পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

ট্রানজিস্টর

  • 03 July, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 1241 view(s)
  • লিখেছেন : শাহনাজ বশির
কিছু মানুষের মস্তিষ্কে গুজব আর ভুল বোঝাবুঝি, অজ্ঞানতা আর লাগামছাড়া আবেগ অবিচ্ছেদ্য অঙ্গের মত বিদ্যমান। শরীরে প্রতিটা বুলেট গেঁথে যাবার সঙ্গে সঙ্গে তার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল বিপ্লবের প্রতি আনুগত্যের এক একটি স্মৃতি ......... স্বাধীনতার স্লোগানের জবাবে ছুঁড়ে দেওয়া মুষ্টিবদ্ধ হাত ...... গলার শির ফুলিয়ে বলা ‘আজাদী’ ......

সাথী বিদ্রোহীদের সঙ্গে সিগারেট আর চুটকির আদানপ্রদান, মিছিলে হাঁটা, ধরপাকড়ের সময়ে বাড়ীর চিলে কোঠায় তাদের লুকিয়ে রাখা, নিজের ফেরানের তলায় লুকিয়ে অস্ত্র পাচারে সাহায্য করা, গ্রামে সেনা অভিযানের সময় নিজের বিপদের ঝুঁকি নিয়েও তাদের আড়াল করে রাখা ...... আর এ সবই নিজের দাদাকে বারবার হতাশ করার বিনিময়ে।

একটা বুলেট ট্রানজিস্টরের মিটার ব্যান্ড ফুঁড়ে বেরোল, বিস্ফোরণের সাথে সাথে টুকরো হয়ে গেল রেডিওটা। পড়ে থাকল তার ধ্বংসাবশেষ - একটা স্পীকার আর তার সঙ্গে তার দিয়ে জোড়া ইলেক্ট্রনিক চিপ। তখনও গমগম করে বাজছে বিবিসির খবর।

মাটিতে লুটিয়ে পড়ার সময়ে ইউসুফের ডান চোখের কোণায় জমাট বাঁধছিল একফোঁটা বাষ্প - আশ্চর্য রকমের চকচকে ... জল হয়ে ঝরে পড়তে উদগ্রীব সে অপেক্ষা করছিল ইউসুফের চোখে অন্ধকার নামার।

***

মহম্মদ ইউসুফ দারের সময় কেটে যেত চাষের কাজে। তার দাদা, আব্দুল রহমান দার ছিলেন মূলধারার রাজনীতিক। স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে গোটা দাদ্গামে তাঁকে সবাই অপছন্দ করত। আদর্শগত তফাৎ সত্ত্বেও দুই ভাই একই বাড়ীতে থাকত, তাদের সখ্যতাও অটুট ছিল। দুজনেই কখনও রাজনীতির আলোচনা এবং প্রকাশ্যে একে অপরের বিরোধিতা করত না।

১৯৯০ এর শুরুতে স্বাধীনতার আন্দোলন তুঙ্গে ওঠায় রহমান সন্ত্রস্ত হল। আন্দোলনের প্রতি আনুগত্যের বিন্দুমাত্র অভাব দেখলেই বিদ্রোহীরা কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করছিল। ফলে পরিবার নিয়ে রহমান দিল্লি পাড়ি দিল, আন্দোলনের তীব্রতা একটু কমলেই ফেরার আশায়। ইউসুফের বড় একা লাগতে লাগল। আদরের ভাইপো ভাইঝিদের অনুপস্থিতিতে বিশাল পারিবারিক বাড়ীটা যেন তাঁকে গিলে খেতে আসত। তার স্ত্রী আর দুই পুত্রের উপস্থিতিও তার কাছে নীরবতাই মনে হত, মন অশান্ত থাকত। ইউসুফের কাছে পরিবারের ভাল থাকার অর্থ ছিল বাড়ীতে সদাই হৈ হুল্লোড়, চিৎকার চেঁচামেচি।

