পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

টুইন টাওয়ার ধবংস- কিছুই কি করা যেত না?

  • 09 September, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 964 view(s)
  • লিখেছেন : উজ্জয়নী হালিম
সুপ্রিম কোর্টের আদেশ শিরোধার্য করেও একটা খটকা থেকেই যায়, ১০০০ কোটি টাকার সম্পত্তি যা ধ্বংস করতে ২০ কোটি টাকার বিস্ফোরক লাগে, সেই সম্পত্তি কি সরকার অধিগ্রহণ করে কোন বৃহত্তর জনস্বার্থে ব্যবহার করতে পারতো না! অতীতে বে আইনী নির্মাণ অধিগ্রহণ করার নজির তো কম নেই।

২৮ এ অগাস্ট ২০২২, দেশের বহু মানুষ রুদ্ধশ্বাসে 'উপভোগ' করলো এক ধ্বংস যজ্ঞ। ১২ সেকেন্ডের সেই দৃশ্য দেখতে ঐ দিন দিল্লির অদূরে নয়ডায় যেমন ভিড় জমিয়েছিলেন বহু সাধারণ মানুষ তেমনি তাদেরও আগে সেখানে পৌঁছে গেছিল সংবাদমাধ্যম - আক্ষরিক অর্থে ব্রেকিং নিউজ দেখাতে। তবে এই 'থ্রিলিং' ঘটনার প্রস্তুতির খুঁটিনাটি বিভিন্ন চ্যানেলে কিছুদিন আগে থেকেই দেখানো শুরু হয়েছিল। কি ভাবে আর কোথা থেকে আসবে বিস্ফোরক, কি ধরনের বিস্ফোরক ব্যবহৃত হবে থেকে শুরু করে, আশে পাশের প্রতিবেশীদের প্রতিক্রিয়ার ঝলক, কি ছিল না সেই সব ধারাবাহিক বিবরণে? শুধু বাদ পড়েছিল এই ঘটনাটিকে ঘিরে উপস্থিত আরও কিছু সত্য, যে সত্য কটু, যে সত্যের প্রচারে টি আর পি বাড়ে না, সাধারণ মানুষের তাৎক্ষণিক উত্তেজনার খোরাক যে সত্য যোগাতে পারে না; বরং যে সত্য আমাদের সবাইকে প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে, বাধ্য করে শহরগুলোর আবাসন নীতি নিয়ে ভাবতে, পরিবেশ নিয়ে ভাবতে, সেই সব পরিবারের কথাও ভাবতে যারা এখনো টুইন টাওয়ারের ফ্ল্যাট বুকিং এর টাকা ফেরত পায়নি ।
কিন্তু দেশবাসী যদি ক্ষণিকের উত্তেজনাই খোঁজে, তাহলে ভিতরে-বাইরে নেহাতই বানিজ্যিক সংস্থা হয়ে ওঠা প্রধান সংবাদমাধ্যম, গরম কচুরির মতো সে খবরই বেচবে এতে আশ্চর্য কি! গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ হয়ে ওঠার দায় থেকে কবেই তো তারা নিজেদেরকে মুক্তি দিয়েছে।

