পূর্ব প্রসঙ্গে ফিরে যাই। বেকার ভাতার সেদিনের সেই ঘটনা, সেদিনের সেই প্রচেষ্টা, সেগুলি যদি আত্মমর্যাদার সমতুল্য হয়, তাহলে আজকে যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়েই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই যে তথাকথিত উন্নয়নের চাকা ঘোরাচ্ছেন, সেই জায়গা টাকে যখন উপহাস করা হয় একদম রকের ভাষায়, বলতে গেলে 'খিল্লি' করা হয়, তখন কিন্তু যে অংশের মানুষ, আমার- আপনার করের টাকাতে সরকারের থেকে এই সুযোগ-সুবিধাগুলো পাচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে অপমান আত্মমর্যাদার, তাঁদের প্রতি অসম্মান-- এই জিনিসগুলো এমন একটা প্রবল আকার ধারণ করে, যেটা ওই গরিব মানুষ, শ্রেণী অবস্থান অনুযায়ী, যাঁদের বামপন্থী শিবির ভুক্ত থাকারই কথা, তাঁরা কিন্তু বামপন্থী সভা সমিতিতে ভিড় জমালেও, ইভিএম এর বোতাম টেপার ক্ষেত্রে অনেক ক্ষেত্রেই বামপন্থীদের প্রতি সদর্থক ভূমিকা পালন করতে চাইছেন না।
নির্বাচনের এই ধরনের হতাশা ব্যঞ্জন ফলের পর সিপিআই(এম ) দলের রাজ্য সম্পাদক মহঃ সেলিম গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে খুব স্পষ্ট ভাষাতেই বলেছেন, রাজ্য সরকার যে ধরনের ভাতা ইত্যাদি দেয়, বিশেষ করে লক্ষ্মীর ভান্ডার, এগুলিকে ঘিরে প্রকৃত কোনো বামপন্থী উপহাস সূচক কোনো কথা বলতে পারেন না। যারা এই ধরনের উপহাস সূচক কথা বলেন, তারা আর যাই হোক বামপন্থী নন ।
এ কথাটা নির্বাচনী বিপর্যয়ের পরেও বলবার মতো হিম্মত যে সেলিম দেখাতে পেরেছেন, এটা বর্তমান সময়ে রাজনীতির প্রেক্ষাপটে সত্যিই একটা ব্যতিক্রমী বিষয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আজ যে রিলিফের জায়গাগুলি তৈরি করেছেন, সেগুলো অদূর ভবিষ্যতে মানবসম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রে কতখানি সুদূর প্রসারী প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ এবং সংশয় থাকা সত্ত্বেও, এ কথাটা স্বীকার করতেই হয়, সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে গরিব মানুষ, তাঁরা কিন্তু হাতে গরম সুবিধের বিষয়টিকে, দীর্ঘমেয়াদি সুবিধের থেকেও, অনেক বেশি গুরুত্ব দেন। আর গুরুত্ব দেন বলেই এককালে যে মানুষ ভূমি সংস্কার, অপারেশন বর্গা ইত্যাদির ফলে নিজেদের অর্থনৈতিক জীবনে একটা ইতিবাচক মোড় ফেরাতে পেরেছিলেন, সেই মানুষই, যাঁরা অর্থনৈতিকভাবে আজও তাঁদের দুরবস্থাকে সেভাবে কাটিয়ে উঠতে পারেননি, তাঁরা কিন্তু বামপন্থীদের সভা সমিতিতে ভিড় জমান। কিন্তু ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বল্প মেয়াদী সুযোগ-সুবিধাগুলির প্রতিই তাঁদের আস্থা বেশি করে প্রকাশ করেছেন
