পশ্চিম বাংলার নির্বাচনের ফলাফল যাই হোক না কেন, একটা কথা এখন স্পষ্ট ভাবে বোঝা যাচ্ছে : ২রা মে র পরে এ রাজ্যের রাজনীতির চেহারাটা চিরকালের মতো পাল্টে যাবে।
এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে ভারতীয় জনতা পার্টির ভোট ও আসন সংখ্যা দুই ই ২০১৬ র তুলনায় বেশ ভালো পরিমাণে বাড়তে যাচ্ছে। এখন অবধি নির্বাচনের যা খবর পাওয়া যাচ্ছে তাতে এটা মনে হয়না যে ওরা জিতে সরকার বানাবার মতো অবস্থায় আসতে পারবে। কিন্তু যদি ৭০ থেকে ৮০ আসন ও পায় তাহলে তার অর্থ কি দাঁড়াবে সেটা হয়তো এই মুহূর্তে অনেকে বুঝতে পারছেন না।
বলাই বাহুল্য, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ আরো বাড়বে, কথায় কথায় দাঙ্গা হবে ও রাজ্যের দৈনন্দিন জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। কিন্তু আমরা, যারা উত্তর ভারতে থাকি, তারা জানি এই সব ছাড়াও কি পরিমাণ সমস্যা এরা তৈরী করতে পারে। এই সমস্যাগুলি কে অজুহাত করে কেন্দ্রীয় সরকার ক্রমাগত হস্তক্ষেপ করে রাজ্যা সরকারের পদক্ষেপগুলো বানচাল করতে থাকবে। মনে রাখা দরকার যে মার্চ ২০২০র দিল্লির 'দাঙ্গা' এদের দ্বারা শাসিত রাজ্যে বাধানো হয়নি - বরঞ্চ স্থানীয় বিজেপি ও কেন্দ্র সরকারের যৌথ প্রচেষ্টায় সেটা কার্যকরী করা হয়েছিল। আর সাধারণ মুসলমানদের জীবন তো বিপন্ন হবেই - এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
সাধারণ মানুষ যে এটা বুঝতে পারছেন না সেটা অস্বাভাবিক নয় কারণ বিজেপি সম্বন্ধে তাদের সরাসরি কোনো অভিজ্ঞতা নেই। শুধু যে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার অভাব রয়েছে তাই নয়, যেহেতু সম্পূর্ণ মিডিয়া কেবল কেন্দ্র সরকার ও বিজেপির পক্ষেই প্রচার চালিয়ে যায়, সেহেতু অনেক মানুষের বিভ্রান্ত হওয়াটাই স্বাভাবিক। সাধারণত নির্বাচনী প্রচার অভিযানগুলির মধ্য দিয়ে পরিস্থতির অন্য রুপ বা দিকটা লোকেদের সামনে তুলে ধরার একটা সুযোগ থাকে। সেই সুযোগটাও কাজে লাগান যাচ্ছে না এবার। বরঞ্চ হচ্ছে তার উল্টোটা। গত সপ্তাহে বীরভূমের প্রবীণ সিপিআই নেতা কৃষ্ণপদ সিংহরায় একটা সাক্ষাৎকারে বললেন যে স্বাধীনতার পরে গোটা ভারতে এমন বিপদ তিনি দেখেন নি, অথচ "আব্বাসবাদী আলিমুদ্দিন ও অধীরপন্থী কংগ্রেস মমতা ব্যানার্জী কেই প্রধান শত্রু হিসাবে দেখছে। তাই প্রচারে শুধু মমতা বিরোধিতাই করছে, বিজেপির বিরুদ্ধে কোনো কথাই বলছে না। কৃষ্ণপদ বাবু তো বামফ্রন্টের শরিক দলের প্রবীণ নেতা, সেই কারণেও ওনার কথাগুলি গুরুত্বপূর্ণ।
এই কথাই মনরঞ্জন ব্যাপারি আর একটু খুলে তাঁর এক লম্বা ফেসবুক পোস্টে বলেছেন। তিনি লিখেছেন "যারা রেল বেচে দিলো, প্লেন বেচে দিলো, পিএম কেয়ার ফান্ডের লক্ষ কোটি টাকা ঝেঁপে দিলো, লাল কেল্লা বন্ধক দিয়ে দিলো, দেশের হাজার দু হাজার টন সোনা বন্ধক দিয়ে দিলো, চৌদ্দটা ব্যাঙ্ক খালি করে সাঁইত্রিশ জন গুজরাতি বিদেশে পালিয়ে যেতে সহযোগ দিলো, গুজরাট, দিল্লি তে নিরীহ লোকেদের নির্মম ভাবে খুন করিয়ে দিলো, ব্যাপম রাফায়েল হাজার দুর্নীতি, তবু এই পক্ষের কোন অপরাধ আর তাদের চোখে অপরাধ নয়। ক্রোধ আক্রোশ তাদের এত অন্ধ করে দিয়েছে।"
