রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) ভারতবর্ষের বুকে একটি ফ্যাসিবাদি ধর্মীয় সংগঠন, এবং পশ্চিমবাংলাতেও তারা দীর্ঘদিন ধরে জমি তৈরি করার চেষ্টা করছে। পশ্চিমবাংলাতে তারা কিয়দাংশে সফল - গত এক দেড় দশকে আরএসএস এর শাখা সংগঠনগুলির প্রবল প্রচেষ্টা, নরেন্দ্র মোদির সরকারের শাসন ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠা হওয়া ও তৃণমূল কংগ্রেসের শাসনকালে মতাদর্শগত সামঞ্জস্য থাকার ফলে গত গত দশ বছরে পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের শাখার সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১১ সালে রাজ্যে প্রায় ৫৮০টি শাখা ছিল, যা ২০১৬ সালে বেড়ে ১,৪৯২ টিতে পৌঁছায় ২০১৮ সালে শাখার সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেয়ে ১,৩৫০ এবং ২০২৫ সালের মার্চ মাসে ৫০০টি নতুন শাখা যুক্ত হয়ে ১,৮২৩-এ দাঁড়িয়েছে। আরএস এসের শাখা বৃদ্ধির সাথে পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়ার সম্পর্ক সমানুপাতিক। ২০২৫ সালের রামনবমী কেন্দ্র করে যে পরিমানে উগ্রতা আমরা প্রত্যক্ষ করলাম তা আরএসএস-এর বিষবৃক্ষের শিকড় গভীরতর হবার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। এবং এই উগ্রতার সরাসরি উত্তর ভারতের মডেলকে অনুসরণ করেছে এইবার। বর্তমানে উত্তর ভারতের বিপুল বেকার মজুত বাহিনীর কর্মসংস্থানগুলি হল গোরক্ষাবাহিনীতে যোগদান ও মুসলমান ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষদের ধরে ধরে প্রহার, মসজিদের তলায় খনন ও শিবলিঙ্গ উদ্ধার এবং, মসজিদের সামনে দল বেঁধে গিয়ে ডিজে চালিয়ে নাচনকোদন করা। শেষোক্ত বিষয়টি এক সরাসরি আক্রমণাত্মক, উন্মত্ত ও জান্তব চেহারা নিয়েছে বেশ কয়েক বছরে। ডিজে গানগুলির লিরিক হিন্দুত্ববাদ সুলভ পাশবিক- 'ভারতকা কাঠ মোল্লা, জয় জয় জয় শ্রী রাম বোলে গা', 'মোল্লা মাদারচোদ' ইত্যাদি। দাঙ্গা লাগানো আজকের উত্তর ভারতে কোন অন্ধকার গোপনীয় বিষয় নয়, ট্রাকভর্তি ডিজেবক্স নিয়ে মসজিদের সামনে সনাতনী জোম্বিদের বাঁদরনাচের ভিডিও দেখলে বোঝা যায় এসবের পিছনে সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় ইন্ধন রয়েছে। ২০২৫ এর রামনবমী উপলক্ষ্যে বাংলাতেও এই মডেল ঢুকে পড়েছে। মালদহ জেলার মোথাবাড়ি ও মুর্শিদাবাদের লালগোলায় মসজিদের সামনে ডিজে বাজানো কেন্দ্র করে এক ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে আরএসএস। বাংলায় রাম ও হনুমানকে কেন্দ্র করে ফের একবার মুসলিম বিদ্বেষের তুফান উঠেছে। এই প্রবন্ধ লেখার সময়েই ঘটে গেছে সামসেরগঞ্জের ঘটনা, তিন