পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

ট্রাম্প-মাস্ক ও সমাজ মাধ্যম

  • 01 January, 1970
  • 0 Comment(s)
  • 209 view(s)
  • লিখেছেন : অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
গুগল, ফেসবুক, অ্যামাজন, এক্স - আর কেবল কর্পোরেশন নেই। এগুলি মনোযোগ আকর্ষণের পরিকাঠামো। আমরা যে প্রতিটি ক্লিক বা টাচ করি, একটি ছবির উপর চোখ থামিয়ে বুড়ো আঙুলের বিরতি নিই, অনুসন্ধান বাক্সে আমরা যে প্রতিটি প্রশ্ন টাইপ করি - এগুলি এই পরিকাঠামোতে কোনো অলস অঙ্গভঙ্গি হিসাবে গণ্য করা হয় না। এগুলি হল নতুন অর্থনীতির অবৈতনিক শ্রম। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলি কেবল আমাদের বিনোদিত করে না; তারা আমাদের অধ্যয়ন করে, খনন করে, আমাদের অনুকরণ করে। আর এটি করার মাধ্যমে, তারা একটি নতুন ধরণের উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরি করে যা অদৃশ্য কিন্তু বিশাল।

আজকাল গণতন্ত্রকে আর অন্ধকারে হত্যা করা হচ্ছে না। প্রকাশ্য দিবালোকে, হাততালির শব্দে এবং টেলিভিশনে বিতর্কের শব্দে এটি ধীরে ধীরে নিজেকে হত্যা করছে। নেতা হাত নাড়ছেন। ভোট বাক্স পূর্ণ। আদালত খোলা রয়েছে। তবুও, মৌলিক কিছু ভেঙে গেছে। যা অবশিষ্ট আছে তা গণতন্ত্র নয় - এটি তার আচার-অনুষ্ঠানের খোলস, একটি নতুন, শীতল শক্তি দ্বারা সজ্জিত। এটা পুরনো ধাঁচের একনায়কতন্ত্র নয়। রাস্তায় কোনও ট্যাঙ্ক নেই। প্রকাশ্য সেন্সরশিপ বা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ভিন্নমত পোষণকারীদের নীরব করার কোনও ব্যবস্থা নেই। বরং, আরও একটি ছলনাময়ী বিবর্তন দেখা যাচ্ছে। উন্নয়নের নামে দরিদ্রদের অপমান করা হয়। জাতীয় ঐক্যের নামে সংখ্যালঘুদের হয়রানি করা হয়। জনশৃঙ্খলার নামে বিক্ষোভকারীদের মারধর করা হয়। এবং আশ্চর্যজনকভাবে, জনতা উল্লাস করে। রাষ্ট্র ‘অন্যদের’ উপর যত বেশি যন্ত্রণা দেয়, ততই তা আকর্ষণীয় বলে মনে হয়।

সমৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দিয়ে নয়, বরং প্রতিশোধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সরকার এখন নিজেকে টিকিয়ে রাখে। যেটা ইরান-ইস্রায়েল-আমেরিকার মধ্যে ঘটে চলেছে। এটি কোনও ‘বাগ’ নয়—এটি ব্যবস্থার আবেগগত সফটওয়্যার। একটা উদাহরণ দিই। ধরা যাক, আপনি ইরানের বিরুদ্ধে আমেরিকার আক্রমণের তীব্র বিরোধী এবং আপনার সমস্ত অনুভূতি এর প্রতিবাদে আপনাকে মুখর করে তুলতে চায়। আপনার কাছে প্রতিবাদের সহজলভ্য মাধ্যমটি কী? ফেসবুক অথবা এক্স(ট্যুইটার)। ভেবে দেখুন এই দুটোই হল আমেরিকারই কোম্পানি এবং এরা আপনাকে আমেরিকার বিপক্ষে দাঁড়ানোর পূর্ণ স্বাধীনতা দিচ্ছে। আপনি এই গণতান্ত্রিকতাকে অস্বীকার করতে পারেন না, আবার সত্যই কি এটা আপনার প্রতিবাদটিকে এমন পর্যায়ে পৌঁছে দিচ্ছে যেখান থেকে যুদ্ধ থামানোর পক্ষে একচুল প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ আপনার আছে? উত্তর হল, না। এটা আদতে গণতন্ত্রই নয়, এটা হল এমন একটা পন্থা যেখানে আপনার সমস্ত ক্রোধ, বিবেকের জ্বালা কয়েকটি লাইক কমেন্ট ও শেয়ারের মাধ্যমে ঠান্ডা করে দেওয়া হয়। অবশেষে আপনি শান্ত হন এবং গোটা ব্যবস্থাটা নির্বিঘ্নে চলতেই থাকে। এটার ব্যাপারে ট্রাম্প ও মাস্ক একটি ব্যখ্যাকারী উদাহরণ হিসাবে কাজ করতে পারে।

