পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

স্বস্তিকা চিহ্নের ছায়ায়

  • 01 January, 1970
  • 0 Comment(s)
  • 202 view(s)
  • লিখেছেন : মানবেন্দ্রনাথ রায়
ফ্যাসিবাদ হল, “সমস্ত ধরণের বিমূর্ত, যুক্তিবাদী, অ-ধর্মীয়, এমনকি অস্বাভাবিক উদারতাবাদ ও যথেষ্ট মাত্রার বস্তুবাদী ফ্রি-ম্যাসন সৌভ্রাতৃত্ব ইত্যাদির সমস্ত ধরণ ও ব্যবস্থার” ঘোষিত জাতশত্রু। এখানে আমরা দেখি যে ছদ্মবেশ ছিন্ন করে আধ্যাত্মিকতাবাদ তার আসল চেহারায় প্রকাশিত হয়ে দাঁড়ায়। ফ্যাসিবাদ রিলিজিয়াস; তাই সে যুক্তিবাদকে বিপদ হিসেবে আর উদারতাবাদকে অনাসৃষ্টি বলে ঘোষণা করে। এই কথাগুলো লিখেছিলেন এম এন রায় ১৯৩৮ সালে। আজকের সময়ে ২০২৫ সালে ঐ লেখার অনুবাদ করলেন মলয় তেওয়ারি। আজ চতুর্থ অধ্যায়- স্বস্তিকা চিহ্নের ছায়ায়। আগের প্রতিটি লেখার সূত্র এই লেখার প্রথমেই থাকলো।

অধ্যায় ১ - ফ্যাসিবাদ - দর্শন, আদর্শ ও অনুশীলন

অধ্যায় ২ - ফ্যাসিবাদী দর্শনের ভিত্তি

অধ্যায় ৩ - সুপারম্যানের উপাসনা

 

অধ্যায় ৪

নীৎশের ক্ষমতাচিন্তার নিষ্ঠুর দর্শনের পটভূমিতে কাইজারলিং, স্পেংলার, স্প্যন, জোমবার্ট প্রমুখ দার্শনিকের আবির্ভাব, যারা সরাসরি “ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট” অর্থাৎ ‘নাৎসি’ আন্দোলনের আদর্শ গঠন করেছেন—যে আন্দোলন স্বস্তিকা’র পবিত্র প্রতীকের ছায়াতলে বিকশিত হয়েছে। এরা সকলেই দার্শনিক বস্তুবাদের তীব্র শত্রু এবং পশ্চিমী সভ্যতার আধ্যাত্মিক পুনর্জন্মের পক্ষাবলম্বন করেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ প্রাচ্যের অতীন্দ্রিয় বার্তার সন্ধান করেছেন। স্বস্তিকা চিহ্নটি ফ্যাসিবাদী ক্ষমতা ও হিংসা উপাসনার প্রাচ্যদেশীয় উৎস দেখিয়ে দেয়। এডলফ হিটলার ও তার রক্তপিপাসু দল হলো এই প্রাচ্য-প্রেরিত “আধ্যাত্মিক” বার্তার প্রচারক। আধুনিক এই প্রচারকদের কাছে বিনয় আর কোনো গুণবাচক অভিব্যক্তি নয়। ক্ষমতার মত্ততায় হিটলার বিশ্ববাসীর সামনে ঔদ্ধত্যপূর্ণ ঘোষণা দেন:  “তাদের বলো, মানব ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত এখন। বলো, এডলফ হিটলারই তার যুগপুরুষ, শুধু এই কারণে নয় যে তিনি চ্যান্সেলর নিযুক্ত হয়েছেন, বরং এই কারণে যে আর কাউকেই চ্যান্সেলর নিযুক্ত করা যেত না”।  (কর্নেলিয়াস ভ্যান্ডারবিল্ট জুনিয়রের সাথে বিশেষ সাক্ষাৎকার, আমেরিকান ম্যাগাজিন ‘রেড বুক’-এ প্রকাশিত, ১৯৩৩)। 

স্বস্তিকা পূজার এই রক্তলোলুপ প্রচারকেরা সত্যিই যদি ভারতের আধ্যাত্মিক সন্তান হত তা হলেও পবিত্র ভারতীয় মাতৃভূমির গর্ব করার কোনও কারণ থাকত না। যদিও তাদের আদর্শ ভারতীয় গোঁড়া জাতীয়তাবাদের সঙ্গে আশ্চর্য মিল রাখে, তবু ঐতিহাসিকভাবে ফ্যাসিস্টরা পশ্চিমী আধ্যাত্মিকতার ধারক। কিন্তু যেহেতু পশ্চিমী আধ্যাত্মিকতা ভারতীয় ধাঁচ থেকে আলাদা নয়, তাই এর নেতৃত্ব যদি কখনো ক্ষমতায় আসে, তাহলে তারাও সমান নিষ্ঠুর রূপ দেখাবে।  

 

প্রুশিয়ার পুরনো শাসনামলের এক জাঙ্কার (ভূস্বামী) কাইজারলিং ভারতীয় অতীন্দ্রিয়বাদের ভক্ত। ১৯১৮ সালের বিপ্লবে সামন্ততান্ত্রিক-সামরিক প্রাধান্যের পুরনো সমাজ-রাজনৈতিক কাঠামো ধ্বংস হয়েছিল। কাইজারলিং-এর কাছে তা “পশ্চিমী সভ্যতার পতন” বলে মনে হয়েছিল, যে সভ্যতাকে তিনি তাঁর নিজের শ্রেণির নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ও সমৃদ্ধির সঙ্গে এক করে দেখতেন। স্বাভাবিকভাবেই, ভবিষ্যৎ অন্ধকার বলে মনে হয়েছিল তাঁর। যেহেতু গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক “মূঢ়তা” অভিজাত শ্রেণির বিশেষাধিকার ও সামরিক শক্তি ধ্বংসের হুমকি হাজির করছিল, তাই কাইজারলিং অনুতাপের সাথে আশা করেছিলেন যে অতীন্দ্রিয়বাদ হয়তো এতদসত্বেও তিনি যেগুলিকে ইউরোপীয় সংস্কৃতির স্তম্ভ মনে করতেন সেগুলিকে রক্ষা করতে পারবে। তিনি “প্রাচ্যের রহস্যময় সংস্কৃতি”-কে মহিমান্বিত করতে শুরু করলেন শুধুমাত্র এই সরল কিন্তু উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কারণে যে প্রাচ্যের সেই সংস্কৃতি “আদর্শ সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও অপরিবর্তনীয় মানবীয় মূল্যবোধ” ধরে রেখেছে। তিনি লিখেছেন: “হিন্দু ফকিরেরাই বিশ্বাস ও জ্ঞানের আদর্শ। মানুষ তার গভীরতম সত্তায় আত্মা, এবং যত বেশি সে এটা বুঝবে, যত দৃঢ়ভাবে সে এতে বিশ্বাস করবে, ততই দ্রুত তার শৃঙ্খল খুলে যাবে। তাই হিন্দু পুরাণে দেখা যায়, পরম জ্ঞান মৃত্যুকেও জয় করতে পারে। ঈশ্বর মানুষের কাছে সর্বত্র তার পূর্বসংস্কারের কাঠামোর মধ্যেই প্রকাশ পায়”।(কাউন্ট ফন কাইজারলিং, ‘ট্রাভেলস জার্নাল অব আ ফিলোসফার)।  

যেহেতু হিন্দু পুরাণ মৃত্যুকে জয় করার আশা দেয়, তাই একটি ধ্বংসোন্মুখ শ্রেণির প্রতিনিধি স্বাভাবিকভাবেই একে সর্বোচ্চ জ্ঞান বলে মনে করে এবং তার সহযোগীদের রহস্যবাদের দিকে ঝুঁকতে উপদেশ দেয়। তোমার “গোঁড়া পূর্বসংস্কারকে” আঁকড়ে ধরো, তাহলে কোনো অলৌকিক ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপে আসন্ন বিপর্যয় এড়ানো যেতে পারে। হিটলারের উত্থানই ছিল সেই কাঙ্ক্ষিত অলৌকিক ঘটনা। যারা নিজেদের সামাজিক উপযোগিতা হারিয়ে আত্মবিশ্বাসহীন হয়ে পড়েছে, তাদের অবশ্যই জাদু, রহস্যবাদ, অতিপ্রাকৃত ও দৈবের উপর ভরসা রাখতে হবে। বেঁচে থাকার নাছোড়বান্দা ইচ্ছা তাদেরকে এই পথে সান্ত্বনা খুঁজতে বাধ্য করে। ফ্যাসিবাদ এসেছে রহস্যবাদী বার্তাবাহক হিসেবে, ইউরোপীয় সংস্কৃতির ত্রাতা হিসেবে—যার ভিত্তি হলো অভিজাত শ্রেণির বিশেষাধিকার, সামরিক শক্তি এবং পুঁজিবাদী শোষণের প্রাধান্য। স্বস্তিকের পবিত্র চিহ্নের অধীনে প্রতিষ্ঠিত ফ্যাসিস্ট একনায়কত্ব শুধু পতনশীল পুঁজিবাদী শোষণ ব্যবস্থাকেই টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে না, বরং প্রুশিয়ার পরজীবী জাঙ্কার (সামন্ত ভূস্বামী) শ্রেণিকেও রক্ষা করে।    

