ভারতে ফ্যাসিবাদ এসে গেছে না আসছে --- তা নিয়ে এখনো কেউ কেউ তর্কে লিপ্ত, কিন্তু কতকগুলো ব্যাপার নিয়ে কোন তর্ক নেই। যেমন --- ১) গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো এখন কয়েকজনের জন্য সংরক্ষিত। ২) মুখে বলব ধর্মীয় সংখ্যালঘু আর দলিতরা সকলের সমান, আর কাজের বেলায় তাদের অন্যদের চেয়ে কম অধিকারসম্পন্ন মনে করব --- এই দ্বিচারিতায় রাষ্ট্র আর নেই। এখন সে বুক ফুলিয়েই দলিত আর মুসলমানদের প্রতি দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের আচরণ করছে। ৩) কৃষক, শ্রমিকের অধিকার (কায়িক শ্রম করেন না এমন চাকুরিজীবীও এই গোত্রেরই) বলে আর কিছু নেই, থাকা উচিৎ বলেও রাষ্ট্র মনে করে না। ৪) সরকারের বিরোধিতা মানেই দেশের বিরোধিতা, যার শাস্তি কারাবাস। ৫) গরীব এবং মধ্যবিত্তের খাওয়া পরা, জীবন জীবিকা নিয়ে রাষ্ট্রের কোন মাথাব্যথা নেই। ধায় যেন মোর সকল ভালবাসা, প্রভু ধনীর পানে। ৬) নির্বাচন ব্যাপারটার তাৎপর্য তলানিতে ঠেকেছে। ভোটাররা যাকেই ভোট দিন, টাকার জোর বা ক্ষমতার জোরে প্রতিকূল ফলকেও কেন্দ্রের শাসক দল অবিলম্বেই অনুকূল করে ফেলতে পারে। প্রচারপর্বেও তাদের জন্য নিয়মকানুন আলাদা। অন্যরা যা করলে নির্বাচনী বিধি ভঙ্গ হয়, বিজেপি বা তাদের জোটসঙ্গী তা করলে বিধির শ্রীবৃদ্ধি হয়। ৭) বিজেপির রাজনৈতিক বিরোধীদের মধ্যেও জনপ্রিয়তা পুনরুদ্ধার বা বজায় রাখার উপায় হিসাবে বিজেপিতর হওয়ার প্রচেষ্টা ক্রমবর্ধমান। সে কমলনাথের রাম পথ বা গোশালা নির্মাণের প্রতিশ্রুতিই হোক আর কেজরিওয়ালের সরকারী উদ্যোগে লক্ষ্মীপুজোর সরাসরি সম্প্রচারই হোক।
এক কথায়, সারা দেশে দক্ষিণা হাওয়া প্রবল। এমতাবস্থায় বামপন্থীরা শক্তি সঞ্চয় করবেন, বা যেটুকু শক্তি আছে তা একত্র করে দক্ষিণপন্থার বিরুদ্ধে জোর লড়াই করবেন --- এটাই প্রত্যাশিত। বিহারের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল সেদিক থেকে আশাব্যঞ্জক ছিল। এই প্রথম একটা রাজ্যে সমস্ত বিজেপিবিরোধী শক্তি এক হয়ে নির্বাচনে লড়ল এবং বিজেপির বিপুল অর্থ, প্রচারমাধ্যমের নির্লজ্জ পক্ষপাত, প্রশাসনের পক্ষপাত --- সবকিছু সত্ত্বেও হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করতে পারল। আরো যা উৎসাহব্যঞ্জক, দেখা গেল ভোটাররা চাকরি বাকরি, রাস্তাঘাট, সরকারী পরিষেবার মত ইস্যুকে একেবারেই আর গুরুত্ব দেন না এমন নয়। সর্বোপরি বিহারে বামপন্থীদের শক্তি বেড়ে গেল অনেকটা। কেবল বামপন্থী নয়, অনেক বিজেপিবিরোধী গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষই ভেবেছিলেন, এই শক্তি বৃদ্ধি পশ্চিমবঙ্গের লড়াইতে বামপন্থীদের জ্বালানি হয়ে দাঁড়াবে। ক্ষয়িষ্ণু অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বিজেপির সাথে সমানে সমানে টক্কর দিতে যা যা করা দরকার সবই তাঁরা করবেন। কিন্তু ঘটছে উল্টো। এই মুহূর্তে ধুন্ধুমার লড়াই চলছে দু দল বামপন্থীর মধ্যে। উপপাদ্য দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের মন্তব্য --- বিজেপিই প্রধান শত্রু।
