কলকাতা সহ এই রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় ছোটো বড় যে লালবাতি এলাকা গুলো আছে সেগুলোতে প্রায় ষাট হাজার কমার্শিয়াল সেক্স ওয়ার্কার বসবাস করে। লকডাউনে আমরা কি ভাবছি তারা কিভাবে বেঁচে আছে বা থাকছে? নাকি আমাদের শহুরে জীবন যাপনের বিলাসিতা তাদেরকে আরও প্রান্তিকতর জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে বা দিতে চলেছে।
কলকাতা সহ এই রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় ছোটো বড় যে লালবাতি এলাকা গুলো আছে সেগুলোতে প্রায় ষাট হাজার কমার্শিয়াল সেক্স ওয়ার্কার বসবাস করে। লকডাউনে আমরা কি ভাবছি তারা কিভাবে বেঁচে আছে বা থাকছে? নাকি আমাদের শহুরে জীবন যাপনের বিলাসিতা তাদেরকে আরও প্রান্তিকতর জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে বা দিতে চলেছে।
এই ষাট হাজার মানুষের কথা একটা দুটো জায়গায় ছাড়া বিশেষ কেউ লিখেছে বলে চোখে পড়ে নি। এমন কি কোনো টিভি চ্যানেলেও দেখলাম না, মিডিয়া রাজনৈতিক তর্জা সামলাতে ব্যস্ত। অথচ এরা কিন্তু সত্যি খুব খারাপ অবস্থায় দাঁডিয়ে, বলা যায় খাদের ধারেই প্রায় লকডাউনের সময় তো বটেই লকডাউন উঠে গেলেও কতদিন এই পরিস্থিতি চলবে বলা খুব কঠিন।
দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির প্রধান উপদেষ্টা ড স্মরজিৎ জানার কাছে জানতে চাইছিলাম এই সময় দুর্বার কিভাবে মেয়েদের পাশে থাকছে বা কাজ করছে বা তাদের অবস্থাটা কেমন হয়ে আছে। তিনি যে বিষয়গুলোর কথা বললেন সেগুলোকে বিচার বিশ্লেষন করলে বোঝা যায় কি হতে চলেছে আগামী দিনে।
ড: জানার মতে আজ লক ডাউনের ৩২ তম দিন। মেয়েদের গত একমাস ধরে রোজগার বন্ধ। এদের মধ্যে অনেকেরই যেহেতু রেশন কার্ড নেই সেহেতু অনেকেই রেশনের চাল, আটা ইত্যাদি পাচ্ছেন না। দুর্বার এর তরফ থেকে বিভিন্ন জেলায় ও কলকাতায় বসবাসকারী এই ব্যবসার সাথে যুক্ত মেয়েদের জন্য খাবার সরবরাহ করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে আপাতত। সেখানে সাহায্যর হাত বাড়িয়ে দিয়েছে কিছু স্বেচ্ছা সেবী সংস্থা ওঃ পাড়ার কিছু ক্লাব,
ছোটো ছোটো কিছু এন জি ও এবং ব্যাক্তিগত ভাবে কিছু মানুষ। কিন্তু কতদিন এরা এইভাবে সাহায্য দেবেন ।লকডাউন উঠে গেলেও আগামী এক মাস বা তার বেশি এরা কোনো খদ্দের নিতে পারবে না। তাহলে খাবার সরবরাহের ব্যবস্থা লক ডাউন পরবর্তী সময়ের জন্য ভাবতে হবে।
শুধু খাবার দিলেও চলবে না দীর্ঘ দুমাস ক্যাশ ফ্লো বন্ধ। রোজগার নেই মানে হাতে প্রায় টাকা নেই। এদের অনেকের রোজগারের ওপর পরিবার অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল। তাদের কিভাবে চলবে। তাই অর্থের যোগান দেওয়ার ব্যবস্থার কথা ভাবতে হবে অনন্ত কিছুদিনের জন্য।
