বাবরি মসজিদ যখন ধ্বংস করা হ'ল তখন আমি পাশের বাড়ির লালমোহন কাকুকে হেব্বি মারলাম। ও হিন্দু তাই। গুজরাত দাঙ্গার সময়ে পাড়ার মায়া কাকিমাকে ঠেঙিয়ে দিলাম। ও হিন্দু তাই। চাওয়ালা নরেনদাও মার খেল। ও হিন্দু তাই। মুদি দোকানের অমিতকাকুকে খুঁজে পাই নি, পেলে বুকে ছুরি বসিয়ে দিতাম। ও হিন্দু তাই।
উত্তর প্রদেশে মুহম্মদ আখলাখকে যখন গণপিটুনি দিয়ে মারা হ'ল, গরুর মাংস খাওয়ার অভিযোগে, তখন হাতে পতাকা নিয়ে পাশের পাড়ার রবিন জেঠু আর ওর বন্ধুরা, যেমন সাধ্বী প্রাচী কাকিমা, মেরে ওদের মুখপিঠ ফাটিয়ে দিলাম। ওরা হিন্দু তাই।
তারপর আবারও কাশ্মীর। ভারতীয় সেনার পেলেট বা ছররা বন্দুকের আঘাতে যখন হাজারে হাজারে মানুষ আহত হচ্ছে, চোখ হারাচ্ছে শিশুরাও, তখন পাড়ার ইশকুলের রাজনাথ স্যারকে শুনিয়ে দিলাম দু’চার কথা, সঙ্গে দিলাম কয়েক ঘা। ও হিন্দু তাই।
তারপর ধরুন, সেই আবার কাশ্মীর, কাঠুয়া। আট বছরের আসিফাকে সাতজন হিন্দু মিলে, একটা মন্দিরে, হ্যাঁ, একটা মন্দিরে, সাত দিন ধ'রে গণধর্ষণ আর খুন করল, মাথা থেঁৎলে দিল। তো আমি খুঁজে খুঁজে সানজি রাম, দীপক, বিশাল এইসব লোকেদের ধ'রে ধ'রে হেব্বি মারলাম আর যা যা করলাম বুঝে নিন। তারপর ধরুন হাথরাস, উন্নাও ইত্যাদি তো আছেই। তো এইসব ক'রে চলেছি কেন? কারণ ওরা হিন্দু তাই।
এইরকম আরও অনেক অনেক মেরেছি, খুন করেছি, গুম করেছি, রেপ করেছি। সব লিখে রাখি নি, এত মনে রাখা যায় না কি? যেমন ধরুন কাশ্মীরের কুনান-পাশপোরায় যখন সিআরপিএফ আর বিএসএফ অসংখ্য মেয়ের গণধর্ষণ করল তখন আমি নিজ পাড়ায়-বেপাড়ায় হিন্দু মেয়েদের যা যা করতে চাইলাম সে আর...
কেন? এখনও বুঝলেন না? আমাকে বন্ধুতালিকা থেকে 'আসতে পারেন' বলবেন? ব্লক করবেন? ট্রোল করবেন? রাস্তায়-বাসে-ট্রামে-চা দোকানে কটুবাক্য বলবেন? কিন্তু তারপরেও একটু কেমন কেমন লাগছে? পড়তে বা ভাবতেই খারাপ লাগছে? মনে হচ্ছে না, হিন্দু-মুসলমান হিন্দু-মুসলমান হিন্দু-মুসলমান... যুগের পর যুগ ধ'রে কে, কারা খেলিয়ে দিচ্ছে আমাকে-আপনাকে? কেন? কী স্বার্থ তাদের? এইবারেও ভাববেন না? এখনও ভাববেন না?