***

কম কথার মানুষ ইউসুফের ছিল অপরিসীম রেডিও প্রীতি। কাশ্মীর নিয়ে সরকারী খবরে বিশ্বাস ছিল না বলে সে কেবলই বিবিসির খবর শুনত। ক্রিকেটের ধারাবিবরণী ছিল তার দ্বিতীয় পছন্দ। রেডিওয় প্রতিদিনের খবর শুনতে সে কখনও ভুলত না। ক্বচিৎ কালেভদ্রে এমন হলেও তা ব্যতিক্রম হিসেবেই ধরতে হবে। বহু বছরের নিবিড় অনুশীলনের ফলে অনুষ্ঠানের সময় না দেখেই সে নির্দিষ্ট স্টেশন ধরতে শিখে গেছিল। রেডিওর নব অল্প অল্প ঘোরানোর সময় কড় কড় করে বিরক্তিকর শব্দ বেরনো সত্ত্বেও বিবিসি স্টেশন ধরতে তার পারদর্শিতা ছিল অভাবনীয়। ঘরে টিভি চললেও ইউসুফের রেডিও চলতেই থাকত।

কতগুলো রেডিও এ যাবত বদলেছে - কোনটা ঘরের উঁচু তাক থেকে পড়ে, কোনটা আপেল গাছের ডাল থেকে পড়ে, কোনটা বাচ্চাদের দৌরাত্মির জন্য, কোনটা ব্যাটারি লিক করার জন্য বদলাতে হয়েছিল - পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মনে রাখত ইউসুফ। কয়েকটা সে তার বিদ্রোহী বন্ধুদের উপহারও দিয়েছিল। ইউসুফের শোবার ঘরটা ছিল পুরনো রেডিওর সংগ্রহশালা। তার হেফাজতে খারাপ হয়ে যাওয়া মারফি, প্যানাসনিক, ফিলিপ্স, সোনি, জিনাত এবং অন্যান্য রকমারি কার্ডবোর্ড বা প্লাস্টিক ফ্রেমের ট্রানজিস্টর ছিল। তার কয়েকটা আবার বাদামী বা কালো চামড়ার সুদৃশ্য খাপে মোড়া। তার সংগ্রহের সবচেয়ে পুরনো আধা কাঠের, আধা প্লাস্টিকের চোখ ধাঁধানো, ফলের ক্রেটের আকারের মারফি সেটটা ঠাকুরদার উপহার। আর সবচেয়ে আধুনিক সেটটা ছিল মাঝারি মাপের ফিলিপস। রান্নাঘরের তাক থেকে নীচে পড়ে গিয়ে সেটার চেহারা দাঁড়িয়েছিল অপুষ্টিতে ভোগা বাচ্চার মত। ইউসুফের স্ত্রী নাসিমা আচমকা লোডশেডিং এর সময় দেশলাই পাড়তে গিয়ে অসাবধানে হাত লাগিয়ে ফেলায় এই দুর্ঘটনা ঘটে। পরে অবশ্য ইউসুফ কোনমতে আঠা লাগিয়ে জোড়াতালি দেয়।

