চিনের সঙ্গে সীমান্তে ভারতের দ্বৈরথ চলছে, বেশ কিছু দিন ধরে। তাহলে ভারত কি যুদ্ধে যাচ্ছে? এরকম অনেক প্রশ্ন অনেকের মাথায় ঘুরছে? ভারত কি পারবে এতো বড় শক্তিধর একটা দেশের সঙ্গে যুদ্ধ করতে? করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ভুলে অনেকেই প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে যুদ্ধে যাবার উন্মাদনায় ভুগছেন। কিন্তু সত্যিই কি যুদ্ধ হবে? নাকি ভারত সরকার যেভাবে বেশ কিছু চাইনিজ মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন নিষিদ্ধ করছেন তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখবে নিজেদেরকে?
প্রথমে জেনে নেওয়া জরুরী এই পাবজি আসলে কিরকম ধরনের খেলা? সরকার কেন এই খেলাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলো? এর মধ্যেও কি কোনও রাজনীতি আছে? এর পিছনেও কি কোনও উদ্দেশ্য আছে? নাকি সরকার চীনকে শিক্ষা দিতেই এই কাজটি করলো?
এই পাবজি খেলা কিন্তু অনেকদিন ধরেই চলছিল। একদল আরেকদলকে মারছে। একজন আরেকজনকে নির্দেশ দিচ্ছে হেডফোনে ‘একটু বাঁদিক চেপে যা, সামনে নিচু জায়গায় বসে আছে আসল শত্রু’। অন্যজন তাঁর নির্দেশ পালন করছে রাস্তায় চলতে চলতে। প্রয়োজনমত আরও কাউকে কাউকে ডেকে নিচ্ছে তাঁকে সাহায্য করার জন্য। খেলা চলছে। শত্রু চিহ্নিত করা চলছে। বেশীর ভাগ সময়েই এই শত্রুরা সেই অর্থে ‘দেশের শত্রু’ আর যারা খেলছে তাঁরা সবাই দেশপ্রেমিক। অনেকেই হয়তো খেলাটা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন, কিন্তু খেলা চলছিল স্মার্টফোনে। দেশের একটা বড় অংশ এই খেলাতে মগ্ন। যাঁদের বয়স মূলত ১৫ থেকে ২৫। যাঁদের কথা ছিল দুঃসহ স্পর্ধা দেখানোর তাঁদেরকে নেশাগ্রস্ত করে রাখা হয়েছিল এই খেলা দিয়ে, যার নাম ‘পাবজি’ বা ‘প্লেয়ারস আনআইডেনটিফায়েড ব্যাটেল গ্রাউন্ড’। যেখানে কেউ কাউকে চেনে না কিন্তু সবাই শত্রুকে চেনে।কখনও কখনও একটা অলীক চরিত্র এসে বলে যাচ্ছে কেন এই শত্রুদের মারা উচিত। শুধু এটা নয় আরও বেশ কিছু এরকম খেলা মোবাইলের জন্য তৈরি হয়েছে যা আরও সরাসরি দেশপ্রেমের কথা বলছে যেমন ‘কাউন্টার স্ট্রাইক’, ‘ফোরটনাইট’ ইত্যাদি যা আরও সরাসরি জাতীয়তাবাদ প্রচার করছে। যদিও বেশ কিছু রাজ্যে এই খেলাগুলো নিষিদ্ধ তবুও যেকোনো নিষিদ্ধ বস্তুর তো আকর্ষণ বেশী হয়। তাই খেলা চলছে আর খেলার মধ্যে দিয়ে কখন আমাদের অজান্তেই আমরা হয়ে উঠছি জাতীয়তাবাদী।
পাবজি সহ আরও ১১৮ টি চাইনিজ অ্যাপ ব্যান করা হয়েছে। যদিও পাবজি চাইনিজ মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন নয়, তাহলে অনেকে ভাবতে পারেন তাহলে কি দেশের সরকার সত্যিই বদলাচ্ছে নিজেকে? নিজেদের আর জাতীয়তাবাদী দেখাতে চাইছে না? না তা নয়। আসলে যারা ফেসবুক করেন, তাঁরা নিশ্চিত খেয়াল করেছেন যে আরও বেশ কিছু অনলাইন খেলা এসেছে যেগুলোকে সামনে আনার চেষ্টা চলছে। তার একটি দুটির নাম বললে হয়তো অনেকেই বুঝতে পারবেন। অনলাইন রামি খেলা, বা এমপিএল এর অনলাইন ক্রিকেট এরকম বেশ কিছু মোবাইল অ্যাপ নিয়ে অনেকেই মগ্ন হয়ে আছেন। এর পাশাপাশি আরও একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় তা হলো, এই অনলাইন খেলাগুলোর বিজ্ঞাপণ সাধারণ মিডিয়াতেও আসছে। বিভিন্ন সিনেমা যেগুলো ইদানীং কোভিডের কারণে হলে রিলিজ হচ্ছে না, দেখা যাচ্ছে সেগুলোরও প্রযোজনায় এই অনলাইন খেলাগুলো থাকছে। আরও কিছু বিষয় খেয়াল করার প্রয়োজন। ইদানীং রাস্তাঘাটে বড় বড় বিলবোর্ডে ফেসবুক এবং হোয়াটসআপের বিজ্ঞাপণ দেখা যাচ্ছে। তার বয়ান মুলত এটাই ‘ মন খুললেই পৃথিবী খুলে যাবে’। আসলে ঠিক উল্টো কথা বলা হচ্ছে, মানুষকে আরও স্মার্টফোনমুখী অর্থাৎ ঘরমুখো বানানোর চেস্টা চলছে। মহাভারতে ছিল দ্যূতক্রীড়া অর্থাৎ জুয়াখেলা। সমাজে এখনও এই বিষয়ে প্রচুর খারাপ ধারণা আছে, এই অনলাইন খেলাগুলোকে মোবাইলের মধ্যে দিয়ে এনে এগুলোকে মান্যতা দেওয়ার জন্যই কি এই ধরনের খেলাগুলোকে আরও বেশী বেশী বিজ্ঞাপণ দেওয়া হচ্ছে? অনেকে ভাবতে পারেন পাবজি দিয়েও তো কমবয়সী যুবকদের ঘরে বা সেই অর্থে ফোনে বুঁদ রাখা যেত, তাহলে অন্যগুলো চলতে দিয়ে এটাকে নিষিদ্ধ করার কারণ কি ?
