উত্তরবঙ্গের মেচি নদীর সেতু পেরিয়েই শুরু হচ্ছে নেপাল সীমান্ত। রাজধানী কাঠমান্ডু সহ নেপালের এক বড় অংশ ব্যাপক জনবিক্ষোভে অগ্নিগর্ভ। ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন সংবাদ সংস্থা থেকে পাওয়া খবর অনুযায়ী, নেপালের প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন, তিনি এখন সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে। শুধু সরকার পক্ষ নয়, বিরোধী সবকটি রাজনৈতিক দল এবং উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও ছাত্র যুবদের নেতৃত্বে আপামর জনগণ প্রতিবাদ বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছেন। সমস্ত নেতাদের বাড়িঘর ভাঙচুর, লুঠপাট করে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যে সমস্ত হোটেল, দোকান কোন না কোন রাজনৈতিক নেতার বা তাদের আত্মীয়ের নামে, সেগুলোই জ্বালিয়ে দেওয়া হয় আবাসিকদের বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিয়ে। পার্শ্ববর্তী অন্যান্য হোটেল রয়েছে অক্ষত।
সংসদ ভবন, সুপ্রিম কোর্ট, প্রেসিডেন্টের বাসভবন জ্বলল দাউদাউ করে। মন্ত্রীসভার সদস্যদের দেশ ত্যাগের হিড়িক পড়েছে। কাঠমান্ডু ও ইটাহারি সহ বিভিন্ন শহরে পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সংঘর্ষে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ২৩ এবং তিন শতাধিক আহত।
নেপালের বিক্ষোভের প্রতিক্রিয়ায় কারণে কাঠমান্ডু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বন্ধ হয়ে পড়ে। নেপালে আসা যাওয়ার সব বিমান বন্ধ রেখেছে ইন্ডিগো ও এয়ার লাইন্সের মতো ভারতীয় বিমান সংস্থাগুলো। শিলিগুড়ি কাঠমান্ডু বাস পরিষেবা বন্ধ। ভারত নেপাল সীমান্ত কার্যত বন্ধ।
নেপালের এই ভয়াবহ ঘটনা থেকে একটা স্পষ্ট বার্তা পাওয়া যায়, রাজনৈতিক দলগুলো ও বর্তমান গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দেশের মানুষ অত্যন্ত বীতশ্রদ্ধ বিরক্ত। তিনদিনের বিক্ষোভ ভাঙচুর অগ্নিসংযোগের পর ১০ তারিখ সকাল থেকেই সেনাবাহিনী শাসনভার নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছে। কারফিউ ও রুট মার্চ চলছে। নতুন শাসক হিসেবে বিক্ষোভকারীরা দেশের প্রথম মহিলা প্রধান বিচারপতি এবং স্বচ্ছ ভাবমূর্তি ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করা সুশীলা কার্কির নাম প্রস্তাব করেছে। ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার দিকে নেপালের এগিয়ে যাওয়া এখনও বিশ বাঁও জলে।
১১ সেপ্টেম্বর : নতুন সরকার গঠনের রূপরেখা স্থির করতে সেনাবাহিনীর সদর দফতরে সেনাপ্রধান, সম্ভাব্য নতুন প্রধানমন্ত্রী সুশীলা কার্কি এবং আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধিদের মধ্যে ত্রিপাক্ষিক বৈঠক শুরু হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে বৈঠকে অংশ নিতে আসেন রাজতন্ত্র এবং হিন্দু রাষ্ট্রপন্থী আন্দোলনের নেতা দুর্গা প্রসাই। সঙ্গে সঙ্গে বৈঠক থেকে ওয়াকআউট করেন 'জেন জি' আন্দোলনের প্রতিনিধিরা৷ তাঁরা দুর্গা প্রসাই এবং রাজতন্ত্রের সমর্থক রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রীয় স্বতন্ত্র পার্টিকে আন্দোলনের অংশ হিসাবে মানতে রাজি নন। আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধিরা বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন, তাঁদের আন্দোলন হাইজ্যাক করা হয়েছে। আন্দোলনের নামে ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম সংগঠিত হয়েছে। আন্দোলনের শক্তি হিসাবে রাজতন্ত্রীদের সামনে আনা হচ্ছে। আন্দোলনকারীরা সাংবাদিক সম্মেলনে জানিয়েছেন, তাঁরা সংবিধানের বিরোধিতা করতে চান না৷ সংবিধান মেনেই এগিয়ে যেতে চান। সব দেখেশুনে মনে হচ্ছে, ঠিক বাংলাদেশের মতোই সম্ভবত পরিস্থিতির উপর থেকে বিক্ষুব্ধ তরুণ প্রজন্মের নিয়ন্ত্রণ কমছে।