জনের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া গেছে, হিন্দু ও মুসলমান মিলিয়ে। উন্মত্ত আরএসএস বিজেপি সনাতন ধর্ম বিপন্ন এই প্রচারের তুফান তুলে দিয়েছে বাংলা ও ভারতে। রামনবমীর আক্রমণাত্মক ক্যাম্পেইন হাতেনাতে ফল দিয়েছে সামসেরগঞ্জে – প্রথমে মসজিদের সামনে সনাতনী অশ্লীলতা, তারপর বিহার ঝাড়খন্ড থেকে দুর্বৃত্ত ঢুকিয়ে অঞ্চলের পরিস্থিতি দূষিত করা, অমিত শাহের বিএসএফের ঘোলা জলে মাছ ধরতে নামা (মনে রাখা দরকার, কয়েক বছর আগে অমিত শাহের এক নির্দেশে আইন জারী করে সীমান্তের পঞ্চাশ কিলোমিটার ভিতর অব্ধি এখন বিএসএফ এর অবাধ বিচরণ নিশ্চিত করা হয় – বাংলার মুসলমান অধ্যুষিত সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে হিন্দুত্ববাদের জমি শক্ত করার উদ্দেশেই), ওয়াকফ বিল নিয়ে স্থানীয় মুসলিম সংগঠনগুলি বিক্ষোভ – সব মিলে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে রক্ত ঝড়ল সাধারণ মানুষের। মালদা ও মুর্শিদাবাদ দীর্ঘদিন ধরে আরএসএসের লক্ষ্যবস্তু – এখানকার পরিযায়ী শ্রমিকদের বাংলাদেশী বলে রাষ্ট্রীয় মদতে হেনস্তা করা হয় চলেছে দীর্ঘদিন। কয়েক মাস আগে ইলেকট্রনিক ডিসপ্লেতে নবী মুহম্মদের নামে অশ্লীল বাক্য চালিয়ে প্রায় দাঙ্গা লাগিয়ে ফেলেছিল এক উন্মাদ ‘হিন্দুবীর’। গত কয়েক মাসে একাধিক দেবদেবী মূর্তি ভাঙ্গার ঘটনায় ধরা পড়ে একাধিক ব্যক্তি যারা ধর্মে হিন্দু। সেই মুর্শিদাবাদ প্রায় জিহাদি জেলায় পরিনত, হিন্দু বাঙালির আর থাকার উপায় নেই বাংলায়, হিন্দু নারীরা নৌকা চেপে গঙ্গা পার করে মালদায় আশ্রয় নিয়েছে ইত্যাদি প্রচারে ভেসে গেল মিডিয়া ও স্যোসাল মিডিয়া। শরনার্থী শিবিরের ঘটনাটি সত্য, কয়েকশো পরিবার ওখানে গিয়ে ঠাঁই নিয়েছেন। প্রখ্যাত সাংবাদিক সুমন চট্টোপাধ্যায় যিনি চিট ফান্ডের টাকা খেয়ে জেলে গিয়েছিলেন, সেই হিন্দু শরনার্থী শিবির নিয়ে একটি ভিডিও বানিয়েছেন। ওই ভিডিওতে হানাহানিতে আতঙ্কিত মহিলাদের ভয়ার্ত বক্তব্যের পাশাপাশি এক বিজেপি বিধায়কের বক্তব্য আছে, যাকে সুমনের ভাড়া করা সাংবাদিক অতি উৎসাহের সাথে প্রশ্ন করছে হিন্দু মহিলাদের সাথে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে কিনা –বিজেপি সাংসদ সায় দিয়ে বলল ‘ওপেন রেপ’ হয়েছে! এবং বিনা এডিটে এই মিথ্যাটি চালিয়ে দেওয়া হল সুমন চট্টোপাধ্যায়ের বাংলাস্ফিয়ার ইউটিউব চ্যানেলে। মাঝে মধ্যেই সাংবাদিকতার মান নিয়ে জ্ঞানগর্ভপূর্ণ বক্তৃতা দেওয়া সুমন চট্টোপাধ্যায় কোনো তদন্ত অনুসন্ধান না করেই এই ফেক নিউজ চালালেন কেন? মুর্শিদাবাদের এই সঙ্কটপূর্ণ পরিস্থিতিতে হিন্দু খেপানোর উসকানিমূলক বক্তব্যের কোনো চেক নেই কেন? নেই কারণ এই সব সাংবাদিকরা এই কালের কলঙ্ক, আরএসএসের দালাল। সুমন চট্টোপাধ্যায় কয়েক বছর আগে জেল থেকে বেরিয়ে আরএসএসের শাখা সংগঠনের অনুষ্ঠানে মঞ্চ আলো করে বক্তৃতা দিতে উঠেছিলেন, পেশার জগতে পুনর্বাসনের জন্য মেফিস্টোরা ফ্যাসিস্টদের ক্রোড়ে আশ্রয় নিয়েই থাকে। মুর্শিদাবাদের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে একাধিক ভিডিও রয়েছে ওই চ্যানেলে, পুলিশ প্রশাসনের ব্যর্থতা ইত্যাদি নিয়ে বক্তব্য রয়েছে – এবং পরতে পরতে বক্তব্য হল ওয়াকফ বিল নিয়ে বাংলার সাধারণ মুসলমানদের কোনো মাথা ব্যাথাই থাকা উচিৎ নয়, এবং এই নিয়ে গন্ডগোলের দায় সম্পূর্ণ মুসলিম মোয়াজ্জেম/ইমাম এদের। সুমনবাবুর এই চমৎকার মুসলিমবিদ্বেষী মগজধোলাই এর বক্তব্যের সাথে আরএসএসের বক্তব্য মিলে যায়। ২০১৪ সালের পর থেকে একের পর এক আইন লাগু করে ভারতের মুসলিম জনগোষ্ঠীকে কোনঠাসা করা, দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিনত করার উদ্যোগ নিয়েছে মোদি সরকার – সিএএ হোক, এনআরসি হোক, তিন তালাক আইন হোক, ইউনিফর্ম সিভিল কোড বা সাম্প্রতিক ওয়াকফ বিল, প্রতিটির উদ্দেশ্য হল মুসলমান অস্তিত্বকে হেনস্তা করা, চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া যে মুসলিমরা এদেশে সংখ্যাগুরুর অনুগ্রহপ্রার্থী হয়ে বাঁচবে। মুসলিম সমাজের মধ্যকার প্রভূত বৈষম্য, নারীবিদ্বেষ ও অন্যায় বর্তমান, যা হিন্দু সমাজের মধ্যেও রয়েছে। কিন্তু সংখ্যাগুরু ফ্যাসিবাদীরা যখন অতি উৎসাহে আইন চাপিয়ে মুসলিম সমাজ সংস্কারের বুলি আওড়ায়, বুঝতে হবে বদ উদ্দেশ্যেই তা আওড়ানো হচ্ছে। সুমনবাবু অতি চালাকির সাথে মুর্শিদাবাদ কান্ডের জন্য মুসলিমদের দায়ী করলেন, ওয়াকফ বিল পাস করিয়ে ভারত জুড়ে ফের গন্ডোগোল পাকানোর হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা নিয়ে তিনি রা কাড়তে নারাজ, মুর্শিদাবাদ তথা মুসলিমপ্রধান জেলাগুলিকে কেন্দ্র করে আরএসএসের উগ্র সন্ত্রাসবাদী পরিকল্পনা তার আলোচনায় আসে না (এর মধ্যে কার্তিক মহারাজের মত এক ধর্মীয় উন্মাদকে পদ্মশ্রী পাইয়ে দেওয়াও রয়েছে), বিজেপির দলবল কর্তৃক হিন্দুদের ঘর বাড়ি ভাঙ্গার অতি গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ নিয়ে তিনি নিরুচ্চার।