আসলে একুশ শতকের পুঁজিবাদে ‘ব্যক্তিত্ব’ (পার্সোনালিটি) একটি সম্পদে (অ্যাসেট) পরিণত হয়েছে। ট্রাম্প এবং মাস্ক উভয়েই তাঁদের পরিচয়ের (আইডেনটিটি) বাণিজ্যিকীকরণ করেছেন। ট্রাম্প নিজেকে কট্টর জাতীয়তাবাদী-বহিরাগত ব্যবসায়ী রাজনীতিবিদ হিসেবে, আর মাস্ক প্রযুক্তির ত্রাণকর্তা-উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদের পরিচয় প্রতিষ্ঠা করে বাজারজাত করেছেন। কিন্তু কেন? কারণটা সরাসরি তাঁদের সাংস্কৃতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার খেলার সঙ্গে জড়িত। এটাকে বলা যেতে পারে মনোযোগ-বাজার(অ্যাটেনশন মার্কেট)। এখানে আধিপত্য বিস্তারের জন্য জনগণের মনোযোগ আকর্ষণের একচেটিয়া ক্ষমতা থাকা জরুরি। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মভিত্তিক গড়ে ওঠা এই নতুন ধারার অর্থনীতিতে জনসমাজের মনোযোগ একটি বিনিয়োগসম্ভাব্য মূলধনে রূপান্তরিত হয়েছে। সুতরাং, অনেক মনোযোগের সঞ্চয় জরুরি।

এর মূলে আছে একটি প্রশ্ন যে, কীভাবে মনোযোগ—যা আগে ছিল একটি ব্যক্তিগত রুচির ও সামাজিক দায়িত্ববোধের ঘটনা— এখন মুনাফা এবং ক্ষমতার কাঁচামাল হয়ে উঠেছে? ১৮৯৯ সালে থরস্টাইন ভেবলেন প্রথম এই দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন। ‘দ্য থিওরি অফ দ্য লেজার ক্লাস’ বইয়ে দেখিয়েছিলেন যে কীভাবে প্রতিপত্তি এবং দৃশ্যমানতা প্রতীকী মূলধনে রূপান্তরিত হয়। আজকের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মভিত্তিক পুঁজিবাদে, মনোযোগ ‘মূল্য’ আহরণের প্রাথমিক স্থান হিসেবে শ্রমকে প্রতিস্থাপন করছে। ‘দ্য এজ অফ সার্ভিল্যান্স ক্যাপিটালিজম’ বইয়ে শোশানা জুবফের মতো অর্থনীতিবিদরা যুক্তি দিয়েছেন যে, আমরা এমন একটি নতুন শাসনব্যবস্থায় প্রবেশ করেছি যেখানে ‘আচরণগত উদ্বৃত্ত’ (ব্যবহারকারীর মনোযোগ থেকে প্রাপ্ত বাজারের ভবিষ্যদ্বাণীমূলক তথ্য যা উৎপাদিত হচ্ছে ক্লিক, লাইক, কমেন্ট, শেয়ার ও অবশেষে সারাদিনের চিন্তার খোরাক এবং আড্ডার বিষয় হিসাবে ভাইরাল হয়ে যাওয়া ঘটনা থেকে) নতুন পণ্যে পরিণত হয়েছে।

এখানে ট্রাম্পের পৃথিবী রাষ্ট্রযন্ত্র নিয়ন্ত্রণের উপর নির্মিত (সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ, বাণিজ্য শুল্ক, রক্ষণশীল বিচার বিভাগ ইত্যাদি) হয়েছে। সেখানে মাস্ক রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের অনুপস্থিতি বা হেরফেরের উপরে নিজের দান ফেলেছেন (যেমন, স্ব-চালিত গাড়ি আইন, শ্রম অধিকার, মহাকাশ বেসরকারীকরণ ইত্যাদি চালু করা)। ঠিক এইখানেই পুনর্বার বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদের একটি গভীর পদ্ধতিগত উদ্বেগ ফুটে উঠেছে।

