ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টির জন্ম ১৯২০ না ১৯২৫ সেই বিতর্কের মধ্যে না ঢুকে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি শতবর্ষ পরেও কেন ভারতীয় জনগণের কাছে এখনও গ্রহণযোগ্য হতে পারল না সেই আলোচনা বেশি প্রয়োজন। আর এই আলোচনায় দরকার তথ্য ও যুক্তি এবং মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি। কোন ব্যক্তি আক্রমণ নয়। ব্যক্তি আক্রমণ আলোচনার বিষয় পথ হারায়।
এটা বাস্তব শতবর্ষ পার হয়ে যাওয়া ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি আজ বহূধা বিভক্ত। ভারতের কমিউনিষ্ট আন্দোলনের মূল সমস্যা সম্ভবতঃ এটাই যে, ভারতীয় কমিউনিষ্টরা এদেশে বিকল্প সমাজব্যবস্থার একটি গ্রহণযোগ্য মতাদর্শ ও নেতৃত্ব প্রদানকারি দিকনির্দেশ ভারতীয় জনগণের সামনে আজও তুলে ধরতে পারেননি। এদেশে ‘৪৭ পূর্ব ভারতীয় কমিউনিষ্টরা জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের নেতৃত্ব গ্রহণ করতে পারেননি। এমনকি সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী কোনো কার্যকরী লড়াই গড়ে তুলতে পারেননি। মূলতঃ জাতীয় কংগ্রেস ও তার অনুগামীদের লেজুরবৃত্তি করেছেন। মাঝেমধ্যে জঙ্গী আস্ফালন দেখিয়েছেন। অন্যদিকে নীচু তলাকার কর্মীরা ব্রিটিশ সরকারের হাতে বন্দী হয়ে ভয়ানকভাবে অত্যাচারিত হয়েছেন, আত্মত্যাগ করেছেন, কেউ বা শহীদ হয়েছেন।
শতবর্ষ আগে প্রতিবেশি দেশ চীনেও কমিউনিস্ট পার্টি জন্ম নিয়েছিল। পার্টি প্রতিষ্ঠার ২৮ বছর পর ১৯৪৯ সালে সেদেশে সাম্রাজ্যবাদ-সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থার উদ্যোগ নেওয়া হয়। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি তাদের দেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির সঠিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে নিজেরা পথ খুঁজে নিতে পেরেছিল অথচ ভারতীয় কমিউনিস্টরা এখানেই ব্যর্থ হয়েছিল। চীন কমিউনিস্ট পার্টি জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে এবং সাম্রাজ্যবাদ প্রতিরোধ যুদ্ধে নিজেকে নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিল কিন্তু ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি সে ক্ষেত্রে নিজেদের দেশে ব্যর্থ হয়েছিল।
চীন দেশের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মাওসেতুং বলেছেন কমিউনিস্ট পার্টির করণীয় কাজ কি - ‘এই স্তরে সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্ততান্ত্রিক জমিদারশ্রেণী যখন চীন বিপ্লবের প্রধান শত্রু, তখন চীন বিপ্লবের প্রধান করণীয় কাজ হচ্ছে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী পীড়নকে উচ্ছেদ করে জাতীয় বিপ্লব সমাধা করা এবং দেশীয় সামন্ততান্ত্রিক জমিদারশ্রেণীর পীড়নকে উচ্ছেদ করে গণতান্ত্রিক বিপ্লব সমাধা করা। আর সর্বপ্রধান কাজ হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদকে উচ্ছেদ করে জাতীয়বিপ্লব সমাধা করা। চীন বিপ্লবের এই বিরাট কাজ দুটি পরস্পর সম্পর্কিত। সাম্রাজ্যবাদী শাসনের উচ্ছেদ না হলে, সামন্ততান্ত্রিক জমিদারশ্রেণীর শাসনের অবসান ঘটানো অসম্ভব কারণ সাম্রাজ্যবাদই হচ্ছে ঐ শ্রেণীর প্রধান অবলম্বন। বিপরীতক্রমে সামন্ততান্ত্রিক জমিদারশ্রেণীকে উচ্ছেদ করার সংগ্রামে যদি কৃষকদের সহায়তা করা না হয় তাহলে সাম্রাজ্যবাদী শাসনের উচ্ছেদ করার জন্য শক্তিশালী বিপ্লবী বাহিনী গড়ে তোলা অসম্ভব হবে কারণ চীনদেশে সাম্রাজ্যবাদী শাসনের