লকডাউন উঠে গেলে পরবর্তী একমাস তাদের খদ্দের না নিতে বলা হয়েছে। তারপর তারা যে খদ্দের নেবে সেখানেও সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে, সোসাল ডিসটেন্সিং বজায় রাখতে হবে পড়তে হবে মাস্ক স্যানিটাইজ করতে হবে নিজেদের ঘরদোর ও খদ্দেরকেও বলতে হবে এইসব মেইনটেইন করতে। এখন কথা হল কতজন খদ্দের এসব মেইনটেইন করতে চাইবে যেখানে অধিকাংশ সময়ে তাদের মনোভাব থাকে “পয়সা দিচ্ছি তা এত কথা শুনব কেন “। ড: জানার হিসেব অনুযায়ী প্রায় পন্চাশ হাজার মাস্ক লাগবে এদের জন্য। তার সাথে সাথে লাগবে স্যানিটীইজার যা এখন অত্যাবশকীয় জিনিসের মধ্যে পড়ছে। এত পরিমানে লাগবে এগুলো যে সংগঠন থেকে নিজেরাই তৈরি করবে বলে ভাবা হচ্ছে। তাছাড়া যেসব ডাক্তাররা এদের চিকিত্সা করবে তাদের জন্য কিছু PPE ও লাগবে।
খদ্দেরের কথা যখন উঠলেই তখন একটু পরিস্কার করে নেওয়া যাক বিযয়টা। লকডাউন পরবর্তী সময়ে খদ্দেরদের ও আকাল পড়বে। কারন এদের কাছে মূলত যে ধরনের অর্থনৈতিক ক্লাসের মানুষরা আসেন তাদের মধ্যে ও প্রচুর কাজ হারাবেন, পকেটে টাকার টান পড়লে তারা এই পাড়ার দিকে আসতে সাহস পাবে না বা আসলেও লালাবাতি এলাকার মেয়েদের হয়তো রেট কমাতে হতে পারে। রোজগারের নিশ্চয়তার কথা ভেবে। খদ্দেরদের মধ্যে একটা বড় অংশ হল মাইগ্রেন্ট শ্রমিকরা। যারা আজ কাজ হারানো অবস্থায় তারা না আসলে খদ্দেরে ও টান পড়বে। সর্বাপরি এইরকম অর্থনৈতিক সামাজিক পরিবেশের মধ্যেও এইসব মানুষগললোকে বেঁচে থাকার জন্য মানসিকভাবে জোড় যোগাতে হবে। তাদের জীবনমুখী করে তুলতে হবে।
দুর্বারের তরফ থেকে সাস্থ্য দপ্তরের কাছে অনুমতি চাওয়া হয়েছে কোরেন্টাইন সেন্টার বানানোর জন্য কয়েকটা লালবাতি এলাকায়। কারন তাদের মনে হয়েছে সমাজের মধ্যে এত স্টিগমা রয়েছে জাতপাত বা অন্যান্য বিষয় নিয়ে যেখানে তারা অনেক আগে থেকেই অপর, হয়তো অন্যান্য মানুষের সাথে এক জায়গায় থাকলে তারা ডিসক্রিমিনেশনের শিকার হতে পারে যা তাদেরকে আর ও অপরত্বের দিকে ঠেলে দেবে। সেই চিন্তা থেকে আলাদা কোয়েরন্টাইন সেন্টার বানানোর ভাবনা।,
সামগ্রিকভাবে এটাই চিত্র সমস্ত লালবাতি এলাকাগুলোয় থাকা মেয়েদের। অনিশ্চয়তার ওপর বসে এরা। সেই অনিশ্চয়তার কালো মেঘ কবে সরে যাবে কেউ জানে না। কারন ভয়াবহ করোনার থাবা কবে যাবে সেটাই একটা বড় প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে।
দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি এই প্রত্যেকটা বিষয় নিয়ে ই সরকারের দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা চাইছেন লালবাতি এলাকার যেসব মেয়েদের রেশন কার্ড নেই তারাও যেন রেশনের সুবিধাভুক্ত হতে পারে। তাহলে খাবারের যোগানের চিন্তা খানিকটা কমবে। চিঠি তারা দিয়েছে সরকারকে। এখন সেই চিঠির উত্তরের অপেক্ষা। রাস্ট্র নামক যন্ত্রটি যে বড় জটিল । চিঠির উত্তর আসতে আসতে যেন বছর না পেরিয়ে যায়।
হাজার হাজার মানুষ যেখানে এই অনিশ্চয়তার মুখে দাঁডিয়ে সেখানে শুধু বাজার করা রান্না করা, আমেরিকা চিন নিয়ে বিতর্ক করা, সিনেমা দেখা গান শোনা নিজেদের মন ভালো রাখার ব্যবস্থা করার পাশাপাশি তো আমাদের ও বোধহয় কিছু দায়িত্ব বর্তায়। আসুন না বাড়িতে বসে কে কি করল বা না করল বিচার না করে আমরা যতটুকু করতে পারি তা নিয়ে ভাবি। আমাদের যৌথতার এই ভাবনাগুলোই হয়তো অনেক মানুষকে বাঁচিয়ে রাখবে। লালবাতি এলাকার অনেক পরিবারের মুখে হাসি ফোটাবে।
|