রাজ্যে কোভিড পূর্ববর্তী (২০১৯ সাল) সময়ে করা জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা বা এন.এইচ.এফ.এস -এর রির্পোটি ২০২২ সালে প্রকাশিত হলে আমরা দেখি যে গ্রামীন বাংলার ৪৮.১ শতাংশ শিশু কন্যা বিবাহিত! এছাড়াও প্রকাশিত এই সমীক্ষা রির্পোটিতে রাজ্যের মুর্শিদাবাদ(৫৫.৪), বীরভূম(৪৯.৯%), মালদা(৪৯.১%),পশ্চিম মেদিনীপুর(৫৫.৭%), পূর্ব মেদিনীপুর (৫৭.৬%) সহ অন্যান্য জেলার বিবাহিত শিশু কন্যার পরিসংখ্যানটিও রীতিমতো উদ্বেগজনক।
এতোদিন যেকোন সামাজিক সমস্যার কারণ হিসেবে সাধারন মানুষকে আমরা ধারাবাহিকভাবে ‘অসচেতন’ বলে দায়ী করে এসেছি। অসচেতনতার গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে দারিদ্র ও অশিক্ষাকে বারেবারে চিহ্নিত করেছি। যেকোন সমস্যার ক্ষেত্রে দারিদ্র ও অশিক্ষার মতো ঘটনা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে কিন্তু সেটিকে আমরা সামাজিক সমস্যার একমাত্র কারণ হিসেবে ধরে নিলে সমস্যাটিকে দেখার ক্ষেত্রে অস্বচ্ছতা থেকে যায়। কোভিড পূর্ববর্তী সময়ে করা এন.এইচ.এফ.এস রির্পোটটিতে রাজ্যের মধ্যে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা যেখানে নাবালিকা বিবাহের হার সবথেকে বেশি সেখানে জেলায় ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সের মেয়েদের শিক্ষার হার ৭৭%! অর্থ্যাৎ এরা নবম শ্রেণী বা তার বেশী পড়াশোনা করা সত্ত্বেও সেখানে এধরনের ঘটনা ঘটছে! সমস্যার কারণগুলির ব্যাপারে উদাসীন থেকে অথবা প্রচলিত ধারনার দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার ফলে কয়েক দশক জুড়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নাবালিকা বিবাহ থেকে শুরু করে যে কোন সামাজিক সমস্যার ক্ষেত্রে সাধারন মানুষকে ‘অসচেতন’ বলা একটি সামাজিক মিথ-এ পরিনত হয়েছে। সম্প্রতি সামাজিক এই মিথের তালিকায় যুক্ত হতে চলেছে কোভিড।
নারী দিবসের প্রাক্কালে প্রকাশিত কেন্দ্রীয় সরকারের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, রাজ্যের ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়েসের মেয়েরা পড়াশোনা-প্রশিক্ষন-রোজগার কোনও কিছুর সাথে যুক্ত না থেকে স্রেফ বাড়ির কাজ করেই দিন কাটাচ্ছে। যে রাজ্যে গ্রামীন বাংলার ৪৮.