ভারত মোটের ওপর ধর্মভীরু মানুষের দেশ হলেও বিশুদ্ধ ধর্মাচরণ অনেকেই করে না। তবে ধর্মীয় রিচ্যুয়ালগুলোতে ভিড় জমাতে ধর্মবিশ্বাসী মানুষের উৎসাহ কম নয়। কারণ ধর্মীয় আচার-সংস্কারে বিশ্বাস-ভক্তি সবারই আছে। ধর্মীয় গুরুস্থানীয়দের প্রতি সম্মান, বিশ্বাস তাদের ভালোই। ধর্মীয় মৌলবাদীদের অনেকে মানুষের খণ্ডধর্মমতিতে আক্ষেপ করলেও মানুষের বিচারধারায় বিশেষ নড়চড় হয়নি।
বিজ্ঞানের দৌলতে প্রযুক্তির প্রভূত উন্নতি, মানুষের দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞানের অবদান কমবেশি লেখাপড়া জানা মানুষ বোঝে। কিন্তু অদ্ভূতভাবে মানুষ তার সংস্কার-প্রবণতার অলিন্দে বিজ্ঞানের ব্যবহারিক সার্থকতাকে আত্তীকরণ করে চলেছে। এ হ’ল প্রথাগত বিজ্ঞানশিক্ষার ফলাফল। এই ধারায় বিজ্ঞান সম্পর্কে মানুষের একটা ধারণা আছে মাত্র, বিজ্ঞান-চেতনা নেই। আবার প্রসারিত না হলেও একাংশে চর্চিত বিজ্ঞান-চেতনার একটা ছাপ সাধারণ্যে থেকে যায় নিশ্চয়। এই বাস্তবতা যতদূর প্রসারিত, সেখানে কুসংস্কার-অন্ধ বিশ্বাসের ক্ষয়ক্ষতি কিছু হচ্ছে বৈকি। এপর্যন্ত ব্যাপারটা চলনসই। কিন্তু ক্ষতিপূরণের মহাজন জুটে গেলে মুশকিল।
সাম্প্রতিককালে ধর্মীয় রীতি-আচার তার দস্তুর হারিয়ে গণউন্মাদনার চেহারা নিয়েছে। ধর্মীয় সংস্কৃতির বহু কিছু আরোপিত মতান্ধতার বিকার ও অসহিষ্ঞুতা প্রদর্শনের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। মানুষের সংস্কার-প্রবণতার চোরাপথে ইতিহাস-সাক্ষী কুসংস্কারের নবায়ন হচ্ছে। এসবকিছু সংখ্যাগুরুর ধর্মাচরণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ রাজনৈতিক যোগসাজশ ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার পরিণাম। অন্যদিকে আজ রাষ্ট্রের হাতে থাকা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি চর্চার প্রতিষ্ঠানগুলোকে পর্যায়ক্রমে রাষ্ট্রপরিচালকদের ইচ্ছেঘড়িতে পরিণত করা চলছে। এই প্রক্রিয়া কপট ও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে; এটা বোঝা যায়, যখন দেখি, নভেল করোনা সংকট মোকাবিলায় কাঁসরঘন্টা বাদন, সরকারি তিথিনক্ষত্রের মাপে বিজলির আলো নিভিয়ে নিষ্প্রভ মোমবাতি বা প্রদীপ প্রজ্বলন, এমন রাষ্ট্রীয় ফরমান নেমে আসছে। অভিসন্ধি স্পষ্ট, বিজ্ঞানকে স্রেফ যান্ত্রিক ও বৈষয়িক হিসেবে দেখানো এবং মানুষের মননজগতে কুসংস্কার ও অপবিজ্ঞান গেঁথে দেওয়া। শাসক চাইছে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ঊর্দ্ধে ধর্মতত্ত্বকে স্থান দিতে, বিজ্ঞান-প্রযুক্তিকে ধর্মতত্ত্বের অধীনস্থ বিষয়বস্তু করে রাখতে।
ভারতে আধুনিক রাষ্ট্র-ব্যবস্থা গড়ে ওঠার পূর্বে শাসকের রাজ্যশাসনে ধর্মের অনুশাসনকে যুক্ত করা ও রাজ্যশাসনের প্রয়োজনে ধর্মের অনুশাসন প্রণয়ন করা হত। কিন্তু ধর্মতন্ত্র ও ধর্মাচরণের স্বকীয় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক রূপ কখনোই হারিয়ে যায়নি। আধুনিক রাষ্ট্রে ধর্ম সম্পর্কে এমন দৃষ্টিভঙ্গি হওয়ার কথা নয়। আমাদের দেশে তা হয়নি। দেশশাসনের কাজে কখনো কখনো পরোক্ষে কোনো কোনো ধর্মীয় রীতি-নীতির ব্যবহার হয়েছে বটে; কিন্তু ধর্মকে রাষ্ট্রের বিষয়বস্তু করে তোলা হয়নি। বর্তমানে হচ্ছে। মোদি সরকার হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মোহে ধর্মকে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে টেনে এনেছে, শুধু নয়, দেশটায় কুসংস্কার-ধর্মীয় গোঁড়ামি-অপবিজ্ঞানে ছয়লাপ করতে চাইছে।