পাঠক ঠিকই ধরেছেন, কথা হচ্ছে নয়ডার টুইন টাওয়ারের ঘটনা নিয়ে। এমারেল্ড কোর্টের আবাসিক সংগঠনের দীর্ঘ আইনী লড়াইয়ের পরে, মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ ভেঙে ফেলা হলো, কুতুবমিনারের থেকেও উঁচু দুটি টাওয়ার। কারণ হিসেবে উচ্চতম আদালত জানিয়েছে যে নির্মাণ বিধি যথাযথ পালিত হয়নি। রাখা হয়নি যথেষ্ট দূরত্ব। অভিযোগকারীরা জানিয়েছেন ঐ টাওয়ারের জায়গায় সবুজায়নের কথা ছিল, সেই নকশা মানা হয়নি। নয়ডা অথরিটি যারা এই নির্মাণের অনুমতি দিয়েছে, তাদের সাথে সুপারটেক কোম্পানির অনৈতিক আঁতাতের ইঙ্গিতও দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। ঐ দুই টাওয়ারে যে ৭০০ র বেশি মানুষ ফ্ল্যাট কেনার জন্য অগ্রিম টাকা দিয়েছিলেন, তাদের সেই টাকা ফেরত দেওয়া উচিত বলেও কোর্ট উল্লেখ করে। এই ঘটনা ও তারপর টুইন টাওয়ার ভেঙে ফেলার নাটকীয় দৃশ্য দেখে জনতার উল্লাস, একাধারে অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়, সেই প্রশ্নগুলো তুলে ধরাই এই লেখার উদ্দেশ্য কারণ প্রশ্নগুলো শুধু টুইনটাওয়ার সংক্রান্ত ঘটনাতেই নয় এরকম আরও অনেক বিতর্কের ক্ষেত্রেই প্রাসঙ্গিক। জবাব অবশ্য আমাদের সকলকে যৌথ ভাবে খুঁজতে হবে, এটাই সময়ের দাবি।

প্রথম প্রশ্ন সব রকম নিয়ম কানুনকে তুচ্ছ করে বিশাল ঐ দুটি টাওয়ার বে আইনী ভাবে গড়ে উঠলো কি করে? নয়ডা অথরিটির দিকে স্বভাবতই আঙুল উঠছে দুর্নীতির। কিন্তু আজ আমাদের দেশে যে ধরনের রাজনৈতিক আবহ, তাতে শুধু প্রশাসনের মদতে বা দুর্নীতিতে এত বড় কাণ্ড হতে পারে কি, যদি পিছনে রাজনৈতিক মদত না থাকে? কে না জানে ব্যবসায়ীদের চাঁদা কি ভাবে রাজনৈতিক দলগুলোকে পুষ্ট করে। কাজেই বোঝা যায় দুর্নীতির শিকড় শুধু নয়ডা অথরিটিতে নয়, শিকড় অনেক গভীরে আর সেটা শুধু টুইন টাওয়ার কাণ্ডেও সীমাবদ্ধ নয়। সারা দেশজুড়ে আজ একইরকম নানা দুর্নীতির প্রকাশ। অথচ সেই তুলনায় জনরোষ বা প্রতিবাদ তো নগন্য। মেনে নেওয়াই মনে হয় বর্তমানের রাজনৈতিক ধারা, অন্ধ ভক্তি নাগরিকদের মর্যাদা ক্ষুন্ন করে চলেছে প্রতি নিয়ত। এর সুরাহা কোথায়?
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো যাকে বলে মব সাইকোলজি। এই ভিড়ের মনস্তত্ত্বকে অত্যন্ত চাতুর্যের সাথে তৈরি করা হয়েছে। যে ভিড় শত কষ্ট সহ্য করেও আবেগে ভেসে যায়, করোনা তাড়াতে থালা বাজায়, যে ভিড় হঠাৎই হিংস্র হয়ে ওঠে, যে ভিড় প্রায়শই আইন নিজেদের হাতে তুলে নিতে কুন্ঠিত হয় না, যে ভিড়ের কোন শাস্তিও হয় না ও সব থেকে বড় কথা যে ভিড় কোনদিন শাসকদের প্রশ্ন করে না। সেই ভিড় ভালোবাসে থ্রিল, সেনসেশন, সেই ভিড় মুগ্ধ হয়ে টুইন টাওয়ার গুঁড়িয়ে যাওয়া দেখে হাততালি দেয়। বিশালত্বের মুগ্ধতা তার নাগরিক বোধকে ঢেকে ফেলে। সমপরিমাণ উৎসাহ নিয়ে এই ভিড় দুর্নীতির বিরুদ্ধে, অর্থনৈতিক দৈন্যের বিরুদ্ধে, অসাম্যের বিরুদ্ধে, মানবাধিকার হরণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় না। এই ভিড়ই বুলডোজারের রাজনীতিকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করে। ভিড় এখন যেন এক রাজনৈতিক অস্ত্র। আর এখানেই সমস্যা। গণতন্ত্রে নাগরিকদের নির্দিষ্ট কর্তব্য ও অধিকার থাকে, তাদের ভিড়ের ভূমিকায় দেখা হয় না। আজকের অনেক নাগরিকদের মাথায় এই ভিড়ের মনস্তত্ত্ব আমাদের গণতন্ত্রের ক্রমবর্ধমান দুর্বলতাকেই চিত্রিত করে। আর এই অবস্থা সৃষ্টির দায়ভার যদিও মুষ্টিমেয় ক্ষমতা লিপ্সু গোষ্ঠীর, কিন্তু এর ফলভোগ তো করতে হবে সকলকেই। দেশের ৭৫ তম স্বাধীনতা উদযাপন কালে এই আবহ মনকে ভারাক্রান্ত করে বৈকি।