এখন খাতা নিয়ে বসেছি। তাতে কত অসংখ্য ঘটনা। সুল্লি ডিল অ্যাপ মনে পড়ে? বা বুল্লি বাই অ্যাপ? সুল্লি-বুল্লি দুটিই গালি। মুসলমান মেয়েদের জন্য ব্যবহৃত অপশব্দ। শয়ে শয়ে মুসলমান মেয়েদের অনলাইন নিলামে তোলা হয়েছিল, অবশ্যই ভুয়ো। কিন্তু হেনস্তার দুর্বুদ্ধি ভুয়ো নয়, একদম আসল। খাঁটি। শাবানা আযমি থেকে শুরু ক’রে নামজাদা সাংবাদিক বা সাধারণ এক মুসলমান মেয়ে… কাউকে ছাড় দেওয়া হয় নি। ব্যঙ্গ-ঠাট্টা-হাসি-হেনস্থার আঁধারকুয়োয় সেই নারীদের ফেলে দেওয়াই ছিল এর আড়ালে থাকা প্রবল গেরুয়ামনের হীন অভিসন্ধি।
পহেলগাঁওয়ের ঘটনার একদিন আগে বাঘাযতীন কলোনির লায়েলকা এলাকায়, বিজেপি-র এক পথসভায় নিজ কানে যা শুনেছিলাম তা অবিশ্বাস্য। এই কথাগুলো এখন হরবখৎ নেটপাড়া, পাড়া, ইশকুল-কলেজ, চাকুরিস্থল... সর্বত্র শোনা যায়, অবাক হই না। কিন্তু তাই ব'লে ক'লকাতার রাজপথে, মঞ্চে ঘোষণা ক'রে?! এক নবীন যুবক মাইক বাগিয়ে ধ’রে সগর্বে বললেন, "এলাকার মানুষকে অনুরোধ করব তাঁরা যেন কোনও মুসলমানকে ঘর ভাড়া না দেন। আমি আরও অনুরোধ করব, একটু বেশি টাকার লোভে কেউ যেন মুসলমানদের ফ্ল্যাট বা জমি বিক্রি না করেন।"
তারপরে সিনেমার ভাষায় যাকে বলে, কাট টু মোটের ওপর ১৯১৮-১৯ সাল। আমরা পড়ে নিতে পারি অবিভক্ত কম্যুনিস্ট পার্টির নেতা সোমনাথ লাহিড়ীর জীবনকথার এক ভাগের স্মৃতিচারণ, ‘উত্তরণ’ নামের এক লেখায়। স্থান নদীয়ার শান্তিপুর। “বিসর্জনের মিছিল। পাড়ার মধ্যে সবচেয়ে জাঁক-জমকের পুজো। কর্তার বড় ছেলে শ্রীকান্তবাবু আমাদের মিছিলের নেতা (পরবর্তীকালে ইনি কংগ্রেসের নেতা হয়েছিলেন)। ঢাক ঢোল কাঁসির ওপর ইংরিজি বাজনা। লোহার মশালে ঘুঁটে জ্বালিয়ে আলোয় আলোময়, মাঝে মাঝে বোধহয় দু-একটা অ্যাসিটিলিন বাতিও ছিল।
ডাকঘরের মোড়ের একপাশে মুসলমানদের প্রধান মসজিদ। ঠিক মোড়ে না দাঁড়িয়ে মিছিলটাকে দাঁড় করানো হ’ল প্রায় মসজিদের কোল ঘেঁষে। অনেকক্ষণ দাঁড়াল সেখানে। শ্রীকান্তবাবু বললেন-বাজা, বাজা, যত জোরে পারিস বাজা। আর তার সঙ্গে চিৎকার-জয় মা দুর্গা।
সারা পথের মধ্যে, মনে হল, এখানেই বাজনার উৎসাহ সবচেয়ে বেশি, থামতেই চায় না। ... দাদার বয়সির একজনকে দেরির কারণ শুধোলাম। তিনি বললেন-দেখছিস নে, নেড়েদের মসজিদ? বেটারা বলে-মসজিদের সামনে নাকি বাজনা চলবে না। ওদের একটু জানান দিয়ে যাচ্ছি, মা দুর্গার কি তেজ।
ধর্ম মানে তা হলে ভালবাসা নয়, হিংসে? ঠিক তাই বুঝেছিলাম কিনা জানি না, তবে ভালো লাগে নি।“
