কী কী কাজ করলে দলিত বলা যায় এ নিয়ে বিতর্ক নেই, বিতর্কটা তৈরি করা যায় দলিতরা কী কী কাজ করে তা নিয়ে। সে করতে গেলে তালিকা বানাতে হবে। তালিকা বানাতে গিয়ে পর পর অনেকগুলো তালিকা বানাতে হবে। এই ভাবে তালিকার পর তালিকা জুড়ে যা হয় তাকে যাচ্ছেতাই বলা যেতে পারে নাকি তা কোন একটা কিছুর দিকে নিয়ে যেতে পারবে।
সব সময় নির্দিষ্ট কোন কিছু হলেই যে প্রকল্পনা হবে তার কোন মানে নেই। আমরা একজনের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি চেক কাটবেন এমন কথাই ছিল। তিনি কথা বলবেন এমন কথা ছিল কি? কিন্তু দেখা গেল বাস্তবে তিনি কথা বলছেন ও অসংলগ্ন কিছু কথা তাঁকে চেক কাটা থেকে বিরত করছে। আমরা যেই ভেবেছি উনি চেক বইতে লিখবেন তখনই উনি কলম তুলে নিয়ে শ্যামলদাকে বললেন,“ অবশ্য আপনি একটা অন্য জায়গা থেকে ধরার চেষ্টা করেন। যদিও আপনার সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা আছে তবে অন্যদের মতো আপনি কিন্তু নিজেকে সামনে আনেন না। আনেন কি? যদি আনতেন তবে তো বোঝা যেত আপনি সামনে আনছেন। সেটাই বা বলি কী করে, সব সামনে আনা তো বোঝা যায় না। কী জানি, আচ্ছা আপনি কী বলেন। আপনার কোন অসুবিধে হচ্ছে না তো এ সব বলায় ?” শ্যামলদা বলল,“ না না আমাদের জন্য কোন খাবার টাবার আনতে হবে না কোন অসুবিধে হচ্ছে না। আসলে আমরা চিন্ময়দার বাড়িতে মদ খেতে যাব। এই এক্ষুণি উঠব। একটু তাড়া আছে কারণ মদ কিনতে হবে তো?” যার চেক কাটার ছিল তিনি বললেন,“ চিন্ময়দা কে?” তারপর কোন উত্তর না পেয়ে তখনই চেক কেটে ছিলেন কিনা মনে করতে পারছি না। উনি সারা পৃথিবী ঘুরেছেন সে সব জায়গার অনেক লোকেদের সঙ্গে আগে থেকে যোগাযোগ করে রেখেছিলেন। সেখানকার ফ্লোরা ও ফনা আর বৃষ্টিপাতের পরিমাণ সব এক জায়গায় জড়ো করে উনি বিশাল এক প্রকল্পনা তৈরি করে চলেছেন বেশ কয়েক বছর। আর তাতে দেড় হাজার পাতার একটা বই তৈরি হতে চলেছে যার চেক কাটার কথা ছিল কারণ ছাপার তো খরচাপাতি আছে। শ্যামলদা আমাদের ওখানে নিয়ে গিয়েছিল যাতে তাড়াতাড়ি চেক নিয়ে পালাতে পারে। শ্যামলদাকে জিজ্ঞেস করা হল ওনার যে এই সারা পৃথিবী সম্বন্ধে বিরাট এক প্রকল্পনা এ নিয়ে কিছু বলতে। উত্তর পাওয়া গেল,“ জানি না।"
—— ওনার যে এই তালিকাবদ্ধ , নথিভুক্ত করার বিরাট কাজ সেটা কেমন ?
—— ওটা কাজ কি?
—— নয়?
—— সন্দেহ আছে।
—— কী রকম ?
—— উনি যাদের সঙ্গে আগে থেকে যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন। জড় বস্তু টস্তু সম্পর্কে বিস্তর জেনে ছিলেন। অনেক তালিকা ও তালিকার পর তালিকা তৈরি করেছিলেন - তার কোন মান হয় ?
—— কেন ?
—— উনি প্রত্যেকটা জায়গায় বেড়াতে গেছেন।
—— হ্যাঁ , যা যা তালিকাভুক্ত সব জায়গায় । যা যা নথিভুক্ত সব সম্ভাব্য জায়গায়।
—— গেছেন?
—— শুধু গেছেন না। গিয়ে রীতিমত খানাপিনা করে কাটিয়েছেন।
—— খানাপিনা?
—— নয়ত কী? ও সব লোকজন ফ্লোরা ফনা জড় বস্তু কোন কিছুর সঙ্গে উনি যোগাযোগ করার কথা , সংযোগ করার কথা ভাবেনইনি।
—— সেকি!