‘পুঁজি’ বিষয়টা আদতে একটি রূপান্তরকালে প্রবেশ করেছে। এখন আর পুঁজিবাদকে কেবল কলকারখানা এবং মজুরি ব্যবস্থা হিসেবে বর্ণনা করার যৌক্তিকতা নেই। এটি বিবর্তিত হয়েছে, পরিবর্তিত হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী বাজারের দোকানঘরগুলো ক্রমেই অদৃশ্য হয়ে গেছে, গুদামের কালো রঙের কাঠের তাকগুলি মোবাইলের ডিজিটাল অ্যাপের নীলচে আভা দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে। কারখানার ইউনিফর্ম পরিহিত মজদুরদের ভিড় ও তাঁদের দাবিদাওয়ার গমগমে আঁচ যে ইউনিয়ন হলগুলির ভিতরে একসময় টের পাওয়া যেত, এখন আর সেই শ্রমিক নেই। শ্রমিকেরও রূপান্তর ঘটেছে, সে এখন একজন ব্যবহারকারী, একজন ভোক্তা, একটি তথ্য বিন্দু। এটা শুধু ‘উদ্বৃত্ত মূল্যের’ যুগ নয়, এটাকে বরং বলি ‘ডিজিটাল উদ্বৃত্ত মূল্য’ ব্যবস্থা।

‘ডিজিটাল উদ্বৃত্ত মূল্য’ কাকে বলে? এটি আমাদের রোজকার আচরণ থেকে নিষ্কাশিত হয়। অর্থাৎ ২৪ ঘন্টা ধরে চলা আমাদের অনুসন্ধান(সার্চ), আমাদের কী-স্ট্রোক(বা টাচ) এবং নানান পোস্টে থমকে যাওয়া থেকে গণনা করা আমাদের আবেগগত ওঠানামার পরিমাণ উদ্ভূত একপ্রকার মূল্য। এটাকেই তথ্য হিসাবে গ্রহণ করা হয়, তারপরে চলে গণনাপ্রক্রিয়া এবং অবশেষে এটিকে অনাগত সময়ে আপনার মনোযোগ নিয়ন্ত্রণের ভবিষ্যদ্বাণীমূলক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। এই মূল্য কোনো পণ্যের আকারে উৎপাদিত হয় না। মীনচক্ষু বিজ্ঞাপন(টার্গেটেড অ্যাড), অ্যালগরিদমিক পরামর্শ(সাজেশন) এবং তথ্য-চালিত প্রভাবের মাধ্যমে বিক্রি ও সৃষ্টি হয়। এই নতুন পুঁজিবাদ শ্রমিকের কারখানায় পৌঁছনোর জন্য অপেক্ষা করে না। এটি আমাদের শয্যাগৃহ অব্দি অনুসরণ করে, কোলবালিশে চিত হয়ে শোয়া আর হাতে ধরে থাকা স্ক্রিনের অন্তরালে এটি আমাদের আকাঙ্ক্ষার মানচিত্র তৈরি করে এবং বাস্তব সময়ে সেগুলি আমাদের কাছেই বিক্রি করে।

গুগল, ফেসবুক, অ্যামাজন, এক্স - এগুলি আর কেবল কর্পোরেশন নেই। এগুলি মনোযোগ আকর্ষণের পরিকাঠামো। আমরা যে প্রতিটি ক্লিক বা টাচ করি, একটি ছবির উপর চোখ থামিয়ে বুড়ো আঙুলের বিরতি নিই, অনুসন্ধান বাক্সে আমরা যে প্রতিটি প্রশ্ন টাইপ করি - এগুলি এই পরিকাঠামোতে কোনো অলস অঙ্গভঙ্গি হিসাবে গণ্য করা হয় না। এগুলি হল নতুন অর্থনীতির অবৈতনিক শ্রম। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলি কেবল আমাদের বিনোদিত করে না; তারা আমাদের অধ্যয়ন করে, আমাদের খনন করে, আমাদের অনুকরণ করে। আর এটি করার মাধ্যমে, তারা একটি নতুন ধরণের উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরি করে যা অদৃশ্য কিন্তু বিশাল।