এই উপপাদ্যের পক্ষে মূলত বামফ্রন্টের বাইরের বাম কর্মী সমর্থকরা, বিপক্ষে সিপিএমের কর্মী সমর্থকরা। মতানৈক্যের কারণ পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেস। সিপিএম কর্মী সমর্থকদের মূল বক্তব্য “তৃণমূলকে কেন ছেড়ে দেব? ওরাও একইরকম বিপজ্জনক।” অন্য বামপন্থীদের মধ্যে মূলত দুটো সুর শোনা যাচ্ছে। দীপঙ্করবাবুর পার্টির লোকেরা বলছেন “তৃণমূলও নিশ্চয়ই অগণতান্ত্রিক, বিপজ্জনক। কিন্তু বিজেপির মত নয়।” সিপিএম আর লিবারেশন --- দুটো দলেরই বৃত্তের বাইরে যাঁরা, তাঁদের কাউকে কাউকে বলতে শোনা যাচ্ছে, বামপন্থীদের নিরপেক্ষ থাকলে চলবে না। বিজেপির চেয়ে তৃণমূল শ্রেয়।
সুখের কথা, এই বাকযুদ্ধে লিবারেশন আর সিপিএমের শীর্ষ নেতৃত্ব যথেষ্ট সংযম দেখিয়েছেন এখন পর্যন্ত। সংবাদমাধ্যমগুলোর হাজার প্ররোচনাতেও এখন পর্যন্ত দীপঙ্করবাবুকে দিয়ে বলানো যায়নি, তৃণমূলের প্রতি বামপন্থীদের নরম হওয়া উচিৎ। আবার সীতারাম ইয়েচুরি, বিমান বসুরা বলেছেন, বিজেপি যে প্রধান বিপদ তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই, কিন্তু এ রাজ্যে বিজেপিকে হারাতে গেলে তৃণমূলকে হারাতেই হবে। পরিতাপের বিষয়, দু পক্ষের নীচের তলার কর্মী সমর্থকদের মধ্যে এই সংযম লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। সোশাল মিডিয়ায় অবিরাম একমুঠো ছেঁদো যুক্তিকে কেন্দ্র করে তর্ক আবর্তিত হয়ে চলেছে। উভয় পক্ষেরই সেই যুক্তিগুলো এত দুর্বল যে প্রায়শই তর্কটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে “তুই বেড়াল না মুই বেড়াল” গোছের। যুগটা সোশাল মিডিয়ার না হলে এইসব তর্ক নিয়ে আলাদা করে আলোচনা করার দরকার হত না। কিন্তু এখন বামপন্থীদের এই প্রকাশ্য লড়াই নিঃসন্দেহে নরেন্দ্র মোদী আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় --- উভয়কেই হাসির খোরাক যোগাচ্ছে, নিশ্চিন্ত করছে। কারণ বামপন্থী কর্মীদের লড়াইয়ের অভিমুখ আর দক্ষিণপন্থার দিকে থাকছে না। একে অপরকে শত্রু ভেবে বসছেন শেষ পর্যন্ত, মোদী-মমতারা পেয়ে যাচ্ছেন খোলা ময়দান।
সমস্ত কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীদের মধ্যেই মার্কসের একটা উক্তি খুব জনপ্রিয়। “ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়। প্রথমবার ট্র্যাজেডি হিসাবে, তারপর প্রহসন হিসাবে।” এ-ও যেন ষাট-সত্তরের দশকের সিপিএম-নকশাল দ্বন্দ্বের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। নিজেদের মধ্যে লড়াই করে প্রাণ হারাল, নির্যাতিত হল দু দলের এক ঝাঁক মার্কসবাদী --- আর পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় এসে পড়ল সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের মত দুঃশাসন। রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন, কে প্রকৃত কমিউনিস্ট তা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা ব্যথা নেই এমন নিরীহ নাগরিকের জীবনও দুর্বিষহ হয়ে উঠল। এবারে তফাত হল রক্তক্ষরণটা হচ্ছে সোশাল মিডিয়ায়। এর