প্রথমেই বলি আমি ডাক্তার নই, তাই কি করনীয়র অধিকাংশই ডাক্তারদের সংযোজন। বাকিটা জনস্বাস্থ্য বা পাবলিক হেলথ নিয়ে সামান্য কাজের সুবাদে, চারপাশে যা দেখছি, তার ভিত্তিতে লেখা। আসলে লিখতামই না। কিছু অদ্ভুত পোস্ট আর হোয়াটসঅ্যাপ নিউজ দেখে লিখছি। যারা চিকিৎসক বন্ধুরা আছেন, আমার বক্তব্যে ভুল থাকলে ঠিক করে দেবেন।
১. ভাবুন
করোনা নিঃসন্দেহে এক মারাত্মক ভাইরাস, যা একাধিক মহাদেশে কিছু জনগোষ্ঠীর মধ্যে ছড়িয়ে পরে endemic নামে অভিহিত হয়েছে। endemic আর epidemic এক নয়। কার্যত আমরা করোনাকে epidemic এর মত মনে করছি। সাবধান হওয়া ভালো কিন্তু সেটা সঠিক প্রেক্ষিতে হওয়া দরকার। দেশে বছরে ২২০,০০০ মানুষ টিবিতে মারা যান, ২০১৯ এর নতুন আক্রান্ত ২.১৫ মিলিয়ন। আর করোনা? আজকের তারিখ পর্যন্ত ১০৭টি রোগী ও ২ টি মৃত্যু। WHOর তালিকায়, আক্রান্ত দেশের নিরিখে আমরা অনেক অনেক পিছিয়ে। আর অন্তত এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকাই ভালো। আতঙ্কিত হবেন না।
কোন ছোঁয়াচে রোগের মোকাবিলায় যা সবার আগে দরকার তা হল, তথ্য। অসুখটা কি থেকে হয়, কি ভাবে ছড়ায়, কাদের মাধ্যমে ছড়ায়, এর লক্ষণ কি আর রোগ প্রতিরোধে ও মোকাবিলায় আমাদের কি করনীয়। এখন কথা হল, কোথা থেকে জানবেন? অনেকেরই জানার উৎস ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপ এ পরিবেশিত নিত্য নতুন তথ্য। যার ৯০% ভুল বা অতিরঞ্জন। WHO এর ওয়েবসাইট, ভারত তথা রাজ্য সরকারের ওয়েবসাইট বা প্রথম শ্রেণীর দৈনিকে ছাপা খবর থেকেই জানুন। গুজবে কান দেবেন না। গুজব ছড়াবেন না। কতগুলো সাধারণ চলতি গুজব হল
- চাইনিজ খাবার খেলে করোনা হচ্ছে
- চীনে পরমাণু বোমা পরীক্ষা থেকে এটা হচ্ছে
- চীন করোনাকে জৈব হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে
- মশার কামড় থেকে এই রোগ হয়
- যে কোন হাঁচি-কাশি সর্দি-জ্বর ই করোনা
- করোনা সেরে গেছে যার, সেও আজীবন রোগ ছড়াবে
- অতি গরমে করোনা ভাইরাস এমনিতেই মরে যাবে
ইত্যাদি।
- করোনা সারাতে গোমূত্র পান - এটি হাস্যকর বোকামি।
- প্রতি ১০০ বছরে একটা মহামারী হবেই, এসব জ্যোতিষ বিদ্যা এখন থাক।
- এই অসুখ এদেশেও রাজনৈতিক হাতিয়ার।
উপরোক্ত দাবি গুলির সপক্ষে কোন বৈজ্ঞানিক যুক্তি নেই।
যে সমস্ত ভাইরাল ভিডিও চীন সম্পর্কে চালু আছে, সব জালি। কোন ভিডিও অন্যকে পাঠানোর আগে গুগুলে খুঁজে দেখুন এর সত্যতা, অল্টনিউজের মত পোর্টাল খুব ভালো কাজ করছে এই সব জালি ভিডিওর মুখোশ খুলতে।
যখনি নিজে সঠিক জানবেন, অন্যদের জানান। করোনা যেমন হাসি মস্করার ব্যপার নয় তেমনি অহেতুক আতঙ্কগ্রস্থ হওয়ার ব্যপার নয়।
কি ভাবে প্রতিরোধ করবেন এখন সবাই জানেন। তিনিটি মূখ্য বিষয়
- আক্রান্ত বা সাম্ভাব্য আক্রান্তের কাছ থেকে দূরে থাকুন
- রেসপিরেটরি হাইজিন মেনে চলুন। মানে রুমালে বা টিস্যুতে মুখ চাপা দিয়ে হাঁচি-কাশি। সারাক্ষণ মুখে, চোখে হাত না দেওয়ার চেষ্টা করা