অষ্টম শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত সময়কালে আরব সাম্রাজ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ছিল তুঙ্গস্পর্শী। আরবদের গ্রীক-পারসীক-ভারতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের আকর গ্রন্থ অনুবাদ ও দর্শন-কলা-চিকিৎসাবিজ্ঞান-জ্যোতির্বিদ্যা-ভূবিদ্যা-গণিত-পদার্থবিদ্যায় মৌলিক অবদানের নজির সমকালীন পৃথিবীর ইতিহাসে মেলে না। এমনকি যে পাশ্চাত্য সভ্যতাকে আমরা সারা পৃথিবীতে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার পথপ্রদর্শক বলে জানি, পাশ্চাত্যের সেই দেশগুলো তখন ছিল অজ্ঞানতার নিকষ অন্ধকারে। পরবর্তীকালে আরব সাম্রাজ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার প্রসারিত পরিসর সঙ্কুচিত হতে শুরু হলে দ্রুত তা রুদ্ধ হয়ে পড়ে। তা স্থানান্তরিত হতে থাকে পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে। পঞ্চদশ শতক থেকে আরবীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের আত্তীকরণ ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে মৌলিক অবদানের সুবাদে পাশ্চাত্য দুনিয়া শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা পেয়ে যায়। এ কোনো আপতিক ঘটনাক্রম নয়। এর পিছনে কারণ হ’ল রাজনৈতিক অনুশাসন।
আরব সাম্রাজ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার মূলে ছিল ইসলামীয় সমদর্শী ভাবধারা ও যুগোত্তীর্ণ ধর্মতত্ত্ব। ইসলাম ধর্মে তত্ত্বগতভাবে ধর্মতন্ত্র ও রাজনীতি ওত:প্রোত সম্পর্কিত। আধুনিক রাষ্ট্র-ভাবনা গড়ে ওঠার পূর্বে ইসলামীয় সাম্রাজ্যের শাসক অর্থাৎ খলিফা ছিল স্বয়ং প্রধান ধর্মনেতা। ৭৫০ খ্রীষ্টাব্দে আব্বাসিদ বংশের শাসনে আসে আরব সাম্রাজ্য। এই বংশের খলিফা আবু আল-আব্বাস থেকে আল-মামুন ছিলেন জ্ঞান-বিজ্ঞান-মুক্তচিন্তার একান্ত অনুরাগী। তাঁদের উৎসাহে ও পৃষ্ঠপোষকতায় আরব সাম্রাজ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা অনন্য গভীরতায় প্রসারিত হয়। পরবর্তী সময়ে কালক্রমে খলিফাদের ধর্মীয় গোঁড়ামি ও শাসকসুলভ অভিপ্রায়ে এই ধারা মর্যাদা হারাতে থাকে। অবশেষে রুদ্ধ হয়ে পড়ে। পরিণামে আরব সাম্রাজ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাজানো বাগান শুকাতে শুকাতে ঊষর মরুভূমি হয়ে যায়। দিনে দিনে সেই বাগানের চারাগুলি ইউরোপে বাহিত হয়ে প্রাণোচ্ছল বৃক্ষে পরিণত হয়।
বর্তমানে আমাদের দেশে ধর্ম ও বিজ্ঞান চর্চাক্ষেত্রে রাষ্ট্রপরিচালকদের শ্যেন দৃষ্টি পড়েছে। ধর্মতত্ত্ব থেকে ধর্মীয় রিচ্যুয়াল এবং বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্র ও ধারার অনেক কিছুতে দেশের শাসক নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে চলেছে। শাসক কুসংস্কার, গোঁড়ামি ও অপবিজ্ঞানের সওদাগরি শুরু করেছে। ন’মিনিটের অন্ধকার কোটি মিনিট অন্ধকারের ইঙ্গিতবাহী। এই কালান্তক ধারা রোধ করা না গেলে আরবীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার বিয়োগান্তক ইতিহাসের মতো পরিণাম নেমে আসবে আমাদের দেশে।