প্রধান সামাজিক ভিত্তি হচ্ছে সামন্ততান্ত্রিক জমিদারশ্রেণী এবং কৃষকশ্রেণী হচ্ছে চীন বিপ্লবের প্রধান শক্তি। সুতরাং এই দুটি মৌলিক কাজ - জাতীয় বিপ্লব ও গণতান্ত্রিক বিপ্লব একই সময়ে পৃথক ও ঐক্যবদ্ধ। যেহেতু চীনের জাতীয় বিপ্লবের আশু প্রধান কর্তব্য হচ্ছে জাপ-সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণকারীদের প্রতিহত করা এবং যেহেতু যুদ্ধে জয়লাভ করতে হলে গণতান্ত্রিক বিপ্লব অবশ্যই সমাধা করতে হবে সুতরাং বিপ্লবী কাজ দুটি ইতিপূর্বেই সংযুক্ত হয়ে গেছে। জাতীয় বিপ্লব ও গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে বিপ্লবের দুটি সম্পূর্ণরূপে ভিন্ন স্তর রূপে মনে করা ভুল হবে’ (মাওসেতুং রচনাবলী, ১ খন্ড, পিকিং)।
১৯২৮ সালে কমিন্টার্ন-এর (আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট পার্টিগুলির সংগঠন) ষষ্ঠ কংগ্রেসের গৃহীত আদর্শগত রাজনৈতিক সাংগঠনিক দিকনির্দেশ থেকে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি ক্রমশ দূরে যেতে লাগল। যে সম্মেলনে বলা হয়েছিল ঔপনিবেশিক দেশগুলিতে কমিউনিস্ট পার্টিকে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে। কিন্তু ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি নিজেদের একটা স্বতন্ত্র শ্রমিকশ্রেণীর পার্টি হিসেবে গড়ে তোলা, কংগ্রেস সহ আপসকামী দলগুলি ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আদর্শগত সংগ্রাম গড়ে তোলার পরিবর্তে কংগ্রেসের লেজুড়বৃত্তির রাজনৈতিক লাইন গ্রহণ করল।
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পটভূমিতে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে কৃষক জনগণ ও নতুন উদীয়মান শ্রমিকশ্রেণিসহ ভারতীয় জনগণের মধ্যে ফুটতে থাকা অসন্তোষ জনগণের বিভিন্ন অংশকে সংগঠিত হওয়ার দিকে নিয়ে গিয়েছিল। এটা ব্রিটিশ শাসকদের আতঙ্কিত করে তুলে তখন ব্রিটিশ সরকার তাদের সামাজিক অবলম্বন বড় বুর্জোয়া এবং বড় সামন্ত জমিদারদের প্রণোদিত করে জাতীয় রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করতে এবং জাতীয় আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করতে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যখন জনগণের অসন্তোষ বৃদ্ধি পায় এবং রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের বিজয় ঘটে তখন এই শ্রেণীর রাজনৈতিক প্রতিনিধিরা কংগ্রেসের গান্ধীবাদী নেতৃত্বে নিজেদেরকে সংহত করে। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের গান্ধীবাদী নেতৃত্ব, ভারতীয় জনগণকে নিজেদের কব্জায় নিয়ে আসে ও উপর উপর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিরোধিতা দেখায়। কিছু সংস্কারের কথা বলে এবং অন্যদিকে 'অহিংসা' ও 'নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ' এসব পদ্ধতির মাধ্যমে জাতীয় আন্দোলনকে বিপ্লবের পথ থেকে সরিয়ে এনে সমঝোতার পথে পরিচালিত করে।
সোভিয়েত রাশিয়ায় নভেম্বর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, যা সাম্রাজ্যবাদী শৃঙ্খলের সবচেয়ে দুর্বল গ্রন্থিকে ভেঙে দিয়েছিল তার বিজয়ের সাথে সাথে ভারতীয় বিপ্লব হয়ে দাঁড়ালো বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের অংশ। ভারতে তা নিয়ে এল মার্কসবাদ-লেনিনবাদের বৈজ্ঞানিক মতাদর্শ এবং জন্ম নিলো ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি যা ভারতীয় বিপ্লবে একটি নতুন উপাদান যোগ করলো। এত বিশাল সুযোগ থাকা