বিধানসভা নির্বাচনে শুভেন্দু অধিকারীকে জয়লাভ করতে হলে বিজেপি-র কর্পোরেট বসদের শুভাশিস পেতে হবে। যার একমাত্র শর্ত, মালিকদের খুশি মতো যে কোনো জায়গায় জমি খনি জঙ্গল জল দখলের পক্ষে নিঃশর্ত সম্মতি। ফলে সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের কর্পোরেট দখলদারির বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা গণ সংগ্রামের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক ছেদ করতে হবে। আমি কিছু করিনি, করতে চাইনি; আমাকে দিয়ে জোর করে করিয়ে নেওয়া হয়েছে—এমনতর কথা বলতে হবে।
বোঝা যায়।
নন্দীগ্রামের আসনে জিততে হলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীকে শুধু এক পায়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে হুইল চেয়ারে বসে প্রচার করলে হবে না, যে কোনো ভাবে নন্দীগ্রামের কংগ্রেসি জমানা থেকে টিএমসি হয়ে বিজেপি ঘরানার শরিক গ্রামীন-মাফিয়া অধিকারী পায়রাবাবুদের বদনাম দিতে হবে, যার সম্ভবত একটা উপায় হিসাবে তিনি বেছে নিয়েছেন ১৪ মার্চ ২০০৭-এর সিপিএম-হার্মাদি হামলার সঙ্গে অধিকারীদের যুক্ত করে প্রচার তোলার কৌশল।
বোঝা যায়।
যেটা একেবারেই বোঝা যাচ্ছে না, এই সব কাদার তাল নিক্ষেপন কায়দার “খেলা”-য় সিপিএম-এর এত উল্লসিত হওয়ার কারণ কী।
প্রকৃতপক্ষে ২০০৭ সালের ৩ জানুয়ারি থেকেই নন্দীগ্রাম উত্তাল হয়ে ওঠে। সালেম-সান্তোসা গোষ্ঠীর সঙ্গে ইন্দোনেশিয়ায় বসে বুদ্ধবাবু কী চুক্তি করেছিলেন, কেমিক্যাল হাব নির্মাণের জন্য চিন থেকে দুর্নীতির অভিযোগে বিতাড়িত সেই গোষ্ঠীকে নন্দীগ্রামে সেজ মাফিক কী কী সুবিধা দেবেন বলেছিলেন, তার অনেক কিছুই এখনও অজানা। আশা করি কর্দম-মন্থনের শেষে একদিন সেই সব তথ্য জনগোচরে উঠে আসবে। কিন্তু সেদিন সেই চুক্তিপত্রে স্বাক্ষরের কথা প্রকাশ পাওয়ার পর থেকেই নন্দীগ্রামে গণ বিক্ষোভ পুঞ্জীভূত হতে থাকে। স্থানীয়ভাবে কংগ্রেস, সিপিআই, সিপিআই (এম), টিএমসি, এসইউসিআই-এর কর্মীদের তরফে প্রথম দিকে বিচ্ছিন্নভাবে, পরবর্তীকালে সংগঠিতভাবে বিরোধ শুরু হয়। বুদ্ধদেব সরকারের সরকারি আধিকারিকরা হলদিয়ার শিল্পমাফিয়া সিপিএম-এর তৎকালিক নেতা সাংসদ লক্ষণ শেঠের ছাতা নিয়ে জমির দখল নিতে গেলে তারা গ্রামবাসীর ব্যাপক প্রতিরোধের সামনে পড়ে।
তারই বদলা নিতে ১৪ মার্চ যে দিন ভর ভয়াবহ হামলা হয়, হাওয়াই চটি পায়ে পুলিশের পোশাকে যারা যথেচ্ছ গুলি চালায়, সরকারি মতে ১৪ জন খুন হয়, সেই সব ঘটনা অনেকেই সারা দিন টিভিতে চোখ মেলে দেখেছেন। আমিও কলকাতা টিভির চ্যানেলে সেই প্রদর্শন অনেক সময় ধরে দেখেছি। এও দেখেছি, স্বরাষ্ট্র সচিব প্রসাদ রঞ্জন রায় বারবার প্রেসের কাছে দুঃখ করে বলছেন, কত রাউন্ড গুলি চলেছে, কত জন হতাহত—তার কোনো সরকারি রিপোর্ট জেলা প্রশাসনের তরফে তখনও আসেনি, তাই তিনি কোনো পূর্ণাঙ্গ খবর দিতে পারছেন না। স্বভাবতই টিভিতেও সমস্ত ঘটনা দেখা সম্ভব ছিল না। একে তো সাংবাদিকদের পক্ষে সর্বত্র ওবিভ্যান নিয়ে ঘোরা কার্যত সম্ভব ছিল না। যে সব জায়গায় হয়ত সম্ভব ছিল, সেখানেও সিপিএম ক্যাডাররা ঢুকতে বাধা দিয়েছে, ক্যামেরা ভেঙে দিয়েছে, ইত্যাদি যত ভাবে পেরেছে তারা সংবাদ সংগ্রহে বাধা দিয়েছে। পুলিশ অসংখ্য আন্দোলনকারীকে গ্রেপ্তার করেছে। যাদের অনেকেই এখনও, মমতা জমানাতেও বিনা বিচারে জেল বন্দি হয়ে রয়েছেন।
তা, শুভেন্দু-মমতা তর্জা থেকে এই পুরো ঘটনার নতুন কী ভাষ্য উঠে এল?
