সোসাল মিডিয়ার কল্যাণে ভিডিওটা ইতিমধ্যেই ভাইরাল। যোগীরাজের জমানায় উত্তর প্রদেশের এক স্কুলে শিক্ষাদানের কাজে রত এক মহিলা ( সচেতন ভাবেই শিক্ষিকা কথাটি ব্যবহার করলাম না), নাম তৃপ্তি ত্যাগী দ্বিতীয় শ্রেণির এক মুসলিম ছাত্রের জন্য শাস্তি নির্দিষ্ট করেছেন তার হিন্দু সহপাঠীদের দ্বারা চপেটাঘাত। নতুন ভারতের এই অমৃত কালে চড় যাতে যথেষ্ট জোরে ঐ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিশুটির মুখের উপরে পরে তা ' যথেষ্ট ' যত্ন নিয়েই তদারকি করছেন তৃপ্তি ত্যাগী,ভাইরাল ভিডিও ক্লিপ থেকে সেই বিষয়টাও পরিষ্কার। এই ঘটনা নিয়ে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ার মধ্যেও কোন নতুনত্ব নেই।রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃবৃন্দের নিন্দাবাদ,মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সম্প্রদায়ের ' এমনটা হওয়া ঠিক নয়'-- মার্কা নির্লজ্জ বিলাপ এবং অবশ্যই প্রশাসনের ব্যবস্থা নেওয়ার শূন্য গর্ভ আস্ফালন। আসলে এমনটাই তো হওয়ার ছিল,আমাদের একটা বড়ো অংশের মধ্যেই তো এই ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক মতাদর্শের জোরদার ফলন। প্রতি মুহূর্তে ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র বানাবার যে নীল নকশা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ ও তার উপাঙ্গ সংগঠনগুলো প্রস্তুত করে চলেছে, আমরা বুঝে হোক বা না বুঝে সেই খেলার অংশ হয়ে উঠেছি। বিষ ওগরানোর এই মতাদর্শ থেকে তাই শিশুদেরও রক্ষা নেই।
মুজাফরনগরের ঘটনাটি সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পে পরিপূর্ণ এক হোমো স্যাপিয়ান্সের মানসিক বিকৃতির প্রকাশ, এ এক দৈহিক সন্ত্রাসের পৈশাচিক দৃশ্য। কিন্তু ১৫ আগস্ট (২০২৩) গুজরাটের মেহসানা জেলার লুনভা গ্রামের কে টি প্যাটেল স্মৃতি মহাবিদ্যালয়ের ঘটনাটি অন্তর্বস্তুতে আরো বেশি ভয়ঙ্কর,এক শীতল রাষ্ট্রীয় ঘৃণার নৃশংস প্রকাশ। প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবসে দশম শ্রেণির প্রথম হওয়া ছাত্রীকে পুরষ্কৃত করা বিদ্যালয়ে দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা এক প্রথা।তাই কিশোরী আরনাজ বানু অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল কখন তার নাম দশম শ্রেণিতে প্রথম হওয়া ছাত্রী হিসাবে ডাকা হবে। কিন্তু শুধু মাত্র মুসলমান হওয়ার কারণে আরনাজ বানুর নাম ডাকা হল না,পুরষ্কৃত করা হল দ্বিতীয় স্থানাধিকারী ছাত্রীকে,ধর্ম পরিচয়ে যে হিন্দু। সহপাঠিনী ও অভিভাবকদের সামনে চূড়ান্ত অপমানিত কিশোরীটি কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে যায়।এটা এক কিশোরীর মননে প্রাতিষ্ঠানিক সন্ত্রাস নয়?