স্যার এভলিন রেঞ্চ লন্ডনের ‘স্পেক্টেটর’ পত্রিকায় একজন “প্রগতিশীল রক্ষণশীল জমিদার”-এর নিম্নিলিখিত মতামত উদ্ধৃত করেছেন: “হিটলারের মধ্যে জাতীয় নেতা হওয়ার গুণ আছে কিনা তা নিয়ে আমি সন্দিহান ছিলাম... কিন্তু তিনি জার্মান জাতির পুনর্জন্ম ঘটিয়েছেন। আমরা আবার বেঁচে উঠেছি বলে অনুভব করছি। আমরা আবার মাথা উঁচু করে চলতে পারছি”।  হিটলারের প্রথমদিককার “সমাজতন্ত্র”-সংক্রান্ত জনপ্রিয় কিন্তু ভণ্ডবক্তৃতায় জমিদার অভিজাত শ্রেণি খুব ভয় পেয়ে গেছিল। ভন পাপেনের “একচোখা মন্ত্রিসভা”-র মাধ্যমে তারাই হিটলারের ক্ষমতায় আসার শেষ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বৃহৎ পুঁজির চাপে জমিদার শ্রেণিকে পিছু হটতে হয়। ক্ষমতায় এসে হিটলার জমিদারদের অমূলক ভয় দূর করেন। তাঁর উত্থান মানে ১৯১৮ সালের বিপ্লবের ব্যর্থতা—তাই একে “জার্মান জাতির পুনর্জন্ম” হিসেবে প্রশংসা করা হয়।  ক্ষমতাসীন প্রতিটি শ্রেণিই নিজেকে সমগ্র জাতির সঙ্গে একাত্ম মনে করে। অভিজাতরা আর ডেমোক্রেটিক ভাইমার সংবিধানের অশুভ ছায়ার নিচে বাস করতে চায় না। স্বাভাবিকভাবেই তারা মনে করে তারা আবার বেঁচে উঠেছে এবং মাথা উঁচু করে চলতে পারছে। আশ্চর্য নয় যে তাদের শ্রেণির আদর্শবাদী কাইজারলিং স্বস্তিকের—প্রাচ্যের রহস্যবাদের চিহ্নের—আগমন ঘোষণা করবেন।  

ফ্যাসিস্ট একনায়কত্বের আরেক আদর্শবাদী পল আর্নস্ট “জার্মান আদর্শবাদের পতন” নিয়ে শোক প্রকাশ করেন। কিন্তু তাঁর মতে, এই পতন প্রকাশ পায়—পুঁজিবাদী সমাজের ক্রমাগত পতন রোধের ব্যর্থতায়, এবং বিপ্লবী শক্তির অগ্রগতি ঠেকানোর অক্ষমতায়।  তিনি প্রাচ্যের অতীন্দ্রিয় রহস্যবাদকে বিপুল মাত্রায় সংযোজিত করে পশ্চিমা আদর্শবাদকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রস্তাব দেন। সমাজবিপ্লবের অপ্রতিরোধ্য শক্তিকে ব্যর্থ করতে সর্বশেষ মরিয়া চেষ্টা হিসেবে বিপ্লব-বিরোধী দায়িত্ব পালন করতে হলে, আদর্শবাদী দর্শনকে তার যুক্তিবাদী বোঝা বয়ে চলা থেকে সরে আসতে হবে এবং ছদ্ম-বৈজ্ঞানিক মুখোশ ত্যাগ করতে হবে। বিশ্বাস ও কুসংস্কারের পুরনো অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে মাঠে নামতে হবে। এবং স্বাভাবিকভাবেই, ভারতের দিকে তীর্থযাত্রা করতে হবে—যেখানে এই পবিত্র হাতিয়ারগুলো যুগ যুগ ধরে সংরক্ষিত হয়েছে। “আমাদের সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক চিন্তার জন্য আমরা সেই মানুষদের কাছে ঋণী, যারা নগ্ন অবস্থায় ভারতের বনে বাস করতেন এবং শিষ্যদের ভিক্ষা করে আনা অন্নে জীবনধারণ করতেন” (পল আর্নস্ট, ‘দ্য ব্রেকডাউন অব জার্মান আইডিয়ালিজম’)।  

জনসাধারণ ক্রমশ “বস্তুবাদী” হয়ে উঠছে। তারা তাদের শ্রমের পূর্ণ মূল্য দাবি করছে—এ দাবি যদি কার্যকর হয়, তবে তা হবে সেই অলস ধনী অল্পসংখ্যকদের বিলুপ্তি, যারাই নাকি একমাত্র আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ বুঝতে পারে এবং প্রগতি ত্বরান্বিত করতে সক্ষম বলে দাবি করে। জনগণকে তাদের অবস্থানে আটকে রাখতে তাদের “সাদাসিধে জীবন ও উচ্চ চিন্তার” গুণ শেখানো দরকার। এই মহৎ উদ্দেশ্যে প্রাচীন ভারতের নগ্ন সাধুদের চেয়ে ভালো উদাহরণ আর কে হতে পারে? আধুনিক যুগের কোনো “ল্যাংগোটা বাবা”-ও অবশ্য সে কাজ চালিয়ে দিতে পারে।  

ভারতীয় গোঁড়া জাতীয়তাবাদীদের মতো ফ্যাসিবাদের আদর্শবাদীরাও পুঁজিবাদকে নিন্দা করে—কিন্তু তা মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা একটি উৎপাদন ব্যবস্থা, যার ঐতিহাসিক ভূমিকা ইতিমধ্যেই সমাপ্ত হয়েছে, তার নিন্দা ওরা করে না, বরং তাদের কাছে পুঁজিবাদের একমাত্র দোষ হলো এটি “মানুষের ব্যক্তিতাকে ধ্বংস করে”। ভারতের অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনবাদীরাও একই অবস্থান নেয়, যারা “যন্ত্র সভ্যতা”-র বিরুদ্ধে চিৎকার করে, বলে যে এই সভ্যতা মানুষকে যন্ত্রে পরিণত করে। তাদের মাথায় আসে না যে মানুষই যন্ত্রের স্রষ্টা, এবং চাইলে মানুষ তার নিজের সৃষ্টির নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠে এর অপব্যবহার বন্ধ করতেও পারে। ফ্যাসিবাদের মার্গদর্শকও সেই ব্যবস্থাকে বিলোপ করার প্রস্তাব দেয় না যে ব্যবস্থায় যন্ত্র মানুষের ব্যক্তিত্বকে রুদ্ধ করে। বরং তিনি এই ব্যবস্থাকে “আধ্যাত্মিকীকরণ”-এর পরামর্শ দেন। তাঁর মতে, “কোনো ব্যবস্থার ভালো-মন্দ তার নিজের মধ্যে নিহিত নেই, বরং তা হল সেই ব্যবস্থা সৃষ্টির পেছনে যে মনোভাব কাজ করেছে তার ফসল”। (পল আর্নস্ট, পূর্বোক্ত)  

সুতরাং, তাঁর প্রস্তাবের সারমর্ম হলো: পুঁজিবাদের মনোভাব বদলে দাও (তা ঈশ্বরের সেবায় হোক বা জাতি নামের বিমূর্ত সত্তার সেবায়), তাহলে তা “ভালো” হয়ে যাবে। এটি গান্ধীবাদেরই প্রতিধ্বনি; বরং বলা যায়, গান্ধীবাদই এর প্রতিধ্বনি। কারণ আর্নস্ট এ’কথা ১৯২১ সালেই লিখেছিলেন। কালানুক্রমিক সম্পর্ক যাই হোক না কেন, তত্ত্বটা একই। সর্বোচ্চ স্তরে এ এক বিভ্রম; বাস্তবে—এক প্রতারণা।

যে উদ্দেশ্যে একটি ব্যবস্থা সৃষ্টি হয় সেটা ছাড়া আলাদা কোনো অস্তিত্ব সেই ব্যবস্থার থাকে না। পুঁজিবাদের উদ্দেশ্য—বস্তুত, এর কার্যকারিতা হল মুনাফা অর্জন করা। আর, মুনাফা অর্জন সম্ভবই নয় যদি শ্রমিকরা তাদের শ্রমের পূর্ণ মূল্য পায়। উৎপাদনকারী সংখ্যাগরিষ্ঠকে শোষণ করাই হল পুঁজিবাদের মূল উদ্দেশ্য। সমাজকে শ্রেণীতে বিভক্ত করে এমন যে কোন ব্যবস্থারই উদ্দেশ্য ওটাই। এই উদ্দেশ্য নিয়েই ব্যবস্থাটি তৈরি হয়েছে, এবং তাই যদি কখনও এই উদ্দেশ্য ত্যাগের কথা ভাবে, তাহলে তার নিজের অস্তিত্বই আর থাকে না। 

কোনো দার্শনিক বা পয়গম্বর যে ব্যবস্থাটিকে তার অন্তর্নিহিত ত্রুটি থেকে মুক্ত করতে চান, সেই ব্যবস্থা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞতার ভিত্তিতে তৈরি হওয়া মূঢ় বিভ্রান্তির উপর গুরুত্ব আরোপ করে তিনি আস্থা আদায় করতে পারেন না। তাই, প্রতিকারটি নির্ধারিত হয় অন্য পক্ষের জন্য। স্পষ্টতই, পুঁজিবাদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিটাই পরিবর্তন করা উচিত। এই প্রস্তাবটি অবশ্যই ভাববাদী দর্শনের সীমার মধ্যে তৈরি করা ও বজায় রাখা যায়। এটি একটি প্রতারণা যা আধ্যাত্মিক অনুমোদন পেতে পারে। পুঁজিবাদ নিজে ভালো বা খারাপ তো নয়, ভালো না খারাপ তা আমাদের চিন্তাভাবনা অনুযায়ী ঠিক হয়। এই পাপী (বস্তুবাদী) ধারণা ত্যাগ করুন যে ওটা খারাপ, এবং দেখবেন সেটা আর খারাপ থাকবে না। পুঁজিবাদ তার শিকারদের শোষণ করে না; ওইসব দুর্দশা আসলে তাদের মানসিক অবস্থার ফল, পুঁজিবাদের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গির ফসল। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে রাজি করান, দুর্দশার মধ্যেও নিজেকে সুখী মনে করতে, দাসত্বের শৃঙ্খলেও নিজেকে মুক্ত মনে করতে শেখান, তখন আর পুঁজিবাদ খারাপ থাকবে না। তাদের কাজকে “ঈশ্বরের সেবা” হিসেবে বিবেচনা করতে বলুন, তারা মজুরি দাসত্বের শিকার বোধ করা বন্ধ করে নিজেদের কৃপাধন্য মহিমান্বিত বোধ করবে। গীতায় কি ঈশ্বর নিজেই শিক্ষা দেন না: “ফলের জন্য চিন্তা না করে তোমার কর্তব্য সম্পাদন কর”? এবং ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার একজন আধুনিক অবতার, বিপিন চন্দ্র পাল, গীতার ঐশ্বরিক মতবাদ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে, পুঁজিবাদের শিকারদের উদ্দেশ্যে প্রচার করেছিলেন: “কাজের জন্য কাজ কর; মজুরি তো বাইপ্রোডাক্ট মাত্র”।