যদিও নেপালের বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলে রাজতন্ত্র বিরোধী কমিউনিস্ট, মাওবাদী এবং কংগ্রেস-সহ গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির উপস্থিতি প্রবল। কিন্তু সোস্যাল মিডিয়ায় তাঁরা প্রায় অস্তিত্বহীন। বরং জেন জি আন্দোলনের বিভিন্ন অংশ, আর্ন্তজাতিক এনজিও এবং রাজতন্ত্রীদের প্রভাব অনেক বেশি। নেপালের পরিস্থিতি জটিল থেকে ক্রমশ জটিলতর হচ্ছে।
কেন এই ব্যাপক জন বিক্ষোভ?
নেপাল সরকার ৪ সেপ্টেম্বর ২৬টি সামাজিক মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম –ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউব, এক্স (টুইটার), ইত্যাদি ব্লক করে দেয়। সরকারের দাবি অনুযায়ী এই মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলি নিবন্ধনের শর্ত পূরণ করেনি। নেটিজেন ও বিশেষ করে যুবক যুবতীরা এটিকে মতপ্রকাশে হস্তক্ষেপ এবং সেন্সরশিপের প্রচেষ্টা হিসেবে বিচার করে রাস্তায় নেমে পড়েন সোমবার, ৮ ই সেপ্টেম্বর থেকে।
যদিও এই ব্যাপক জনরোষের পিছনে আরও অনেক গভীর কারণ আছে : দীর্ঘদিনের দুর্নীতি ও প্রশাসনিক দুর্বলতা, স্বজনপোষণ, সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ, চরম বেকারী। দেশে কর্মসংস্থান তলানিতে ঠেকায় কাজের খোঁজে বিদেশে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশে যেতে বাধ্য হওয়া, লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি, আর্থিক বৈষম্য, ইত্যাদি কারণে যুব সম্প্রদায় তথা Gen-Z ক্ষুব্ধ ছিলই। অবস্থাটা অনেকটা আমাদের দেশের মতোই। ধিকিধিকি করে জ্বলতে থাকা ছাইচাপা আগুনে ঘৃতাহুতি হল সোশ্যাল মিডিয়া ব্যান করার সরকারি ঘোষণায়। লক্ষ লক্ষ নেপালবাসী ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক, ইউটিউব, স্ন্যাপচ্যাটের মতো সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেন। বলাই বাহুল্য বর্তমান যুগে শুধুমাত্র সংবাদ বা বিনোদনের জন্যই নয়, ব্যবসায়িক কারণেও বহু মানুষ এইসব প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহার করেন। প্রতিবাদকারী যুবক যুবতীদের প্রতিক্রিয়া –“সরকার দুর্নীতি আটকাতে পারছে না। তাই মানুষের বাকস্বাধীনতা ও ভাব প্রকাশের অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ করছে।” কেউ বা বলছেন –“নেপালে দুর্নীতিরাজ একটা প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা নিয়েছে। ঘুষ না দিলে সাধারণ একটা পরিষেবাও পাওয়া দুষ্কর। নেতামন্ত্রীদের ছেলেমেয়েদের বিলাসবহুল জীবনযাপনের খবর সমাজমধ্যমে ফাঁস হয়ে যাচ্ছিল। তাই তড়িঘড়ি নিষেধাজ্ঞা।” আরও কিছুটা এগিয়ে এক তরুণী জানালেন –“সরকারের স্বেচ্ছাচারী মনোভাবের প্রতিবাদে পথে নেমেছি। আমরা এই পরিস্থিতির বদল চাই। অন্যরা মেনে নিলেও তরুণ প্রজন্ম এর শেষ দেখতে চায়।”