প্রভাব কিন্তু ভোটার মানসে পড়তে বাধ্য। কারণ মানুষ দেখছেন ছ-সাত মাস পরে ভোট, অথচ বামপন্থীরা তর্ক করছেন শত্রুদের মধ্যে কাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে তা নিয়ে। তাঁরা পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এলে কর্মসংস্থানের সমস্যার কী সমাধান করবেন তা নিয়ে ভাবছেন না, এ রাজ্যে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে গত কয়েক বছরে যে বৈরিতা সম্প্রীতির ইমারতের দেওয়াল ফাটিয়ে গজিয়ে উঠেছে তার সমূলে উৎপাটন কিভাবে হবে তা নিয়ে কথা বলছেন না, বেহাল স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কী সুরাহা করবেন তা নিয়ে কিছু ভাবছেন বলে মনে হচ্ছে না, স্কুল কলেজে স্থায়ী শিক্ষকের অভাব নিয়েও তাঁদের এখন পর্যন্ত কোন বক্তব্য নেই। বামপন্থীরা যখন এরপর বাড়ি বাড়ি ভোট চাইতে যাবেন, তখন কী বলে ভোট চাইবেন? কেবল মোদী আর মমতার ব্যর্থতার তালিকা দেখিয়ে যে ভোট পাওয়া যাবে না --- তা সাম্প্রতিককালের সব নির্বাচনে প্রমাণিত।
কেউ বলতেই পারেন, পার্টি নেতৃত্ব এই তর্ক থামিয়ে দিলেই থেমে যাবে। কিন্তু সোশাল মিডিয়ার যুগে তেমন কড়া রেজিমেন্টেশন বজায় রাখা আর সম্ভব নয়, তাছাড়া রেজিমেন্টেশন শেষ বিচারে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ভাল করে কিনা তা নিয়েও বিশ্বব্যাপী তর্ক আছে। উপরন্তু, মতপার্থক্য সাধারণভাবে একটা গণতান্ত্রিক লক্ষণ। বিজেপি কর্মীদের মধ্যে কোন মতপার্থক্য দেখা যায় কি? তাঁদের তো সব পথ এসে মোদীর দুখানি নয়নেই শেষে মিলে যায়। তৃণমূলে যা দেখা যায় সেটাও খেয়োখেয়ি, আদপেই মতপার্থক্য নয়। তাছাড়া সিপিএম, সিপিআই, লিবারেশন, এসইউসিআই যখন আলাদা আলাদা দল তখন মতভেদ থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই তর্কে যা উদ্বেগজনক তা হল দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্যতা। গোটা দেশ কোন বিপদের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে তা সংক্ষেপে প্রথম অনুচ্ছেদে লিখেছি। এই পরিস্থিতিতে বামপন্থীরা এমন সর্বশক্তি দিয়ে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করছেন, যেন দেশে দক্ষিণপন্থা কোন বিপদ নয়। কে বেশি বামপন্থী সেটা ঠিক করতে পারলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আজ আমরা এমন একটা সময়ে দাঁড়িয়ে, যে হয়ত ভোটে বিজেপির নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি হবে ভিন্নধর্মী মানুষের বিবাহের বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন। যেমনটা বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলোতে হচ্ছে। সেই পরিস্থিতিতে এই রাজ্যের বামপন্থীরা যে তর্ক করছেন, সেটাকে বলা যেতে পারে অরাজনৈতিক অথচ পার্টিজান তর্ক। কোন ইস্যুর নির্দিষ্ট অভিঘাত বিচার না করে অন্ধভাবে নিজের পার্টি লাইনে অনড় থেকে তর্ক করাকে এই অভিধা দিয়েছে আমার এক বন্ধু। যে পার্টির লোকই করুক, প্রবণতাটা নিতান্ত দক্ষিণপন্থী। ব্যাপারটা কিরকম? আসুন এই চালু তর্কে দু পক্ষেরই কয়েকটা জনপ্রিয় যুক্তি দিয়ে দেখে নেওয়া যাক।