সিপিএম ক্যাডাররা সেদিন হামলা করেনি? অন্য লোকে করে সিপিএম-এর বদনাম করেছে?
বেশ।
হাওয়াই চটি পায়ে গলিয়ে পুলিশের উর্দি পরে যারা হামলা চালাচ্ছিল, তারা কারা? অ-সিপিএম বহিরাগত গুন্ডা? শিশির শুভেন্দুরা জুটিয়ে এনেছিল? মমতার নির্দেশে এনেছিল? পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করল না কেন? চার বছর ধরে বুদ্ধদেব তারপরও কুর্সিতে বসেছিলেন, সেই সব দৃশ্যমান হার্মাদদের গ্রেপ্তার তদন্ত এবং সনাক্ত করলেন না কেন? প্রাক-তর্জা চোদ্দ বছর ধরে সিপিএম একবারও বলল না কেন—চটি পরে যাদের দেখা গিয়েছিল, তারা বাইরের গুন্ডা, টিএমসি ওদের নিয়ে এসেছিল? মমতার বিবৃতির পরেই কেন তারা এটা বলতে শুরু করেছে? আগে জানত না?
এই সব দেখে শুনে প্রদোষ মিত্তির বলতই, “ব্যাপারটা ভালো ঠেকছে না, বুঝেছিস তোপসে, লোকগুলোকে অ্যাদ্দিনেও এরা ধরতে পারল না কেন? এক জোড়া হাওয়াই চটি নিয়ে যারা এত কথা বলে, তারা এতগুলো হাওয়াই চটি এক জায়গায় দেখেও কিছু বলল না—এটা কম আশ্চর্যের নয়।”
একটা বিরাট চক্রান্তের গল্প অনেক দিন ধরেই সিপিআই (এম) বলে আসছে। চক্রান্তটা কী?
সিঙ্গুরে ন্যানো কারখানার জন্য জমি অধিগ্রহণে জবরদস্তি হয়নি? ২৪ সেপ্টেম্বর ২০০৬ বিডিও অফিসের সামনে বিক্ষোভ অবস্থান চলা কালীন, সন্ধেবেলা আলো নিভিয়ে চার দিক ঘিরে পুলিশি আক্রমণ হয়নি? অসংখ্য আন্দোলনকারীকে সেদিনও গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ? ছাত্র রাজকুমার ভুলকে গুলি করে হত্যা করেনি বামফ্রন্টের পুলিশ?
এর মধ্যে কোনটা চক্রান্ত? কাদের দ্বারা এবং কাদের বিরুদ্ধে?