সত্ত্বেও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টি নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি কারণ পার্টি নেতৃত্ব কৃষক জনগনের উপর আস্থা রাখতে ও ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে তাদের টেনে আনতে ব্যর্থ হয় এবং গণমুক্তি ফৌজ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। পার্টি নেতৃত্ব বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী সমর্থক কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ নেতৃত্বের পেছন পেছন চলে যা ভারতীয় বিপ্লব ও জনগণের স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তা সত্ত্বেও, পার্টির সাধারণ কর্মীরা দৃঢ়ভাবে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে, অসংখ্য শ্রেণী যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে এবং ভারতীয় জনগণ ও ভারতীয় সর্বহারা শ্রেণীর জন্য অবর্ণিত ত্যাগ স্বীকার করেছে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে তখন থেকে লাগাতার দুই লাইনের সংগ্রাম চলেছে। একটি লাইন সংগ্রামের আরেকটি সমঝোতার লাইন।
১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আবহাওয়া তৈরি হলে বলশেভিক পার্টি এই যুদ্ধকে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ বলে অবহিত করে। ১৯৪১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রান্ত হয়। যুদ্ধে জার্মান, জাপান ও ইতালি ফ্যাসিষ্টদের বিরুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে ব্রিটিশ ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সাথে কৌশলগত যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। এই যুদ্ধে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাময়িক সন্ধি হওয়ায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি নিজের দেশে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিরত থাকে। ফলে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলন নয় বরং সর্বাত্মক সহযোগিতা করার রাস্তায় নেতৃত্ব পার্টিকে দাঁড় করালো ফলে বেআইনি কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা থেকে ব্রিটিশ সরকার মুক্তি দেয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ যাতে যুদ্ধের সময় কোনভাবে বিপদে না পড়ে তার জন্যই এই অবস্থান। ফলে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি বিকল্প পথে শ্রমজীবী কৃষক, শ্রমিক ও দেশপ্রেমিকদের ঐক্যবদ্ধ করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সব থেকে সংকটের সময় তাকে আঘাত করার পরিবর্তে তাকে সহযোগিতার অবস্থান গ্রহণ করল। আসলে তৎকালীন কমিউনিস্ট নেতৃত্ব শ্রমিক কৃষক ও অন্যান্য শ্রমজীবী ঐক্যের উপর দাঁড়িয়ে ক্ষমতা দখলের রাজনীতি থেকে আপস মিমাংসার পথে আস্থা রেখেছিল। বলা হল - ‘এখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে আক্রমণ করা মানে জাপানি ফ্যাসিষ্টদের হাতকে শক্ত করা যা জাতির জন্য মৃত্যু পরোয়ানার সামিল’ (জি চক্রবর্তী ২০০৭, পি সি জোশি, এনবিটি, নয়াদিল্লি)। এই সিদ্ধান্ত ছিল কমিন্টার্নের ষষ্ঠ কংগ্রেসে গৃহীত সিদ্ধান্তের পরিপন্থী।