সুমন চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে এতখানি শক্তিক্ষয় করার কারণ রয়েছে -বাংলায় মিডিয়া ও স্যোসাল মিডিয়াগুলি আরএসএসের হয়ে কিভাবে খাটছে তার একটি খন্ডচিত্র পেতে সুমনের চ্যানেলের অবতারণা। এই নববর্ষে বাংলাস্ফিয়ার চ্যানেলে ‘বাঙালির অস্তিত্ব বিপন্ন’ কিনা প্রসঙ্গে বাঙালিবিদ্বেষী সংগঠন আরএসএস এর নেতা জিষ্ণু বসুর সাথে মনোজ্ঞ আলোচনা চালালেন তিনি! ঐতিহাসিক কারণে বাংলাতে আরএসএসের ভিত্তি দুর্বল থেকেই গেছে, তাদের আইডিওলজিকাল অ্যাপারেটাস সবসময়ই নড়বড়ে ছিল এই রাজ্যে। জিষ্ণু বসুর মত মানুষদের গ্রহণযোগ্যতার জমি তৈরী করতে সুমন চট্টোপাধ্যায়দের মত বহু সাংবাদিক মাঠে নেমে পড়েছেন, আরএসএসের বিষবৃক্ষকে সার জল দিতে।
সুমন বাবু সাংবাদিকতার রাঘববোয়াল, এবং তার আলোচনা সূক্ষ্ম, জামদানি কাজের মত বিন্যাস। কিন্তু নেটমাধ্যমে/ইউটিউবে গন্ডায় গন্ডায় চ্যানেল রয়েছে যারা সচেতন ভাবে মুসলিম বিদ্বেষী শব্দচয়ন করে, সচেতন ভাবে ফেক নিউজ ছড়ায় ও হিন্দুরাষ্ট্র বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্যে প্রতিদিন নানা অঙ্গভঙ্গি করে আরএসএসের প্রোপাগান্ডা ছড়ায়। এই সব চ্যানেলগুলি দেখলে মনে হবে আমরা হয় বাংলাদেশ বা পাকিস্তানে বাস করছি, হিন্দু ও হিন্দুত্ব ভয়াবহ ভাবে আক্রান্ত, বাংলা তথা দেশে কোনো আর কোনো সমস্যার (যেমন বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, অর্থনৈতিক মন্দা) অস্তিত্ব নেই – গলায় রক্ত তুলে মুসলিমরা জঙ্গী এই প্রচার করে চলেছে। উদাহরণ স্বরূপ নাম করা যেতে পারে Bibidho News, Bongo Tv, Madhyom, Songe_Adwitiya, Hothat Jodi Uthlo Kotha, Arambagh TV, I AM BOSE ও অন্যান্য। এর মধ্যে কিছু চ্যানেলের নাম দেখে হয়ত আশ্চর্য লাগবে – মমতা বিরোধী হিসেবে পরিচিত চ্যানেলকে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে আরএসএসের ফ্রন্ট হিসাবে? কিন্তু বাস্তবটি অন্য – একটি চ্যানেলের উদাহরণ দিই, Hothat Jodi Uthlo Kotha, দীর্ঘদিন ধরে বাংলা ও বাঙালির সমাজ সংস্কৃতি বিষয়ে নানা বক্তব্য রেখে আসছে। আপাত নিরীহ এই চ্যানেলেই সাম্প্রতিকতম ভিডিও হল ভয়ে বাঁচা: মুর্শিদাবাদের হিন্দুরা বাড়ি ফিরবে? পুলিশ, কেন্দ্রীয় বাহিনী চলে গেলে আবার সেই চোখের জল? মুর্শিদাবাদের হিন্দুদের উপর অত্যাচারের প্রেক্ষিতে চালিয়ে দেওয়া হল আদিত্যনাথের যোগী আদিত্যনাথের বক্তৃতা। আদিত্যনাথের বক্তব্য ‘দাঙ্গাইওকো মমতা শান্তিকা দূত বোলতা হ্যায়’ অর্থাৎ মুসলমানেরা দাঙ্গাকারী। মমতার জবাবও দেওয়া আছে, কিন্তু সেটা ভিডিও নয় - ইমামদের সভায় যোগীর প্রত্যুত্তরে বিদঘুটে হিন্দিতে যা বলছেন সেটা সঞ্চালিকা পাঠ করলেন ব্যাঙ্গাত্মক ভাবে। মমতার স্বৈরাতান্ত্রিক রাজনীতির বিরোধিতা করা প্রবল জরুরি – কিন্তু মমতার ‘মুসলিম তোষণ’ কাউন্টার করতে চরম দাঙ্গাবাজ যোগীর ভিডিও প্রচার করা স্রেফ বদমাইশি – দাঙ্গাবাজ হিন্দুত্ববাদের স্বপক্ষে ঝোল টানা। প্রতিনিয়ত শুভেন্দু, দিলীপ, সুকান্তরা হিন্দুদের উসকাচ্ছে, ঘরে ঘরে অস্ত্র রাখার সওয়াল করেছে, মুসলিমদের চ্যাংদোলা করে ছুঁড়ে ফেলার হুমকি দিচ্ছে আর এই চ্যানেলগুলো সেই সব দাঙ্গাবাজির উপাদানগুলি প্রচারের কাজ করছে - যেনতেনপ্রকারেণ মেরুকরণ চালিয়ে সমাজকে অসুস্থ বিদ্বেষী করে তোলার এগুলি নিয়োজিত।