সাদা ধুতি পরে বুদ্ধদেব ভটচাজ হুঙ্কার দিয়েছিলেন—“টাটার কেশাগ্রও স্পর্শ করতে দেব না!” আমরা সেই কোটেশন যত্ন করে বাঁধিয়ে রেখেছি। এখন অসুস্থ শরীরে তাঁকে যতই নিরীহ মনে করা হোক, ভদ্রলোক সাজানোর চেষ্টা হোক, ২০০৬-০৭-এ আমরা এক অন্য “ভদ্রলোক” দেখেছিলাম।
বিনয় কোঙার অনিল বসুদের অমলিন উদ্ধৃতিগুলি কাদের পক্ষে কাদের বিরুদ্ধে উচ্চারিত হয়েছিল? অনিচ্ছুক চাষিদের ব্যাপারে সুশান্ত ঘোষের অমর বাণীটি কী ছিল? চক্রই বলি, চক্রান্তই বলি, জাল ছড়ানো ছিল অনেক দূর।
সিঙ্গুরে রতন টাটার সঙ্গে যে গোপন চুক্তি হয়েছিল, তার ধারাউপধারাগুলি সিপিএমই না হয় সামনে নিয়ে আসুক। প্রকাশ্যে জানাক, টাটাকে তারা কী কী সুবিধা দিয়ে জামাই আদর করে ধরে রাখতে চেয়েছিল? সেই চুক্তি যাতে টিএমসি সরকার প্রকাশ করে না দেয়, তা আটকাতে টাটা কেন হাইকোর্ট হয়ে সুপ্রিম কোর্ট অবধি গিয়েছিল? কী যক্ষের বাণী আছে সেই চুক্তিতে?
সেই চক্রান্তও ফাঁস হোক।
একটা জিনিস মাথায় ধাক্কা দিচ্ছে। সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম ঐতিহ্য এখন মমতা ব্যানার্জীর গলাতেও কাঁটা হয়ে বিঁধছে না তো? দুটো মেয়াদ চলে গেছে। শ্রীশ্রী প্রকল্প করে জনগণের বিভিন্ন অংশকে ভিক্ষে দেবার প্রুধোপন্থী কর্মসূচিতে আম জনতা ভুলে থাকলেও কর্পোরেট চক্রকে আর ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। শুধু আন্দোলনকারীদের জেলে ভরে রেখে, দোষী পুলিশ অফিসারদের প্রোমোশন দিয়ে দলে ঢুকিয়ে কর্পোরেটকে ভোলানো যাচ্ছে না। ফলে যেভাবেই হোক, তাঁকেও এখন খয়রাতি রাজ থেকে বেরিয়ে বৃহৎ পুঁজির মালিকদের সঙ্গে বোঝাপড়ায় আসতে হবে। আজ না হোক কাল। নন্দীগ্রামের এই চণ্ডীপাঠ সেই সুদূর প্রসারী দৃকপাত কিনা কে বলতে পারে! নইলে অধিকারী পরিবারকে মমতার দল তো কম দেয়নি। ওদের বাড়ির গরু ছাগলেরও বোধ হয় সরকারি দুএকটা পদ আছে। যেমন, ধরা যাক: নন্দীগ্রাম গরুশ্রী, পূর্ব মেদিনীপুর ছাগল ভোলা, ইত্যাদি। এখন লেগে গেছে বলে দুই পক্ষ পরস্পরের দিকে কাদার গোলা ছুঁড়ছে।
তবে ইতিহাস অনেক সময় সাহায্য করে। বামফ্রন্টের ৩৪ বছরের ক্যালেন্ডার যাঁদের স্মৃতিতে উজ্জ্বল, তাঁরা নিশ্চয়ই মনে করতে পারবেন, প্রথম তিনটে মেয়াদে বামফ্রন্টও একই রকম ভাবে প্রুধোমাফিক রিলিফ কর্মকাণ্ড চালিয়েছিল। বেকার ভাতা, বিধবা ভাতা, বার্ধক্য ভাতা, ইত্যাদি। তারপর—১৯৯১ সালে মনমোহন দিল্লিতে যখন নিয়ে এলেন উদার অর্থনীতি, প্রণব মুখার্জী সই করলেন ডাঙ্কেলের নাকখতে, বিশ্বায়নের সেই ডামাডোলের বাজারে প্রভাত পট্টনায়কের বহুজাতিক লগ্নিপুঁজি বিরোধী থিসিস পড়তে পড়তেই সিপিএমও ঢুকল শিল্পায়নের অ্যাজেন্ডায়।
আর কী সাংঘাতিক সেই শিল্প বিপ্লবের শ্লোগানের গমক!