অর্থাৎ সব চেয়ে মারাত্মক ব্যাপার হল এই যে বামফ্রন্ট ও সংযুক্ত মোর্চা, এবং বিশেষ করে সিপিএম, মোটামুটি বিজেপির ঘৃণিত রাজনীতির ওপর নীরব থেকে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধেই তাদের আক্রমণটা কেন্দ্র করেছে। এটা এমনিতে নতুন কিছু নয় কারণ ২০১৯ এর লোক সভা নির্বাচনের সময়েও তারা বেশ খোলাখুলি ভাবেই বিজেপি কে ভোট পাইয়ে দিয়েছিল। 'এবার রাম পরে বাম' কথাটা প্রত্যক্ষ ভাবে পার্টির স্লোগান না থাকলেও এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে রাস্তা ঘাটে ওটাই তাদের আসল কার্য্যকরী স্লোগান ছিল। সেইবার তো রাজ্যের ক্ষমতার প্রশ্ন ও ছিল না, কিন্তু সব কিছু জেনে শুনেও তারা নরেন্দ্র মোদির বিজেপির জয়ে তাদের অবদান রাখতে কোনো রকম সংকোচ বোধ করলো না। আর এবার তো রাজ্যের নির্বাচন - এখন তো এ রাজ্যে কে শাসন করবে সেটা ঠিক হওয়ার কথা। ফলে 'একুশে রাম, ছাব্বিশে বাম' হলো এবারকার স্লোগান। “তৃণমূল কংগ্রেসের ঠ্যাঙানি খেয়ে খেয়ে আত্মরক্ষার তাগিদেই আমরা এখন বিজেপির শরণ নিয়েছি”, এমন একটা তর্ক এখন সর্বত্র শোনা যাচ্ছে। কথাটা ঠিক এই ভাবে বললে সিপিএম এর লোকেদের গায়ে লাগতে পারে কিন্তু যেটা ঘটনা সেটা অস্বীকার করার তো কোন অবকাশ নেই – আর সে বিলাসিতার সুযোগও নেই। তাদের এই মতিভ্রমটা আসলে কোনো রণনীতি বা কৌশলের দিক থেকে বোঝা সম্ভব নয় - আর মার্ক্সবাদী কোনো দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তো নয়ই। খোকা একটা ছোট গুণ্ডার হাতে মার খেতে খেতে লাফিয়ে উঠে গেছে বড় মস্তানের কোলে - এভাবে ছাড়া আর অন্য দিক থেকে তাদের এই অবস্থানের যুক্তি খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়।
সুতরাং দ্বিতীয় যে অর্থে পশ্ছিম বঙ্গের রাজনীতি এবার পুরোপুরি পাল্টে যেতে বাধ্য সেটার লক্ষণ এই অবস্থাতে আমরা পরিষ্কার দেখতে পাই। এই বিগত তিন বছরের ইতিহাসের ভিত্তি তে মনে হয় রাজ্যের রাজনীতিতে সিপিএম বিজেপি শিবিরের পার্টি হয়ে থাকবে - এটা ধরে নিতে হবে। শীতলকুচির ঘটনার পরে যে ভাবে সিপিএমের নেতাদের বক্তব্যগুলি আসতে শুরু করে - সেগুলির আর অমিত শাহ এর বক্তব্যর মধ্যে খুব একটা তফাৎ দেখা যায় নি। আর কিছু দিন আগে সর্বদলীয় বৈঠকেও অতিমারীর ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে যখন তৃণমূল কংগ্রেস বাকি তিন দফা নির্বাচন এক সঙ্গে সেরে ফেলার প্রস্তাব আনল, তখনও সিপিএম কে বিজেপির পাশে দাঁড়াতেই দেখা গেলো। কে না জানে যে বাংলায় আটটা ফেজে নির্বাচনের কর্মসূচি বিজেপির সুবিধেটা মাথায় রেখেই নেওয়া হয়েছিল, আর এখন এই ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে সেটা করার আর কোনো যুক্তিই নেই। এই সমস্ত ব্যাপারে সিপিএমের ধরণ ধারণ দেখে তো মনে হয় যে তারা খুব ভেবে চিনতে ফ্যাসিস্ট শক্তির সহায়ক হিসাবে নিজেদের ভূমিকা ঠিক করে ফেলেছে।
নির্বাচনের পরে সিপিএমের সহযোগী বামপন্থী পার্টিগুলির সামনে একটা বিরাট বড় প্রশ্ন এসে হাজির হবে। তাদের ঠিক করতে হবে তারা কোথায় দাঁড়াবেন। যতদূর দেখা যায় ২রা মে’র পরে পশ্ছিম বঙ্গর রাজনীতি এক ভয়ানক হিংস্র পথে অগ্রসর হতে চলেছে যেখানে পুরাতন সি পি এম কে ব্যারিকেডের অন্যে দিকে দেখতে আমাদের অভ্যস্ত হয়ে যেতে হবে।
এখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার। তৃণমূল কংগ্রেসের কার্যকলাপের মধ্যে অনেক কিছুই আছে যা আমাদের অপছন্দ হতে পারে। তার সমালোচনা যেমন করে যেতে হবে, তেমনি তার ভুল কাজ গুলির বিরুদ্ধে প্রয়োজনে রাস্তায় ও নামতে হবে। বিজেপি কে প্রধান শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করার অর্থ এ নয় যে বাম শক্তিগুলি কে শাসক দলের ভুল কাজগুলিকেও সমর্থন করে যেতে হবে। আগামি দিনগুলি তে তৃণমূল কংগ্রেস শাসক দল থাকুক বা নাই থাকুক, বিজেপির বিপদটা আরো বড় আকারে হাজির হতে চলেছে।