এই নিয়োজন কি আরএসএসের থেকে আর্থিক সহায়তা পায়? এটা সরাসরি বলার মত তথ্য এই নিবন্ধকারের নেই, এবং অনেক চ্যানেলই হিন্দুত্ববাদের ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ইউটিউব চ্যানেল শুরু করেছে হয়ত। পাশাপাশি আর এস এসের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতার উৎস খুঁজে পাওয়া মুশকিল - মেডুসার মত অসংখ্য শাখা বিশ্বজুড়ে লকলক করছে, সাউথ এশিয়ান সিটিজেন ওয়েব এর হিসাব অনুযায়ী ২০০১-২০১৪ সালের মধ্যে শুধু একল বিদ্যালয়া ফাউন্ডেশন অফ আমেরিকা ২৭ মিলিয়ন ডলার অনুদান পাঠিয়েছে ভারতে। এছাড়া বিশ্ব হিন্দু পরিষদ অফ আমেরিকা, সেওয়া ইন্টারন্যাশেনাল, ইনিফিনিটি ফাউন্ডেশন ও একাধিক শাখা সংগঠনের মাধ্যমে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার পাঠানো হয়েছে এই দেশে, উগ্র হিন্দুত্ববাদের প্রচারের জন্য। আমাদের স্মরণ করা উচিৎ ইনকাম ট্যাক্স অফিসার বিশ্ববন্ধু গুপ্তের ঘটনা যিনি বিশ্ব হিন্দু পরিষদকে নোটিশ পাঠিয়েছিলেন তাদের আর্থিক লেনদেনের হিসাব প্রকাশ করার জন্য, ১৯৯০ সালে। বিশ্ববন্ধুকে সাসপেন্ড ও পরবর্তীতে বরখাস্ত করা হয়। ২০১৪ সালের আগে ছিল এই পরিস্থিতি, নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর আরএসএসের লক্ষ্মীর ভান্ডার বহুগুনে বৃদ্ধি পেয়েছে তা বলাই বাহুল্য।
২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদি ন্যাশেনাল ক্রিয়েটর অ্যাওয়ার্ডস অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে ইউটিউব কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের (যাদের ৯৯ শতাংশ সনাতনী হিন্দুত্বের ইতিহাসবিকৃত গরিমা প্রচার করে) সাথে ফটোসেশন করেছিলেন। ২০২৩ সাল থেকেই অল্পবয়সীদের সমর্থন আদায়ের জন্য বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ইউটিউবারদের সাহায্যে হিন্দুত্ববাদের প্রচার চালানোর উদ্যোগ নিয়েছে। যেমন রণবীর আলুয়ালিয়া, ছয় মিলিয়ন সাবস্ক্রাইবার যুক্ত মাথামোটামির জ্বলন্ত উদাহরণ – কিন্তু ভয়াবহ রকমের ক্ষতিকর। বাংলার হিন্দুত্ববাদী ইউটিউব চ্যানেলগুলিও প্রায় একই নিম্নমানের, উচ্চকিত হেডলাইনের আড়ালে যুক্তিবোধবর্জিত নিম্নমেধার সাংবাদিকতা। Bongo Tv তে মুর্শিদাবাদের প্রসঙ্গে টিভির পরিচিত বোদ্ধা ও