***

দাদা দিল্লি চলে যাওয়ার পর প্রথমবার পারিবারিক ফলের বাগানে গিয়ে ইউসুফ লক্ষ্য করল গ্রামের লোকজন তাকে অদ্ভুতভাবে নজর করছে। বসন্তের শুরুর দিকে একদিন সকালে ইউসুফ প্রসন্নচিত্তে দাদ্গাম বাজারে ঢুকল। যাওয়ার পথে পড়ে নাজির আহমেদ মালিকের বিখ্যাত ‘মালিক জেনারাল স্টোর’। এই মালিককে লোকে চিনত ‘তোতাপাখী’ নামে।গোলাকৃতি মুখে তামাকের ছোপ লাগা দাঁত ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে বাইরে বেরিয়ে থাকায় তাকে সদাহাস্যময় দেখাত। গ্রামের বাচ্চারা তাকে উদারমনা ভেবে ভুল করত কারণ বিনা পয়সায় লজেন্স চাইলে শাপশাপান্ত করার সময়ও মনে হত মালিক হাসছে। দোকানের সামনে সর্বদাই ভিড় লেগে থাকত। ওইখানে বসেই গ্রামের লোকজন অনন্ত সময় ধরে স্থানীয় রাজনীতি নিয়ে বকবক করে সময় কাটাত। রসালো গুজব ছড়ানোয় মালিক ছিল পারদর্শী। সব জানা সত্ত্বেও গ্রামের কিছু মাথা মালিক যা বলত তাই পুরোপুরি বিশ্বাস করত। এদের মধ্যে একজন ছিল দাড়িওয়ালা আব্দুল আহাদ মাগরে। আব্দুল রহমান দারের কাছ থেকে প্রচুর সুযোগসুবিধা নেওয়া এই লোকটি সর্বদাই আলোচনা ঘুরিয়ে দিত মূলধারার রাজনীতির দিকে। এছাড়া থাকত স্থানীয় বিদ্রোহী নেতার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে হবার আগে পর্যন্ত সশস্ত্র আন্দোলনের তুমুল বিরোধী এবং বর্তমানে সশস্ত্র সংগ্রামের পক্ষে আড়বুঝো যুক্তি দেওয়া খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা মুখের আব্দুল আজিজ গনি। থাকত কারও প্রত্যুত্তরের অপেক্ষায় না থেকে অনর্গল বকে যাওয়া কাঠ ব্যবসায়ী মুহম্মদ রমজান মালিক। আর থাকত নীরবে সবার বক্তব্য শুনে সব শেষে মুখ খোলা দাদ্গাম জামে মসজিদের ইমাম, অপরিছন্ন দাড়িওয়ালা মৌলভী আলি মুহম্মদ শাহ। দোকানে আসা নতুন খদ্দেরের কাছে এই মানুষটিই সবচেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত প্রতিভাত হত - এমন মানুষ যে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে সঠিক সময়ে আলোচনায় অংশ নিয়ে অন্যদের সমস্ত যুক্তি কাটাছেঁড়া করার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু অধিকাংশ সময়েই তার নির্বোধ কথাবার্তায় শ্রোতার মোহভঙ্গ হত।

সেই সকালে ফেরনের নীচে ট্রানজিস্টর চালু রেখে ইউসুফ মালিক জেনারাল স্টোরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। চোখের ইশারায় মালিক দোকানে জমায়েত আড্ডার দৃষ্টি আকর্ষণ করল ইউসুফের দিকে। তারপর সারাদিন ধরে গ্রামের মাথাদের আলোচনা ঘুরতে লাগল আব্দুল রহমান দারের নির্বাসন, দুই ভাইয়ের তুলনা, সেখান থেকে সূক্ষ্মভাবে সশস্ত্র আন্দোলনের সমর্থনে না দাঁড়ানো কাশ্মীরীদের সমালোচনা ঘিরে। একবার আব্দুল রহমান মালিকের ক্লাস টেন ফেল ছেলের সরকারী চাকরির জন্য সাহায্য করতে অস্বীকার করেছিল। সেই থেকে দার পরিবারের প্রতি মালিকের খুব রাগ।

****

দাদ্গাম শহরের মধ্য দিয়ে ভাঙ্গাচোরা একটা রাস্তা দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে ঃ এক ভাগ মালভূমি, সেখানে আছে আপেল আর তালের বাগান; অন্য ভাগে গ্রামের মানুষের বসতি। বসতি হলেও জায়গাটা বিশেষ ঘিঞ্জি নয়। অনেকটা খোলা জায়গা নিয়ে চুনকাম না হওয়া বড় বড় ইটের বাড়ী, নাক দিয়ে শিকনি ঝরা বাচ্চার দল, গবাদি পশু, গোবর, খেলনা মার্বেল, খড়, পুরনো সাইকেল, রোদে গা সেঁকতে থাকা লঙ্কা, হামানদিস্তা এসবের চমৎকার সহাবস্থান। গ্রামের বাকি অংশে আছে সারি সারি আখরোট গাছ আর প্রধান সড়কের দুই পাশ ধরে পাকা বাজার।

