একটা দু’চাকার গাড়িতে চেপে বসেছে চার চারজন, বাবা-মায়ের মাঝখানে দুটো বাচ্চা, চেপ্টে স্যান্ডউইচ। দৃশ্যটা দেখে রতন টাটার মন খারাপ হয়ে গেল, তড়িৎ গতিতে বানিয়ে ফেললেন ‘ন্যানো’ গাড়ি। উদ্বোধনপর্বটা ছিল বর্ণাঢ্য, ২০১০ সালে অনবদ্য প্রকৌশলের জন্য বছরের শ্রেষ্ঠ গাড়ি হিসেবে সে পুরস্কারও জিতে নিল। লহমার আয়ুষ্কালে এটা ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে সস্তা গাড়ি।
রতন টাটার চোখে ঠুলি লাগানো ছিল। এ-দেশের মধ্যবিত্ত মানুষজনের আয়েশ আর নিরাপত্তা নিয়ে তাঁর উদ্বেগ প্রশংসনীয় ঠিকই, কিন্তু ছবিটাকে আরও বড় করে দেখলে কেমন দেখায়? ১৯৫০-এর পর থেকে আমাদের দেশে গাড়ি তৈরির বহর বেড়েছে বছরে ১১ শতাংশ হারে, আর রাস্তার বহর বেড়েছে মোটে ৪ শতাংশ হারে। ট্র্যাফিক জ্যাম আর বায়ুদূষণ আমাদের নিত্য সহচর; তার উপর আছে পথ দুর্ঘটনায় প্রতিদিন ৫০০ জনের মৃত্যু। আমাদের রাস্তাঘাটের প্রায় ৭০ শতাংশ থাকে অসরকারি আর ব্যক্তিগত গাড়িগুলোর দখলে আর সেই যানগুলো ব্যবহার করে মাত্র ৩৭ শতাংশ যাত্রী। তার মানে, সরকারি গাড়িগুলোই অধিকাংশ যাত্রীর ভার নেয় অথচ তাদের হাতে থাকে রাস্তাঘাটের বাদবাকি, ছোট অংশটা। তাহলে প্রতিটি পরিবারের একটা করে গাড়ি থাকবে, রতন টাটার এই অন্তর্দৃষ্টি দেশের গরিব বা সচ্ছল, কারোরই কাজে লাগল না। দু’পক্ষই বায়ুদূষণ, ট্র্যাফিক জ্যাম আর দুর্ঘটনার শিকার হয়ে থাকলেন। যাতায়তের ক্ষিপ্রতা যদি সমস্যা হয়ে থাকে তবে তার সমাধান ছিল রাস্তাঘাট আর সরকারি যানবাহনের মান উন্নত করায়। কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোটার প্রাক্তন মেয়র গুস্তাভ পেট্রোর একটা বিখ্যাত উক্তি ছিল, ‘গরিবের ঘরে গাড়ি থাকলেই তাকে উন্নত দেশ বলে না, বরং যেখানে ধনীরাও সরকারি যান ব্যবহার করে সেই দেশই উন্নত’।
মানব-হিতৈষী এমন আরও একজন আছেন, পোলিও আক্রান্ত শিশুদের কথা ভেবে যাঁর মন ভেঙে গিয়েছিল; তিনি বিল গেটস। সংক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করার লক্ষে তিনি টিকাদানের কাজে আত্মনিয়োগ করলেন, গেটস ফাউন্ডেশনকে নিয়ে তিনি তৈরি করলেন একটি বিশ্ব মোর্চা – গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাক্সিনস অ্যান্ড ইম্যুনাইজেশন্স, সংক্ষেপে ‘গাভি’ নামে এখন তা পরিচিত। এই উদ্যোগে তাঁর প্রাথমিক বিনিয়োগ ছিল ৭৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, এখন তা বেড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। তাঁর উৎসাহও খুবই প্রশংসনীয়; কিন্তু আবার সেই একই প্রশ্ন, বড় ছবিটা ঠিক কেমন? টিকাদানকে জাতীয় কর্মসূচির মধ্যে রাখতে গেলে আগে ভাবতে হয়, কোন দেশের কোথায়, কতটা, কী দরকার; অর্থাৎ জনস্বাস্থ্যের দাবিটা কোথায় কেমন? টিকাদানের বড় বড় সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে বড় বড় ব্যর্থতাও আছে, বিশেষ করে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। টিকা দেওয়া হয় সুস্থ লোকজনকে; তাই টিকার কুফল নিয়ে ভাবাটা জরুরি, সে যত কমই হোক না-কেন। এখানে নীতি বা ন্যায্যতা, মানুষের নিরাপত্তা এবং আস্থার কথা চলে আসে। টিকা দেওয়ার পরে কোনও কুফল ঘটছে কিনা, কতটা ঘটছে তা একেবারে শুরুতেই সনাক্ত করার জন্য একটা শক্তিশালী বন্দোবস্ত থাকা একান্ত জরুরি।