১ শতাংশ কন্যা শিশুর আঠের বছর বয়সের আগে বিয়ে হয় সেখানে কিশোরী-তরুণী-যুবতীদের মধ্যে অর্ধেক মেয়ে এই শ্রেণীভুক্ত হবে সেটি নতুন কথা নয়। এমন ঘটনায় বিশেষজ্ঞদের মধ্যে অনেকেই মনে করছেন যে এরজন্য বাংলায় কোভিডের ধাক্কা ও কন্যাশ্রী প্রকল্পের উল্টো ফল এর জন্য দায়ী হতে পারে। অর্থনীতিবিদ, গবেষক বা সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষেদের আশঙ্কাটি হল যে কন্যাশ্রী প্রকল্পে মেয়েরা আঠের বছর বয়েসে একটি থোক টাকা (২৫০০০ হাজার) পাচ্ছে, সেইকারনেই অভিভাবকরা কম বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন।
যেকোন সামাজিক সমস্যার সমাধানের পথ খুঁজতে হলে সমাজের নানান স্তরের ছড়িয়ে থাকা কারণ গুলি চিহ্নিত করা অত্যন্ত জরুরী। সাধারন মানুষের অবস্থা পরিস্থিতি বিবেচনা না করে সমস্যার সঠিক কারণ চিহ্নিত না হলে প্রতিরোধ গড়ে তোলার হাতিয়ারগুলি কার্যকর হয়না। আমরা ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি পুরুলিয়া একটি পিছিয়ে পড়া জেলা। তেমন উন্নাসিকরা আমাদের দেখে খানিক নাক উঁচুও করতেন বইকি। সম্প্রতি প্রকাশিত এন.এইচ.এফ.এস -এর রির্পোটিতে এমন পিছিয়ে পড়া জেলাটি অন্তত পক্ষে নাবালিকা বিবাহের ক্ষেত্রে শীর্ষ স্থানাধিকারী পাঁচটি জেলার তুলনায় পিছিয়ে আছে। পুরুলিয়া জেলায় নাবালিকা বিবাহ ৩৭ শতাংশ ও জেলায় ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সের মেয়েদের শিক্ষার হার ৬১ শতাংশ, এই পরিসংখ্যানটি দেখে অনেকে ধরেই নিলেন জেলা জুড়ে আদিবাসী মানুষের বসবাস মানে তারা খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বী। খ্রীষ্টান মানেই কি আলোকপ্রাপ্ত? ঝাড়খন্ডের দুমকা জেলায় গ্রামকে গ্রাম জুড়ে ধর্মান্তরিত খ্রীষ্টান পরিবার দেখেছি। যাদের বাড়ির দেওয়াল জুড়ে ক্রশবিদ্ধ যীশুর ছবি, সাপ্তাহিক প্রার্থনায় গির্জায় যাওয়ার পাশাপাশি নিষ্ঠাভরে নিজ নিজ ধর্মাচরন পালন বা নিজনিজ সংস্কৃতি আঁকড়েই তাদের দৈনন্দিন যাপন। ধর্মান্তরিত হওয়াতে তাদের আর্থিক অবস্থার ও তেমন কোন উন্নতি হয়েছে বলে দেখিনি। প্রসঙ্গ উঠতেই আমার মা বললেন-‘পুরুলিয়ার গ্রাম বা শহরে কটা চার্চ দেখেছো? মহাশ্বেতাদেবী আদিবাসীদের নিয়ে কাজ করেছেন যেমন তেমনি ভুলে যেও না জেলার বড় অংশ জুড়ে উৎকলদের বসবাস। উৎকলদের মেয়ের বিয়েতে কত পণ দিতে হয় জানো তো। একটা মেয়ের বিয়েতে ধারদেনা করে আশি নব্বই লাখের বেশি টাকা খরচা করতে হয়। দ্বিতীয় তৃতীয় মেয়ের বিয়ে দিতে হলে টাকা জোগাড় করতে বাবার সময় লাগবে না? চাইলেই কি মেয়ের বিয়ে দেওয়া যায়? তাই হয়তো মেয়েদের আঠের বা তার বেশি বয়সে বিয়ে হচ্ছে’। বহু বছর আগে উড়িষ্যা থেকে যেসব পরিবার পুরুলিয়া ও বাঁকুড়া জেলায় চলে এসে নতুন করে