যুক্তি ১: তৃণমূলই এ রাজ্যে বিজেপিকে ডেকে এনেছে, অতএব তৃণমূলই বিজেপি
নির্দিষ্ট প্রতিযুক্তি যা অন্য পক্ষের বলা উচিৎ ছিল, কিন্তু বলছেন না: যেন তেন প্রকারেণ পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতা দখল করতে মমতা ব্যানার্জি বিজেপিকে ডেকে এনেছিলেন। একই উদ্দেশ্যে পরে আবার বিজেপিকে ছেড়ে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করেছিলেন। কিন্তু এই মুহূর্তে তিনি ফের বিজেপির হাত ধরার অবস্থায় নেই, কারণ পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ৩০% মুসলমান অধিবাসীকে তিনি চটাতে পারেন না। যদি নির্বাচনের পর ত্রিশঙ্কু বিধানসভায় (সারদার চোখ রাঙানিতে) তিনি বিজেপির সঙ্গী হন, তাহলে তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ঝরঝরে। অতএব তৃণমূলকে ভোট দেওয়া মানেই বিজেপিকে ভোট দেওয়া --- এই মুহূর্তে এটা অতিসরলীকরণ।
যুক্তি ২: তৃণমূলের লোকেরা বিজেপিতে যাচ্ছে তো কী হয়েছে? সিপিএমের লোকেরাও তো যাচ্ছে
নির্দিষ্ট প্রতিযুক্তি যা অন্য পক্ষ বলছেন না: সিপিএম থেকে এখন অব্দি যে নেতা, কর্মীরা বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন তাঁরা ধারে ও ভারে যে তৃণমূলীরা যোগ দিয়েছেন তাঁদের ধারে কাছে আসেন না। মমতার এক সময়কার ডান হাত মুকুল রায় বিজেপিতে, বিধাননগর পৌরসভার মেয়র গিয়ে বিজেপিতে ঢুকে পড়েছেন। একই সঙ্গে কলকাতার মেয়র এবং রাজ্যের মন্ত্রীর পদে থাকা, মুখ্যমন্ত্রীর পরম স্নেহভাজন শোভন চট্টোপাধ্যায় বিজেপিতে। ভাল মন্দ যা-ই হোক, উত্তর ২৪ পরগণায় অর্জুন সিং এর প্রভাব অস্বীকার করবে কোন আহাম্মক? ভারতী ঘোষকে পুলিশের পোশাকে তৃণমূল নেত্রী মনে করা হত। তিনিও বিজেপিতে। সিপিএমত্যাগী রিঙ্কু নস্কর, জ্যোতির্ময়ী শিকদার, খগেন মুর্মু বা বিতাড়িত আইনুল হকের রাজনৈতিক প্রভাব ওঁদের ধারে কাছেও নয়। কোনদিনই ছিল না। অতএব নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিতে তৃণমূল বিধায়কদের দল বদলানোর সম্ভাবনা এখনো বেশি। বিজেপিবিরোধী মানুষের এই উদ্বেগ হেসে উড়িয়ে দেওয়ার নয়।
যুক্তি ৩: বিজেপি বাঙালিবিরোধী, হিন্দি আধিপত্যবাদী। মমতা তা নন
নির্দিষ্ট প্রতিযুক্তি যা অন্য পক্ষ বলছেন না: ছটপুজোয় বাংলায় সরকারী ছুটি চালু করেছেন মমতা। এখনো মুর্শিদাবাদের মত বড় জেলায় একটা বিশ্ববিদ্যালয় নেই, অথচ রাজ্যে হিন্দি বিশ্ববিদ্যালয় চালু করার প্রয়োজন বোধ করেছেন তিনি। অর্থাৎ ক্ষমতায় টিকে থাকতে হিন্দি সংস্কৃতিকে তোল্লাই দিতে তাঁর বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। কেন্দ্রে বিজেপি, এ রাজ্যে তিনি ক্ষমতায় থাকলে তিনি হিন্দি আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন --- এমন মনে করার কোন কারণ ঘটেনি।
যুক্তি ৪: বিজেপি সাম্প্রদায়িক, তৃণমূল ধর্মনিরপেক্ষ