নেপালে ডিজিটাল পরিষেবা বন্ধের ঘটনা প্রতিবেশী দেশগুলোর বৃহত্তর দৃষ্টিভঙ্গির অংশ। যেখানে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশই (যেমন ভারত বাংলাদেশ পাকিস্তান) ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম নিয়ন্ত্রণে বারংবার কঠোর অবস্থান নিয়েছে। AP News-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, নেপালের সংশ্লিষ্ট ঘটনা তরুণ তরুণীদের বিশাল ক্ষোভের প্রতিফলন। এটি কেবল সামাজিক মিডিয়ায় স্বাধীনতা নয়। বরং দুর্নীতি, অগ্রগতিহীনতা ও রাজনৈতিক স্বচ্ছতার অভাবের বিরুদ্ধে একটি বিস্তৃত প্রতিবাদের অংশ। স্বভাবতই পুরো দেশ এখন রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে। সরকারের পালাবদল একরকম নিশ্চিত। বিক্ষোভকারীরা যদিও রাজতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা চাইছেন। গণ্ডগোলটা তো সেখানেই। অনেকেই মনে করছেন, নেপালে রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বর্তমান ভারত সরকারের ভালো রকম ইন্ধন আছে। অনেক কিছুই ধীরে ধীরে প্রকাশিত হবে। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে অনেক কেউটে গোখরো বেরিয়ে পড়বে। আমাদের নজর থাকবে সেইদিকে। কিন্তু আবার কেন রাজতন্ত্র চাইছেন নেপালের মানুষ?
নেপালে পালাবদল ও স্বপ্নভঙ্গের ইতিহাস :
২০০১-২০০৮ : নেপালের রাজা ছিলেন জ্ঞানেন্দ্র। ২০০৫ সালে তিনি পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে দেশে জরুরী অবস্থা জারি করেন এবং অত্যন্ত কড়া হাতে মাওবাদীদের দমন করার উদ্যোগ নেন। যার জেরে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল জ্ঞানেন্দ্রকে। প্রতিক্রিয়ায় যা ধীরে ধীরে গণ আন্দোলনের রূপ নেয়। বামপন্থীদের নেতৃত্বে জনগনের ব্যাপক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ২০০৮ সালে রাজতন্ত্রের অবসান হয়। ক্ষমতায় আসে নির্বাচিত বামপন্থী সরকার। এতদিন যে দেশ ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ হিসেবে পরিচিত ছিল, তার নতুন পরিচয় হয় ‘ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্র’। উত্তাল সময় পেরিয়ে নতুন রূপের নতুন শাসনে জনগণ কী পেলেন? প্রবল দুর্নীতি, নেতা মন্ত্রী ও তাঁদের পরিবারের বিলাস বৈভব ও স্বজনপোষণ, আর অন্যদিকে আর্থিক সংকটে জর্জরিত দেশের আপামর জনগণ। এহেন রাষ্ট্রের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে গত কয়েক বছর ধরেই ক্ষোভ বাড়তে থাকে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে। যেসব নেতা এতদিন ধরে রাজনৈতিক স্থিতাবস্থার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছেন, বাস্তবে তা না মেলায় স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে নেপালবাসীর। ২০২৪ সালের মার্চ ও মে মাসে সরকার বিরোধী বেশ কিছু মহামিছিল ও সমাবেশ হয়। তখন প্রতিরোধের অন্যতম মুখ হিসেবে আবার সামনের সারিতে উঠে আসেন রাজা জ্ঞানেন্দ্রই। জানা যাচ্ছে, বহুদিন ক্ষমতার অলিন্দের বাইরে থাকলেও দেশে প্রাক্তন রাজার সমর্থকের সংখ্যা কম নয়। এবং সমর্থকদের দাবি –বর্তমান অস্থির সময়ে দেশকে দিশা দেখাতে পারেন প্রাক্তন রাজাই। ১৮ বছর আগে দেশের মানুষ ঠিক যেভাবে রাজতন্ত্র ও হিন্দু রাষ্ট্রের অবসানের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতেন, সেই স্লোগান বিক্ষোভ প্রতিবাদের সুচিমুখ এখন ঘুরে গেছে বামপন্থী শাসকদের বিরুদ্ধে। দেশের মানুষের কেন এত বিক্ষোভ?