দার পরিবারের আপেল বাগানের ঠিক পাশে, মালভূমির অন্য প্রান্তে এক বিশাল সেনা ছাউনি। উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া এই আপেল বাগানের সমান সমান মালিকানা ইউসুফ আর রহমানের। দুই ভাই অবশ্য তাদের নিজেদের অংশ আলাদা করে চিহ্নিত করার প্রয়োজন বোধ করেনি। বাগানের সীমানা বরাবর কাঁটাতারের বেড়া দিলেও দুই ভাই এমনভাবে বাগানের রক্ষণাবেক্ষণ করত যেন এর মালিক একজনই। বাগানের মাঝ বরাবর একটা আলপথ বাগানকে মোটামুটি সমান দুই ভাগে ভাগ করেই রেখেছিল। দুই ভাইই কিন্তু গোটা বাগানেরই যত্ন নিত। তারা পালা করে গাছের ডাল ছাঁটা বা কীটনাশক ছড়ানোর মত কাজের দায়িত্ব নিত। বাগান থেকে রোজগারও সমান দুই ভাগে ভাগ হত।

সেনা ছাউনি কিন্তু রহমানের অংশের দিকে অল্প অল্প করে বাড়তে শুরু করেছিল। আগে তারা আপেল বা কাঠ চুরি করেই সন্তুষ্ট ছিল কিন্তু এখন তাদের ধান্দা ছিল জমি দখল। একদিকের বেড়া তারা ভেঙ্গে দিয়েছিল।

দাদার অংশের দিকে চারটে গরুকে ঘুরে বেড়াতে দেখে ইউসুফ অগ্নিশর্মা হয়ে উঠল। জানোয়ারগুলো ঢুকেছিল ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়ে। ট্রানজিস্টর গাছের ডালে রেখে, ফেরন ডান কাঁধের উপর ঝুলিয়ে ইউসুফ বেড়া সারাতে লেগে গেল। ভাঙা তারগুলো টেনে টেনে ফাঁকে ফাঁকে শুকনো ডাল আর পাতা দিয়ে কোনমতে জোড়াতালি দেওয়া গেল। এর মধ্যে ট্রানজিস্টরের শব্দে ছাউনিতে থাকা বাহিনী সতর্ক হয়ে উঠল। যতক্ষণ না ইউসুফ বেড়া ঠিক করে নিজের অংশের দিকে সরে গেল ততক্ষণ তারা চুপ করে তার কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করতে থাকল।

***

উপত্যকা ছেড়ে যাওয়ার পর ইউসুফকে লেখা প্রথম চিঠিতে অন্যান্য সাধারণ জিনিস ছাড়া রহমান জানতে চাইল দিল্লি থেকে তার জন্য কিছু পাঠাতে হবে কিনা। ইউসুফ চিঠিটা বারবার পড়ল, প্রাণভরে নীল খামের ঘ্রাণ নিল, মমতার সঙ্গে হাত বোলাল প্রতিটি উর্দু অক্ষরের উপর, শেষে যত্ন করে তুলে রাখল একটা চামড়ার থলিতে। চিঠির উত্তরে সে লিখল ঃ

সব ঠিক আছে। নিশ্চয় জান সেনাবাহিনী আপেলবাগানে অনুপ্রবেশ করার চেষ্টা করছে। এইটাই চিন্তার। আমার নিজের জন্য কিছু চাই না। যদি একটা ভাল ট্রানজিস্টর পাঠাতে পার তবে ভাল হয়। যেটা তুমি দেখে গেছ সেটার অবস্থা ভাল নয়। দুর্ঘটনাবশত নাসিমার হাত লেগে খারাপ হয়েছে। ব্যাটারিগুলো খাপে খাপে রাখার জন্য কিছু না কিছু গুঁজে দিচ্ছি কিন্তু কোনটাই কাজ করছে না। এর মধ্যে দুবার সারানো হয়ে গেছে, কিন্তু ব্যাটারি খাপে আঁটছে না। আর সব খবর ভাল ...... “