এই নির্লজ্জ পুঁজিবাদী প্রচারগুলি আদর্শবাদী দর্শনের রঙিন আলোয় আধ্যাত্মিক রূপ নেয়, যা বস্তুনিষ্ঠ সত্যকে অস্বীকার করে। যেসব অবতার সত্যের পূজা করেন, অনুশীলনে তারা সবসময় অসত্যের কারবার চালান। পুঁজিবাদের দোষগুলো তার পতনের যুগে অত্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যান্য প্রাকৃতিক ও সামাজিক ঘটনার মতো সেগুলো কোনো বস্তুনিষ্ঠ বাস্তবতা রাখে না। এগুলি কেবল পুঁজিবাদের শিকারদের চেতনায় বাস করে মাত্র। শ্রমিকরা প্রকৃতপক্ষে শোষিত হয় না; অন্যায় অবিচারের শিকার হওয়ার অনুভূতি তাদের নিজস্ব বিকৃত কল্পনা মাত্র। তারা ক্ষুধার যন্ত্রণা অনুভব করবে না যদি তারা বুঝতে পারে যে শারীরিক অস্তিত্ব নিছক এক মায়া, আত্মা অমর এবং আত্মা মোটেই খাদ্যাভাবে ভোগে না। বেদান্ত, মায়াবাদ সহ অথবা তা বাদ দিয়ে, এই শিক্ষা দেয়। বেদান্তের সর্বেশ্বরবাদ সঙ্গতিপূর্ণ হতে হলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে পরম সত্তার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে ব্যাখ্যা করা দরকার হয়। এইভাবে, ফ্যাসিবাদের আরেক দার্শনিক খাঁটি বেদান্তকে “বস্তুবাদী” পাশ্চাত্য সভ্যতা রক্ষার উপায় হিসেবে ব্যাখ্যা করছেন! 

জঙ্গী বস্তুবাদ-বিরোধীতার এই অগ্রদূত, এই নব্য-রহস্যবাদের আবেগঘন অবতার, এই হিটলারবাদের অগ্রণী প্রণেতা, পল আর্নস্ট, একসময় তলস্তয়বাদী ছিলেন। কিন্তু ১৯২০ সালেই তিনি সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক পবিত্র ধর্মযোদ্ধা হিসেবে মাঠে নামেন। এমনকি সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাটিক পার্টি, যা সম্প্রতি বিপ্লবের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, সেই পার্টিও রহস্যবাদের এই চরম প্রতিক্রিয়াশীল মসিহার পক্ষে একটু বেশিই বিপ্লবী ছিল। শুধু সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধেই নয়, গণতন্ত্রের বিপদ থেকেও রক্ষার গ্যারান্টি হিসেবে তিনি একনায়কের প্রয়োজনীয়তার পক্ষে যুক্তি দিয়েছিলেন। তলস্তয়বাদী অহিংসাপ্রেমী দার্শনিক মহাশয় হিংস্রভাবে ঘোষণা করেছিলেন যে, “স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে শুধুমাত্র তখনই যখন আমাদের শহরের রাস্তায় দশ হাজার বদমাশ ব্যক্তিকে ফাঁসি দেওয়া হবে”। (পল আর্নস্ট, “আত্মা, জাগ্রত হও!”) যে বদমাশদের এভাবে ফাঁসি দেওয়ার কথা বলছেন তারা হল সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্ট, যাদের পাপ ছিল পুঁজিবাদী শোষণ থেকে শ্রমিক শ্রেণীর মুক্তির জন্য সংগ্রাম করা। যখন জাগতিক ক্ষমতা ও বিশেষাধিকারের প্রশ্ন আসে, তখন প্রাচ্যের বার্তা প্রচারক এই রহস্যবাদী আধ্যাত্মিক তাঁর শান্তিবাদ ও অহিংসাপ্রেম ভুলে যান এবং প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার রক্তপিপাসু রক্ষক হিসেবে আবির্ভূত হন। জনসাধারণের জন্য তাঁর আধ্যাত্মিক স্বাধীনতার ধারণার অর্থ হল দাসত্ব। এই ধরনের হিংস্র কিন্তু রহস্যময় মতবাদ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে, জার্মানিতে ফ্যাসিবাদের উদ্ভব হয়েছিল শ্রেণী শাসনের ক্ষয়প্রাপ্ত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ঘনিয়ে ওঠা জনগণের বিদ্রোহ দমনের লক্ষ্যে।

তাঁর বিখ্যাত রচনা “পাশ্চাত্যের পতন”-এ স্পেংগলার সবচেয়ে রোগগ্রস্ত ধরণের হতাশাবাদী রহস্যবাদ প্রচার করেন। তিনি যুক্তিবাদ ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিকে প্রচণ্ডভাবে আক্রমণ করেন এবং মানুষের “অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ ও আত্মিক” দিকটিকে স্থায়ী ও মূল্যবান হিসেবে তুলে ধরেন। পরবর্তী রচনা “সিদ্ধান্তের বছরগুলি”-তে স্পেংগলার তাঁর অতীন্দ্রিয় রহস্যবাদকে বিস্তৃত করেন, যাতে বৈজ্ঞানিকভাবে অসমর্থনযোগ্য এই থিসিসকে প্রতিষ্ঠা করা যায় যে সাংস্কৃতিক পার্থক্যগুলির শেকড় বিভিন্ন জাতির আত্মায় প্রোথিত। এর একটি অনুষঙ্গ হিসেবে, তাঁর পুরানো জাতিগত উগ্র জাত্যাভিমান এমন অবিশ্বাস্য পর্যায়ে পৌঁছায় যে তিনি দাবি করেন জার্মানিতে ব্যাপক বেকারত্বের কারণ হলো “কালো জাতিগুলির অনুপ্রবেশ”। কোনো এক অদ্ভুত রহস্যময় কারণে রাশিয়ানরাও এই ক্যাটেগরির অন্তর্ভুক্ত হয়। এখানে রহস্যবাদের প্রকৃত জাতিবিদ্বেষী স্বরূপ উন্মোচিত হয়। রহস্যবাদ হয়ে ওঠে সাম্রাজ্যবাদের দর্শন। শুধু তাই নয়, উদারতাবাদ, মানবতাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদের বিরুদ্ধে—এসবই ফ্যাসিস্টদের কাছে অভিশাপস্বরূপ—স্পেংগলারের রহস্যবাদ প্রচুর কটুক্তিতে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।

ফ্যাসিবাদের এই রহস্যবাদী দার্শনিকের মতে, বর্তমান সময়ের সর্বোচ্চ কাজ হলো “কালার্ড রেসেস” বা “কালো জাতিগুলি” এবং “অতিপ্রশ্রয়পুষ্ট শ্বেতাঙ্গ শ্রমিক” উভয় হুমকির বিরুদ্ধে লড়াই করা। এটি হলো সেই “রক্তের মানুষ”-দের কাজ, যারা “মানব সভ্যতার সাধারণ জনতার প্রতি অবজ্ঞায় স্থিত হয়ে আইন, শৃঙ্খলা ও সম্মান পুনরুদ্ধার করবে”। এই সভ্যতার ত্রাণকর্তারা—নীৎসে দ্বারা আদর্শায়িত “এই উৎকৃষ্ট শিকারী পশুরা”—“কঠোর গুণাবলির জন্য লড়াই করতে ও মরতে প্রস্তুত, মানুষের সমতার ভাবালু ধারণা দ্বারা বিন্দুমাত্র প্রভাবিত না হয়ে”। 

ট্রেইৎস্কে, নীৎসে, চেম্বারলেইন প্রমুখ—জার্মান সাম্রাজ্যবাদের এইসব জঙ্গী মতাদর্শবিদদের থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে, পাশ্চাত্যের পতনের শোকগাথাকার এই রহস্যবাদী দার্শনিক উনবিংশ শতাব্দীর গণতান্ত্রিক ও উদারনৈতিক ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। তিনি ঘোষণা করেন: “এই গ্রহ দখলের যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। বেঁচে থাকতে হলে এই শতকের উদারনীতিবাদী শান্তিবাদকে পরাজিত করতে হবে”। এই হল নব্য জার্মান সাম্রাজ্যবাদের মতাদর্শ, যা হুমকি দেয় যে, জার্মানি যদি আবার সূর্যের নিচে তার স্থান ফিরে না পায় তাহলে বিশ্বকে তারা এক ধ্বংসযজ্ঞে ডুবিয়ে দেবে। উপনিবেশ গড়ার ফ্যাসিস্টদের দাবি হলো স্পেংগলারের মতো “প্রাচ্যের বার্তাবাহক”-দের জাতিবিদ্বেষী রহস্যবাদের প্রতিধ্বনি।

কিন্তু ব্যবহারিক বিষয়ে তিনি স্পষ্টবাদী। চিড়িয়াকে চিড়িয়াই বলেন। প্রাশিয়ান সামরিকবাদের পুনরুত্থানই পশ্চিমকে ধ্বংস থেকে রক্ষা করবে, ভারতের আধ্যাত্মিক বার্তা নয়। তিনি স্বাধীনতার বার্তা নয়, বরং আত্তিলার বর্বর দলকে আবাহন করেন। এটাই হলো প্রাচ্যের সেই আত্মা যা ফ্যাসিস্টদের আকর্ষণ করে এবং তাদের রক্তপাত ও বর্বরোচিত কাজে অনুপ্রাণিত করে। 

