পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

পরিযায়ী শ্রমিকদের ভবিতব‍্য কি?

  • 19 June, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 1858 view(s)
  • লিখেছেন : সন্দীপন নন্দী
শেষ ভাল যার সব ভাল।অথচ সেই সেসের টাকাই খরচ না করে জমিয়ে সরকার মাসে মাসে সুদ খাচ্ছেন।সেখানে পরিযায়ী শ্রমিকদের ভবিতব‍্য ভাল না হওয়াই স্বাভাবিক।

তুড়িপট্টির অন্ধকার বস্তি থেকে মোবাইল ফোনে গানটা ভেসে আসছিল। "মধুর ধ্বনি বাজে ,হৃদয় কমল মন
মাঝে " ।বাবাকে বহুদিন পর কাছে পেয়ে আনন্দে মেয়ে নাচ দেখাচ্ছিল।তাই প্রায় হাজার কিলোমিটার পথের ধকল
সয়েও মনটা জুড়িয়ে যাচ্ছিল সনাতনের।সনতন বারিক।একবছর রাজস্থানের উদয়পুরে এক পাথরের কারখানায়
কাজ সেরে এইমাত্র ঘরে ফিরেছে।বাবা আরেকটা দেখাই,বলেই ফোনে "কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই
মানা,মনে মনে" র সাথে নেচে উঠল সনাতনের একরত্তি মেয়ে।তবে স্ত্রী,বাবা ,মা আর এক মেয়ের সংসারে এ মুহূর্তে
মধুর ধ্বনিতে মনে মনে হারিয়ে যাবার মত পরিস্থিতি না থাকলেও শুধু মেয়ের কথা ভেবে মনটা দৃঢ় করবার চেষ্টা
করল সনাতন।একটু ভাল করে বললে পরিযায়ী শ্রমিক সনাতন।যা মুখেই ছিল ।খাতায় তার কোন প্রমাণ ছিলনা।
এ বস্তি থেকে ওরা গতবছর পঞ্চাশজন মিলে রাজস্থান গিয়েছিল।কিন্তু সারাবছর যা মজুরি পেয়েছিল,তার নাকি
অর্ধেকই দালাল কমিশন হিসেবে নিয়ে নিয়েছে।তাই কোনমতে বাঁচিয়ে আনা নশো টাকাই এখন সনাতনের
সম্বল।তবে সনাতন বলল,ওরা পঞ্চাশজন গেলেও ফিরেছে মাত্র উনিশজন।বাকিরা কোথায় কেউ জানেনা। তাই
একমাস হল এবস্তির এই উনিশজন বেকার।কোন রোজগার নেই।ঘরে বসে বসে দেশের দশের মজা দেখছে
তারা।হেসে সনাতন বলেছিল,কাজই নেই,তাই হারানোর ভয়ও নেই।তাই ওসব মন্দা ,ছাঁটাই বড়লোকদের ভাবনার
বিষয়।এভাবেই একটা তাচ্ছিল‍্যের স্বর নিজেরমত করে তৈরি করেছিল কাজহারানো এক শ্রমিক।সেকারণে
আক্ষরিক অর্থেই সেদ্ধভাত খেয়ে দিন কাটছে পরিবারগুলোর।মাঝে মাঝে কয়েকটি এনজিওর দয়ায় বাচ্চাটা দুধ
ফল পেলেও সরকার দুমাসের চাল ডাল ময়দা দিয়েই দায় সেরেছে।পয়সা চাই দাদা।কটা টাকা চাই।বলেই ঘর
থেকে বেরিয়ে গেল সনাতন। তবে এই উনিশজন ভিনরাজ‍্যে কাজে গেলেও সরকারি খাতায় কোন নাম না থাকায়
এরা পরিযায়ী শ্রমিকের সুবিধে পায়নি।কেননা যে দালাল ঠিকাদার সংস্থার প্রয়োজন মেটাতে তাদেরকে রাজস্থান
নিয়ে গিয়েছিল,তারা কেউই চায়নি ওরা এই সম্মান পাক।তেমন আমাদের দেশের এমন লক্ষ লক্ষ শ্রমিকও
সনাতন আর তার সহকর্মীদের মত খাতায় নাম না ওঠানোর খেসারত দিচ্ছে প্রতিদিন।অথচ দেশের বিভিন্ন