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন পার্টি নেতৃত্ব শ্রমজীবী মানুষদের গড়ে ওঠা গণসংগ্রাম ও অভ্যুত্থানগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে উৎখাত করার পরিবর্তে আপসকামী নীতি ও কৌশল গ্রহণ করল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে ভীষণভাবে দুর্বল করে তুলেছিল। সারা ভারতবর্ষে তখন মানুষের বিক্ষোভআন্দোলন ব্রিটিশ রাজশক্তিকে ভীষণভাবে কোণঠাসা করে তুলেছিল। শ্রমিকদের বিক্ষোভ, নৌবিদ্রোহ, আজাদ হিন্দ ফৌজের মুক্তির দাবিতে সারা দেশব্যাপী উত্তাল গণ-আন্দোলন, কেরালায় পুন্নাপ্রা ভায়লারারের সশস্ত্র কৃষক বিদ্রোহ, তেলেঙ্গানার ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন, তেভাগার আন্দোলন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কাছে শেষ অবস্থা বলে হাজির হয়। এইরকম অবস্থায় তৎকালীন নেতৃত্ব জাতীয় মুক্তি ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনকে নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হয়।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ চরম সংকট থেকে নিজেদের স্বার্থকে অক্ষুন্ন রাখতে ১৯৪৭ সালে ১৪ ও ১৫ আগষ্ট পাকিস্তান ও ভারত দুটি অংশে দেশকে বিভাজিত করে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করলো সবরকম স্বার্থকে সুরক্ষিত রেখে।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বৃহৎ বুর্জোয়া ও জমিদারদের প্রতিনিধি জাতীয় কংগ্রেসের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে চলে যাবার পর ১৯৫২ সালে ভারতে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তখন তেলেঙ্গানা কৃষক আন্দোলন চলছে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি সশস্ত্র কৃষক আন্দোলন প্রত্যাহার করে ও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। দীর্ঘস্থায়ী জনযুদ্ধের পথ, যে পথে চীন বিপ্লব জয়যুক্ত হয়েছিল তাকে বিরোধিতা করে সংসদীয় পথ গ্রহণ করে। ১৯৫৬ তে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির ২০তম কংগ্রেসে নিঃস্তালিনীকরণ শুরু হওয়ার সাথে সাথে হাজির হল সংসদীয় পথে শান্তিপূর্ণভাবে সমাজতন্ত্রে উত্তরনের তত্ত্ব। মার্কসবাদ বিরোধী এই তত্ত্বটি আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গ্রহণ করে কিন্তু এই প্রশ্নকে কেন্দ্র করে পার্টির মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। ‘৬০ এর দশকের গোড়ায় চীন-সোভিয়েত মতাদর্শগত বিতর্কে চীনের পার্টি ক্রুশ্চভের এই প্রতিবিপ্লবী তত্ত্বকে সরাসরি আক্রমণ করে এবং সেই বিতর্কের প্রভাবে ভারতেও বিভিন্ন প্রশ্নে মতাদর্শগত বিতর্ক তীব্রতর হয়ে ওঠে। '৬২-তে ভারত-চীন যুদ্ধ সেই বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ করে। পার্টির বিপ্লবী অংশ ও কর্মীরা অধিকাংশই চীনের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন তারই পরিণতিতে ১৯৬৪-তে অবিভক্ত সিপিআই দু'ভাগ হয়ে যায়, জন্ম নেয় সিপিআই(এম)। উল্লেখ্য যে, এই নতুন পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠ কর্মী মতাদর্শগতভাবে চীনের অবস্থানের পক্ষে থাকলেও পার্টি-নেতৃত্বের অধিকাংশেরই মতাদর্শগত অবস্থান ছিল মধ্যপন্থী ও প্রচ্ছন্নভাবে সোভিয়েত পার্টির পক্ষে। নতুন পার্টি গড়ার সূচনা পর্বেই তার প্রমাণ মেলে। ১৯৬৪-র সিপিএম এর ১ম পার্টি কংগ্রেসে কর্মসূচীর প্রাথমিক খসড়ায় ‘শান্তিপূর্ণ পথে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের জন্য কমিউনিষ্ট পার্টির আকাঙ্ক্ষার কথা উল্লেখ করা হয়’, এবং পার্টি কংগ্রেসে গৃহীত চূড়ান্ত কর্মসূচিতে একটি নতুন ধারা (১১২ নং) সংযোজিত করে- ‘সুযোগ পেলে জনগণের আশু সমস্যাবলী প্রশমন করতে পারে এবং এইভাবে গণআন্দোলনকে শক্তিশালী করতে পারে এমন একটি অতিক্রান্তিকালীন সরকার গঠন' এর কথা উল্লেখ করা হয়।