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, সামগ্রিকভাবে রাজনৈতিক ব্যবস্থার উপর বীতশ্রদ্ধ হয়েই রাজতন্ত্র ফেরত চাইছেন নেপালবাসীরা। ২০০৮ সালে এ দেশে প্রথম নির্বাচন হওয়ার পর একটি সরকারও পূর্ণ মেয়াদ ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। গত ১৭ বছরে এক ডোজনের বেশি প্রধানমন্ত্রী বসেছেন নেপালের শীর্ষপদে। বামপন্থী সিপিএন- ইউএমএল নেতা ওলি, নেপালি কংগ্রেস প্রধান শের বাহাদুর দেউবা, বামপন্থী নেতা পুষ্পকমল দোহাল অর্থাৎ প্রচন্ড যখন যেমন প্রয়োজন জোট সরকার তৈরি করে নিয়েছেন নিজেদের সুবিধামতো। উদাহরণস্বরূপ, ২০২২ সালের ভোটে তৃতীয় স্থান পেয়েও প্রচণ্ড ক্ষমতার অলিন্দে চলে আসেন ওলি ও দেউবার সমর্থনে। এভাবেই নেপালের গণতন্ত্র বারবার প্রহসনে পরিণত হয়েছে। নড়বড়ে সরকারগুলি নীতিপঙ্গুতে ভোগে, উন্নয়নের কাজে এগোয় না, বেকারত্ব ঘোচে না, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমশ দুর্বল হতে থাকে, ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে সাধারণ মানুষের দুর্দশা। তবুও ক্ষমতার রাশ ছাড়তে নারাজ শাসক বাহিনী। নেপালের প্রথম মহিলা রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিজের মেয়াদ শেষ করে সিপিএন-ইউএমএলের চেয়ারপার্সন পদে নির্বাচনে ওলির বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বিদ্যাদেবী ভান্ডারী। ফল? দল তাঁর সদস্যপদই খারিজ করে দেয়। সেই ওলি আজ শুধু গদিচ্যুত নন, তিনি ভিটেচ্যুতও হলেন।
অন্যদিকে, বর্তমান টালমাটাল সুযোগকে কাজে লাগিয়ে প্রাক্তন রাজা জ্ঞানেন্দ্র আবার স্বমহিমায় ফিরছেন। তাঁর লম্বাচওড়া বিবৃতি –“নতুন প্রজন্মের ন্যায্য দাবি না শুনে যেভাবে মানুষের প্রাণ নেওয়া হল, অনেকে জখম হলেন, তা অত্যন্ত নিন্দনীয়। শান্তিপূর্ণ নেপালি সমাজের সঙ্গে এই ধরনের হিংসার ঘটনা খাপ খায় না। দুর্নীতি দমন ও সুশাসনের যে দাবি প্রতিবাদীরা তুলেছেন তা অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত। দেশের ভবিষ্যতের কথা ভেবে এদিকে আমাদের নজর দিতে হবে।” একই সঙ্গে যদিও দেশের যুবসমাজের প্রতি তাঁর আবেদন –“হিংসা ও নৈরাজ্য থেকে দূরে থাকুন। প্ররোচনায় পা দেবেন না।” তোবা তোবা! জনগনের প্রবল আন্দোলনে গদিচ্যুত রাজার রাজত্ব ফিরে পাওয়ার তীব্র আকুতি।
নানান মহলে প্রতিক্রিয়া:
বর্তমান আন্দোলনে কোনও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক নেতৃত্ব না থাকলেও কাঠমান্ডুর নির্দল মেয়র, গায়ক বালেন্দ্র শাহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন। নেপালের কমিউনিস্ট পার্টির (মাওবাদী কেন্দ্র) নেতা, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী প্রচণ্ড আন্দোলনকারীদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন৷ তিনি সরকারের সমালোচনা করেন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যান করার জন্য। নেত্র বিক্রম চাঁদের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি আন্দোলনকারীদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন। ‘কমিউনিস্ট পার্টি অফ নেপাল (ইউনিফায়েড সোস্যালিস্ট)’ এর নেতা এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মাধব নেপালও আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। নেপালের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন জানিয়েছে –“বিক্ষোভকে উস্কে দিতেই পুলিশ ও সামরিক বাহিনী আন্দোলনের উপর ইচ্ছাকৃত দমন পীড়ন নামিয়ে এনেছে। তারা নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে।” কাঠমাণ্ডুভিত্তিক বামপন্থী যুব সংগঠনগুলি রাজপথে সক্রিয় আছে ঠিকই। কিন্তু একইসঙ্গে নেপালের রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনার দাবিতে সক্রিয় দক্ষিণপন্থীরাও এই আন্দোলনের মধ্যে আছে। বৃহত্তর নেপাল গঠনের সমর্থক সহ বিভিন্ন বাম এবং ডানপন্থী শক্তি আন্দোলনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছে।