নির্দিষ্ট প্রতিযুক্তি যা অন্য পক্ষ বলছেন না: মমতা যথেষ্ট সাম্প্রদায়িক। ইমাম, মুয়াজ্জিমদের ভাতার ব্যবস্থায় হিন্দুরা রেগে যাচ্ছে বুঝে তিনি পুরোহিতদের জন্য ভাতা চালু করেছেন। এটা শুধু সাম্প্রদায়িক সিদ্ধান্ত নয়, ব্রাহ্মণ্যবাদী পদক্ষেপও বটে। দলিত সাহিত্য অ্যাকাডেমি তৈরি করে এই দোষ স্খালন করা যায় না। দুর্গাপুজোয় সরকারী অর্থসাহায্যও কম সাম্প্রদায়িক নয়। এমনকি সি এ এ-এন আর সি বিরোধী আন্দোলনের সময় গ্রামাঞ্চলে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের উপর পুলিশি হয়রানির অভিযোগও আছে। ফেসবুক ঘাঁটলেই দেখা যায়।
যুক্তি ৫: বিজেপির মত মমতাও গণতন্ত্রবিরোধী, কোন তফাত নেই
নির্দিষ্ট প্রতিযুক্তি যা অন্য পক্ষ বলছেন না: কোন সন্দেহ নেই উনি গণতন্ত্রবিরোধী। শিলাদিত্য বা অম্বিকেশ মহাপাত্রের মত পুরনো ঘটনার কথা ছেড়ে দিন। এ রাজ্যে মাদ্রাসা শিক্ষকদের আন্দোলনে পুলিশের লাঠিচার্জ করার কথাও ভুলে যান। যে এন আই এ আইনে এই মুহূর্তে বহু প্রতিবাদীকে আটক করে রাখা হয়েছে, সেই বিল নিয়ে লোকসভার ভোটাভুটিতে তাঁর পার্টি বিলের বিপক্ষে ভোট দেয়নি। কিন্তু তৃণমূল সরকার এখনো গণতান্ত্রিক হওয়ার ভান করার প্রয়োজন বোধ করে। তাই সোশাল মিডিয়ায় এখনো সমালোচনা চলে। বিজেপির সমালোচনা তো চলেই। কিন্তু বিজেপির ভান নেই। পশ্চিমবঙ্গে তাদের সরকার হলে কেবল ফেসবুক পোস্টের জন্য মাসের পর মাসে বিনা বিচারে কারাবাস নয়, বাড়িতে আর এস এস গুন্ডাবাহিনীর চড়াও হওয়াও নিয়ম হয়ে দাঁড়াতে পারে।
যুক্তি ৬: সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের আন্দোলনে নকশালপন্থীরা মমতার সঙ্গেই ছিল, এস ইউ সি আই ২০১১ বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের সাথে জোট করেছিল, তাই এরা মমতাকে লঘুতর শত্রু বলে মনে করছে
নির্দিষ্ট প্রতিযুক্তি যা অন্য পক্ষ বলছেন না: এটা ২০২০। পরিস্থিতি অনুযায়ী সব দলেরই অবস্থান বদলায়। জরুরী অবস্থার বিরুদ্ধে জ্যোতি বসু আর অটলবিহারী বাজপেয়ী এক মঞ্চে দাঁড়িয়েছিলেন এবং বেশ করেছিলেন। তখন দেশের সামনে মূর্তিমান বিপদ ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী, সঙ্ঘ পরিবার নয়। তখনো হিন্দুত্ব বাজপেয়ীর এজেন্ডা ছিল না। এখন দেশের সামনে, পশ্চিমবঙ্গের সামনে মূর্তিমান বিপদ হল বিজেপি-আর এস এস। এই বিপদ ইন্দিরার চেয়েও অনেক বড়। অতএব এক-দেড় দশক আগে কে কী অবস্থান নিয়েছিল তা নিয়ে রাগ করে থাকার সময় এটা নয়।
তালিকা দীর্ঘায়িত করা নিষ্প্রয়োজন। বলছিলাম এ হেন অরাজনৈতিক পার্টিজান তর্ক আসলে দক্ষিণপন্থী প্রবণতা। কথাটা যে সত্যি, বামপন্থীদের মধ্যেও যে দক্ষিণপন্থা ঢুকে পড়ছে, তার প্রমাণ কেরালা সরকারের পুলিশ আইনে নবতম সংশোধনী। বাম আন্দোলনের ভিতর থেকেই প্রবল সমালোচনার মুখে পিনারাই কিছুটা পিছু হটেছেন। কিন্তু ফেসবুক পোস্টের জন্য কারাবাস অথবা জরিমানা করার আইন যদি কোন বামপন্থী সরকার করে, তাহলে বিজেপির বিরুদ্ধে যারা, তাদের পায়ের তলার মাটি সরে যায়। অতএব কে কত বড় মার্কসবাদী, কে অতিবাম আর কে বুর্জোয়া দলে পরিণত হয়েছে --- সে তর্ক এখন থাক না। বামপন্থা মানুষের জন্য, মানুষ তো বামপন্থার জন্য নয়।