গোটা দেশ ডুবে আছে করোনা ভাইরাস নামে এক মহামারির আতঙ্কে। সরকারি বেসরকারি যাবতীয় উদ্যোগ এখন ওই নবীন সংক্রমণকারী ভাইরাসকে ঘিরে, যার মারণ ক্ষমতা অন্তত এই ভারতে নেহাতই নগন্য— দুই থেকে তিন শতাংশের বেশি নয়। পরিসংখ্যানের মধ্যে যাচ্ছি না, কারণ যে কোনও দিকে চোখ ফেরালে কিংবা কান পাতলে বিশ্ব, দেশ এবং রাজ্যের করোনা পরিসংখ্যান না-দেখে বা না-শুনে উপায় নেই। করোনা আমাদের শরীরে সংক্রমিত হোক বা না-হোক, আমরা মানসিকভাবে ওই ভাইরাসের দ্বারা ভয়ানক রকমে সংক্রমিত হয়ে পড়েছি। অথচ সংক্রমিত হয় এমন রোগ তো আমাদের দেশে নতুন নয়। বরং বলা যায় আমরা নানা রকমের জীবাণু সংক্রমণের মধ্যেই বাস করি। যেমন যক্ষা বা টিউবারোকুলোসিস বহু বছরে বহু চেষ্টার পরেও সংক্রমিত হয়ে চলেছে এ দেশের মানুষের মধ্যে। ‘গ্লোবাল যক্ষা রিপোর্ট’ জানাচ্ছে, আমাদের দেশে ফি বছর যক্ষায় ৪ লক্ষ ৪০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। এই লেখা যখন আমরা পড়ছি কখনও দিনে ১২০৫ জন মানুষের মৃত্যু হচ্ছে যক্ষা রোগে। কিন্তু সবচেয়ে ভয়াবহ তথ্য হল, আমাদের দেশের প্রায় ৫২ কোটি মানুষ যক্ষা রোগে আক্রান্ত।
আজকের দিনে যখন করোনা বিনে কথা নাই, তখন যক্ষা নিয়ে এই আলোচনা অবান্তর অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে। আসলে যেটা বলার, যে বিপুল অর্থব্যয়ে যে বিশাল আয়োজনে এ দেশে করোনা মোকাবিলার চেষ্টা চলছে, সেই মনোযোগের সামান্য অংশও যক্ষা প্রতিরোধে খরচা করলে অন্তত কয়েক লক্ষ মানুষ বেঁচে যেত। তা করা হবে না কিংবা করা যাবে না। কারণ যক্ষা রোগে যাদের মৃত্যু হয় তারা মূলত ‘অদৃশ্য’ নাগরিক। তাদের দেখা যায় না। কোনও সংবাদ মাধ্যম এদের কথা বলে না। কারণ তারা উল্লিখিত হওয়ার মতো পণ্য নয়। এমনকি ফেসবুক, হোয়াটঅ্যাপ, টুইটারের মতো সোশাল মিডিয়ায় যাঁরা দেশের ভাবনা ভেবে অস্থির রাতদিন, যক্ষা আক্রান্ত বা ওই রোগে মৃত নাগরিকেরা তাঁদেরও বিবেচনার মধ্যে থাকে না। কারণ সেই একটাই— তারা অদৃশ্য নাগরিক।
আরও আছে, রাষ্ট্র সংঘের রিপোর্ট মোতাবেক আমাদের দেশে ২০১৯ সালে আট লক্ষেরও বেশি নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে। কেন? মূলত পুষ্টি, পরিচ্ছন্নতা এবং স্বাস্থ্য পরিষেবার অভাবেই এই মৃত্যু। তাদের খবরও কি আমারা রাখি? না, রাখি না। কারণ তারাও সেই ‘অদৃশ্য’ নাগরিকদেরও ঘরে জন্মেছিল। তাদের মায়েরা হতদরিদ্র, প্রান্তিকতম। অথচ অতি সামান্য মনোযোগেই এই বিপুল সংখ্যক নবজাতকের মৃত্যু আটকে দেওয়া সম্ভব। আবারও একই কথা বলতে হয়, অদৃশ্য অজানা করোনা ভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধে চালাতে আমরা যে উদ্যোগ খরচ করছি তার সিকি ভাগ মনোযোগ পেলে অন্তত দুই লক্ষাধিক নবজাতককে বাঁচিয়ে রাখা যেত। ভারতে নবজাতকের মৃত্যুর হার প্রায় ২.৩ শতাংশ। এই মৃত্যুর হার করোনা ভাইরাসের চেয়ে বেশি। উন্নত দেশগুলোতে নবজাতকের মৃত্যুর হার ০.৩ শতাংশ।