Amnesty International ও জাতিসংঘের মানবাধিকার তত্ত্বাবধানকারী সংস্থাগুলো নেপালের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে একটি স্বতন্ত্র, নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি করেছে। আন্তর্জাতিক সাংবাদিক সংস্থা IFJ, Federation of Nepali Journalists এবং Nepal Press Union সাংবাদিকদের উপর পুলিশের সহিংস আচরণের তীব্র নিন্দা করে মামলা ও হত্যার ঘটনা অনুসন্ধানে দ্রুত তদন্তের আহ্বান জানায়। বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিনিধি জানিয়েছেন –“যখন সামাজিক যোগাযোগ অপরিহার্য হয়ে উঠছে, তখন এই নিষেধাজ্ঞা এবং আন্দোলন দেশীয় অর্থনীতি ও ডিজিটাল যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম, তরুণ সমাজ ও ডিজিটাল ব্যবসার ওপর।” Euronews-এ প্রকাশিত বিশ্লেষণে উল্লেখ করা হয়েছে, নেপাল সরকারের নিষেধাজ্ঞা বিশ্বের অন্যান্য দেশে ক্রমবর্ধমান প্রবণতার অংশ। যেখানে বিভিন্ন সরকারগুলো তথ্য নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়াসে সোশ্যাল মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। Freedom House-এর একজন বিশেষজ্ঞের মন্তব্য –“সোশ্যাল মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণের নামে পুরোপরি ব্লক করাটা অযৌক্তিক এবং অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে।”
এইসব প্রতিক্রিয়া থেকে স্পষ্ট যে, নেপালের ঘটনা দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং এটি বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র, তথ্য-স্বাধীনতা ও তরুণ প্রজন্মের ক্ষমতায়নের ওপর এক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হচ্ছে। এটাও জলের মতো স্পষ্ট যে, নেপালের ঘটনার সাথে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশ সরাসরি জড়িয়ে আছে এবং জড়িয়ে পড়বে। বাংলাদেশ, মায়ানমার, পাকিস্তান, ভারত সহ এশিয়ার দেশগুলোতে টালমাটাল পরিস্থিতি চলবে বেশ কিছুকাল বলেই মনে হয়।
ভাবনার পরিসরে যা আসা দরকার :
শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়ার পর নেপালের এই ভয়াবহ জনরোষ চোখে আঙুল দিয়ে প্রমাণ করে যে, জনগণের শক্তিই শেষ কথা বলে। যদিও এই ঘটনাগুলোর পিছনে আমেরিকার কলকাঠি নাড়ার প্রশ্নটি বারবার করেই সামনে আসছে। “চীনকে চাপে রাখতে নেপালে বিমান ঘাঁটি বানাতে চায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র” –এইরকম একটি খবর আমাদের দেশের সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘোরাঘুরি করছে। যদিও এই ভুয়ো খবরের কোন তথ্যসূত্র পাওয়া যায়নি। আর, দেশে দেশে সঠিক ধারার কমিউনিস্ট পার্টি না থাকার কারণেও এইসব জনবিক্ষোভ বারবার করে পথভ্রষ্ট হচ্ছে। তার দায়টা কি শুধু বিক্ষোভকারীদের? কেন জনগণের স্বার্থে আজকের যুগোপযোগী সঠিক মতাদর্শের ওপর ভিত্তি করে পার্টি গড়ে উঠছে না, সমস্যা ঠিক কোথায়, তা গভীরে তলিয়ে ভাবার দায়িত্ব কি বামধারার দলগুলোর ওপর বর্তায় না?