বসতি স্থাপন করেছিলেন জেলায় তারা উৎকল বলেই পরিচিত। আমার গ্রামের বাড়িতে ফোন করতেই শুনলাম- ‘জেঠিমা ঠিকই বলিয়্যেছন। চাখইরা আর বেক্যার ছ্যালিয়াদের রেট আলাদা। তবে হাই ইস্কুলের মাষ্টার, ডাক্তার এইসব নামিদামি ছ্যালিয়ারা যা খুশি পণ খুইজতে পারে। আমি জামাই করিয়্যেছি হাই ইস্কুলের মাষ্টার। পঁচাত্তর লাখ টাকা ক্যাস গুনিয়্যে দিয়েছি। বাদবাকি গয়না, বিয়াঘর খরচা ধরিয়্যে লাও।বরযাত্তি আসিয়্যেছিল দেড়শ লোক’।শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল সত্যি কি একটি সামাজিক ব্যাধি অন্য একটি সামাজিক ব্যাধি থেকে মেয়েদের রক্ষা করছে? বিষয়টি যুক্তি সঙ্গত মনে হলেও খতিয়ে দেখার তেমন সুযোগ হয়নি বরং উল্টোটাই দেখেছি।
নাবালিকাদের বিয়ে অথবা নারী পাচার নিয়ে যেসব সংস্থা কাজ করেন তাদের কাছে শুনবেন –‘বাবা মা সচেতন নয়’। মেয়ের বিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে তারা যুক্তি দেখান যে ‘আমার মেয়েটা দেখতে শুনতে ভালো, ছেলের বাড়ি থেকে বললো টাকাপয়সা লাগবে না তাই বিয়েটা দিয়ে দিলাম’। এরা কি কখনও জানার চেষ্টা করেছেন যে মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে একটা পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন হয়? শুধুমাত্র বিনা পণে বা পণের টাকা কম দেওয়ার সু্যোগ থাকায় কতজন নাবালিকা মেয়ের বিয়ে হচ্ছে সেটি দেখার সুযোগ না হলেও আজ থেকে নয় দশ বছর আগে সাড়ে তিন হাজার হাউসহোল্ড সার্ভেতে দেখেছিলাম পরিবারে তিনটি প্রজন্মের মেয়ের বিয়েতে পণ দিতে গিয়ে এক একটি পরিবার নিঃস্ব হয়ে গিয়ে পরিযায়ী শ্রমিকে পরিনত হয়েছে। কাজেই বাবা মা যদি ‘সচেতন’ হয়েও থাকেন তাহলেও কি অকাল বিয়ের মতো সামাজিক অসুখ থেকে নিজের সন্তানকে তারা আগলে রাখতে পারবেন?
মহিলারা অর্থনৈতিক কাজে যতবেশি যুক্ত হচ্ছেন গ্রাম শহর নির্বিশেষে পরিবারের গঠন, পরিবারের সদস্যদের চাহিদা পালটাচ্ছে। সেদিন একজন বলছিলেন-‘এখন আমাদের সংসারে খরচও তোমাদের মতো। তোমাদের মতো ফোন লাগে, জন্মদিনে কেক কেনার টাকা দিতে হয়। ছেলেমেয়েরা গঞ্জের বাজার থেকে চাউমিন কেনার বায়না করে। ওর বাবার একার রোজগারে এসব হয়না তাই এতোদিন ঘর মোছা বাসন মাজার কাজ করতাম। আমার হাতে যেই দুপয়সা আসতে শুরু করলো খরচা বাড়তে শুরু করলো। তাই বারো ঘন্টার কাজ নিয়েছি। এতোদিন একলা ঘরে ভাইবোনরা থাকতো কিন্তু পাড়ায় একটা ঘটনা ঘটলো। ওর বাবা ভয় পেয়ে মেয়েটা নাইনে উঠতেই বিয়ে দিয়ে দিল। আমি বারণ করি কোন সাহসে?