“যে বিশ্ববিপ্লব একশ পঞ্চাশ বছর আগে শুরু হয়েছিল”—তার ভূত দেখে স্পেংগলার এই হিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত। ফ্যাসিস্ট “জাতীয় বিপ্লব”-এর এই দার্শনিক ফরাসি বিপ্লবকে “পশ্চিমের জন্য এক মহা দুর্ভাগ্য” হিসেবে বর্ণনা করেন, কারণ তার মতে, এর থেকেই পশ্চিমের পতনের সূচনা। ইউরোপীয় ইতিহাসের এ এক অনন্য অদ্ভুত দৃষ্টিভঙ্গি। সাধারণ স্কুলছাত্রও জানে যে মহান ফরাসি বিপ্লব আধুনিক পশ্চিমা সভ্যতার জন্ম দিয়েছিল, যা আজ পতনের মুখে। এই দেড়শ বছরে সৃষ্ট ইতিবাচক মূল্যবোধ পতনোন্মুখ নয়, বরং পতনের মুখে আছে শোষণের এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা, যাকে একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ সামাজিক ব্যবস্থার উদ্ভবের জন্য পথ ছাড়তে হবে। কিন্তু স্পেংগলারের কাজ হলো স্বৈরাচারের পুনরুত্থানের জন্য মতাদর্শ তৈরি করা। তাই, দেড়শ বছরের রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও সামাজিক অগ্রগতিকে তিনি দুঃস্বপ্ন হিসেবে ভুলে যেতে বলেন। তিনি ঘোষণা করেন, “সমতা ও গণতন্ত্রের মতবাদ রাষ্ট্রের ভিত্তি নাড়িয়ে দিয়েছে”, কারণ এগুলি শ্রেণীগুলির সামন্ততান্ত্রিক সম্পর্ককে উল্টে দিয়েছে। “উদারনীতিবাদ ও যুক্তিবাদ কর্তৃত্বের ধারণাকে নাড়িয়ে দিয়েছে। ফলাফল হলো বর্তমান বিশৃঙ্খলা, যেখান থেকে কমিউনিজমের ভূত উঠে এসেছে”। স্পেংগলারের উন্মত্ততাতে একটা পদ্ধতি রয়েছে। বুর্জোয়া বিপ্লবের পর অনিবার্যভাবে সর্বহারা বিপ্লব  আসে। তাই, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের এই রহস্যবাদী আধ্যাত্মিক বিদ্বেষী বিপ্লবের হুমকি মোকাবেলার জন্য মতাদর্শিক অস্ত্র খুঁজতে সরাসরি সামন্ততান্ত্রিক মধ্যযুগে ফিরে যায়। যুক্তির স্থানে বিশ্বাস, রহস্যবাদের কাছে যুক্তিবাদের পরাজয়—যাতে ইতিহাসের ঘড়ির কাঁটাকে পিছিয়ে দেওয়ার এই হতাশাব্যঞ্জক প্রচেষ্টাকে সভ্যতা রক্ষার উপায় হিসেবে প্রশংসনীয় করে তোলা যায়। 

তার এইসব ছিটগ্রস্ত উচ্ছ্বাস ও রক্তপিপাসু মতবাদ সত্ত্বেও, স্পেংগলার কঠোরভাবে যৌক্তিক। ফ্যাসিবাদের এই নব্য-রহস্যবাদী দর্শন যে সব থেকে নিকৃষ্ট ধরণের বিকৃত বস্তুবাদী মতাদর্শ তা স্পেংলারের থেকে স্পষ্টভাবে আর কেউ প্রকাশিত করে নি। 

ওয়েবার, জোমবার্ট, স্প্যান—ফ্যাসিবাদের এই সব দার্শনিকরা বস্তুবাদের উগ্র বিরোধী এবং আক্রমণাত্মক আধ্যাত্মিকতার পুনরুত্থানের প্রবক্তা। এই ধর্মযুদ্ধ শুরু হয় দার্শনিক আধ্যাত্মিকতার ঐতিহ্যবাহী নীতির পুনর্বিবৃতি দিয়ে: “প্রকৃতিকে উপলব্ধি করা অসম্ভব”। (অটো স্প্যান, “রাজনৈতিক অর্থনীতির শিক্ষা”)। এ হল সেই পুরনো বার্কলিয় ডগমা—“আমরা শুধু আমাদের নিজস্ব উপলব্ধিগুলিই উপলব্ধি করি”—এবং আরও প্রাচীন ও সম্মানিত মায়াবাদের পুনরাবৃত্তি। সবই বিভ্রম, মায়া। ধর্মযোদ্ধার তেজ নিয়ে স্প্যান এই পুরানো কুখ্যাত অস্ত্র দিয়ে সেই সব “অশুভের মূল আঘাত করতে চান: প্রাকৃতিক বিজ্ঞানকে উৎখাত করতে”, যে বিজ্ঞান ধাপে ধাপে দর্শন থেকে আধ্যাত্মিকতাকে বিতাড়িত করেছে। প্রকৃতিকে জানা যেহেতু অসম্ভব, যেহেতু আমাদের উপলব্ধি প্রকৃতি সম্পর্কে কোনো নির্ভরযোগ্য জ্ঞান দেয় না, তাই প্রাকৃতিক বিজ্ঞানগুলো সব বেকার, কোনও কাজের নয়। অসম্ভবের পিছনে বৃথা ছোটাকে ত্যাগ করা উচিত, এবং ঈশ্বরে বিশ্বাসই জীবনের একমাত্র পথপ্রদর্শক হওয়া উচিত: “সভ্যতা রক্ষা করা যাবে শুধু সেই মতবাদের (দার্শনিক বস্তুবাদ) ধ্বংসের মাধ্যমেই, যা ঈশ্বরবিহীন প্রজ্ঞা ও নীতিবিহীন জ্ঞান দাবি করে”। (উক্ত গ্রন্থ) 

এখানে অন্ধ উদ্দীপনা মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। নিঃসন্দেহে, বস্তুবাদী দর্শন হলো “ঈশ্বরবিহীন জ্ঞান”। বস্তুবাদী দর্শন প্রমাণ করেছে যে ওই দুটি বিষয় পরস্পর সম্পূর্ণ অসঙ্গত। কিন্তু বস্তুবাদ অনুর্বর নাস্তিকতার চেয়ে অনেক বেশি কিছু। কোনো অস্তিত্বহীন ঈশ্বরকে অপসারণের ডনকিহোতীয় প্রচেষ্টায় তা নামে না। শুধু ইঙ্গিত দেয় যে অজ্ঞানই ঈশ্বরের মন্দির; জ্ঞান সেই মন্দিরটিকে নাড়া দেয়, এবং যখন তার কাল্পনিক সত্তার উপর জ্ঞানের আলো ফেলা হয় তখন শেষ পর্যন্ত ঈশ্বর অদৃশ্য হয়ে যায়। ঈশ্বর ও জ্ঞান একসাথে চলতে পারে না, কারণ ঈশ্বর জ্ঞানের পথে বাধা। কিন্তু, স্প্যানের দ্বিতীয় দাবিটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। এটি একটি নিকৃষ্ট অপবাদ। জ্ঞান কভু নীতিকে বর্জন করে না। আধ্যাত্মিকতার জগতে, নীতি আধ্যাত্মিক অহং-এর তৃপ্তির জন্য নিজেকে বিক্রি করে। সে শুধু একটি লক্ষ্যের উপায়মাত্র। বস্তুবাদ নীতিকে তার নিজের মর্যাদাতেই সম্মান করে। এটি তাকে ভ্রষ্ট অপদস্থ অবস্থান থেকে একটি স্বাধীন সত্তার মর্যাদায় উন্নীত করে। ভয় থেকে, সবলের কাছে নত হয়ে বা লোভের বশবর্তী হয়ে বস্তুবাদী নীতিবান হয় না; বস্তুবাদী নীতিবান হয় কারণ সে অন্যরকম হতে পারে না। এবং, কেবলমাত্র জ্ঞানই তাকে আনন্দের সাথে নীতিনিষ্ঠ থাকতে সক্ষম করে তোলে। আধ্যাত্মিক ব্যক্তি এমন মহৎ চেতনা বুঝে উঠতে পারে না। তার নীতি হলো স্বার্থপরতার নীতি, যার জুটি হলো দাসত্বের নৈতিকতা। এরকম নীতি ও নৈতিকতা দরকার পড়ে এই ফাটল ধরা পুঁজিবাদী সমাজের কাঠামোটাকে আবার জোড়াতালি দিয়ে জমাট বাঁধাতে। এগুলি অজ্ঞানতা, কুসংস্কার ও তার ফলে সৃষ্ট বিশ্বাসের সাথে যুক্ত। বস্তুবাদী দর্শন—বিজ্ঞানের বিজ্ঞান—এইসব পুরানো পচা দেবতাদের তাদের মন্দিরের অন্ধকার কোণ থেকে বের করে দেয়। তাই, একে ধ্বংস করা ওদের জন্য জরুরি হয়ে পড়ে। উগ্র ধর্মযোদ্ধাটি ঘোষণা করেন: “যুদ্ধ হওয়া উচিত, যার লক্ষ্য হবে সব রকম বস্তুবাদের সম্পূর্ণ ধ্বংসসাধন। জ্ঞানালোকের যুগ থেকেই এটাই হওয়া উচিত ছিল সংস্কৃতি রক্ষার জন্য সব চেয়ে প্রয়োজনীয় কাজ”। (উক্ত গ্রন্থ)