—— অথচ পাতার পর পাতা লিখেছেন কী ভাবে প্রত্যেক জায়গায় বেড়াতে গিয়ে কার কার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন, কী কী সব গাছ টাছ দেখেছেন।
—— লিখেছেন কী যাওয়ার আগে?
—— জানি না।
—— সেকি!
—— যাওয়ার আগেও হতে পারে , পরেও হতে পারে।
—— তা হলে?
একই কথা এই প্রকল্পটা সম্বন্ধে বলা যায়— দলিতরা কী কী কাজ করে? এ বিষয়ে অনেককে জিজ্ঞেস করে করে একটা তালিকা তৈরি করা গেছে। একজনকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে,“ আপনি কি দলিত?”
—— হ্যাঁ ।
—— আপনি কী কাজ করেন?
—— কেন?
—— এমনি।
—— আমি কী কাজ করি তাতে আপনার কি?
—— আমরা একটা প্রকল্পনা করেছি।
—— কী?
—— প্রকল্পনা, দলিতরা কী কী কাজ করে সে বিষয়ে।
—— ও।
—— কিন্ত আপনি বললেন না তো?
—— আমি? এক সময়ে দোকান করেছিলাম। একটা স্কুলের সামনে। স্কুল বন্ধ আছে। এখন পুকুর লিজে নিয়ে মাছ চাষ করি।
—— দলিতরা কি মাছ চাষ করে?
—— আমি করি?
—— কারণ স্কুল বন্ধ তাই দোকান বন্ধ ।
এর থেকে কোন সিদ্ধান্ত করা যায় কি? স্কুল বন্ধ আছে বলে দোকান বন্ধ আর তাই এই ছেলেটি মাছ চাষ করছে। সমস্ত দলিতরা নিশ্চয় দোকান করে না? তাদের সবার দোকান নিশ্চয় স্কুলের পাশে নয়? সব স্কুলই নিশ্চয়ই বন্ধ নয়? সব দলিত নিশ্চয়ই পুকুর লিজ নিয়ে মাছ চাষ করছে না? এ রকম অসংখ্য প্রশ্ন প্রশ্নই থেকে যাচ্ছে। এবার সম্পূর্ণ অন্য একটি পরিস্থিতিতে অন্য একটিষভূগোলে যাওয়া যেতে পারে। কোথায় যাওয়া হবে সে নিয়ে কোন রকম জোরাজুরি রাখলে চলবে না। তা হলে পক্ষপাত চলে এসে প্রকল্পনা বিঘ্নিত হবে।
রাস্তার পাশে দেখা গেল সারিবদ্ধ ভাবে নারী পুরুষ সব দাঁড়িয়ে। তাদের প্রত্যেকে এক ঝুড়ি করে মাটি নিয়ে অন্যের দিকে এগিয়ে দিচ্ছে।
নারী পুরুষ সব মেশামেশি করে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে পাশের জনের মাথায় ঝুড়ি চালান করছে আবার ফাঁকা ঝুড়ি হাথে হাতে চলে আসছে। ঝুড়ি যাচ্ছে আর আসছে। এত বড় লাইন যে আসলে মাটি কাটছে কে বা কারা আর শেষ পর্যায়ে মাটির ঝুড়ি উপুড় করে কী ভাবে খালি করে দেওয়া হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না। মাঝামাঝি জায়গা থেকে শুরু করা যায়। একজন মহিলাকে জিজ্ঞেস করা হল,“ আপনি কি দলিত?”
—— কী?
—— দলিত।
—— আমি সিডিউল।
—— ওই হল মানে দলিত।
—— দলিত হতে যাব কেন ?
—— একই।
—— একই?
—— হ্যাঁ , একই।
—— হবে।
—— দলিতরা কী কাজ করে?
—— বলব কী করে কে কী কাজ করে!
—— আপনি কী করেন?
—— আমি একশো দিন।
—— একশো দিন মানে?
—— একশো দিনের কাজ করি।
—— তার বেশি করেন না?
—— তার বেশি করি। আমি সব করি। আমার স্বামী সব করে।
—— তা হলে?
—— কী তাহলে?
—— দলিতরা কী কী কাজ করে?