শপিংমল, সেতু,বহুতল নির্মাণে উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে যাওয়া এই উনিশজনের মত অনেকেই নির্মাণ কাজের জন‍্য
চিকিৎসা, মৃত‍্যুকালীন ক্ষতিপূরণ সহ পেনশনের জন‍্য নির্বাচিত হলেন না।তাই দিল্লির বাসস্ট‍্যান্ডের নিরুপায়
জমায়েত না হলে,এইসময়তেও তারা আমাদের চিন্তার বিষয় হতনা।কেউ বিন্দুমাত্রও এই পরিযায়ী শ্রমিকদের
জন‍্য আওয়াজ তুলতো কিনা সন্দেহ।কারণ তাদের সুরক্ষার জন‍্য বরাদ্দ সেস ঠিকঠাক খরচই হয়না বছর
বছর।তাদের জন‍্য বরাদ্দ চাল ডাল এফ সিআইয়ের গুদামে থেকে যায় আর অন‍্যদিকে হাহাকার বাড়ে।আসলে
সবাই বলে,কিন্তু কেউ কথা রাখেনা। তাইতো শ্রমবিষয়ক এক সংসদীয় প্রতিবেদন বলছে,বিগত কুড়ি বছরে দেশে
সেস হিসেবে সাইত্রিশ লক্ষ কোটি টাকা জমা পড়লেও তার মাত্র সাড়ে সাত লক্ষ কোটি খরচ হয়েছে।আর এই
শ্রমিকদের বেশিরভাগই অসংগঠিত ।ফলে তাদের হয়ে বলার কেউ নেই।ইউনিয়ন নেই।আর যার সুযোগ
নির্লজ্জের মত গ্রহণ করছে ঠিকাদার সংস্থাগুলো।তাই ১৯৯৬ এ এই অসহায় অসংগঠিত শ্রমিকদের জন‍্য বিশেষ
আইন চালু করতে 'নির্মাণ শ্রমিক কল‍্যাণ পর্ষদ' গঠিত হলেও তার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন আছে।এমনকি
রাজস্থানে আফরাজুল খুনের পর আমাদের মুখ‍্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন,একশো দিনের কাজকে দুশো দিন
করা হবে,পরিযায়ী শ্রমিকদের দোকান করার জন‍্য এককালীন পঞ্চাশ হাজার টাকা করে সাহায‍্য করা
হবে।অনুরোধ আপনারা ঘরে ফিরুন।কিন্তু বাকিটা সবাই জানেন।আসলে এই সনাতন নামের শ্রমিকরা বঞ্চিত
হবার জন‍্যই জন্ম নেয়।তাইতো দেশের মধ‍্যে ধনী দরিদ্রের বৈষম‍্য যদি না থাকে,তবে তো শোষনের সংজ্ঞাই
বদলে যাবার কথা ছিল।তাই দেশের গরীব মানুষের হাতে অর্থের জোগান বন্ধ করতে অর্থনীতিবিদদের পরামর্শকে
বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আপন মতে চলল সরকার।আর যার ফল ,আজকের এই বিপুল মন্দা আর আর্থিক ক্ষতির
জন‍্য দেশকে প্রস্তুত করা।অথচ এ দেশের মোট জিডিপির প্রায় এক পঞ্চমাংশই আসে নির্মাণ শিল্প থেকে।কিন্তু তা
সর্ত্বেও সেখানে বঞ্চনার পাহাড় তৈরি করেছে সরকার।মূলত তিনটি কারণে এই সমস‍্যার সূত্রপাত।এক ,সেসের
আওতায় শ্রমিকদের নথিভুক্ত যথাযথভাবে নাকরা।দুই, সেস ফাঁকি দিচ্ছে সংস্থাগুলো।তিন, সেস ঠিকঠাক খরচ
হচ্ছেনা।তাই দেখা যাচ্ছে যে,সরকারি খাতায় প্রায় চারকোটি শ্রমিকের নাম নথিভুক্ত থাকলেও সেসের সুবিধে
পেয়ে থাকেন বাস্তবে প্রায় আড়াইকোটি শ্রমিক।আবার বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন বলছে দেশে নির্মাণ শ্রমিকের
সংখ‍্যা বারো কোটিরও বেশি।তারমানে প্রতি তিনজনে দুজনের নামই সেসের জন‍্য নথিভুক্ত হয়নি।ফল যা