এই চন্দ্রাহত সময়ে আমরা এতটাই বোধবুদ্ধি হারিয়েছি যে আরনাজ বানুর ঘটনা আমাদের মননে আর কোন প্রতিক্রিয়া তৈরি করে না। ঘৃণার রাজনীতির পাঠশালা আজ এতটাই শক্তিশালী যে কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘু উন্নয়ন মন্ত্রকের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি ২০২২ সালে লোকসভায় চরম ঔদ্ধত্যের সঙ্গে ঘোষণা করতে পারেন যে মৌলানা আজাদ ন্যাশানাল ফেলোশিপ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে।প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে সাচার কমিটির সুপারিশকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে ইউ পি এ সরকার সংখ্যালঘু শিক্ষার্থীদের জন্য এই স্কলারশিপ চালু করেছিল। ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য দেয় প্রাক মাধ্যমিক স্কলারশিপ তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্রীয় সরকার। এই তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে পথ প্রদর্শক অবশ্যই নরেন্দ্র মোদির বহু আলোচিত গুজরাট মডেল যেখানে ২০০৮ সালেই গুজরাট সরকার সংখ্যালঘুদের জন্য সমস্ত বৃত্তি বন্ধ করে দিয়েছিল।
আসলে সংঘ পরিবারের ধারাবাহিক প্রচারে আমরাও বিশ্বাস করতে শিখেছি মুসলমান শিক্ষার্থী সাধারণ হিসাবে মেধাবী হতে পারে না। তাই যখন কোন পাবলিক পরীক্ষায় ( মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, জয়েন্ট এন্ট্রান্স,আই আই টি মায় সিভিল সার্ভিস) প্রকাশিত মেধাতালিকায় যদি মুসলমান নাম থাকে তাহলে আমাদের প্রতিক্রিয়ার পাল্টে যেতে সময় লাগে না।অভিনন্দন, বড়ো হও,মানুষ হও,আগামী জীবনে সাফল্য কামনা করি মার্কা সুশীল সুবচনীর বদলে জায়গা করে নেয় নিরবিচ্ছিন্ন ঘৃণার লাভাস্রোত। বলবার অপেক্ষা রাখে না যে এইসব মন্তব্য যারা করছেন,ধর্ম পরিচয়ে তারা হিন্দু, প্রোফাইল ঘাটলে দেখা যাচ্ছে তাদের বেশিরভাগই প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা অনুযায়ী শিক্ষিত। মোটের উপর তাদের ঘৃণা ভাষণ একরকম।একজন লিখেছেন এত ভাল রেজাল্ট করে কী হবে,ভবিষ্যতে হবে তো সেই সন্ত্রাসী। একজনের চিন্তা যত মেধাবী,তত কুশলী বোমা বাঁধার কারিগর হওয়ার সম্ভাবনা।একটা বড় অংশের মতে মুসলমান শিক্ষার্থীদের এই ধরণের ভালো রেজাল্ট অসম্ভব, সংখ্যালঘু ভোট নিশ্চিত করতে এসব করানো হচ্ছে। যোগীরাজ থেকে ' প্রগতিশীল ' বাংলা-- ছবিতে কোন রকমফের নেই।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সবচেয়ে বড়ো সাফল্য হল ঘৃণার এক দ্বিমুখী ন্যারেটিভকে জনমানসে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হওয়া। এই ন্যারেটিভের একদিকে রয়েছে সন্ত্রাস ও হিংসার নীল নকশা যার আদর্শ উদাহরণ গুজরাট নরমেধ যজ্ঞ। সেই দর্শন ধর্ম সংসদ আবাহন করে মুসলমানদের শারীরিক ভাবে নিকেশ করার নিদান হাঁকে,মুসলমানদের আর্থিক ভাবে দুর্বল করার জন্য তাদের ব্যবসা বাণিজ্য হিন্দুদের হাতে তুলে দেবার হুমকি দেয়। এমনকি মুসলিম নারীদের কবর থেকে তুলে ধর্ষণ করার শপথও বাদ যায় না। যতি নরসিংহানন্দ,সাধ্বী ঋতাম্ভরা থেকে সাম্প্রতিক হরিয়ানার নুহ দাঙ্গার মাস্টার মাইন্ড বিট্টু বজরঙ্গী সেই হিংস্রতার পদাতিক সেনানী। আর এই ঘৃণার রাজনীতির ফেরিওয়ালাদের সাফল্য নিশ্চিত হয় যখন দেখি রেলওয়ে নিরাপত্তা রক্ষী বাহিনীর এক জওয়ান, যার দায়িত্ব রেলে সফররত যাত্রীদের সুরক্ষা দেওয়া,কামরা থেকে কামড়া মুসলমান খুঁজে বেড়ায় গুলি করে হত্যার জন্য। এটাই আচ্ছে দিনের ভারত!