যেহেতু আক্রমণটি সব ধরনের বস্তুবাদের বিরুদ্ধে, তাই প্রাকৃতিক বিজ্ঞানকেও বিদায় নিতে হবে। এমনকি অজ্ঞেয়বাদীদেরও কোনো রেয়াত দেওয়া হবে না। এ হবে ডায়োনিসাসের এক প্রকৃত নৃত্য—ফ্যাসিবাদের আবির্ভাব। কিন্তু কাকে ধ্বংস করার জন্য? পশ্চিমা সভ্যতার “বস্তুবাদ” ধ্বংস করার জন্য নয়। বরং, এই ধর্মযুদ্ধ হলো বস্তুবাদী দর্শনের বিপদ থেকে পুঁজিবাদী সভ্যতাকে রক্ষা করার জন্য। এর আধ্যাত্মিক সার্বভৌমত্বকে আরেকবার ঊর্ধ্বে তুলে ধরার মধ্যে দিয়ে মুক্তি লাভ করা যাবে, যা নাকি বিজ্ঞানের জ্ঞান দ্বারা কলুষিত ও বিভ্রান্ত হয়ে গেছে। বস্তুবাদ পশ্চিমা সভ্যতার প্রকৃতিতে নেই। পশ্চিমা সভ্যতার আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যে বস্তুবাদ বিদেশী। এটিকে এই সভ্যতার মারাত্মক শত্রু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পুঁজিবাদী সভ্যতার সমগ্র দার্শনিক ইতিহাস ছিল দার্শনিক বস্তুবাদের বিরুদ্ধে লড়াই। অবশেষে, এই লড়াই চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। বস্তুবাদী দর্শনের ধ্বংসই হলো পুঁজিবাদকে রক্ষার শর্ত। মরিয়া জীবন-মরণ সংগ্রামে জড়িয়ে পুঁজিবাদ মৌলবাদী ধর্মের পুনরুজ্জীবনের মধ্যে নিশ্চয়তা খুঁজছে এবং অজ্ঞানতা, কুসংস্কার, বিশ্বাস, রহস্যবাদের অন্ধকার শক্তিগুলিকে কাজে লাগাচ্ছে। নব্য-আধ্যাত্মিকতার দর্শন খালি হাতেই লড়ে যাবে। মধ্যযুগীয় বর্বরতার জাঁকজমকে—এর আদিম বিশুদ্ধতায় আবির্ভূত হয়ে—এটি তার অনুসারীদেরকে উগ্র মতান্ধতায় উদ্বুদ্ধ করবে বলে আশা করে। ছদ্ম-বৈজ্ঞানিক আবরণ ঝেড়ে ফেলে, এটা সাদৃশ্যপূর্ণ হয়ে ওঠে ভারতীয়রা যাকে নিজেদের বিশেষ প্রতিভা বলে লালন করে তার সাথে। বিমূর্তভাবে, এই রহস্যময় ও পৌরাণিক ঐতিহ্য মহৎ বলে মনে হতে পারে। কিন্তু ফ্যাসিবাদ ও হিটলারবাদের অসভ্য বস্তুবাদী ও নৃশংস বর্বরোচিত ঘটনাবলিতে এর ব্যবহারিক মূল্যের প্রদর্শনে সেই সুখস্বপ্ন ভেঙে জেগে ওঠা উচিত। 

প্রগতির শক্তিগুলি যখন নিষ্ক্রিয়, দুর্বল, অপ্রতুল বা দমিত হয়ে পড়ে তখন প্রতিক্রিয়ার মতাদর্শিক অস্ত্র হয় আধ্যাত্মিকতা। ভারতে এটাই এর তাৎপর্য। যেখানে প্রগতির শক্তিগুলি সবল, সক্রিয়, আক্রমণাত্মক, সেখানে প্রতিক্রিয়ার আধ্যাত্মিকতা প্রতিবিপ্লবের রক্তলোলুপ পতাকায় পরিণত হয়। “সামাজিক অসন্তোষের অমঙ্গল”-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে মাঠে নামে। পশ্চিমে, আজ এই উদ্দেশ্যেই তা কাজ করছে। ভারতে, আগামীকাল একই কাজ করতে পারে। ভবিষ্যতের অশুভ লক্ষণ দিগন্তে দেখা যাচ্ছে। উভয় ক্ষেত্রেই, এটি প্রগতির শত্রু।

ফ্যাসিবাদের দর্শন হলো এক জঙ্গী আধ্যাত্মিকতা যা স্বৈরতন্ত্র ও হিংসাকে অধিবিদ্যাগত বৈধতা প্রদান করে। এই দর্শন রহস্যময় এবং উগ্রভাবে ধর্মীয়। হিটলারবাদের গর্বিত লক্ষ্য হলো “আর্য সংস্কৃতির পুনরুত্থানের মাধ্যমে জার্মানিক জাতির আধ্যাত্মিক পুনর্জন্ম”। ফ্যাসিবাদও আধুনিক সভ্যতার “বস্তুবাদ”-এর বিরুদ্ধে ধূমায়িত হয় এবং এই ব্যাধি থেকে মুক্তির দৃঢ় সংকল্প ঘোষণা করে। এর কর্মসূচি হলো জার্মান জাতিকে মধ্যযুগের আদিম পবিত্রতা ও সরলতার দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া; এভাবে পুনর্জন্মপ্রাপ্ত হয়ে জার্মান জনগণ ঈশ্বরের মনোনীত হিসেবে কাজ করবে এবং বিশ্বের বাকি অংশের উপর তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করবে। এ সবই ভারতীয় রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদের দাবিগুলির সাথে আশ্চর্যরকম সাদৃশ্যপূর্ণ।

ফ্যাসিবাদের রহস্যবাদী মতাদর্শ প্রতীকীভাবে উপস্থাপিত হয় স্বস্তিকা চিহ্ন দ্বারা। সেই উগ্র বাহিনী এই প্রতীক বহন করে যাদের কোনো প্রশ্ন না করে কেবল আনুগত্য করতে শেখানো হয়। রহস্যবাদ হলো অজ্ঞানতার মহিমাকরণ। রহস্যবাদ এই অন্যায্য ভিত্তি থেকে আধ্যাত্মিক পুঁজি তৈরি করে। জনগণকে রহস্যাবৃত না করলে তাদের দাসত্বে মগ্ন হওয়ার আশা করা যায় না, তাদের সহযোদ্ধাদেরই রক্তে নিজেদের দাসত্বের জীর্ণ শৃঙ্খলকে শক্তিশালী করার কাজে লিপ্ত করা তো দূরের কথা। এক কাল্পনিক অতীতের আদর্শায়ন জনগণকে বর্তমানের কঠোর বাস্তবতা সম্পর্কে বিস্মৃত করে এবং ভবিষ্যত উন্নত জীবনের কল্পনা থেকে বিরত রাখে। ‘স্বর্ণযুগ’-এর পৌরাণিক দেবতাদের পূজার উন্মাদনায় তারা সহজেই ঐতিহাসিক দায়িত্ব থেকে সরে যায়। সেই শয়তানদের ধ্বংস করার ঐতিহাসিক দায় থেকে সরে যায় যারা তাদের বর্তমান জীবনকে দুঃসহ করে তুলেছে। অতীতের আদর্শায়ন তাদের স্বার্থেই কাজ করে যারা বর্তমানের দুঃখ-দুর্দশা থেকে লাভবান হয়। অতীতের আধ্যাত্মিক সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবনের এই আগ্রহ কেবল বর্তমানের বিকৃত-বস্তুবাদী ভোগসর্বস্ব যাপনকে স্থায়ী করে।

ফ্যাসিবাদ পুঁজিবাদের শত্রুদের ক্রুশবিদ্ধ করতে বাঁকা ক্রুশ (স্বস্তিকা) এর রহস্যময় প্রতীক তুলে ধরে। এই অশুভ ধর্মযুদ্ধ পরিচালিত হয় ধর্মীয় উন্মাদনা নিয়ে। আর্য সংস্কৃতির পুনরুত্থান ঘোষণা করা হয় আধুনিক সংস্কৃতিকে নির্মূল করার বর্বরোচিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে। পৌরাণিক দেবতাদের আহ্বান করা হয় উদ্ভট ধর্মীয় সমাবেশে, উত্তরের বর্বরদের সেই হিংস্র দেবতা থর ও ওডিনের উপাসনা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য। ফ্যাসিস্ট জার্মানির কাল্পনিক “আর্য” পূর্বপুরুষরা মধ্য এশিয়া থেকে আসেনি। তাদেরকে ভাবা হয়েছিল নর্ডিক জাতি হিসেবে - খাঁটি নীল রক্তের।

এখানেই “আর্য সংস্কৃতি”-র উপাসকদের মধ্যে বিবাদের বীজ নিহিত। আর্য জাতি তত্ত্ব আধুনিক নৃতাত্ত্বিক গবেষণা দ্বারা ভুল প্রমাণিত হওয়ায়, কোনো বিশেষ আর্য সংস্কৃতি বিষয়টা নিজেই একটি পৌরাণিক কাহিনীতে পরিণত হয়েছে। ফ্যাসিস্ট আন্দোলনের “আর্যবাদ” দ্বারা আকৃষ্ট ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের একটি বিষয় মনে রাখা উচিত: ফ্যাসিস্ট আর্যবাদ হলো শ্বেতাঙ্গ জাতির শ্রেষ্ঠত্বের পূজা। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পরিবর্তে হিটলার বা মুসোলিনিকে কেন বেশি পছন্দ করবেন, যখন উভয়েই একই সুরে “শ্বেতাঙ্গ মানুষের বোঝা”-র গান গায়? এই করুণ-কৌতুক আর্যবাদের পূজার মিথ-কে উন্মোচিত করে, তা সে পূজা ফ্যাসিস্টরাই করুক বা ভারতীয় আধ্যাত্মিক সাম্রাজ্যবাদীরা। জার্মান সংস্কৃতির মতো ভারতীয় সংস্কৃতিও কোন আর্য জাতির আধ্যাত্মিক প্রতিভার ছাপ বহন করে না। উভয় ক্ষেত্রেই, এই আর্যবাদের পূজা হলো প্রতিক্রিয়ার একটি হাতিয়ার মাত্র, যার কোনো বৈজ্ঞানিক-ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই, যা অজ্ঞতার উপর প্রতিষ্ঠিত, এবং ঊর্ধ্বতন শ্রেণীর স্বার্থ সেবা করে - জার্মানিতে শিল্পপতি ও ব্যাংকারদের, ভারতে পুরোহিত ও জমিদার অভিজাতদের।

থর ও ওডিন পূজার চিত্রবিচিত্র আচারানুষ্ঠান অবশ্য ধর্মীয় আড়ম্বরের চেয়ে বেশি কিছু হয়ে উঠতে পারে না। জার্মানি খুবই সভ্য জাতি, সে এমনকি তার সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া স্তরকেও বর্বরতায় ফিরে যেতে দিতে পারে না। ফ্যাসিস্ট জনপ্রিয়তাবাদ ইতিহাসের ঘড়ির কাঁটাকে অতটাও পিছিয়ে দিতে পারে না, এমনকি অস্থায়ীভাবেও নয়। তাই ফ্যাসিস্ট মতাদর্শ খ্রিস্টান মৌলবাদকে বর্বরতারও আগের যুগের রহস্যবাদের সাথে যুক্ত করে।