- হাত ধোয়া। জানি হ্যান্ড স্যানিটাইজার পাওয়া যাচ্ছে না। মাস্ক পাওয়া যাচ্ছে না। ঘাবড়ানোর কিছু নেই। এগুলোর কোনটাই অপরিহার্য নয়। সাধারণ সাবানে ভালো করে হাত ধুয়ে, জলে ধুয়ে নিলে সেটা সব থেকে কার্যকর। গাদা গাদা ডেটল হাতে মেখে অনেকে বসে আছেন, কেন? আমরা আগেও হাত ধুতাম, এখনো ধুই। কয়েকবার বেশি ধোব। এমন ভাবে সবাই সাবান নিয়ে ঘুরছি যেন এই সেদিন হাত ধোয়া শিখলাম।
সরকারের এক অভিজ্ঞ ডাক্তার বলেছেন মাস্ক যদি পরতে হয়, তবে সঠিক ভাবে পরুন। মানে প্রতি ৬ ঘন্টা পর পর পরে থাকা মাস্ক ফেলে দিয়ে নতুন পরুন। আর বাস্তবে সেটা যদি সম্ভব না হয় তবে মাস্ক মাস্ক করে পাগল হওয়ার কিছু নেই আম আদমির। খুব ভিড়ে যাওয়া বা দৈহিক স্পর্শ যতটা পারেন বাঁচিয়ে চলুন। এ প্রসঙ্গে একটা হাস্যকর মেম দেখছি - 'আমার ভারত মহান' কারণ আমরা নাকি সবাইকে নমস্কার করতে শিখিয়েছি। যখন শিক্ষিত বন্ধুরা এসব পোস্ট করে, তখন ভাবি, মোদি ক্ষমতায় আসবে না তো আর কে আসবে।
প্রাচ্যের অনেক দেশেই সনাতন প্রথা ঝুঁকে অভিবাদন, আদাব স্টাইলে অভিবাদন ও হাতজোড় করে অভিবাদন। করোনার কালে এর উপরে আর প্যাট্রিয়টিজম আরোপ করবেন না। বিজেপি নেতার মত আদাবকে করোনার কারণও ঠাউরাবেন না। অন্তত মনটাকে সজাগ ও সুস্থ রাখুন।
যারা সংক্রান্ত হতে পারেন বলে আশঙ্কা তাদের কোয়ারেন্টাইনে মানে অন্যদের থেকে আলাদা করে ১৪-১৫ দিন রেখে, বার বার রক্ত পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। সহযোগিতা কাম্য। অনেকে ভয়ে তাদের আক্রান্ত হতে পারার সম্ভাবনার কথা চেপে যাচ্ছেন, এটা বিপজ্জনক। সব সাম্ভাব্য আক্রান্তের কিন্তু করোনা হয় না, খুবই কম মানুষের হচ্ছে।
এরপরে যারা আক্রান্ত হয়েছেন তাদের চিকিৎসা। ভালো খবর, আমাদের দেশে সেরে ওঠার ঘটনাই বেশি, ১০৭ র কাছাকাছি আক্রান্ত হলেও মৃত দুজন, দুজনেই ৭০
বয়ষ্করা যেহেতু বেশি ভোগেন, তাদের নিউমোনিয়া ও ফ্লু ভ্যাক্সিন নিয়ে রাখা এমনিতেই ভালো।
অনেক সাম্ভাব্য রোগী নাকি পালিয়ে যাচ্ছে। সেটা করবেন না। সরকার ও মানুষের বোঝা উচিৎ সাম্ভাব্য রোগী মানেই আক্রান্ত রোগী নয় এবং এদের আলাদা করে রাখার সময় যথোপযুক্ত পরিসেবা এঁদের প্রদান করা উচিৎ। স্বাভাবিক স্বাচ্ছন্দ্যে রাখা উচিৎ। এনারা সাম্ভাব্য রোগী। অপরাধী নন।
করোনার জেরে অর্থনীতি ও রাজনীতি উথাল পাথাল। অর্থনৈতিক দিক থেকে আমাদের করনীয় অহেতুক আতঙ্ক ছড়িয়ে চাল, ডাল, ওষুধ মজুত না করা। সরকারের এই ব্যপারে কড়া হওয়া উচিৎ।
করোনার নামে সব সভা সমিতি বাতিল করা, এর মধ্যেও হিন্দু - মুসলিম টেনে আনা চালু আছে। এইসবের কতটা ঠিক আর কতটা বেঠিক নিজেই বুদ্ধি দিয়ে বিচার করুন। বুদ্ধি কারুর কাছে বন্ধক দেবেন না। এটা একান্তই আপনার সম্পদ।
সুস্থ থাকুন, পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন রাখুন। যারা জানলা দিয়ে হাত গলিয়ে ঘরের ময়লা রাস্তায় ফেলে ঘর পরিস্কার রাখেন, তারা এবার উপলব্ধি করুন, ঘর মানে সারা পৃথিবী। গলিতে সবার ঘর তার একটা আক্রান্ত হলে অন্যরা কি অক্ষত থাকবে? মানসিকতা পাল্টান, ঘরের পরিবেশ পাল্টান, বাইরের পরিবেশ পাল্টাবে। বিজ্ঞানে ভরসা রাখুন, জীবনে সরল বৈজ্ঞানিক অনুশাসন মেনে চলুন, করোনা, কিছু করতে পারবে না। গণ উন্মাদনা বা মাস হিস্টিরিয়া এদেশে সহজেই তৈরি হয়। সেটি রুখুন।