কয়েকমাস আগে এই সাহস না পাওয়ার কথাও শুনেছিলাম খিরাইয়ের ফুল বিক্রেতা মায়ের মুখে -‘মেয়ে লেখাপড়া করে রোজগার করবে এমন স্বপ্ন দেখি, তবে আজকাল যা সব ঘটছে। এখন ঘরে ঘরে ছেলেমেয়েরা ফোনে ফোনে প্রেম করে পালিয়ে বিয়ে করছে। বাধা দিলে বিষ খাবে বলে হুমকি দেয়। আপনারা মা বাপকে অশিক্ষিত বলবেন কিন্তু তারাই বা কি করবে? কেউ কেউ তো অঘটন ঘটায়। কাজেই মেয়ে প্রেম করছে কিংবা কোন অবিবাহিত মেয়ে গর্ভবতী হয়েছে শুনলেও বাপ মা তড়িঘড়ি মেয়ের বিয়ে দেবার চেষ্টা করে’।
গ্রামীন বাংলার অথবা বিভিন্ন জেলার নাবালিকা মেয়ের বিয়ের যে পরিসংখ্যানটি আমরা দেখছি কোভিড পরবর্তী সময়ে সেটি কি আকার ধারন করেছে সেটি জানতে হয়তো সময় লাগবে। চাইল্ড লাইনে কর্মরত কর্মীরা বারবার বলছেন যে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ের ঘটনা ঘটছে সবথেকে বেশি। যারা এর বিরুদ্ধে কাজ করছেন তারা কন্যাদের নিয়ে কন্যাশ্রী ক্লাব গঠন করেছেন, তাদের নিয়ে বিভিন্ন ধরনের খেলার দল গঠন করেছেন। কর্মীরা নিয়মিত তাদের সাথে যোগাযোগ রেখে চলেন। তা সত্বেও কন্যাশ্রী ক্লাব নিয়ে তাদের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া-‘কন্যাশ্রীর মেয়েরা নাবালিকাদের বিয়ে আটকাচ্ছে! কি যে বলেন। নাবালিকাদের বিয়ে হলে কন্যাশ্রী ক্লাবের মেয়েরা হয়তো বাবামায়ের বিরুদ্ধে যেতে পারছে না কিন্তু নিজেরাই তো আঠের বছর বয়েসের আগেই পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করছে’। দিনকয়েক আগে পূর্ব মেদিনীপুরের একজন কর্মী এইসব ১৩ থেকে ১৭ বছর বয়সের কন্যাশ্রীদের তথ্য পাঠালেন যারা বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছে। অথচ কয়েকবছর ধরে কন্যাশ্রী ক্লাব নাবালিকা বিয়ে প্রতিরোধে কাজ করছে এমন আংশিক সত্যকে আমাদের সামনে তুলে এনে সাংবাদিক বন্ধুরা আমাদের ক্রমাগত ভুল বুঝিয়ে আসছেন। রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে থাকা চাইল্ড লাইনের কর্মীরা বলছেন –‘প্রশাসনের বিভিন্ন স্বরে যোগাযোগ থাকা সত্বেও আমরা তিরিশ থেকে চল্লিশ শতাংশ ক্ষেত্রে খবর পাই। ব্লকের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা গ্রামগুলোতে কি ঘটছে তার খবর পাওয়া ওদের পক্ষে সম্ভব? বন্ধুওবান্ধব বা আত্মীয়দের ক্ষেত্রে এক দুটো ঘটনা কন্যাশ্রীর মেয়েরা জানতে পারে কিন্তু সেটিকে নিয়ে মিডিয়া যেভাবে লাফালাফি করে সেটা বাড়াবাড়ি’। বাড়াবাড়ি সেটা টের পাই কিন্তু এনিয়ে সাধারন মানুষের কথা যদি ছেড়েও দিই যারা সামজিক সমস্যা নিয়ে রীতিমতো খোঁজখবর রাখেন চর্চা করেন তারাও অনেক সময় কন্যাশ্রীর ভূমিকা আছে বলে বিশ্বাস করেন। সন্ধিহান মন বলে তবে কি এটি একটি সচেতন প্রয়াস?