ফ্যাসিস্ট “জার্মান খ্রিস্টান” আন্দোলনের নেতা লুডভিগ মোলার ঘোষণা করেন: “আডলফ হিটলারকে ঈশ্বর পাঠিয়েছেন পিতৃভূমিকে রক্ষা করতে”। মনে হয় যেন কল্কি অবতার স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে আসার সময় পথ ভুলে ভারতের বদলে জার্মানিতে আবির্ভূত হয়েছেন। কিন্তু তাতে বিশেষ পার্থক্য হওয়ার কথা নয় যতক্ষণ না তিনি আর্যদের সনাতন ধর্ম পুনঃপ্রতিষ্ঠার মিশন সম্পাদন করেন। আডলফ হিটলার নিজেও তার দৈব মিশনে বিশ্বাস করেন। “জার্মান খ্রিস্টান” চার্চের প্রধান পুরোহিতের মতে, চ্যান্সেলর নিযুক্ত হওয়ার পর হিটলার বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছিলেন: “সবই যেন ঈশ্বরের গজব”। নিশ্চয়ই এটা একটা অলৌকিক ঘটনা ছিল; নাহলে কিভাবে একজন অজ্ঞ বাতেলাবাজ ভাঁড় জার্মানির “ত্রাণকর্তা” হতে পারলেন? সীমাহীন ক্ষমতায় নিজের আরোহণ হিটলারের কাছেই আরও বেশি অলৌকিক মনে হয়েছিল কারণ এটা তার নিজের কোনো যোগ্যতার কারণে ঘটেনি। আধুনিক সভ্যতা দ্বারা লালিত সকল মূল্যবোধ ও প্রতিষ্ঠান দমনের প্রায় দুই বছরের অনুশীলনের পর ১৯৩৪ সালের সেপ্টেম্বরে হিটলার ঘোষণা করেন: “সবাই জানে যে আমরা ঈশ্বরহীনতা ও নৈতিকতার পতনের বিরুদ্ধে লড়াই করছি। আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি যে ঈশ্বরের আশীর্বাদ আমাদের কাজের উপর থাকবে”। এক বছর পরে, তার নৃশংস অনুশীলনের সাফল্যে মাতোয়ারা হয়ে তিনি ঘোষণা করেন: “পনের বছর আগে, আমার কাছে কিছুই ছিল না, ছিল শুধু আমার বিশ্বাস ও ইচ্ছাশক্তি। আজ, এই আন্দোলনই জার্মান জাতি ও রাইখ। এটা কি সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের আশীর্বাদ ছাড়া সম্ভব ছিল? আমরা যা হয়েছি তা ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নয়, বরং তার ইচ্ছাতেই”। বিষয়টা নিছক এরকম নয় যে একজন অজ্ঞ দুঃসাহসিকের বিশ্বাস পাহাড় সরিয়েছিল। এটা ছিল শাসক শ্রেণীর ইচ্ছা যা তাদের মনোনীত ব্যক্তির বিজয়ের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পেয়েছিল।

ফ্যাসিস্টরা মানবতার বিরুদ্ধে যে নৃশংস অপরাধ সংঘটিত করে তাকে কোনো মানবিক যুক্তি দ্বারা ন্যায্যতা দেওয়া যায় না; তাই, ঐশ্বরিক অনুমোদন আহ্বান করতে হয়। ন্যায়সঙ্গত, নৈতিক ও উপকারী ঘটনাগুলির ন্যায্যতা প্রদানের জন্য প্রতারকদের অন্যায় কর্তৃত্বের প্রয়োজন হয় না; ওইসব ঘটনা তাদের নিজস্ব গুণেই দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু, হিটলারের ঈশ্বর স্বর্গে বাস করেন না, তিনি এই নশ্বর পৃথিবীতেই অধিষ্ঠান করেন। তিনি জার্মানিতে আবির্ভূত হয়েছেন রক্তাক্ত তরবারি হাতে, ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে নয়, বরং ধনকুবেরদের প্রতিনিধি হিসেবে।

ফ্যাসিস্টদের ধর্মীয়তা ও রহস্যবাদ অসাধু এবং কুসংস্কারপূর্ণ। “জার্মানিয়া” (জার্মান ক্যাথলিক পার্টির মুখপত্র) থেকে উদ্ধৃত নিম্নলিখিত অংশটি হিটলারবাদের ধর্মীয়তার উপর একটি তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য: “ধর্মবিরোধী নব্য-পৌত্তলিকতা প্রাক-খ্রিস্টান পৌত্তলিকতার চেয়েও অনেক নিম্ন স্তরের যা অন্তত তার দেবতাদের সম্মান করত এবং এই দিক থেকে ধার্মিক ছিল”। আরও বেশি ক্ষতিকর মন্তব্য এসেছে খ্রিস্টান বিশ্বের আধ্যাত্মিক প্রধানের কাছ থেকে। জার্মানিতে ক্যাথলিক চার্চের উপর নাৎসি আক্রমণে ক্ষুব্ধ হয়ে পোপ, ফেব্রুয়ারি ১৯৩৪ সালে একটি ঘোষণায় বলেছিলেন: “মহৎ জার্মান জনগণ তার ইতিহাসের একটি করুণ মুহূর্তে রয়েছে, এমন একটি মুহূর্তে যখন খ্রিস্টান বা মানবিক নয় এমনসব ধারণা ও চর্চা উত্থাপিত হচ্ছে, একটি জাতিগত অহংকার যা খ্রিস্টানত্ব বা এমনকি মানবতার চেতনা থেকে যতদূর সম্ভব দূরের এক জীবন-অহংকার উৎপাদন করতে বাধ্য”।

ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসবাদ কেবল রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি জনগণের ধর্মীয় জীবনকেও অশান্ত করে তোলে। সহনশীলতা ফ্যাসিবাদী দর্শনে অজানা একটি বিষয়। হিটলারের ক্ষমতায় আসার সময়, জার্মান প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চের নেতৃত্বে ছিলেন একজন অত্যন্ত জনপ্রিয় ধর্মযাজক। বিশপ বডেলশুইং ছিলেন আধুনিক ও প্রগতিশীল প্রবণতাসম্পন্ন একজন ধর্মীয় নেতা। তিনি ফ্যাসিবাদকে সমর্থন করতেন না। তাঁর গণতান্ত্রিক বিশ্বাস, যা খ্রিস্টান ধর্মপ্রাণতা ও দয়ার দ্বারা সমর্থিত ছিল, তাঁকে “দরিদ্রদের বিশপ” উপাধিতে ভূষিত করেছিল। এমন একজন ব্যক্তি, তাঁর সমস্ত আধ্যাত্মিক গুণাবলী সত্ত্বেও, জার্মান সংস্কৃতির “আর্যকরণ”-এর জন্য নির্ভরযোগ্য ছিলেন না। ধর্মীয় উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের এক সম্মেলনে, হিটলারপন্থীরা তাঁকে সোজা পথে অপসারণ করতে ব্যর্থ হয়। তিনি পুনরায় নির্বাচিত হন। এরপর ফ্যাসিস্টরা একটি জাল নির্বাচন মঞ্চস্থ করে। সম্পূর্ণ ক্ষমতা কব্জায় থাকায় তারা সংসদীয় নির্বাচনে ব্যবহৃত সন্ত্রাস, জবরদস্তি ও অপপ্রচারের সমস্ত পদ্ধতি আরও কার্যকরভাবে এই নির্বাচনেও প্রয়োগ করে। জার্মানির শহুরে জনসংখ্যার বেশিরভাগই শ্রমিক শ্রেণী। তারা ধর্মীয় নির্বাচনের প্রতি উদাসীন ছিল। তাই ফ্যাসিস্ট প্রার্থীর জয় নিশ্চিত ছিল। একজন জনপ্রিয়, সত্যিকারের খ্রিস্টান ধর্মযাজককে হিটলারের এক অনুগত দ্বারা প্রতিস্থাপনের প্রচারণা পরিচালিত হয়েছিল এই স্লোগান সহ— “আমরা যীশু খ্রিস্টের ঝটিকা বাহিনী”। এই ছদ্ম-ধর্মীয় উন্মাদনা দিয়ে, ফ্যাসিস্ট গুন্ডারা লোকদের তাদের বিশ্বাসের বিরুদ্ধে ভোট দিতে বাধ্য করেছিল। এইভাবে “জার্মান খ্রিস্টানত্ব” প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলপ্রয়োগ ও মিথ্যার ভিত্তিতে, যা শিল্পপতি, ব্যাংকিং ম্যাগনেট ও জাঙ্কার-জমিদারদের পার্থিব স্বার্থ রক্ষার জন্য একটি নিকৃষ্ট অস্ত্র হিসাবে কাজ করবে। নির্বাচনী প্রচারণার এক ভাষণে, হিটলার ফ্যাসিস্ট একনায়কত্বের আধ্যাত্মিক চেতনা প্রদর্শন করে ঘোষণা করেছিলেন যে “একটি রাষ্ট্র যা চার্চকে রক্ষা করে না তা মূল্যহীন”। চার্চকে রাষ্ট্রের অনুগত হতে হবে। সম্মানিত ক্যাথলিক চার্চ বা জনপ্রিয় ইভাঞ্জেলিক্যাল চার্চ কোনোটিই কিন্তু ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের সুরক্ষা পায়নি। একটি নতুন চার্চ তৈরি করা হয়েছিল ফ্যাসিস্ট বর্বরতাকে ঐশ্বরিক অনুমোদন দেওয়ার উদ্দেশ্যে এবং এটিকে সর্বশক্তিমান রাষ্ট্রের আধ্যাত্মিক অস্ত্র হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল। একটি ধ্রুপদী “আর্য” চেতনায়, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ধর্ম রক্ষাকে তার কর্তব্যগুলির মধ্যে একটি হিসাবে স্বীকৃতি দেয়, এবং এই ধর্ম হল শ্রেণী আধিপত্যের আধ্যাত্মিক মতাদর্শ। 

জনপ্রিয় খ্রিস্টান ধর্মযাজকের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস, জবরদস্তি ও অপপ্রচারের মাধ্যমে অর্জিত জয়কে হিটলারের বিজয়ী অনুগতরা “ঈশ্বর কৃত এক অলৌকিক ঘটনা” হিসাবে ঘোষণা করেছিল। ফ্যাসিস্টদের পৃথিবীর স্বর্গরাজ্যে, সবকিছু অলৌকিকভাবে ঘটে। ঈশ্বরের আঙুল দেখা যায় প্রতিটি সহিংসতা ও বর্বরতার পিছনে। রাইখস্ট্যাগ অগ্নিকাণ্ডের বিচারে তার কুখ্যাত ভাষণে গোয়েরিং ঘোষণা করেছিলেন যে, “অগ্নিকাণ্ডের রাতে, হিটলার একে স্বর্গ থেকে আসা নিদর্শন হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন”; অগ্নিসংযোগকারী আদতে ঈশ্বরের সেবায় নিয়োজিত, এবং তিনিও বলছেন ঐশ্বরিক অনুপ্রেরণায়! 