তুলনামূলক বিচারে ন্যারেটিভের অপর অংশটি আরো দীর্ঘস্থায়ী ফলদায়ক।এই ন্যারেটিভ আমাদের শেখায় ভারতবর্ষ একহাজার বছরের পরাধীনতার পর ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা পেয়েছিল এবং সেই স্বাধীনতার প্রায়োগিক অর্থ হল মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান ও হিন্দুদের জন্য ভারতবর্ষ ( তাদের বিচারে হিন্দুস্তান) তৈরি হওয়া।এই পাটিগণিত মেনে নেওয়ার অর্থ হল মুসলমানরা এদেশে বহিরাগত ( অপর), দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে বেঁচে থাকাই মুসলমানদের ভবিতব্য। এই ন্যারেটিভ বহুত্ববাদী, ধর্ম নিরপেক্ষ, মুক্তমনা প্রজাতন্ত্রকে নাকচ করে এককেন্দ্রিক হিন্দু রাষ্ট্রের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে চায়। ভারতের সংবিধানকে পাল্টে ফেলে মনুসংহিতার আদর্শে নতুন সংবিধান তৈরি করতে চায়।ভারত রাষ্ট্র তার জন্মলগ্ন থেকে ' নরম ' হিন্দুত্বের যে অনুশীলন করেছে তা সংঘ পরিবারের ' হিন্দু রাষ্ট্র ' প্রকল্পকে জল- বাতাস জুগিয়েছে।এই ভাবনার পক্ষে সংখ্যাগুরু সমাজের একটা বড়ো অংশ আজ সওয়াল শুরু করেছেন।এই ভাবনার আলোকে আমাদের ইতিহাস, ভূগোল,যাপন পর্ব, বিজ্ঞান চেতনাকে নতুন ভাবে লিখবার পরিকল্পনা করেছে সংঘ পরিবার সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের মুখোশে। সেই আখ্যান আমাদের দেশের সুলতানি ও মুঘল যুগের ইতিহাসকে মুছে ফেলতে চায় নির্বাচনী সংখ্যাগরিষ্টতার জোরে।খুব সহজেই তাই মোগলসরাই হয়ে যায় দীনদয়াল উপাধ্যায় নগর,এলাহাবাদ হয়ে ওঠে প্রয়াগরাজ।এই ইতিহাস বোধ তাই মুসলমানদের অস্বীকার করে,আর সেই ইতিহাস বোধে প্রাণিত হয়ে দিল্লির গান্ধী নগরে জনৈকা হেমা গুলাটি চন্দ্রাভিযানের সাফল্যের পরের দিন ভারতের গৌরব গাথা বর্ণনা করার সময় নিঃসংকোচে মুসলমান ছাত্রকে জিজ্ঞেস করেন কেন তাদের বাপ দাদারা সাতচল্লিশ সালে পাকিস্তানে চলে যান নি!
আজ তাই বলতেই হয় তৃপ্তি ত্যাগী বা হেমা গুলাটিরা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।প্রায় একশ বছর ধরে "হিন্দি - হিন্দু- হিন্দুস্তান" প্রকল্পের ঠিকেদাররা যে বিভেদের বীজ বপন করেছিলেন তা আজ ফলন্ত বৃক্ষে পরিণত হয়েছে।এর পেছনে বাম ও গনতান্ত্রিক শক্তির ( যারা এক ন্যায় সমাজের সমর্থক বলে অহরহ নিজেদের দাবি করেন) নিদারুণ ব্যার্থতা বহুলাংশেই দায়ি। এই সত্যকে স্বীকার করেই আজ আমাদের সংঘ পরিবারের বিকল্প ভাবনা প্রতিষ্ঠা করার লড়াই শুরু করতে হবে।