আসলে রামি, বা এমপিএল এগুলোর সঙ্গে সরাসরি টাকার সম্পর্ক আছে। এগুলো পয়সা দিয়ে খেলতে হয় , যেভাবে বিজ্ঞাপণ দেওয়া হচ্ছে সেভাবে সবাই টাকা জেতে, বিষয়টা ততটাও সোজা নয়। যেকোনও বিজ্ঞাপণ দেওয়া হয় আকর্ষণ করার জন্য, তাই যে বয়সী মানুষদের জন্য যা প্রয়োজন সেভাবেই উৎকোচ সাজানো হচ্ছে। যারা টাকা খরচ করতে পারবেন তাঁদের জন্য এগুলো, আর যারা পারবেন না, তাঁদের জন্য পাবজি বা ওই জাতীয় কিছু। তাহলে পাবজি নিষিদ্ধ করার কারণ কি? শোনা যাচ্ছে যে রিলায়েন্স এখানে কিছু নতুন বিনিয়োগ করতে চাইছে। কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী তাঁর ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে দেশীয় প্রযুক্তির কথা বলেছিলেন, কিন্তু সেটার মানে যে রিলায়েন্সের প্রযুক্তি সেটা হয়তো অনেকেই বোঝেননি। আস্তে আস্তে এই তথ্যও সামনে আসছে, যে এই অনলাইন খেলার মধ্যেও রিলায়েন্স আসতে চলেছে। এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশী মোবাইল গ্রাহক যেহেতু তাঁদেরই, সুতরাং তাঁরা তাঁদের মতো করে বিষয়টিকে আনবেন। যেহেতু চীনা মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন দিয়ে চীনা শত্রু মারা সম্ভব নয়, তাই এখানে দেশীয় কোম্পানির বকলমে রিলায়েন্সের প্রবেশ ঘটবে।
এই মুহূর্তে এই প্রযুক্তিনির্ভর কোম্পানিগুলো চায় যে প্রতিটি মানুষ যাতে স্মার্টফোনে ব্যস্ত থাকে, তাঁদের যাতে দেশের বেকারত্ব, জিডিপি বা চাকরি যাওয়া এই সমস্ত বিষয়ের দিকে নজর না যায়। বিভিন্ন বয়সী মানুষের জন্য বিভিন্ন বিনোদন। কম বয়সী মানুষদের জন্য জাতীয়তাবাদী বিনোদন, তার পরের অংশের মানুষের জন্য জুয়া খেলা... আর সববয়সী মানুষকে ফেসবুক এবং হোয়াটসআপের মধ্যে দিয়ে মিথ্যে তথ্য পরিবেশন তো থাকছেই। মুলত প্রতিটি মানুষকে আরও একলা বানিয়ে দেওয়াই লক্ষ্য। একদিকে বিজ্ঞাপণ দিচ্ছে, ‘মন খোলো পৃথিবী খুলে যাবে’ আর অন্যদিকে পৃথিবীর যাবতীয় সমস্যা যাতে কারুর চোখে না পড়ে, সেই ব্যবস্থা করা হচ্ছে। করোনা সংক্রমণে মানুষকে বোঝানো হয়েছে যে শারীরিক দূরত্ব বিধি মেনে চলতে হবে, কিন্তু বলা হয়েছে ‘সামাজিক দূরত্ববিধি’ মানতে। একলা করে দেওয়া হয়েছে, এরপরে এই স্মার্টফোনের মধ্যে দিয়ে আরও একলা করা হচ্ছে। সেই দুশো বছর আগের মার্ক্সের কথা ছিল ধর্ম হল আফিম যা দিয়ে মানুষকে নেশায় ডুবিয়ে রাখা যায়, আর আজকের সময়ে কি তবে স্মার্টফোন এবং তার সঙ্গে পাওয়া মোবাইল অ্যাপলিকেশন ?