উনিশ শতকে মার্ক্স লক্ষ্য করেছিলেন যে, শ্রম থেকে মূল্য কীভাবে আহরণ করা হত। কিন্তু আজ, মূল্য আহরণের জন্য সে-সবের প্রয়োজন নেই। এটি আরও ঘনিষ্ঠ একটি ক্ষেত্র খুঁজে পেয়েছে - আমাদের আচরণ, মনোযোগ ও চিন্তাভাবনা। একবিংশ শতাব্দীর মুনাফার ইঞ্জিন কারখানা নয় বরং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম। কয়লার কালি নয়, তথ্য। শ্রমঘণ্টা নয় বরং স্ক্রিন টাইম।

এই পরিবর্তন কেবল প্রযুক্তিগত নয় - এটি সভ্যতাগত। এটা এককথায় অতুলনীয় প্রতিভার ফল। কারণ এখানে আছে দেয়ালবিহীন ১৮.২২ বিলিয়ন(মোবাইল ডিভাইস) কারখানা, ৭.২১ বিলিয়ন চুক্তিবিহীন কর্মীবাহিনী (স্মার্টফোন ব্যবহারকারী) এবং একটি শ্রম প্রক্রিয়া যেটিকে মানুষের কাছে অবসর-বিনোদনের মতো করে তোলা গেছে। কোনোরকম জোর খাটিয়ে নয় বরং সুবিধাদানের আছিলায় গোটা প্রক্রিয়া পরিচালিত হয়। আমরা আনন্দের সঙ্গে এখানে অংশগ্রহণ করি। ভুলে যাই, আমাদের অনলাইন অস্তিত্ব যে মূল্য তৈরি করে, তার কোনো পারিশ্রমিক আমরা পাই না। অথচ আমাদের উৎপাদিত তথ্যই হল এই পুঁজির পণ্য, তবুও আমাদের কখনই শ্রমিক হিসাবে বিবেচনা করা হয় না। আমরা যে আদতে ‘তথ্য-শ্রমিক’ সেটাই আমরা টের পাই না, আদতে আমরা আমাদের নিজস্ব শোষণের ভোক্তা হয়ে গেছি।

ট্রাম্প ও মাস্ক, ঠিক এইখানেই, প্ল্যাটফর্ম আধিপত্যবাদের খেলাটি খেলছেন। এটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মভিত্তিক একটি সামন্তবাদের দিকে পরিচালিত করছে, যেখানে কয়েকজন প্রযুক্তি-কিংবদন্তি মনোযোগ প্রবাহের পরিকাঠামো নিয়ন্ত্রণ করে এবং দাপুটে রাজনীতিবিদরা দৃশ্যমান থাকার জন্য তাঁদের সঙ্গে জোট বা যুদ্ধের চেষ্টা করছে। উভয়েই খেলাটা খেলেন ডিজিটাল বিশ্বের মাঠে, সেখানে তাঁরা কয়েক ঘন্টা, কয়েকদিন অথবা কয়েক মাসের জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষের মনোযোগ একত্রিত করেন। আর সেই প্ল্যাটফর্মের মূল্য ও গুরুত্ব বৃদ্ধি করেন। এইভাবেই প্ল্যাটফর্ম ‘দানবরা’ মনোযোগের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে।

যে-কারণে দুনিয়াজুড়ে রাজনীতিবিদদের মধ্যে একটা উগ্র-দক্ষিণপন্থী ‘ব্যক্তিত্ব’ ক্রমাগত বাড়ছে, কেননা সেখানেই আদিম রিপুর উৎসব সম্ভব। তাঁরা যেনতেনপ্রকারেণ মানুষের আলোচনার শীর্ষে থাকতে চান। যেহেতু শান্তি, ঐক্য ও মৈত্রীর মাধ্যমে আসা উন্নয়ন এই নব্য পুঁজির বাজারের পক্ষে দুঃসংবাদ, তাই তাঁরা যুদ্ধ, দাঙ্গা, সাম্প্রদায়িকতা ও অশান্তি বাঁধিয়ে রাখার পক্ষপাতি। হাঙ্গেরিতে ভিক্টর অরবান, তুরস্কে এরদোগ্যান, ব্রাজিলে বলসোনারো, ইতালিতে জর্জিয়া মেলোনি, ফ্রান্সে মেরিন লে পেন, ইসরায়েলে নেতানিয়াহু, রাশিয়ায় পুতিন, আর্জেন্টিনায় জাভিয়ের মাইলি, ভারতে মোদী ও বাংলাদেশে ইউনুস প্রত্যেকের ঝোঁক কেবল উগ্রতার প্রতিই অঙ্গুলিনির্দেশ করে। আর এটা কেবল দেশ নয়, রাজ্য, জেলা, পুরসভা ও পঞ্চায়েত অব্দি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এমনকি আমজনতার ভিতরেও ভাইরাল হবার খিদে এতই তীব্র যে যে-কোনোরকম পাশবিক ও অশ্লীল কাজও তাঁরা করে ফেলছেন, জড়িয়ে ফেলছেন বাড়ির খুদেদের, কেননা সিলভার-গোল্ডেন পদকের লোভ ত্যাগ কঠিন।