রাস্তাঘাটের মতোই আমাদের দেশে জনস্বাস্থ্যের বুনিয়াদি কাঠামোগুলোর অবস্থা মর্মান্তিক। এই সীমাবদ্ধতার কথা মাথায় রাখলে বুঝতে অসুবিধে হয় না যে, আমাদের দেশে নতুন নতুন, অপরীক্ষিত টিকা চালু করে দিলে তার পরিণাম কী হতে পারে। জরাজীর্ণ, ক্ষণভঙ্গুর রাস্তার উপর নতুন নতুন গাড়ি চালু করে দিলে যা হয় তাই হবে। নতুন গাড়ির দরকার কতটা তা বুঝতে পারলে এও বুঝে নেওয়া যায় যে, কোভিড-১৯-এর মতো একটা ব্যাধি যেখানে সংক্রমণ-জনিত মৃত্যুহার ০.১ শতাংশেরও কম সেখানে টিকার দরকার ঠিক কতটা। জনস্বাস্থ্যের নীতি তৈরি হয় দেশ বা অঞ্চলের মানুষের চাহিদা অনুযায়ী। একই মাপের জুতো সকলের পায়ে মানায় না। যস্মিন দেশে যদাচারঃ। জনস্বাস্থ্যের ব্যাপারে অন্য দেশের প্রচলিত নীতি টুকে নিয়ে আমাদের দেশে চালু করে দিলে তা কার্যকরী হয় না, দেশের সম্পদও নষ্ট হয়।
এইভাবে আমরা ভয়ংকর ব্যাধিগুলোকে অবহেলা করে যে-সংক্রমণে বিশেষ করে, সুস্থ মানুষজন আর যুবকদের মধ্যে মৃত্যুহার যৎসামান্য সেখানেই দেশের সম্পদ বিনিয়োগ করে যাচ্ছি। আমরা যেন ভুলেই যাচ্ছি যে, প্রতিটি দিন আমাদের দেশে অন্তত ২০০০ শিশু এমন এমন অসুখে মারা যায় যেগুলো প্রতিরোধযোগ্য। প্রতিটি দিন অন্তত ১৪০০ ভারতবাসী টিবিতে মারা যায়। ডেঙ্গু, টাইফয়েড বা চিকুনগুনিয়ার মতো অসুখবিসুখ যাদের প্রাদুর্ভাব আমাদের দেশে বেশি তাদের উপর নজরদারির বন্দোবস্তই আমাদের দেশে নেই। নিজেদের তথ্যপ্রমাণ নেই বলেই যারা অনুদান দেয় আর অনুদানপুষ্ট গবেষণাগুলোর উপরেই আমাদের নির্ভর করতে হয়।
এইরকম একটা অবস্থায় টিকাদানের পর কী কুফল হচ্ছে তার তথ্যপ্রমাণ যোগাড় করা যে আরও দুরূহ তা বলা বাহুল্য। তাই অনেকে যখন বলেন যে, টিকা-জনিত কুফলের কোনও তথ্যপ্রমাণ নেই তখন বলতে হয়, তথ্যের অনুপস্থিতি আর অনুপস্থিতির তথ্য এক কথা না। আমাদের দেশে জনস্বাস্থ্যের জীর্ণ, কংকালসার পথঘাটের উপর দিয়ে সুপারফাস্ট ট্রেন-এর মতো কোভিডের গণটিকাকরণ চলছে। আমরা এখন শুধু ঈশ্বরের কাছে এইটুকু মিনতি জানাতে পারি, লাইনচ্যুত হয়ে যেন বিরাট কোনও দুর্ঘটনা ঘটে না-যায়।
ভাইরাস অসংখ্য, মিউটেশন-সৃষ্ট তাদের বংশধরও অগণন। তাহলে কি অদূর ভবিষ্যতে শয়ে শয়ে টিকা নেওয়াই আমাদের নিয়তি? অতএব আমরা ভাবতে পারি, ‘সক্কলের টিকা হয়ে গেল কিনা এটা উন্নত দেশের প্রমাণ না; বরং উন্নত দেশ তাকেই বলে যেখানে সক্কলের মাথার উপরে ছাদ থাকে, সক্কলে পুষ্টিকর খাবার পায়, স্বাস্থ্য পরিষেবা সক্কলের কাছে পৌঁছে যায়, নির্মল পরিবেশে সক্কলে পরিস্রুত, পানীয় জল পায়। সে এমন এক দেশ যেখানে টিকার ব্যবহারের পিছনে যুক্তি থাকে, বিচক্ষণতাও।’
https://epaper.telegraphindia.com/textview/383613/162135627/71.html
ডাক্তার অমিতাভ ব্যানার্জি
বিভাগীয় প্রধান, কমিউনিটি মেডিসিন, ডা. ডি ওয়াই পাতিল মেডিকেল কলেজ, পুনে, ভারত)
টেলিগ্রাফ ই-পেপার, জানুয়ারি ১২, ২০২২
(ভাষান্তর – স্থবির দাশগুপ্ত)