বাংলাভাষা নিয়ে এপারের বাঙালির সচেতনতা যেমন কম তেমনি বাংলা উইকিপিডিয়া নিয়েও। বাংলাদেশের হাত ধরে বাংলা অনলাইন বিশ্বকোষের জন্ম হয় ২০০৪ সালে। শুধু তাই নয় উইকিপিডিয়ায় বাংলা নিবন্ধ লেখার কাজেও তাঁরা এগিয়ে। তবে ভলেন্টিয়ারের সংখ্যা কম হওয়ায় অন্যান্য ভাষার তুলনায় বাংলা নিবন্ধ সংখ্যা এখনও অনেক কম। বেশি সংখ্যক ভলেন্টিয়ারকে এগিয়ে আসতে হবে তাহলেই বাংলা অনলাইন বিশ্বকোষ অন্যান্য ভাষার সম মর্যাদা পেতে পারবে।
"বাংলা আমার দৃপ্ত শ্লোগান
ক্ষিপ্ত তীর ধনুক"
আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে বাংলা ভাষায় খগেন্দ্র নাথ বসু ২২ খন্ডের বিপুল তথ্য ভান্ডার গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর স্মৃতিতে উত্তর কলকাতার একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে "বিশ্বকোষ" লেন। বিশ্বের বহুল ব্যবহৃত ভাষাগুলোর মধ্যে বাংলা, মৌখিক ভাষা হিসেবে ষষ্ঠ স্থানের অধিকারী। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, বাংলাদেশ এবং বারাক উপত্যকার বিপুল সংখ্যক লোকের মাতৃভাষা হল বাংলা। এছাড়া আন্দামানের অন্যতম প্রধান এবং কর্ণাটকের দ্বিতীয় সরকারি ভাষাও হল বাংলা। বাঙালি আত্মবিস্মৃত জাতি। এরপরেও দেখা যায় বাঙালির নিজ ভাষা চর্চা নিয়ে রয়েছে গ্লানি ও অনীহা। "বাংলা ঠিক আসে না" এই বাক্যের মধ্যে বাঙালি বর্তমানে আত্মপ্রসাদ পায়। বাংলায় উইকিপিডিয়া থাকা সত্ত্বেও ইংরেজি উইকিপিডিয়ার তথ্যের উপর বাঙালিকে বেশি নির্ভরশীল হতে দেখা যায়। অন্য ভাষায় উইকিপিডিয়া নিয়ে সেই ভাষাভাষী লোক যতটা ওয়াকিবহাল, বাঙালি বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি ততটা ওয়াকিবহাল একেবারেই নয়। এ বিষয়ে সচেতনতাও যথেষ্ট কম।
সেদিক থেকে বাংলাদেশ আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে। বাংলা উইকিপিডিয়ার জনক হিসেবে উঠে আসবে বাংলাদেশেরই নাম। তাঁদের হাত ধরেই বাংলা উইকিপিডিয়া পথ চলা শুরু করে। বাংলা ভাষা চর্চা ও সে নিয়ে সচেতনতার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ পশ্চিমবঙ্গকে গুণে গুণে দশ গোল দেবে। কানাডার শিক্ষার্থী শাহ আসাদুজ্জামান প্রথম বাংলা উইকিপিডিয়া তৈরি করার কথা ভেবেছিলেন। ২০০৩ সালের ৯ডিসেম্বর বাংলা উইকিপিডিয়া প্রস্তুত করার অনুরোধ জানিয়ে তিনি পত্র লিখেছিলেন উইকিপিডিয়ার প্রতিষ্ঠাতা জিমি ওয়েলকে। ঐ বছরই ২৬ ডিসেম্বর পরীক্ষামূলকভাবে "হোম পেইজ" নামে একটি পাতা তৈরি করা হয়েছিল। ২৭ জানুয়ারি ২০০৪ সালে একটি আইপি ঠিকানা থেকে প্রধান পাতা তৈরি করার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলা উইকিপিডিয়ার জন্ম হয়। বাংলা উইকিপিডিয়া তৈরি করার পর প্রথম নিবন্ধ হল "বাংলা ভাষা"। এটি ২৪মে ২০০৪ সালে তৈরি করা হয়েছিল।
বাংলা উইকিপিডিয়ায় নিবন্ধ তৈরি করার ক্ষেত্রে একজনের নাম না নিলেই নয়। তিনি হলেন সুব্রত রায়। নিবাস বাংলাদেশ। পেশায় লাইব্রেরিয়ান। বাংলাদেশের নরসিংদী জেলার নারায়নপুরের রাবেয়া মহাবিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত। ২০১৫ সালে তাঁকে "উইকিপিডিয়ার এশিয় দূত" উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল। বাংলা উইকিপিডিয়ায় সুব্রত রায়ের নিবন্ধ সংখ্যা হল প্রায় ৪,৩৬৩।