কিন্তু আমরা দেখছি করোনা ভাইরাসের মোকাবিলা করার জন্য ভারত বিশ্বের কঠোরতম লকডাউন চালু করেছে। এই লকডাউনের ধাক্কায় কত মানুষ যে কর্মচ্যুত হয়েছে, কত মানুষ জীবিকা হারিয়েছে, কত মানুষ না খেতে পেয়ে মৃত্যুর দিন গুণছে তার হিসেব এখনও হয়নি। যে মজুররা ভিন রাজ্যে কাজ করতে গিয়েছিলেন তাঁদের অধিকাংশই ঘরে ফিরতে পারেননি। তার সঠিক সংখ্যা অজ্ঞাত, কিন্তু অবশ্যই সব রাজ্য মিলিয়ে তা কোটির কাছাকাছি পৌঁছবে। তাঁরাও যেমন প্রায় না খেয়ে কঠিন সময় কাটাচ্ছেন তেমনই কয়েকশো কিলোমিটার দূরে তাঁর পরিবারের মানুষেরাও অর্ধাহারে অনাহারে দুশ্চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছেন। একটা বিষয় লক্ষণীয়, এ রাজ্যের যে সব পরিবার তাদের ছেলেমেয়েদের ‘গোছানো’ কেরিয়ার গড়ার স্বপ্ন দেখে রাজস্থানের কোটায় পাঠিয়েছিলেন তার সংখ্যাও আড়াই হাজারের কাছাকাছি। ভিন রাজ্য থেকে শ্রমিকদের ঘরে ফেরানোর কোনও ব্যবস্থা করা না গেলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ইতিমধ্যেই বাস পাঠিয়ে দিয়েছে কোটায় আটকে থাকা ছেলেমেয়েদের ঘরে ফেরাতে। এর থেকে সরকারের এবং নেত্রীর কর্তব্যের অগ্রাধিকার বোঝা যায়।
আগের প্রসঙ্গে ফেরা যাক আরেক বার। আইসিএমআর-এর রিপোর্ট বলছে পরীক্ষায় করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ মিলেছে ৪.৪ শতাংশের শরীরে অর্থাৎ প্রতি ২৩ জন পরীক্ষা করা মানুষের মধ্যে একজন পজিটিভ। অন্যত্র সংখ্যাটা হল: আমেরিকায় ১৯.৩ শতাংশ, স্পেনে ১৮.২ শতাংশ এবং জাপানে ৮.৮ শতাংশ। তবে ব্যাপক সংখ্যায় পরীক্ষা না হলে করোনা-রোগীর প্রকৃত সংখ্যা জানা সম্ভব নয়।
তার জন্য ভারতে যে লকডাউন হয়েছে তা ইউরোপ আমেরিকা বা জাপানের থেকে অনেক বেশি কঠোর। এবং তা ঘোষণাও হয়েছিল রাতারাতি কোনও রকম প্রস্তুতি ছাড়াই। জানা গেছে, এই লকডাউনের জন্য ভারতকে যে মূল্য চোকাতে হবে তা নাকি ১০ লক্ষ কোটি টাকার সমান। এতটাই মূল্যবান করোনা ভাইরাস? এতকিছুর পরেও হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু আটকানো যায়নি। অঙ্কে যাঁরা দঢ় তাঁরা নিশ্চয়ই হিসেব করে বের করে ফেলতে পারবেন, প্রতিটি মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কিংবা প্রতিটি মৃত্যুর জন্য কত খরচ করতে হল এই দেশকে। এর মধ্যে করোনা মোকাবিলার জন্য সাজ-পোশাক, ওষুধ বা হাসপাতালগুলোকে করোনা চিকিৎসার উপযোগী করে গড়ে তোলার খরচ ধরা হয়নি। আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য, করোনা কিন্তু গ্রামীণ প্রান্তিক মানুষদের ছোঁয়নি এখনও। এ রোগ এসেছে ধনবান দেশ থেকে ধনবানদের দ্বারা বাহিত হয়ে। এত মনোযোগের সেটৈও কি কোনও কারণ তবে পারে?
এই কঠোর লকডাউন আরও কতদিন বহাল থাকবে তা কারও জানা নেই। সর্বজ্ঞ প্রধানমন্ত্রী মোদীরও জানা নেই। তবে একটা কথা জোর দিয়েই বলা সম্ভব যে, এ দেশে শেষপর্যন্ত করোনায় যত মানুষের মৃত্যু হবে তার চেয়ে অনেক বেশি রুজি হারানো, উপার্জনহীন, অসহায় মানুষ মারা পড়বে। তাদের খবর আমরা অবশ্যই জানবো না। কারণ তারা সেই ‘অদৃশ্য’ নাগরিক যক্ষা রোগীদের মতো, হতদরিদ্র প্রান্তিক মায়ের সদ্যোজাত শিশুদের মতো।