এক দিকে দমদম থেকে কল্যাণী পর্যন্ত বিটি রোড হয়ে ঘোষ পাড়া রোডের দুধারে এবং হুগলি নদীর পশ্চিম পাড়ে বিশাল বিশাল কারখানাগুলো ঝাঁপ বন্ধ করতে শুরু করল, সেই সব কারখানার দেওয়ালের ভেতরে বড় বড় আবাসন শিল্প গড়ে উঠতে লাগল, শিলিগুড়িতে চাঁদমনি চা বাগানের জমি জলের দরে কিনে সোনার দামে বেচে নেওটিয়ারা ফুলে ফেঁপে উঠল; জ্যোতির বসুর বিশেষ বন্ধু তোদির হাতে রবীন্দ্র সরোবর প্রায় চলে যেতে যেতেও থমকে গেল স্রেফ প্রাতর্ভ্রমণকারীদের একটানা জেদি বিক্ষোভের ফলে। ন্যানোর অঙ্কুরোদ্গমের মুখে বিড়লাদের হিন্দমোটর—এত বছরের মোটর কারখানা—বন্ধ হয়ে গেল। আলিমুদ্দিনের দপ্তরে কেউ তা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন না। বরং শিল্পায়ন এগিয়ে চলল ভয়ঙ্কর গতিতে।
কল্যাণী শিল্পাঞ্চল সেই ১৯৬০-এর দশকে তৈরি হয়ে আজও তিন ভাগের দুভাগ ফাঁকা পড়ে আছে। সেখানে রেল যোগাযোগ আছে শিল্পাঞ্চল ভেদ করে হুগলি নদীর ধার পর্যন্ত। কল্যাণী এক্সপ্রেস রোড তখনই ব্যারাকপুর নিলগঞ্জ পর্যন্ত সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল (এখন বেলঘরিয়ার নিমতার কাছে পৌঁছে গেছে)। ওদিকে নদীর উপর দিয়ে সেতু বয়ে রাস্তা চলে গেছে ত্রিবেণী হয়ে দিল্লি রোডের গায়ে। রতনদাকে সেই শিল্পাঞ্চলে জমি দেখানো বা দেওয়া গেল না। সালেম সান্তোসাকেও অদ্দুর ধরে আনা গেল না। তিন নদী ডিঙিয়ে নন্দীগ্রামই বোধ হয় কাছে মনে হল ওদের। যে কারখানাগুলো উঠে গেল, বন্ধ হয়ে গেল, তার একটাতেও ওদের ডেকে এনে জায়গা করে দেওয়া গেল না।
এই অবস্থায় সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম নিয়ে এত হামলে পড়া কেন—প্রশ্ন তো উঠবেই। এর পেছনেও চক্রান্ত তো ছিল অবশ্যই।
যদি শুভেন্দু-মমতার তর্জার কারণ কর্পোরেট মহাকর্ষ হয়ে থাকে, তবে সিপিএম-নেতৃত্বের পক্ষেও তা অস্বস্তির কারণ। কেন না, এই পলিমাটি বিধৌত বঙ্গভূমিতে আঞ্চলিক দল হিসাবে তাদের দল ছাড়া আর কেউ কর্পোরেটের নেক নজরে পড়ে যায়, তারা তা চাইতে পারে না। তখন টিএমসি সেই মহাকর্ষে বাঁধা পড়েনি প্রমাণ করার দায় তাদের কাঁধে এসে পড়ে বৈকি! একমাত্র এই দিক থেকেই সিপিএম-নেতাদের উল্লসিত হওয়ার কারণ বুঝবার মতো একটা ফাঁক দেখতে পাচ্ছি।
নন্দীগ্রামে সেই বছর যারা শহিদ হয়েছিলেন, খেজুরিতেও যারা মারা পড়েছিলেন, এমনকি সিপিএম-এরও যারা সেই সময় দলের প্রতি আনুগত্য দেখাতে গিয়ে জনরোষের আগুনে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন, তাঁদের সকলের পক্ষ থেকেই এই চক্রান্তের পর্দা ফাঁস করা দরকার।
ভুল করে ভুল স্বীকার করতে পারলে দোষ কেটে যায়। বামপন্থী আন্দোলনের শক্তি বৃদ্ধি পায়। ভুলটাকে আঁকড়ে ধরে রাখলে ভুলের আয়তন বেড়ে যায়! বামপন্থার সামর্থ্য কমতে থাকে।
সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম শুধু পশ্চিম বঙ্গ নয়, শুধু ভারতবর্ষ নয়, সারা পৃথিবীর শোষিত নিপীড়িত মানুষের কাছে গণসংগ্রামের একটা মাইলফলক। তাকে কালিমালিপ্ত করার বিরুদ্ধে সমস্ত বামপন্থী কর্মীদের সোচ্চার হতে হবে। সিপিএম কর্মীদের সামনেও এটা একটা সুযোগ, জনগণ এবং কর্পোরেটের মধ্য থেকে পক্ষ নির্বাচনের।