ফ্যাসিবাদের অনুশীলন যত ঘৃণ্য হয়ে উঠছিল “নেতা”-র দেবত্ব ততই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। আজ, হিটলার জার্মান ঈশ্বর ও “জার্মান জনগণের” সাথে একটি নতুন রহস্যময় ত্রিত্বের সদস্য হয়ে গেছেন। জার্মান ইভাঞ্জেলিক্যাল চার্চের বেদীতে তাঁর ছবি আজ একটি সাধারণ ও পরিচিত দৃশ্য। 

“জার্মান খ্রিস্টানত্ব”-র এই নবীর অ্যাপোস্টল হল আলফ্রেড রোজেনবার্গ, যার বই “দ্য মিথ অফ দ্য টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি” ন্যাশনাল সোশ্যালিজমের বাইবেল হয়ে উঠেছে। তিনি ঐতিহ্যবাহী খ্রিস্টান গুণাবলীকে “নেতিবাচক” হিসাবে প্রত্যাখ্যান করেন এবং তিনি যাকে বলেন “ইতিবাচক খ্রিস্টানত্ব” তা দিয়ে সেগুলোর বিরোধিতা করেন। এই নতুন বিশ্বাস খ্রিস্টের শিক্ষার সাথে এতটাই বিরোধপূর্ণ যে এটি ইভাঞ্জেলিক্যাল চার্চের রক্ষণশীল উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের একটি ম্যানিফেস্টো জারি করতে বাধ্য করেছিল, খ্রিস্টানত্বের এই ধোঁয়াসার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে। যদিও ম্যানিফেস্টোটি স্বয়ং নেতাকেই সম্বোধন করে লেখা হয়েছিল, সম্বোধনে প্রতিবাদকারী পাদ্রীরা নেতাকে সম্মান সহকারে অভিবাদন জানিয়েছিলেন এবং কেবল “উদ্বেগ ও ভয়” প্রকাশ করেছিলেন, তবুও সেই ম্যানিফেস্টোকে পুলিশ তৎক্ষণাৎ দমন করে। এই ঐতিহাসিক দলিলটি এইভাবে শেষ হয়েছে: “এমনকি একটি মহৎ কারণও, যদি তা ঈশ্বরের প্রকাশিত ইচ্ছার বিরোধিতা করে, তাহলে তা অবশেষে জনগণকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। হিটলার জাতীয় পুরোহিতের মর্যাদায় ভূষিত, এমনকি ঈশ্বর ও জনগণের মধ্যে মধ্যস্থকারী হিসেবেও”। 

গোয়েবলসের নিম্নলিখিত ঘোষণাটি প্রমাণ করে যে রক্ষণশীল চার্চের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের উদ্বেগ ও ভয় অমূলক ছিল না: “যখন নেতা জনগণের কাছে তাঁর শেষ আবেদন করেছিলেন, তখন মনে হচ্ছিল যেন একটি গভীর আলোড়ন সমগ্র জাতির মধ্য দিয়ে বয়ে গেল; মনে হচ্ছিল যে জার্মানি ঈশ্বরের গৃহে পরিণত হয়েছে, যেখানে তার সর্বশক্তিমানের সিংহাসনের সামনে দাঁড়িয়ে সুপারিশকারী সাক্ষ্য দিচ্ছে। আমাদের মনে হয়েছিল যে স্বাধীনতা ও শান্তির জন্য একটি জাতির এই গগনবিদারী চিৎকার নিষ্প্রভ হয়ে যেতে পারে না। এটাই ছিল ধর্ম, তার গভীরতম ও রহস্যময় অর্থে। একটি জাতি তখন ঈশ্বরকে স্বীকার করে নিয়েছিল তাঁর মুখপাত্রের মাধ্যমে  এবং তার ভাগ্য ও জীবনকে পূর্ণ আত্মবিশ্বাসে তাঁর (হিটলারের) হাতে সমর্পণ করেছিল”।

নতুন মেসিয়া’র অনুসরণে খ্রিস্টের ছবি এঁকেছেন রোজেনবার্গ। তিনি বাইবেলের খ্রিস্টকে প্রত্যাখ্যান করেছেন প্রতারণামূলক ছবি হিসাবে অভিহিত করে যা “ম্যাথিউ’র মতো ইহুদি উগ্রপন্থী, পল-এর মতো বস্তুবাদী রাব্বি, টারটুলিয়ানের মতো আফ্রিকান আইনজ্ঞ, অগাস্টিনের মতো সংকর জাতের অর্ধ-রক্তদের দ্বারা অঙ্কিত”। তিনি তাঁর “ইতিবাচক খ্রিস্টানত্ব”র খ্রিস্টকে টিউটনিক বাবা-মায়ের সন্তান হিসাবে চিত্রিত করেছেন, একজন আক্রমণাত্মক বিপ্লবী হিসাবে যিনি এই পৃথিবীতে শান্তি আনার জন্য নয়, বরং হিটলারের মতো হাতে তরবারি নিয়ে অবতরণ করেছিলেন। রোজেনবার্গের উদ্ভাবিত খ্রিস্টের মিশন ছিল বিপ্লব দমন করা। তিনি অভিযোগ করেন যে খ্রিস্টান চার্চ তার নবীর শিক্ষা ভুলে গিয়েছিল, এবং ঘোষণা করেন যে হিটলার এসেছেন খ্রিস্টানত্বের প্রতিষ্ঠাতার প্রতিবিপ্লবী মিশন পূরণ করতে। যারা খ্রিস্টানত্বের উৎপত্তি সম্পর্কে অল্পবিস্তর জানেন তারা সকলেই জানেন যে খ্রিস্ট ভীরুভাবে নতি স্বীকারের মতবাদ প্রচার করে থাকুন বা না থাকুন, তিনি নিশ্চয়ই প্রতিবিপ্লবি নায়ক হিসাবে আবির্ভূত হন নি। বরং, ঐতিহাসিক খ্রিস্ট ছিলেন রোমান নিপীড়নের বিরুদ্ধে ইহুদি জনগণের বিদ্রোহের নেতাদের মধ্যে একজন। মূল খ্রিস্টানত্ব ছিল একটি বিপ্লবী আন্দোলনের মতাদর্শ। রোজেনবার্গের “ইতিবাচক খ্রিস্টানত্ব” হল প্রতিবিপ্লবের রক্তাক্ত পূজা। বাস্তবে, তিনি খ্রিস্টান চার্চের প্রতিক্রিয়াশীল রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে মূল খ্রিস্টানত্ব পুনরুজ্জীবিত করার প্রস্তাব দেন না মোটেই। 

“রোজেনবার্গ রোম, উইটেনবার্গ ও জেনেভার ধর্মের বিরোধিতা করে ওডিন ও সিগফ্রিডের ধর্মকে তুলে ধরেন। তিনি খ্রিস্টান ক্রুশের নিষ্প্রভ প্রতীকের বিরোধিতা করে সূর্য দেবতার প্রতীক স্বস্তিকার পক্ষে দাঁড়ান। তিনি ‘সার্বজনীন আত্মা ও মানব ভ্রাতৃত্বের’ ‘অবাস্তব ও নৈতিকতা হরণকারী ও জাতীয়তাবাদ-বিরোধী ধর্মের’ বিরোধিতা করে ‘জাতি ও রক্তের জীবন্ত ধর্ম’-কে তুলে ধরেন। তিনি ‘দুর্বল ও ইতর মানুষের’ ধর্মের বিরোধিতা করে সুপারম্যানের ধর্মকে তুলে ধরেন। তিনি করুণা ও দয়ার দুর্বল খ্রিস্টান গুণাবলীর বিরোধিতা করে সম্মান ও স্বাধীনতার প্রাথমিক জার্মান গুণাবলীকে তুলে ধরেন, যা প্রতিটি সৎ জার্মান নর্ডিক ইউরোপের আত্মার জন্য একটি অশুভ ও স্থায়ী হুমকি বলে অনুভব করে”।(চার্লস সারোলিয়া, “দ্য জার্মান অ্যান্টি-ক্রাইস্ট” ইন “কারেন্ট হিস্ট্রি”, নিউ ইয়র্ক, জুন ১৯৩৫)।

স্পেংলারের ধারণাকে অনুসরণ করে রোজেনবার্গ পশ্চিমের পতনকে এক করুণ প্রক্রিয়া বলে মনে করেন, যা তাঁর মতে, “জার্মানিক সত্য”-কে ইউরোপীয় জনগণের ভুলে যাওয়ার ফল। এই ভুলটি ঘটেছিল চারশ বছর আগে রেনেসাঁর যুগে। এরপর থেকে প্রগতির নামে যা কিছু ঘটেছে, তা সবই “ইউরোপের অবনতি ও বিচ্ছিন্নতার” প্রতীক। সংসদীয় সরকার প্রতিষ্ঠা, গণতন্ত্রের উত্থান, মানবতাবাদের বিজয়, আন্তর্জাতিক ও বিশ্বজনীন চেতনার বিষাক্ত প্রভাব, উদারনীতির বিস্তার, শান্তিবাদ এবং এমনকি নারীবাদ—এসবই এই ক্ষতিকর পশ্চাদ্গমনের অংশ। 