এর দু সপ্তাহ পরে ইউসুফের কাছে পৌঁছল রাংতায় মোড়া একটা বাক্স। রাংতা খুলতেই বেরিয়ে এল ছোট্ট একটা ট্রানজিস্টর- আসমানী রঙের একজোড়া ডায়াল আর বাঁদিকের কোণায় উঁকি দেওয়া কালো রঙের অ্যান্টেনা সহ কালো খাপে মোড়া আয়তাকার, দীর্ঘ বস্তুটির বাঁদিকে মিটার ব্যান্ডের এক চিলতে সরু ফিতে এমনভাবে লেপটে ছিল যে সহজে কারও চোখে পড়বে না। ইউসুফ এমন আকারের, রঙের, গড়নের ট্রানজিস্টর আগে দেখেনি। নতুন ব্যাটারি ভরার সঙ্গে সঙ্গে টগবগে,জোরালো শব্দে গমগম করে উঠল চারপাশ।

***

এক শুক্রবার দুপুরে নাজির আহমেদ মালিককে দারদের বাগানের বাইরে নোংরা সুঁড়িপথের উপর দাঁড়িয়ে ইউসুফ আর তার ট্রানজিস্টরের দিকে অপলকে তাকিয়ে থাকতে দেখা গেল। নিজের বাগান থেকে বেরিয়ে তার গন্তব্য ছিল জামে মসজিদ । বেলা ১২ টার খবর শেষ করে আপেল গাছের ডালে বসা ট্রানজিস্টর তখন ফোঁস ফোঁস করে দম ছাড়ছে। গ্রামের মসজিদগুলো থেকে ভেসে আসা সাপ্তাহিক প্রার্থনার শব্দ ছাড়া চারপাশে দ্বিতীয় আওয়াজটি নেই। ইউসুফ একটু ঝুঁকে কাঁটাতারের বেড়ায় পেরেক লাগাতে ব্যস্ত ছিল।

কাজ শেষ করে কুয়োয় হাত ধুতে যাবার সময় ইউসুফ মালিককে দেখতে পেল। পারস্পরিক অভিবাদন এবং কুশল সংবাদ আদানপ্রদানের পর মালিক বিদায় নিল। কিন্তু যেতে যেতেও ঘুরে ঘুরে বারবার ইউসুফ আর তার ট্রানজিস্টরকে দেখছিল সে।

জুম্মার নামাজ শেষে পিলপিল করে মানুষ এসে মিশছিল মসজিদের সামনের রাস্তায়। ছোট ছোট জটলা, বাচ্চা, বুড়ো, যুবক -সবাই পরচর্চায় ব্যস্ত। নাজির আহমেদ মালিক তার দলবলের সাথে দাঁড়িয়ে ছিল। মসজিদ থেকে ইউসুফকে বেরতে দেখেই মালিক তার সঙ্গীদের ইশারা করল। দলের বৃদ্ধরা সন্দেহের চোখে ইউসুফকে মাপতে লাগল।

“ আজাদী আন্দোলনের উপর টিকটিকিগিরি করার ওর দাদা ওকে একটা ওয়াকি টকি পাঠিয়েছে। আমি নিজের চোখে দেখলাম ... ওর বাগানের কাছে দাঁড়িয়ে সেনাবাহিনীর সিগন্যাল ধরার চেষ্টা করছিল।” সবাই মালিকের কথা বিশ্বাস করল, ট্রানজিস্টর হয়ে গেল ওয়াকি টকি। মালিকের মুখে লেগে থাকা হাসি, মিষ্টি বুলি ... বিশ্বাস না করে উপায় আছে! ইউসুফের রাজনীতি যে এ যাবতকাল অপরিবর্তিত থেকেছে সে কথা ভুলে সকলে দুয়ে দুয়ে চার করতে লেগে গেল।