আসলে মধ্যবিত্ত সমাজে অবস্থান করা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা গরিব মানুষদের খানিকটা কৌতুকে করুণায় দেখতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। গরিব মানুষের নাড়ীর প্রতি যে টান, সেটা কিন্তু মধ্যবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত অন্তর থেকে সেভাবে উপলব্ধি করতে পারে না। তার মানে এই নয় যে ,লোক দেখানো টালির চালে বাস করে, গরিব মানুষের প্রতি যথার্থ কোনো অন্তরের টান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনুভব করেন। সেটা যদি তিনি অনুভব করতেন, তাহলে এই ভয়াবহ চাকরি দুর্নীতি হত না। রাজ্য সরকারের অন্তর্গত প্রত্যেকটি নিয়োগ ঘিরে এই ধরনের বিতর্ক তৈরি হতো না। কিন্তু এসব সত্ত্বেও, খুব ভালো রকম কোনো পেশাদার পরামর্শদাতার পরামর্শ অনুযায়ী এই যে নানা ধরনের সরকারি অনুদানের ব্যবস্থা মমতা করেছেন ,সেগুলি কিন্তু তাঁকে এত ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ সত্ত্বেও একটা নির্বাচনী সাফল্য বারবার দিয়ে চলেছে।
বামপন্থীদের এই ফলের জন্য অনেকে সরকারে থাকাকালীন একাংশের বামপন্থী নেতাকর্মীদের আচার-আচরণ, বিশেষ করে এক ধরনের ক্ষমতার মদমত্ততাকে দায়ী করে থাকেন। কিন্তু মানুষের স্মৃতি ১০ বছর, ১৫ বছর আগের ঘটনাক্রমকে ঘিরে এতটা আবর্তিত হয় না, যার জেরে, তাঁরা একের পর এক নির্বাচনে বামপন্থীদের আইনসভায় ঢুকবার মতো সুযোগই তৈরি করে দেবেন না। রাজনীতিকদের ব্যবহার আচার-আচরণ এটাই যদি সাধারণ ভোটারদের, ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে সবথেকে বড় অনুঘটকের ভূমিকা হিসেবে দেখা দিতো, তাহলে হলফ করে বলতে পারা যায় যে, তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা কর্মীদের ব্যবহার এবং তাদের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ ঘিরে সাধারণ মানুষের যে ধারণা, ট্রেনে- বাসে- ট্রামে, মানুষ যেভাবে আজকে খুল্লামখুল্লা ভাবে সোচ্চার হয়েছে, তার নিরিখে তৃণমূল কংগ্রেসের তো ভোট পাওয়ার ই কথা নয়।
সাধারণ মানুষ, যাঁরা হয়তো রাজনীতিগত ক্ষেত্রে অত বেশি সচেতন নন। প্রথাগত শিক্ষার বিস্তৃত সুযোগ-সুবিধা যাঁরা পাননি। তাঁরা কিন্তু ভোট দেওয়ার আগে সবথেকে বেশি বিবেচনা করতে শুরু করেছেন ,এখন কোন্ অবস্থার মধ্যে থাকলে, আমরা খুব কম পরিশ্রমে, অনেক টাকার মালিক হতে পারব। আর সামাজিক আচার-আচরণ তৈরির চাবিকাঠিটাও আমাদের হাতে থাকবে।
এই বিষয়গুলি নিয়ে সাধারণ মানুষের চেতনার স্তরটিকে বিগত ২০-২৫ বছর ধরে, শান দেওয়ার যে কাজ, সেটা কিন্তু সেভাবে হয়নি। আর হয়নি বলেই সাধারণ মানুষ কিন্তু এখন বৃহত্তর কোনো পরিকল্পনা, যে পরিকল্পনার মধ্যে দিয়ে আমার নয়, আমার সন্তানেরও নয় ,আমার নাতি নাতনিদের প্রজন্মের উন্নতি ঘটতে পারে ,এমন বিষয়কে কেন্দ্র করে ভোট রাজনীতির ক্ষেত্রে নিজেদের ভাবনা চিন্তাকে পরিচালিত করবে, সেই অবস্থাটা কিন্তু এখন আর নেই।
ছয়ের দশকের সাধারণ ভোটারদের যে মানসিকতা ছিল, সেই মানসিকতার প্রতিফলন আমরা দেখেছি সাতের দশকে। সাধারণ মানুষের উপর, সমাজের অভিজাত আর মধ্যবিত্ত, যাঁদের সঙ্গে শাসকের সম্পর্কটা খুব নিকট চিরদিন থাকে, সেই অংশের যে দ্বন্দ্ব ,সেই অংশের যে সংঘাত, তার প্রতিফলন কিন্তু আমরা সাতাত্তর সালের নির্বাচনে দেখতে পেয়েছিলাম। সেটা দেখতে পেয়েছিলাম বলেই জরুরি অবস্থা জনিত পরিবেশ পরিস্থিতি সাধারণ মানুষকে এতটাই ক্ষোভ-বিক্ষোভের কিনারে এনে দাঁড় করাতে পেরেছিল ,যার জেরে বামপন্থীরা শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিল ।