—— সে আপনি বুঝুন।
এটা কোন নতুন কিছু নয়। সমীক্ষায় এ হতেই পারে। কিন্তু সিদ্ধান্ত ? একশো দিনের কাজ সব জায়গাতেই হয়। সব জায়গাতেই মাটি কাটার কাজ হবে এমন কোন মানে নেই, সব জায়গাতেই সারিবদ্ধ লাইন দিয়ে লোকে মাটি ভরা আর মাটি খালি করা ঝুড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে এরকম কোন কথাও চলতে পারে না, কোন লেখাও লেখা যাবে না। আর কথা ও লেখা বন্ধ হলে প্রকল্পনা মার খেতে বাধ্য। দলিতরা কী কী কাজ করে বুঝতে অতএব ইতিহাসকে বাড়ানো চলতে থাকে। প্রচুর বইপত্র , দলিল দস্তাবেজ ঘেঁটে ঘেঁটে স্তুপ বানানো হয়। সে স্তুপগুলোর থেকে আবার অসংখ্য ছোট ছোট সিদ্ধান্ত বেরতে থাকে। বেরিয়ে আসা সিদ্ধান্তকে লাইন করে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। কেউ হল্লাগুল্লা করলে বলা হয়,“ চুপ!” সবাই চুপ করে গেলে নরম সুরে আবার বলা হয়,“ চুপ। ” তখন সবাই অনেক দিনের জন্য চুপ থেকে যায় আর তাদের থামার জন্য ইতিহাসকে চেষ্টা করতে হয়নি।কারণ সবাই বুঝতে পেরে গেছে ইততিহাসকে বাড়ানো চলছে।
একই ভাবে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে অসংখ্য ভূগোলকে ছোট ছোট ভাগে আড়াল দিয়ে দিয়ে এক সঙ্গে করে এক জায়গায় নিয়ে এসে যা করা হয় তাকে ভূগোলের সম্প্রসারণ বলে। ইতিহাস ও ভূগোল এই দুই বেড়ে গেলে, সম্প্রসারিত হলে আর প্রশ্ন থাকে না দলিতরা কী কী করতে পারে। একেই বলা যেতে পারে সফল প্রকল্পনা যা কেবল মাত্র সফলই হতে পারে।
শ্যামলদা অবশ্য বলেই চলেছে,“ এর কোন মানেই হয় না। তাদের কথা বলে, বর্ণনা করে , ন্যারেটিভ বানিয়ে অথচ তাদের সঙ্গে দেখা না করে - সংযোগ ছাড়াই, কী ভাবে এত বড় একটা প্রকল্পনা উনি লিখে ফেললেন। ”
—— লিখে ফেললেন ?
—— অবশ্যই! দেড় হাজার পাতা!
—— পুরোটা।
—— পুরোটা এবং সাজিয়ে ।
—— সাজিয়ে ?
—— অবশ্যই। তবে পর পর সাজিয়ে নয়।
—— কী রকম?
—— প্র — এ কী হয়?
—— কী?
—— প্রবন্ধ ।
—— ক— এ কী হয়?
—— কী ?
—— কবিতা।
—— ল্প— এ কী হয়?
—— কী?
—— গল্প।
—— না— এ কী হয়?
—— কী?
—— নাটক।
—— সব মিলিয়ে প্রকল্পনা।
—— হ্যাঁ । অতি দীর্ঘ সে প্রকল্পনা।
সত্যি দলিতরা কী কী কাজ করতে পারে তা অতি দীর্ঘ এক প্রকল্পনাই বটে যার সঙ্গে স্কুলের সামনের দোকানটি বন্ধ থাকবে কিনা, মানব চেনের বাবুদিগের প্রতিবাদের মতো একশো দিনের মাথায় মাটির ঝুড়ি সারিবদ্ধ দলিতের নিরবিচ্ছিন্ন কনভেয়ার বেল্ট থাকবে কিনা, ইতিহাস - ভূগোল আর দেড় হাজার পাতার বইয়ের নিখুঁত পৃথিবী নির্যাস সংযোগ ছাড়াই লেখার মতলব হতে থাকবে।
রিকশা চালাতে চালাতে বাঁচতে ইচ্ছা করলে মনোরঞ্জন ব্যাপারীকে বলা হবে -ওটা হল জিজীবিষা- যা দলিতরা মানতে বাধ্য। আর বামফ্রন্ট সরকারী লোক পোক বলবে ,“ উনি- মানে মদন দত্ত, লেখে ভালো। রিকশোও চালায়। ” তারপর ওনাকে রান্নার কাজ দেওয়া হবে, তারপর গ্রন্থগারিক করা হবে, তারপর দলিত একাদেমি করা হবে, তারপর দলিত একাদেমি করা হবে, তারপর দলিত একাদেমি করা হবে।
হ্যাঁ , দলিতরা কী কাজ করে এটার মানেও যা দলিতরা কী কী কাজ করবে এটার মানেও ঠিক করা হবে, ঠিক করা হবে, ঠিক করা হবে। পাঠ করা হবে, পাঠ করা হবে — দলিতরা পাঠ করা হবে।