হিটলারবাদের এই মহাযাজকের মতে, “প্রতিটি জীবন্ত ধর্ম জাতীয় চেতনা দ্বারা অনুপ্রাণিত হতে হবে: জাতিগুলিই ঈশ্বরের চিন্তা”। জার্মানরাই, অবশ্যই, ঈশ্বরের নির্বাচিত জাতি; জার্মান জাতিই সম্ভবত ঈশ্বরের সর্বোচ্চ ধারণা। তাই, তাদের “একটি পবিত্র মিশন পূরণের জন্য আলাদা করা হয়েছে, এবং জার্মান জাতীয় চার্চের একমাত্র উদ্দেশ্য হলো সকল নাগরিককে ঐ ঐশ্বরিক মিশনের সেবায় একত্রিত করা”। নীৎসের অনুসারী রোজেনবার্গ অবজ্ঞার সাথে “সারমন অন দ্য মাউন্টের ভণ্ড নৈতিক মূল্যবোধ” প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি জার্মান জনগণকে ভালো-মন্দের ধারণার ঊর্ধ্বে উঠতে আহ্বান জানান। অবশ্য, এই রহস্যময় উচ্চতা সকল জার্মানরাও অর্জন করতে পারবে না—এটি শুধুমাত্র সেইসব সুপারম্যানের জন্য, যারা স্বস্তিকার প্রতীকের নিচে দাঁড়িয়ে পৃথিবী জয়ের সংকল্পে অটল। 

 

ফ্যাসিস্টদের নতুন ধর্ম, তথা “জার্মান খ্রিস্টানত্ব”, বাইবেল বর্জন করে আইসল্যান্ডিক সাগা, নিবেলুংগেন, শোপেনহাওয়ার ও নীৎসের রচনা, এবং চেম্বারলেনের প্যান-জার্মান মতবাদ গ্রহণ করবে। পুনরুত্থিত জার্মানরা ওডিন ও সিগফ্রিডের মতো পৌরাণিক নায়ক, আত্তিলা ও থিওডোরিকের মতো বর্বর বিজয়ী, ফ্রেডরিক দ্য গ্রেটের মতো সামন্ততান্ত্রিক রাজা, বিসমার্কের মতো প্রুশিয়ান সামরিকবাদী—এবং এই চিত্রকল্পময় দেবমণ্ডলীর সর্বশেষ দেবতা হিটলারকে পূজা করবে। এই দেবতাদের উপাসকরা “নর্ডিক পুরাণ, সাগা ও রূপকথা” থেকে অনুপ্রেরণা নেবে, যা একমাত্র “জার্মান আকাঙ্ক্ষা, আদর্শ ও নৈতিক মূল্যবোধ” প্রকাশ করে। মানবতার এই নতুন ত্রাণকর্তাদের আধ্যাত্মিক চিন্তাধারার এর চেয়ে স্পষ্ট প্রকাশ আর কিছুই হতে পারে না। 

এই নতুন জার্মান চার্চের প্রতিষ্ঠাতার মতে, এর মিশন হলো “রক্তের রহস্যময় ধর্ম ও সম্মান ও বীরত্বের বীরোপাসনা প্রতিষ্ঠা করা”। এই আধ্যাত্মিক মিশন পূরণ হলে, পুনর্জন্মপ্রাপ্ত সুপারম্যানেরা তাদের পৌরাণিক পূর্বপুরুষদের “আক্রমণাত্মক বীরত্ব” অনুকরণ করে “সমগ্র বিশ্বের উপর তাদের ইচ্ছা চাপিয়ে দিতে” সক্ষম হবে। খ্রিস্টান দয়া ও মানবতাবাদী ধর্মনিষ্ঠাকে “প্রাণঘাতী প্রাচ্য বিষ” হিসেবে নিন্দা করা হয়। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক জার্মানি একটি “মৌলিক ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক বিপ্লব”-এর মাধ্যমে এই বিষ থেকে মুক্ত হবে। 

এটাই হলো “প্রাচ্যের আধ্যাত্মিক বার্তা”-র ব্যবহারিক প্রয়োগ, যখন তা “পাশ্চাত্যের বস্তুবাদ”-এ সাড়া পায়। ধর্মান্তরিত ব্যক্তি, নব্য-ধর্মীয় উন্মাদনায়, ধর্মীয় সংস্কৃতির মহৎ ও প্রগতিশীল উপাদান বর্জন করে, বিশ্বাস ও কুসংস্কারের ভিত্তিতে তার প্রতিবিপ্লবী উদ্দেশ্যের অস্ত্র খুঁজে পায়। 

“বাস্তবে, নাৎসি আন্দোলন হলো সেই রাজনীতির বিরুদ্ধে একটি জোরালো প্রতিক্রিয়া, যা অর্থনীতিকে প্রধান বিবেচনা করে এবং মানুষের আত্মার কথা ভাবে না”। (অসওয়াল্ড গ্যারিসন ভিলার্ড, “দ্য জার্মান ফিনিক্স”)। আত্মার তত্ত্ব ও আধ্যাত্মিক দর্শনের অপূরণীয় ক্ষতি হয় যখন ফ্যাসিবাদের মতো হিংস্র, নৃশংস, মিথ্যাবাদী, নীচ ও বর্বর আন্দোলনে তাদের সমর্থকদের পাওয়া যায়। 

হান্স হাইনৎস ইভার্স হচ্ছেন সেইসব বিরল বিশিষ্ট জার্মান লেখকদের মধ্যে একজন, যারা হিটলারবাদের পক্ষ নিয়েছিলেন। তিনি এই আন্দোলনের প্রধান সরকারি মতাদর্শিক ব্যাখ্যাকার হয়ে ওঠেন। তাঁর সর্বশেষ বই ফ্যাসিবাদী মতাদর্শের একটি চিত্রণময় ব্যাখ্যা দেয়: “স্বস্তিকার দর্শন যুক্তির দাম্ভিকতার বিরুদ্ধে হৃদয়ের প্রবৃত্তিকে রক্ষা করে”। (এইচ. এইচ. ইভার্স, “রাইডার অব দ্য নাইট”)। ইভার্স ফ্যাসিবাদকে ব্যাখ্যা করেন ওয়াগনারের রহস্যবাদ ও নীৎসের দুঃখ ও কষ্টের পূজার মিশ্রণ হিসেবে, যা বিভিন্ন অযৌক্তিক মানসিক প্রবৃত্তির সাথে যুক্ত—এবং ঠিক এই অযৌক্তিকতার কারণেই এগুলোকে আধ্যাত্মিক শক্তি হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়, যা বস্তুগত জীবনের সীমা ও নিয়ম দ্বারা আবদ্ধ নয়। 

একজন সমালোচক ইভার্সের বই পর্যালোচনা করে যথার্থই মন্তব্য করেন: “স্বস্তিকার দর্শন সেই বিশ্বের প্রস্তাব দেয়, যা ক্ষুধার্ত ও হতাশ আত্মাদের সবচেয়ে বেশি প্রলুব্ধ করে—যা হল কুসংস্কার ও পুরাণের জগৎ”।(“দ্য নিউ রিপাবলিক”, নিউ ইয়র্ক, ১০ মে ১৯৮৩)। রোমান একনায়কেরা রুটি না দিয়ে জনতাকে বিশ্বাসের সার্কাস দিয়ে বিনোদন দিত; ফ্যাসিস্ট একনায়কেরা আরও ভালো কাজ করে—তারা পুঁজিবাদী পতনের শিকারদের আধ্যাত্মিক সার্কাস দিয়ে তৃপ্ত করে। আধ্যাত্মিকতা ও রহস্যবাদ হলো ক্ষুধার্ত ও হতাশ আত্মাদের খাদ্য। সাধারণ মানুষ, যাদের সামনে বস্তুগত, বৌদ্ধিক ও নৈতিক বিকাশের পথ খোলা, তারা এই কাল্পনিক স্বাস্থ্যের মাদক পানে আগ্রহী নয়।

যেভাবে পুঁজিবাদী সমাজের বর্তমান দুরারোগ্য সংকট আধুনিক ইউরোপীয় দর্শনকে রহস্যবাদ ও ধর্মীয় মৌলবাদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, ঠিক তেমনই ভারতীয় সংস্কৃতির আধ্যাত্মিকতা আসলে অতীত যুগের এক অনতিক্রম্য সামাজিক সংকটের ফসল। এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী রোগ, যা বহু শতাব্দী ধরে ভারতের সামাজিক কাঠামোর মর্মমূলে প্রবেশ করে আমাদের জনগণের দীর্ঘস্থায়ী দাসত্বের কারণ হয়ে রয়েছে। আজ অন্যদেরও একই রোগে আক্রান্ত হতে দেখা যাচ্ছে, কিন্তু তা এই রোগের ভয়াবহতা কমায় না। বরং, স্বাস্থ্যকর সমাজেও এর সংক্রমণ প্রমাণ করে এর মারাত্মক ভয়াবহতা। বিশ্বের অন্যান্য অংশে এই রোগের কুৎসিত লক্ষণগুলোর প্রাদুর্ভাবে আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত এবং এর প্রতিকার খুঁজে বের করা উচিত।

যারা সব কিছুর পিছনে ঈশ্বরের হাত দেখে, বা বিশ্বাস করে যে সবকিছুই কোনো রহস্যময় ঐশ্বরিক উদ্দেশ্যে ঘটে, তারা বিশ্বকে যেমন আছে তেমনই মেনে নেয়। কারণ, এর প্রতি যে কোনো অসন্তোষই ধর্মবিরোধী; এই বিশ্বকে পরিবর্তনের ইচ্ছা নাস্তিকতা, এবং একে পুনর্গঠনের প্রচেষ্টা সরাসরি ধর্মদ্রোহিতা—ঈশ্বরের বিধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। তাই, ধর্ম ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের নামে একে যেকোনো উপায়ে দমন করতে হবে। প্রায়শই ধর্মীয় উগ্রপন্থীরা তাদের কুসংস্কার ও বিশ্বাসের অনুসরণে অনৈতিক আচরণ করে ও সহিংসতা চালায়। যদি কেউ তার বিশ্বাস বা দর্শনকে সর্বোচ্চ মূল্যে রক্ষা করতে প্রস্তুত না থাকে, তবে সেই বিশ্বাসের কী মূল্য? ধর্ম ও আধ্যাত্মিক দর্শন হলো একটি প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থাকে রক্ষার মতাদর্শ। এটি প্রগতির শক্তির সম্পূর্ণ বিপরীত।

0 Comments

Post Comment