হবার তাই হয়েছে।নির্মাণ শ্রমিকদের দুর্দশার বিবরণ দৈর্ঘে প্রস্থে বেড়েছে দিনদিন।সনাতনদের মত অনেক ঘরে নুন
আনতে পানতা ফুরিয়েছে।আর সেই সুযোগে ঠিকাদার সংস্থাগুলো যে নির্মাণে এক থেকে দেড় হাজার শ্রমিক কাজ
করেছে,খাতায় কলমে মাত্র পঞ্চাশ থেকে ষাটজন দেখাচ্ছে।ফলে সেস ফাঁকি দেওয়া জলভাত হয়ে যাচ্ছে তাদের
কাছে।প্রশাসন নির্বিকার।কোথাও কোথাও আবার সেসের টাকা জনপ্রতি মজুরদের মজুরি থেকে কাজদেওয়া
বাবদ কমিশন হিসেবে কেড়ে নেবার দৃষ্টান্তও আছে।কোথাও পায়ের বুড়ো আঙুলে মাস্টার রোলে ছাপ দেবার
ঘটনা ঘটেছে।কোথাও বুড়ো আঙুল প্লাস্টিকে মুড়েও ভুয়োবিল হাতিয়ে নেবার ঘটনা চলছে।তবে সরকারি
সমীক্ষায় দেখা গেছে সরকারি নির্মাণে বরাত পাওয়া ঠিকাদার সংস্থা বা কোন বৃহৎ কর্পোরেট গোষ্ঠি ছাড়া
বেশিরভাগ ঠিকাদার সংস্থাই সেসের টাকা ফাঁকি দেয়।ফলে সবমিলিয়ে ভারতবর্ষে লকডাউনের মত বিপর্যয়ের
মুহূর্তে সরকারি সেসের যে টাকা বৃহৎ সংখ‍্যার শ্রমিকদের মুখে সঞ্জীবনী সুধার মত হাসি ফোটাতে পারত,তা আর
হলনা।কারণ সরকারের অনীহা।কারণ কর্মতৎপরতার অভাব।কারণ একটা সিস্টেমকে নিজেদের সার্থে
তাসেরঘরের মত ভেঙে দেওয়া।অথচ নিয়মানুসারে শ্রমিকদের পক্ষে মাত্র ত্রিশটাকা খরচ করে নাম নথিভুক্ত
করণের যে প্রয়াস ,সেখানেই গয়ংগচ্ছ মনোভাব ফুটে উঠল।আসলে নির্দিষ্ট পরিযায়ী শ্রম আইন থাকায় ,সরকার
থেকে ঠিকাদার সংস্থা কেউই চায়না নির্মাণশ্রমিকদের নাম খাতায় উঠুক।কেননা পরিযায়ী শ্রমিক হলেই দায়বদ্ধতা
বাড়বে সরকারের।বিপদে আপদে তাদের চিকিৎসার ব‍্যয়ভার বহন করতে হবে,মৃত‍্যুকালীন ক্ষতিপূরণ দিতে
হবে।সর্বোপরি কাজের নির্দিষ্ট সময়পঞ্জীর বাইরে কাজ করানো যাবেনা।তাই এতো সাতসতেরো মেনে নিয়ে সেসের
টাকা তাদের জন‍্য ব‍্যয় হলে সে যে গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতই লাগবে,মনে করল সরকার।তাই আজ
লকডাউনের দিনে দেশের লক্ষ লক্ষ কাজ হারানো শ্রমিকদের নিরাপত্তাহীনতার জন‍্য যে এই মুনাফালোভী নির্মাণ
সংস্থা আর সরকার দায়ী,তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।

0 Comments

Post Comment