সাধারণ মানুষের হাতে ক্ষমতা সিংহভাগ তুলে দেওয়ার যে রাজনৈতিক মানসিকতা নিয়ে জ্যোতি বসু ,প্রমোদ দাশগুপ্তদের মতো প্রজন্মের বামপন্থী নেতৃত্ব আন্দোলন করেছিলেন, তার ফলশ্রুতি হিসেবে তাঁরা সরকার তৈরির পরে ,সেই আন্দোলনের মূল বিষয়গুলির প্রতিফলন সমাজে ঘটানোর জন্য আন্তরিক উদ্যোগ নিয়েছিলেন ।আর সেই উদ্যোগের ফলে ক্ষমতা আর অর্থনীতির বিকেন্দ্রীকরণ এমন একটা জায়গায় চলে গেল যে, গ্রামের একটা হা অন্ন মানুষও নিজেকে দেশ পরিচালনার একটি অঙ্গ হিসেবে ধরে নিতে পারলেন। প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেন।
পঞ্চায়েত ব্যবস্থা বামফ্রন্টের আগে যে পশ্চিমবঙ্গের বুকে ছিল না তা নয়। কিন্তু সেই পঞ্চায়েত ছিল নামেই একটা গণতান্ত্রিক বিষয়। কার্যক্ষেত্রে সেই পঞ্চায়েতগুলি ছিল আমলাতন্ত্রের দ্বারা পরিচালিত। বামফ্রন্ট কিন্তু পঞ্চায়েতের সংস্কারের ক্ষেত্রে আমলাতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে, মানুষের হাতে ক্ষমতা তুলে দিলেন। এ নিয়ে কায়েমি স্বার্থান্বেষী সমাজ বহু ধরনের কটুক্তি বামপন্থীদের প্রতি করেছে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের প্রথাগত শিক্ষা নিয়ে অনেক ধরনের কটুক্তি বামপন্থীদের শুনতে হয়েছে। কিন্তু বামপন্থী নেতৃত্ব একটি বারের জন্য নিজেদের সেই আদর্শগত অবস্থান থেকে সরে আসেননি। আর সরে আসেননি বলেই একটা দীর্ঘ সময় ধরে একেবারে ভুমিস্তরে বামপন্থী রাজনীতির শিকড়টা কিছুটা হলেও বিস্তার লাভ করতে পেরেছিল। কিন্তু সেই বিস্তারের মধ্যে সময়ের নিরিখে যেভাবে ভিন্ন শ্রেণি অবস্থানের মানুষ ছদ্মবেশে ঢুকে পড়তে শুরু করে, সেটাকে আটকানোর ক্ষেত্রে যে রাজনৈতিক উদ্যোগ বামপন্থীতে নেওয়া দরকার ছিল, সেটা যে কোনো কারণেই হোক তাঁরা নেননি।
ফলে ধীরে ধীরে যে শ্রেণীশত্রুকে ক্ষমতাচ্যুত করে, সর্বহারা অংশ পঞ্চায়েতের পরিচালক হয়েছিল, অতীতের সেই শ্রেণীশত্রুরাই আবার সর্বহারা সেজে, নিজেদের মন মানসিকতা, রাজনৈতিক চেতনার এতটুকু পরিবর্তন না ঘটিয়ে,পঞ্চায়েত গুলি দখল করে। ফলে আমরা বহিরঙ্গ থেকে দেখতে পেয়েছি হয়তো বামপন্থীদের দ্বারা পরিচালিত পঞ্চায়েত , কিন্তু অন্তরঙ্গে দেখা গেছে, সেই সমস্ত পরিচালকদের মন মানসিকতার সঙ্গে শ্রেণী সংগ্রামের রাজনীতির কোথাও কোনো সংযোগ নেই।
একই অবস্থা হয়েছে ধীরে ধীরে স্থানীয় প্রশাসন গুলির মধ্যে ও। আজকে যখন সংসদীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে। বামপন্থীরা ক্রমশ কোনঠাসা হয়ে পড়ছে, তখন কিন্তু ওই বহুরূপী সম্প্রদায়, যারা একটা সময় শ্রেণীশত্রু হিসেবেই কাজ করেছে, মানুষের প্রকৃত মঙ্গলের ক্ষেত্রে যাদের কোনো রকমের দায়িত্ব, ইচ্ছা, কোনো কিছুই ছিল না, সেই অংশই আবার শাসনের মৌতাত পাওয়ার জন্য ছদ্মবেশ ধরে গিয়ে ভিড় জমিয়েছে প্রগতিশীল শিবিরে। বামপন্থী শিবিরে ।
খুব স্বাভাবিকভাবেই সেই অংশের কিছু লোক আজও বামপন্থী সভা সমিতিতে যায়। এমনকি তাদের সঙ্গে শত্রু শিবিরের যোগাযোগের ও নানা ধরনের অভিযোগ ওঠে। এই মানুষেরাই ভোট রাজনীতির ক্ষেত্রে শত্রুশিবির কে উৎসাহিত করে বামপন্থীদের প্রতি সমর্থন না দেওয়ার জন্য।