কৌশলগত কারণে সংসদীয় নির্বাচনে বা সরকারে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে সংসদ-সর্বস্বতার শিকার হয়ে পড়ার বিপদ-সম্পর্কে মার্কসবাদী সতর্কবার্তা কিন্তু কোনো দিনই এই দুই কমিউনিস্ট পার্টির কর্মসূচীতে বা কোনো রাজনৈতিক প্রস্তাবে স্থান পায়নি। স্থান পায়নি লেনিনের প্রাসঙ্গিক এই শিক্ষাও যে, 'পার্লামেন্টের ভেতরকার কাজকে পুরোপুরিভাবে এবং সম্পূর্ণভাবে পার্লামেন্ট-বহির্ভূত গণআন্দোলনের লক্ষ্য ও কর্তব্যের অধীন হতে হবে’।
সিপিএম গঠিত হবার কয়েক বছর বাদে দলের সংশোধনবাদী সংসদ সর্বস্বতা চরিত্র উদঘাটিত হয়ে যায়। ১৯৬৭ সালে মে মাসে যুক্তফ্রন্ট সরকার নকশালবাড়ি সশস্ত্র কৃষক আন্দোলনের উপর গুলি চালিয়ে নারী পুরুষ ও শিশুসহ কৃষক হত্যা করে। এই বিদ্রোহের পরিণতিতে ১৯৬৯ সালে ১লা মে গঠিত হয় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)।
সংসদীয় লাইনের কানাগলিতেই সমস্ত বিপ্লবী উদ্যোগকে স্তব্ধ করে দিতে চাইছিল সিপিআই ও সিপিএম। নকশালবাড়ির কৃষক সংগ্রাম ছিলো তার বিরুদ্ধে পরিচালিত মতাদর্শগত সংগ্রামের পরিণতি। সংসদীয় পথের কানাগলি নয় বরং সশস্ত্র কৃষিবিপ্লবই যে ভারতীয় জনগণের মুক্তির একমাত্র পথ এই অমোঘ সত্য বিপ্লবীদের মধ্যে স্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল নকশালবাড়ির কৃষক আন্দোলন। 'ভারতের মতো একটি আধা-সামন্ততান্ত্রিক ও আধা-ঔপনিবেশিক দেশে কে বিপ্লবী আর কে প্রতিবিপ্লবী, কে প্রগতিশীল আর কে মার্কসবাদী আর কে সংশোধনবাদী এবং কোন রাজনৈতিক দল গণতান্ত্রিক বিপ্লব অর্থাৎ কৃষিবিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায় আর কে আধা-সামন্ততান্ত্রিক ও আধা-ঔপনিবেশিক ব্যবস্থাকে প্রলেপ দিয়ে টিকিয়ে রাখতে চায় তা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে যায় নকশালবাড়ির কৃষক সংগ্রামের কষ্টিপাথরে।
তবে কিছুদিনের মধ্যেই এই নতুন পার্টি বাম বিচ্যুতির শিকার হয় এবং রাষ্ট্র শক্তির প্রবল আক্রমণের সামনে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। আজ নকশালপন্থীরা বহূধা বিভক্ত। বিভিন্ন গ্রুপ তাদের নিজেদের মতো করে বিপ্লবী আন্দোলন গড়ার চেষ্টা করছেন আবার কেউ কেউ সশস্ত্র কৃষি বিপ্লবের রাজনীতি তুলে ধরার বিপরীতে সিপিআই সিপিএম এর মতো বিকল্প সরকার গঠনের প্রচার চালাচ্ছেন। কেউ কেউ বর্তমান ভারতবর্ষকে পুঁজিবাদী দেশ হিসেবে চিহ্নিত করে সেই হিসেবে সংগঠনের কর্মসূচি নিচ্ছেন। এই হল আজকের ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিগুলির অবস্থা। সংশোধনবাদ ও বাম বিচ্যুতির শিকার বহূধা বিভক্ত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিগুলি তাই আজও জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠতে পারেনি।
আজ ভারতের বিপ্লবীদের একটি একক ও ঐক্যবদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তুলতে হবে নকশালবাড়ি সশস্ত্র কৃষক সংগ্রামের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে। নকশালবাড়ি আন্দোলনের শিক্ষা- ভারতের বুকে সশস্ত্র কৃষি বিপ্লব গড়ে তুলে সমাজ বদল করতে হবে তাছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই।
সমালোচনায়: তথাকথিত লাল দল ও নানা 'মার্কসবাদী' লেখক - দেবজিৎ ভট্টাচার্য
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার একশো বছর : ফিরে দেখা- সুশোভন মুখোপাধ্যায়