২০০৯-২০১০ এর মাঝামাঝি সময় থেকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বাংলা উইকিপিডিয়া নিয়ে কাজ করা আরম্ভ হয়। বাংলাদেশের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে বাংলা উইকিপিডিয়া নিয়ে শুধু সচেতনতাই কম নয়, ভলেন্টিয়ারের সংখ্যাও খুব কম। হাতে গোনা কয়েকজন নিয়মিত কাজ করে চলেছেন। ভাষার প্রতি ভালোবাসা এবং স্বেচ্ছা শ্রমদানকে মূলধন করে তাঁরা এই কাজ করছেন। পশ্চিমবঙ্গে বাংলা উইকিপিডিয়ার কমিউনিটি প্রথম গড়ে তুলেছিলেন জয়ন্ত নাথ। যিনি বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের বাংলা উইকিপিডিয়ার অন্যতম এবং একমাত্র অ্যাডমিন। আর যাঁরা রয়েছেন তাঁরা সকলেই বাংলাদেশের।
বর্তমানে আর্টিকেল তৈরি এবং এডিট করা ছাড়া বাংলা উইকিপিডিয়ায় আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করা হচ্ছে। সেটি হল অসংখ্য কপিরাইট মুক্ত বইকে উইকি সংকলন বা উইকি সোর্সে যুক্ত করা। এরফলে পাঠক বিনামূল্যে বই পড়তে পারবেন। প্রাচীন দুষ্প্রাপ্য বই, পত্র-পত্রিকা স্ক্যান করে রাখা হচ্ছে উইকি সংকলনের একটি বৃহৎ লাইব্রেরিতে।
বর্তমান সময়ে পশ্চিমবঙ্গে নিবন্ধ লেখার কাজে সবচেয়ে নিরলসভাবে পরিশ্রম করছেন শুভেন্দু খান এবং তরুণ সামন্ত। বিনা পারিশ্রমিকে তাঁরা এই কাজ করে চলেছেন। এছাড়াও রয়েছেন পিনাকী বিশ্বাস। তিনি পশ্চিমবঙ্গের বাংলা উইকিপিডিয়ার মুখপাত্র হিসেবে কাজ করে থাকেন। নিবন্ধ লেখার পাশাপাশি বাংলা উইকিপিডিয়ার জন্য কনফারেন্সের ব্যবস্থা করে সচেতনতা বৃদ্ধি করার দায়িত্বও রয়েছে পিনাকী বিশ্বাসের উপর। স্কুল বা কলেজে ঘর নিয়ে তিনি কনফারেন্সের ব্যবস্থা করেন। সেখানে সারাদিন ধরে চলে উইকিপিডিয়ার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কর্মশালা। এ বিষয়ে অন্যান্যরাও তাঁকে সাহায্য করেন। পিনাকী বিশ্বাসের বাড়ি নদীয়া জেলার কল্যাণীতে। চাকরির পাশাপাশি সময় বের করে গত চার বছর ধরে তিনি এই কাজ করে চলেছেন। শুধুমাত্র বাংলা ভাষার প্রতি ভালোবাসা থেকে তিনি এই কাজে যুক্ত হয়েছিলেন। সম্পূর্ন বিনা পারিশ্রমিকে এবং নিঃস্বার্থভাবে পিনাকীবাবু এই কাজ করে চলেছেন। সেই সঙ্গে বাংলা উইকিপিডিয়ার সার্বিক প্রচার এবং বেশি সংখ্যক মানুষ যাতে তা ব্যবহার করেন সে বিষয়েও পিনাকী বিশ্বাস সচেতনামূলক কাজ করছেন।
২৮ এপ্রিল ২০২০ পর্যন্ত বাংলা উইকিপিডিয়ার নিবন্ধ সংখ্যা ছিল প্রায় ৮৬,৯৪১। যদিও এই সংখ্যা অন্যান্য ভাষার তুলনায় নিতান্তই কম। জার্মানী ভাষায় নিবন্ধ সংখ্যা হল প্রায় ২৩ লক্ষ। পোলিশ ভাষায় হল ১৩ লক্ষ ২১ হাজার। প্রায় ২৬১ মিলিয়ন লোক বাংলা ভাষায় কথা বলেন। সেখানে জার্মানী ভাষায় ৯০-৯৫ মিলিয়ন আর পোলিশ ভাষায় মাত্র ৪৫ মিলিয়ন লোক কথা বলেন। এর থেকেই অনুমান করা যায় বাংলা ভাষায় নিবন্ধ রচনায় আমরা কতটা পিছিয়ে রয়েছি। মালায়ালম বা তামিল ভাষার নিবন্ধ সংখ্যাও বাংলার থেকে অনেক বেশি। বর্তমানে বিভিন্ন ভাষার উইকিপিডিয়ার মধ্যে বাংলা ভাষার স্হান হল ৭০তম। ভাষার প্রতি একমাত্র ভালোবাসা ও সচেতনতাই পারে বাংলা অনলাইন বিশ্বকোষকে সমৃদ্ধ করতে। সেই সঙ্গে চাই আরও বেশি সংখ্যক ভলেন্টিয়ার। তাহলেই বাংলা বিশ্বকোষ শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে মহীরুহ হয়ে উঠতে পারবে।