আমরা বিত্তবান তাই অনায়াসে একটি সম্ভাবনার কথা বলছি যে কন্যাশ্রী প্রকল্পে একটি থোক টাকা (২৫০০০ হাজার) পাচ্ছেন বলে অভিভাবকরা কম বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিচ্ছেন। গ্রামেগঞ্জে মেয়ের বিয়ে আয়োজন দেখেছেন কখনও? শুনলেন না চাউমিন, দামি মোবাইল, জন্মদিনের কেকের কথা। গরীব বলে কি আজকের বাজারে ২৫০০০ হাজার টাকা ‘ফিরি’(ফ্রী)তে পাবে বলে সেই ভরসায় অভিভাবক মেয়ের বিয়ে দেবার কথা ভাববে? খবরের কাগজের সম্পাদকীয় কলমে নাবালিকা বিবাহ সক্রান্ত প্রবন্ধটি প্রকাশিত হলে বন্ধুরা ফোন করলেন –‘ভাগ্যিশ বাংলা করে বলোনি। কন্যাশ্রী প্রকল্পকে উহ্য রেখে যা সব বললে আমাদের বুঝতে অসুবিধে হলোনা যে প্রকল্পটি ফ্লপ হয়েছে’। কথাটি সত্যি যে বাংলা করে বলিনি কিন্তু প্রশ্নটি এই যে সেটি কি কারো জানতে বাকি আছে? বিশেষ করে গ্রামবাংলার দাতা গ্রহীতা থেকে শুরু করে আমজনতা প্রত্যেকে জানে বিবাহিত অবিবাহিত মেয়েদের কন্যাশ্রী প্রকল্পকে টাকা পাওয়ার কথা। অথচ কারা যেন রাজ্যকে পুরস্কৃত করে ফেললেন! কারা যেন গবেষনায় কন্যাশ্রী প্রকল্পের সাফল্যও দেখতে পেলেন!
কোভিডের মতো মহামারীর অছিলায় স্মার্ট ফোনের সংখ্যা বৃদ্ধি হয়েছে আমাদের কন্যাশ্রী পুত্রশ্রীদের হাতে। তারই সৌজন্যে গণহারে মেয়েদের আলাপ হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া, আত্মীয় বন্ধুদের সাথে। সহজেই যোগাযোগ প্রেম আর বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করার মতো ঘটনা ঘটছে। কাজেই অভিভাবকরা মেয়ের প্রেম বা সম্পর্কের কথা জানতে পারলেই ১৪ থেকে ১৭ বছর বা তার বেশি বয়সের মেয়ের তড়িঘড়ি বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করছেন। সরকারি বেসরকারি সংস্থা যারা নাবালিকা বিয়ে প্রতিরোধে কাজ করছেন তারা স্বীকার করছেন যে ‘যতোগুলো ইনটারভেনশেনে যাই তার দশ শতাংশও বিয়ে আটকানো যায় না। মুচলেকা লেখানো হৈহট্টগোল করে একটা কেওয়াস হয় মাত্র। ব্যাপারটা থিতু হলেই মেয়েকে আত্মীয় বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বিয়ে দেয়’। রাজ্যজুড়ে চাইল্ড লাইনের কর্মীরা বলছেন নাবালিকা বিয়ের ক্ষেত্রে পালিয়ে বিয়ে করার সংখ্যা বেশি। পাচারকারীর ফাঁদে বাচ্চারা সহজেই ধরা দেয়। এদের মধ্যে কিছুজনকে চাইল্ড লাইনের কর্মীরা পাচারকারীদের হাত থেকে রেশকিউ করতে পারেন কিন্তু বাকিরা? গ্রামেগঞ্জে পাচার সংক্রান্ত খবর বা নাবালিকাদের বিয়ের ব্যাপারে কিন্তু সকলে মুখে কুলুপ আঁটেন। সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থেকে আর যারা কুলুপ আঁটেন তারা হলেন শিক্ষকশিক্ষিকারা। তাদের স্কুলের কোন ছাত্রীর বিয়ে হবে সেই খবরটি সাধারনত তারা পান। বেসরকারী সংস্থার কর্মীরা বলছিলেন-‘স্কুল যখন দেখে তাদের বেশ কয়েকজন ছাত্রীর বিয়ে হচ্ছে তখন তারা স্কুলে ক্যাম্প করার জন্য আমাদের ডাকে’। চাইল্ড লাইনের কর্মীরা সেই ক্যাম্পে নাবালিকা বিয়ে প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ফোন নম্বর, সরকারী প্রকল্প, আইন ইত্যাদি বিষয়ে জানানো ছাড়াও পাচার সংক্রান্ত ভিডিও ক্লিপিং, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়গুলি আলোচনা করেন। মানুষ গড়ার কারিগরদের কাছে আমার বিনীত প্রশ্ন- যবে আমার ঘরে আগুন লাগবে তবে আগুন নেভাতে জলের খোঁজ করবো? নাকি আগুন যাতে না লাগে তার প্রস্তুতি নেবো? আপনি কি মনে করেন একদিন দুদিনের ওই ক্যাম্পে এমন গুরুতর বিষয়ে নাবালিকা সাবালিকাদের মোটিভেট করা যায়? নাবালিকাদের বিয়ের খবরে সরকারী আধিকারিকদের সাথে চাইল্ড লাইনের কর্মীরা ইনটারভেনশনে যাচ্ছেন। নিয়মিত গ্রাসরুট লেবেলের কর্মীদের সাথে যোগাযোগ রেখে আন্তরিকভাবে শিশু কন্যাদের বিয়ের খবর যোগাড় করার চেষ্টা করছেন। তাদেরকে গ্রামবাসীর প্রবল প্রতিরোধের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। আমরা তো ধরেই নিয়েছি যে গ্রামবাসী অসচেতন কাজেই থানা পুলিশ করলেও সেই মুচলেকা লেখান হলেও হৈহট্টগোল কেওয়াস হবে আবার রাতের অন্ধকারে চুপিসারে বিয়েটাও হবে। আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি যে প্রতিরোধের নামে একেবারে বিয়ের আসরে গিয়ে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তি, পুলিশসহ লোকজন নিয়ে হামলা করার পদ্ধতিটি কার্যকরী কিনা। দরিদ্র বা মধ্যবিত্ত ‘কন্যাদায়গ্রস্ত’ আয়োজক পিতা প্রতিবেশী গ্রামবাসীদের সমর্থন পাবেনই। আর এই সমর্থনটুকু পান বলেই রাতের অন্ধকারে অথবা আত্মীয়বাড়িতে গিয়ে নাবালিকা মেয়েটির বিয়ে দেন। সেই কারণেই হয়তো নাবালিকা বিবাহ প্রতিরোধে কমিউনিটি পার্টিশিপেশনকে সুনিশ্চিত করতে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য জীবিকা মিশনের ‘আনন্দধারা’ প্রকল্পের অধীনে রাজ্যে ১০.৪৫ লক্ষ স্বনির্ভর গোষ্ঠির সংযুক্তিকরন, কন্যাশ্রী রুপশ্রীর মতো সরকারি প্রকল্প, সরকারি বেসরকারি সংস্থার মাঠে নেমে প্রতিরোধ, চাইল্ড লাইন কর্মীদের সচেতনতা শিবির সবকটি প্রচেষ্টা যে ব্যর্থ তার প্রতিফলন দেখতে পাই রাজ্যজুড়ে অকাল বিয়ের পরিসংখ্যানটিতে। পুলিশ নিয়ে গিয়ে বিয়ে ভন্ডূল করে কিংবা মেয়ে পাচারের ভিডিও ক্লিপিং দেখিয়ে না বাবা মা না ছেলেমেয়ে কাউকেই মোটিভেট করা যাবেনা। কাজেই যতদিন না অকাল বিয়ে প্রতিরোধের হাতিয়ারগুলি মজবুত হবে প্রশাসকসহ রাজনৈতিক ব্যক্তিরা যতদিন না স্বচ্ছতার সাথে কন্যাশ্রী রুপশ্রী প্রকল্প বিতরণে সততা দেখাবেন ততদিন কোভিড পূর্ববর্তী হোক বা কোভিড পরবর্তী নাবালিকা বিবাহের তালিকাটি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে দেখবো।