তারপরে একশ বছরেরও অধিক সময় পার ক’রে কত নদীর কত জলহাওয়ায় ঘৃণার রক্তগঙ্গা এই দেশে বয়ে গেল, কিন্তু দ্বেষের রং ফিকে হ’ল না। শুধু নামের জামা বদল হয়েছে। জয় মা দুর্গা আজ জয় শ্রীরাম হয়েছে। ঘৃণা-হিংসার নির্মম-ক্রুর চোরাবালিতে আমরা ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছি। ধর্মপরিচয় জেনে হত্যা করাকে আমরা আলবাৎ নিন্দা করব, কিন্তু তার সঙ্গে এইটাও কি ভাবব না, সেই সমীকরণের বিষে আমরা আমাদের সহ-নাগরিকদের কাঠগড়ায় তুলব কেন? কেন এই সহজ কথাটা ভাবব না, এইসব কূটবুদ্ধিতে আমরা যে শয়ে শয়ে বছর ধ’রে পুতুল হয়ে নেচে চলেছি, যারা এই লড়াই জারি রাখতে চায় তারা সেইটা মোক্ষম জানে? দিন তিনেক আগে, জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত আমার এক ‘মুসলমান’ চলচ্চিত্রনির্মাতা বন্ধুর সাইকেল চুরি যায়, আমাদের কলোনি এলাকায় সদ্য কেনা ফ্ল্যাটে সে নতুনই বলা চলে। পাশের মুদিদোকানে সিসিটিভি থাকতে পারে মনে ক’রে সে গেল। দোকানি আমার আপনার বাড়ির কাকুজেঠুসম স্নেহশীল। সিসিটিভি নেই বটে, তবে বয়সের অভিজ্ঞতা আছে। তারা আলাপ করলেন এলাকায় চুরি বাড়ছে ব’লে, আজকালকার নিরাপত্তার অভাব নিয়ে পারস্পরিক শঙ্কাবিনিময়ও হ’ল। এবং ও চ’লে আসার আগে উনি আরও চিন্তিত হয়ে বললেন, “তা ছাড়া অনেক মুসলমানও আজকাল আসছে, বড় বড় ব্যাগ নিয়ে।“ আমার বন্ধুটি তাঁর কিছু আগেই রিক্সাওয়ালার ‘মুসলমানরাই দেশটার সব্ শেষ ক’রে দিল’ শুনতে শুনতে মুদিখানার সামনে এসে নেমেছিল। সে যে মুসলমান এই তথ্য রিক্সাওয়ালাকে জানালেও মুদিকাকুকে আর বলে নি। ক্লান্তিতে, বিষাদে, মন খারাপে। কিন্তু এই শুনে আমার লায়েলকার সেই সভার কথা মনে পড়ে গেল। সেখানে বিজেপি নেতারা আরও যা বলছিলেন, তা হ’ল, তাদের দলটি না থাকলে দেশটা এতদিনে পাকিস্তান এসে দখল নিয়ে নিত, দেশটা ‘মুসলমানের দেশ’ হয়ে যেত। যেন বা মুসলমানের দেশ পাকিস্তান ভারত দেশটাকে বড় ব্যাগে পুড়ে অনায়াসে কান্ধে ফেলে নিয়ে চ’লে যেত!
১৯৮৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি। নেলি গণহত্যায় ১৪টি গ্রামের, সরকারি হিসেবে মৃতের সংখ্যা প্রায় ২০০০ আর বেসরকারি হিসেবে তিন থেকে পাঁচ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। হ্যাঁ, পড়ুন মুসলমান জনগোষ্ঠীর মানুষ। বাঙালি মুসলমান। হত্যাকারীরা সময় নিয়েছিল মাত্র ছয় ঘণ্টা। দেশভাগ পরবর্তী ভারতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সবচেয়ে ভয়ংকর গণহত্যা হিসাবে গণ্য করা হয়। আমাদের জনস্মৃতিতে সেই নৃশংস ঘটনা আজ উঁকিও দেয় না। তদন্তের জন্য গঠিত তিওয়ারি কমিশনের রিপোর্ট আজও খামবন্দী। সমস্ত মামলা পরবর্তীকালে খারিজ ক’রে দেওয়া হয়, এবং হ্যাঁ, আজ অবধি একজনও শাস্তি পায় নি। এত হিঁদু-মুসলমান হুহুঙ্কার দেখেশুনে পাবলিক মেমোরিতে ইচ্ছে করেই টোকা মারতে চাইলাম, আর বলতে চাইলাম,
হে অমৃতকালের ভারত, জেনেশুনে আর কতকাল বিষপান ক’রে যাবেন?