার নার্সদের উপর। কিন্তু পনেরো লাখী ডাক্তারদের সাথে মুখ তুলে কথা বলবে মাসে ১৫ হাজারী রুগীর পরিবার, এটা মেনে নেওয়া মুশকিল নয় কি?

সুরক্ষা এখন এক সামাজিক স্ট্যাটাস এবং অতি ধনীদের প্রয়োজনীয়তাও বটে। এত অসাম্য হলে ধন সম্পত্তি নিয়ে আতঙ্কে থাকাই স্বাভাবিক হয়ে যায়। শাহরুখ খান যদি তার দেহ রক্ষী কে মাসে ১৫ লাখ টাকা দিতে পারেন তবে একজন সিনিয়র সার্জন অন্তত এক লাখ তো দিতেই পারেন। অতি ধনীরা সদাই ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে যে কখন সাধারণ লোক, যারা তাদের ভাষায় দুষ্কৃতি (অথবা চটি চাটা দুষ্কৃতি) তাদের সম্পদ ছিনতাই করবে। তাদের পরিবারের মেয়েরা আম জনতার টিটকারী নিয়ে চিন্তিত থাকেন। এই অসাম্য যে কোনো সময় সাধারণ মানুষকে  প্রতিহিংসাপরায়ন করে তুলতে পারে, এই ভয় তারা দিন রাত কাটায় বৈকি।

সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতিরা এই কদর্য অসাম্যের পিরামিডের উপরের স্তরে বসবাস করেন। তাই তাদেরও প্রাইভেট রক্ষী লাগে। তাই ধনঞ্জয় নামক এক প্রাইভেট নিরাপত্তা কর্মীকে খুন এবং ধর্ষণের দায়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিলেও প্রাইভেট নিরাপত্তা রক্ষীদের বহাল করাতে কোনো আপত্তি তোলেন না তারা। আজকেই দিল্লির এইমস হাসপতালে একজন নিরাপত্তা কর্মীর বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ এসেছে। কিন্তু কখনোই বিচারপতিরা রায় দেন না যে প্রাইভেট রক্ষীদের ইস্কুল আর হাসপাতাল আর এলিট হাউজিং এ নিয়োগ করা চলবে না। এমন নির্দেশ দিলে যে জজ দের জীবন যাপন অসম্ভব হয়ে উঠবে!!! তাহলে সিভিক পুলিশ কি দোষ করলো? ধর্ষণের জন্য যদি কোনো প্রফেশন নিষিদ্ধ করতে হয় তবে দুনিয়ায় কোনো প্রফেশন আর থাকবে না বোধহয়।
সিভিক দেখলেই নাক কুঁচকে যায়  তথাকথিত বামপন্থীদের। স্পষ্ট হয় যে তারাও নিজেদের ধন সম্পত্তি আগলাতে ব্যস্ত। যে দেশে যত বেশি অসাম্য সেই দেশে এই নিরাপত্তা বাহিনী কদর ততই বেশি। মার্কিন সমাজের উপরের ১% দেশের ৩৭ শতাংশ সম্পদের মালিক আর ভারতে ১ শতাংশ ‌জনসংখ্যা দেশের ৫৮ শতাংশ সম্পদের মালিক। যত সমাজে সম্পদের তফাৎ বৃদ্ধি পাবে, ততই ছোটলোকদের থেকে বাঁচতে অতি ধনীদের সুরক্ষার অভাব ঘটবে, বাস্তবে কতটা আর কতটা তাদের কষ্টকল্পনায় সেটা যদিও আলোচ্য নয়।।

0 Comments

Post Comment