গলকম্বলযুক্ত জ্ঞানী বিশ্বনাথ চক্রবর্তী সেখানকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বিএসএফের গুণগান গাইতে লাগলো - Bongo Tv এর সাংবাদিকের কোনো বোধই নেই যে বিএসএফের কাজ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা নয় এই প্রশ্নটি তোলা। আধা-সামরিক বা সামরিক বাহিনীকে দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে দেওয়া যে একটি ফ্যাসিবাদী প্রকল্প তা এই সব সাংবাদিকের চেতনা থেকে অবলুপ্ত, শুধু তাই নয় এই ফ্যাসীবাদী প্রকল্পগুলিকে জনমানসে প্রতিষ্ঠা করার কাজ করে চলেছে এরা।
বাংলার সমাজের সর্বস্তরে আরএসএস অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালাচ্ছে। বেছে বেছে মুসলমান প্রধান জেলাগুলিতে ক্রমাগত নাশকতার ঘটনা ঘটানোর চেষ্টা করছে, যেই জেলাগুলিতে নিম্নবর্ণের হিন্দু মুসলামান সমন্বয়ের সাথে শতকের পর শতক বাস করেছেন। আরএসএসের রাজনীতি এটাই, ক্রমাগত মুসলিমবিদ্বেষ চালিয়ে যাওয়া। এবং আরএসএসের বাড়বাড়ন্তের দায় মূলতঃ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তার দল তৃণমূলের –এই দলের নৈতিকতা আরএসএসের অনুসরণেই চলে। রামনবমী পালন, হনুমান পুজো ইত্যাদি যত না আরএসএস বিজেপি করিয়েছে তার চেয়ে বেশি সংখ্যায় উদ্যোগ নিয়েছে তৃণমূলের নেতা, এমএলএ, কাউন্সিলারেরা। আরএসএস নেতা মোহন ভাগবত এক সাক্ষাৎকারে বলেছিল বিজেপি নির্বাচনে হেরে গেলেহিন্দুত্ব ভারতের রাজনীতির চালিকা শক্তি হয়ে উঠেছে, এটাই হিন্দুত্বের জয়। তৃণমূল, আপ ইত্যাদি পার্টিগুলি মোহন ভাগবতের বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণে একনিষ্ঠ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইলেকশনে জিতছেন কারণ মুসলিমরা বাঁচার তাগিদে, ভয়ে মমতাকেই ভোট দেন, এক্ষেত্রে ভোট ভাগ হলে তাদের সর্বনাশ। সামাজিক স্তরে আরএসএসকে এক কণা প্রতিরোধ করার ক্ষমতা তৃণমূলের নেই।
এতমবস্থায়, এই ফ্যাসিস্ট আরএসএসকে বাংলায় রুখতে ময়দানী, মৌলিক লড়াই এ ফেরা ছাড়া উপায় নেই। যারা ময়দানী লড়াইতে নামতে পারছেন না, তাদের উচিৎ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সম্পন্ন, ইতিহাসভিত্তিক লেখাপত্র প্রচার করা, সেইরকম ইউটিউব চ্যানেল বানানো যা ফ্যাসিস্ট আরএসএসের নীলনকশা উন্মোচন করতে পারে, যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে। এই কাজের সাথে ভোট রাজনীতির সম্পর্ক থাকলে তা চুলোয় যেতে বাধ্য, নির্বাচনী সমীকরণের বাধ্যতায় এই ঐতিহাসিক কাজ করা সম্ভব নয়।এবং এ দ্বায়িত্ব সম্পন্ন করার মত মানুষের অভাব নেই বাংলায়, তবে তাদের দিবানিদ্রা ভাঙানোও একটা কঠিন কাজ।