পরের শুক্রবার আসতে আসতে গোটা দাদ্গামে ইউসুফের “ওয়াকি টকি” র কথা ছড়িয়ে পড়ল। জুম্মাবারের জমায়েতে খুৎবার ঠিক আগে মৌলভী আলি মুহম্মদ শাহ ঘোষণা করলেন “ আমাদের কাছে খবর এসেছে কিছু ভ্রষ্টাচারী গ্রামের লোকের উপর টিকটিকিগিরি করছে। এরা ওয়ারলেস সেটের মাধ্যমে আন্দোলনের খবর সেনাবাহিনীর কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। ভাল করে বুঝে নাও তোমরা - ওয়ারলেস সেটের মাধ্যমে খবর যাচ্ছে। এই লোকগুলো আজাদী এবং ইসলামের শত্রু। আজ এদের শেষবারের মত সতর্ক করে দেওয়া হচ্ছে।” জুম্মার নামাজ দশ মিনিট পিছিয়ে দিয়ে মৌলভি শাহ ইসলামে বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি নিয়ে নাতিদীর্ঘ বক্তব্য রাখলেন। ইউসুফ মন দিয়ে সবটা শুনল। “বিশ্বাসঘাতকদের “ পরিচয় নিয়ে মনে কৌতূহল জাগল, খানিক সংশয়ও। সে খেয়াল করল না যে সকলেই লুকিয়ে লুকিয়ে তাকেই দেখছে। খুৎবা দেওয়া শুরু হবার পরে তার চোখ ভক্তদের সারি থেকে সারিতে ঘুরতে লাগল।

“ ফয়েজ আহমেদ ভাট? গ্রামের সবাই বলে ও নেশা করে। নাঃ, হতে পারে না। ফয়েজের ভাই ফারুক তো শহীদ। ও হতে পারে না ।” বাঁদিকে তাকাল ইউসুফ।

“ নাজির আহমেদ মালিকের ছেলে আলতাফ? লোকে বলে ও ভয়ানক দুশ্চরিত্র। বিদ্রোহীরা ওকে অনেকবার সাবধান করেছে, হুঁশিয়ারি দিয়েছে যেন গ্রামের মেয়েদের পিছনে না ঘোরে। না, এও নয়। দুশ্চরিত্র হলেই কেউ বিশ্বাসঘাতক হয় না কি!” শেষে হাল ছেড়ে দিল ইউসুফ। চোখ বুজে বুকের উপর হাত রেখে খুৎবা শুনতে লাগল।

*****

কয়েকদিন পরের কথা। রান্নাঘরে মন দিয়ে বিবিসির রাত সাড়ে আটটার খবর শুনছিল ইউসুফ। সরকারী বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিটি ঘটনার উল্লেখের সঙ্গে সঙ্গে চলছিল তার শাপ শাপান্ত। এক কোণে দাঁড়িয়ে মন দিয়ে আলু ভাজছিল নাসিমা। বাচ্চারা পরের দিনের হোমওয়ার্কে ব্যস্ত ছিল। হঠাৎ সমস্ত আলো নিভে গেল আর জোরে জোরে দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ এল। নাসিমা আর ইউসুফ মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে ভাবার চেষ্টা করল এত রাতে কে আসতে পারে।

দরজায় ধাক্কার জোর বাড়তে লাগল। ইউসুফ ফিসফিস করে নাসিমাকে বলল “ এ নিশ্চয় সেনাবাহিনীর লোক। বাগানে দাদার দিকটা দখল করার রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছি বলে আমার উপর ক্ষেপে আছে নিশ্চয়। দাঁড়াও, আমি দেখে আসছি ।” বুক কাঁপতে থাকলেও সাহস সঞ্চয় করে একহাতে চালু বিবিসি স্টেশন আর অন্যহাতে মোমবাতি নিয়ে সে দরজা খুলতে গেল। মোমবাতিটা সদর দরজার উল্টোদিকের সিঁড়ির রেলিঙয়ের ফাঁকে বসিয়ে সে ছিটকিনিটা নামাল। আবছা আলোয় তিনটি মানুষের অবয়ব ভেসে উঠল। তাদের পরিচয় বা আসার উদ্দেশ্য জানার আগেই তিনটে বন্দুক গর্জে উঠল।

অনুবাদ - শুভ্রদীপ ঘোষ

0 Comments

Post Comment