বিশ্বজুড়ে অর্থ-পুঁজির গভীর সংকট প্রকৃতি পরিবেশ সহ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবন জীবিকার ওপর সরাসরি আঘাত হানছে। আমেরিকার বিভিন্ন প্রদেশে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের নানান দেশেও দীর্ঘদিন ধরে প্রবল বিক্ষোভ প্রতিবাদ, আন্দোলন চলছে। আর এইসব অঞ্চলে জনগণের লড়াই আন্দোলন মূলত শাসকশ্রেণীর নয়া নয়া জনবিরোধী নীতি এবং প্রকৃতি পরিবেশ সংরক্ষণে সরকারের অপদার্থতা ও অযৌক্তিক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে। আর্থিক বৈষম্য, মুদ্রাস্ফীতি, ব্যাপক কর্মসংকোচনের বিরুদ্ধেও এইসব অঞ্চলে লক্ষ লক্ষ মানুষের বিশাল বিশাল মিছিল, বিক্ষোভ কর্মসূচি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
পৃথিবী কি তাহলে এক নতুন যুগের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে? যদিও বর্তমানে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে সামাজিক, রাজনৈতিক, বা অর্থনৈতিক অস্থিরতার সাথে ঐ ঐ অঞ্চলের ভূ রাজনৈতিক পরিস্থিতিও একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। গুরুত্বপূর্ণ স্বপ্নের অপমৃত্যু, বিশ্বাসের কবর। যে বিপুল বিশ্বাসে ভর করে অবিভক্ত মাওবাদী পার্টি ও প্রচণ্ডের নেতৃত্বে নেপালের জনগণ বিদ্রোহ করেছিলেন, দল এবং দলনেতা সেই বিশ্বাসের মর্যাদা রাখেননি। একদা ঐক্যবদ্ধ দল আজ ভেঙে খানখান। জনগণের নেতা ও সাথী প্রচণ্ড প্রধানমন্ত্রী হলেও মহিলা সহ সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানের বিশেষ কোন হেরফের হয়নি। জনগণের অভিজ্ঞতা –তাঁদের নেতা বদলে গিয়েছেন। দলও বদলে গিয়েছে। তাই জনগণের ভাবনাচিন্তা, আশা আকাঙ্ক্ষাও বদলে গিয়েছে। বামপন্থী সহ প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলির বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছেন জনগণ। যদিও এর বিকল্প কোনভাবেই স্বৈরাচারী, স্বেচ্ছাচারী রাজতন্ত্র হতে পারেনা। কিন্তু মনে রাখতে হবে বেশ কিছুকাল ধরেই নেপালের এক গরিষ্ঠ অংশ রাজতন্ত্রের পক্ষে সওয়াল করছিলেন। মিটিং মিছিল বিক্ষোভ সমাবেশও জারি ছিল। রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনগণের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর বামপন্থী দল পরিচালিত সরকারের বিরুদ্ধে রাজতন্ত্রের জয়গান উঠছে কেন, আমরা ভাববো না? যাঁরা সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেন, নেপালের শিক্ষা তাঁদের কাছে বিরাট বড় পাথেয় হয়ে থাকবে নিশ্চিত করেই।
তথ্যসূত্র:
সোশ্যাল মিডিয়ার বেশ কিছু লেখা।
এইসময়, আনন্দবাজার পত্রিকা।
The Hindu news paper