আর পরিশেষে সুপ্রিম কোর্টের আদেশ শিরোধার্য করেও একটা খটকা থেকেই যায়, ১০০০ কোটি টাকার সম্পত্তি যা ধ্বংস করতে ২০ কোটি টাকার বিস্ফোরক লাগে, সেই সম্পত্তি কি সরকার অধিগ্রহণ করে কোন বৃহত্তর জনস্বার্থে ব্যবহার করতে পারতো না! অতীতে বে আইনী নির্মাণ অধিগ্রহণ করার নজির তো কম নেই। নানা লেখা পড়ে অবশ্য এটাও মনে হয়েছে পরিবেশ তথা সুরক্ষার কারণে টাওয়ার দুটোকে কোনভাবেই বাঁচানো যেত না। কিন্তু তার ধ্বংসের উদযাপন তো এড়ানো যেত। সংবাদমাধ্যম থেকে সমাজ মাধ্যম জুড়ে যে উদ্দীপনা দেখা গেল, তাকে যদি দেশবাসীর বহুমুখী হতাশার বিকৃত বহিঃপ্রকাশ বলে ভাবা হয়, সেটাও কি খুব ভুল হবে? যে কোম্পানি এই টাওয়ার বানাচ্ছিল, তারা সুবিধামত আদালতে নিজেদের নিঃস্ব ঘোষণা করেছে। সুতরাং যে সমস্ত ক্রেতারা এখনো টাকা ফেরত পাননি, তাদের গগনচুম্বী বহুতলে থাকার স্বপ্নের সাথে সাথে হয়তো জমা করা টাকাও ধুলোয় মিলিয়ে গেল। এদের ক্ষতিপূরণের দায়ভার কার? কেই বা নিশ্চিত করবে ক্রেতার অধিকার!


পরিশেষে যে প্রশ্নের উত্তর পেতে আমরা অনাগত সময়ের দ্বারস্থ হব, তা হলো টুইন টাওয়ার ধ্বংসের মধ্য দিয়ে সত্যিই ভবিষ্যতের জনস্বার্থ সুরক্ষিত করার পথ প্রশস্ত হবে তো? আমাদের সিস্টেমে যে দুর্নীতি শিকড় চালিয়েছে তা ঐ টুইন টাওয়ারের মতন সমূলে উপড়ে ফেলা যাবে তো? এই সাড়ম্বরে ধ্বংস উদযাপন আমাদের কি বার্তা দিল? আপাতদৃষ্টিতে ১২ সেকেণ্ডের টান টান উত্তেজনা ছাড়া আর যা কিছু তা যেন ধ্বংসস্তূপের কালো ধোঁয়ার আড়ালেই থেকে গেল। টুইনটাওয়ারের জায়গায় সবুজায়নের মূল নকশা রূপায়ণ হবে কিনা সেটা সময়ই বলবে।

0 Comments

Post Comment