এখানেই তাই আরেকটি প্রশ্ন জরুরি হয়, ডিজিটাল উদ্বৃত্ত মূল্যের যুগে প্রতিরোধ কেমন হবে? প্রথম কাজ হল নিজেদের চেনা। এখানে যদি তথ্য উৎপাদন শ্রম হয়, তবে ব্যবহারকারীরা শ্রমিক। যদি প্ল্যাটফর্মগুলি ব্যবহারকারীদের আচরণ থেকে মূল্য আহরণ করে, তবে ব্যবহারকারীর সেই মূল্যের অধিকার প্রাপ্য। একটি গণতান্ত্রিক ডিজিটাল অর্থনীতির অর্থ হল সহযোগিতামূলক মালিকানাধীন প্ল্যাটফর্ম, স্বচ্ছ অ্যালগরিদম এবং তথ্য-উদ্ভূত সম্পদের পুনর্বণ্টন। আরও জরুরিভাবে, রাজনৈতিক ভবিষ্যতচিন্তা, যা একসময় ছিল কল্পনার শিল্প, সেটিকে পুনরুজ্জীবিত করা। বর্তমান সময়ের বড় ট্র্যাজেডি কেবল এই নয় যে পুঁজি প্রতিরোধকে ছাড়িয়ে গেছে, বরং এটি যে এর প্রতিরোধ যে সম্ভব সেই কল্পনাশক্তির হারিয়ে যাওয়া।

মনে পড়ে, ১৯৮০-এর দশকের আমেরিকান আইন পণ্ডিত এডগার কানের কথা। তিনি ‘সময় ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা’ বা টাইম ব্যাঙ্কিং-কে সামাজিক অবহেলার বিরুদ্ধে একটি হাতিয়ার হিসেবে প্রস্তাব করেছিলেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে, মানবসমাজের সেবা-প্রদানের প্রতিটি ঘন্টা - তা সে একজন বয়স্ক ব্যক্তির যত্ন নেওয়া হোক কিংবা শিশুকে পড়ানো অথবা প্রতিবেশীর ছাদ মেরামত করা - সমানভাবে গণনা করা হবে এবং ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্য সংরক্ষণ করা হবে। এক ঘন্টার অর্থ এক ঘন্টাই, কী কাজ করা হল বা যিনি করলেন তাঁর সামাজিক প্রতিপত্তি কতখানি কিছুই সেখানে বিচার করা হবে না। কান মানুষের প্রতি মানুষের যত্নশীলতা, আত্মীয়তা ও উদারতার প্রক্রিয়াকে বৃদ্ধি করতে চেয়েছিলেন। এই ধারণাটি জাপানের বয়স্ক জনসংখ্যার অভাব-অভিযোগের মোকাবেলা করার জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল।

বর্তমানের ডিজিটাল ত্বরণ এবং ‘ব্যক্তিত্ব’ পণ্যীকরণের যুগে, ‘সময় ব্যাঙ্ক’ নীরবে মৌলিক বিকল্প হিসেবে আছে। এটি মুনাফার অঙ্ক কষে না। এটি অ্যালগরিদম অনুসারে বাছাই করে না। এটি আমাদের মধ্যকার মানবিকতাকে পুরস্কৃত করে। এমন একটি অর্থনীতি যেখানে মনোযোগকে পণ্যে ও তথ্য উৎপাদনকে অবৈতনিক শ্রমে রূপান্তরিত করা হয়েছে, সেখানে ‘সময় ব্যাঙ্ক’ মৃদুভাবে বলে যে জীবনের মূল্য এখনও শান্তভাব ও সম্প্রীতির দ্বারা পরিমাপ করা সম্ভব।

0 Comments

Post Comment