রবীন্দ্রনাথের স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান বিশ্বভারতীকে নিয়ে শুরু হয়েছে তীব্র বিতর্ক। এই ভয়ঙ্কর অতিমারির সুযোগে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের কিছু সিদ্ধান্ত নাড়া দিয়ে গেছে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষকে। আসলে সারা ভারতে যত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে সবার থেকে বিশ্বভারতী আলাদা। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আবেগ, মানুষের ভালোবাসা। রবীন্দ্রনাথ দেশজ চিন্তাভাবনা আর সারা বিশ্বের ভাবনার মিলন ঘটাতে চেয়েছিলেন। মনেপ্রাণে আন্তর্জাতিক রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন হিংসা, বিদ্বেষ রুখতে বিশ্বজনীনতার আদর্শই আমাদের ভরসাস্থল হতে পারে। বৈশ্বিক চিন্তার উপাসক রবীন্দ্রনাথ কখনও ভুলে যাননি দেশ এবং বাংলার মাহাত্ম্যের কথা।
তাঁর গান ও সমস্ত সৃজনশীলতায় এই ভাবনার প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই। ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার 'পরে ঠেকাই মাথা। তোমাতে বিশ্বময়ীর, তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা।’— দেশের মাটির সঙ্গে সমগ্র বিশ্ববাসীর সংযোগের চিত্র তাঁর লেখায় সতত উজ্জ্বল। ভারতবর্ষ বহুত্ববাদী দেশ। বিভিন্ন জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ এখানে অনেক অনেক বছর ধরে বসবাস করছেন। বহুমাত্রিক চিন্তাভাবনার মধ্যেই অনুরণিত হয় ঐক্যবোধের মহান বাণী। কবির ভাষায় বলি, ‘অহরহ তব আহ্বান প্রচারিত, শুনি তব উদার বাণী/হিন্দু বৌদ্ধ শিখ জৈন পারসিক মুসলমান খৃস্টানী/পূরব পশ্চিম আসে তব সিংহাসন পাশে/প্রেমহার হয় গাঁথা।’ রবীন্দ্রনাথের লেখায় বারবার ফুটে উঠেছে সেই সুমহান চিন্তা। রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন বিশ্বভারতীতে এই পরীক্ষা চালাতে, সফলতাও তিনি পেয়েছিলেন। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কলা, বিজ্ঞান, সঙ্গীত, চিত্রকলা সহ নানা বিষয় নিয়ে পড়তে। এই বিশ্ববিদ্যালয় কোন মতেই অন্য শিক্ষাঙ্গনের রেপ্লিকা হতে পারে না। তিনি চেয়েছিলেন গ্রামের অর্থনীতি স্বনির্ভর হোক। স্থানীয় অর্থনীতির উন্নয়নের কথা তিনি ভেবেছিলেন। ছেলেমেয়েরা যাতে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে পঠনপাঠন চালাতে পারে তাই গাছের তলায় পড়াশোনা করা পদ্ধতি চালু করা হয়। প্রথাগত শিক্ষা শিশু রবীন্দ্রনাথের মননে ও চিন্তনে এমন আঘাত করেছিল যে ইঁট, পাথরের জঙ্গলের মধ্যে শিক্ষা গ্রহণ করার তিনি বিরোধী হয়ে ওঠেন। ফাঁকা মাঠে ঘোরা, পথের ধুলো মাখা সবকিছুর মধ্যেই এক অনাবিল আনন্দ আছে। সেই পরম নির্ভেজাল সুখ কখনও বদ্ধ ক্লাসে মেলে না।
বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের কিছু সিদ্ধান্ত এই ভাবনার সাথে কোথাও মেলে না। বেশ কিছু বছর আগে কবির নোবেল পুরস্কার চুরি যাওয়ার পর থেকে বিশ্বভারতীর নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। নিরাপত্তা কথা এমনভাবে ভাবা উচিত যাতে কবির ভাবাদর্শের মূল সুর বিঘ্নিত না হয়। নিরাপত্তা রক্ষার কড়াকড়ি যদি স্বাভাবিক ছন্দ নষ্ট করে তাহলে তো বলতে হবেই। সাম্প্রতিক পাঁচিল তোলা ও ভাঙার সঙ্গে আলোচিত কথাগুলির যোগ আছে। কয়েক মাস আগে ঐতিহ্যবাহী পৌষমেলাও বন্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়। এটি রবীন্দ্রনাথের ভাবাদর্শের পরিপন্থী। বোলপুরের মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে এইসব মেলা জড়িয়ে আছে। এই কঠিন সময়ে আমরা দেখি পাঁচিল তোলা নিয়ে শান্তিনিকেতনের মাটি তপ্ত হয়ে উঠেছে। বেশ কয়েক মাস ধরেই সেখানে সাধারণ মানুষ এই বিষয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন। সেদিন সোশ্যাল মিডিয়াতে দেখলাম একজন প্রাক্তনী দুঃখ প্রকাশ করছেন। যদি একটু আলোচনা হত তাহলে বোধহয় কিছু মানুষের দ্বারা সংঘটিত পাঁচিল ভাঙার কাজকে আটকানো যেত। চূড়ান্ত অপ্রীতিকর পরিস্থিতি হয়তো হত না। উপাচার্য মহাশয় এবং কর্তৃপক্ষ বোধহয় একটু নমনীয় হতে পারতেন। গ্রিণ ট্রাইব্যুনালের রায় নিয়েও কিছু কথা বলা দরকার। ট্রাইব্যুনালে বিশ্বভারতীকে নিজের সীমানা নির্ধারণ করার রায় দেওয়া হয়েছে। সেটি বিশ্ববিদ্যালয়র পরিবেশ অক্ষুণ্ণ রেখেও করা হয়তো যেত। সেজন্য দরকার ছিল আলোচনা। ঔদ্ধত্য এবং অহঙ্কার সমস্যা বাড়ায়।
যে মানুষটি চিরকাল মানবতা ও শান্তির কথা বলে গেছেন তাঁর হাতে তৈরি প্রতিষ্ঠানের মাটিতে দাঁড়িয়ে এটুকু সহানুভূতি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আশা করা খুব অসঙ্গত নয়। আসলে আমরা রবীন্দ্রনাথকে শুধু পঁচিশে বৈশাখ আর বাইশে শ্রাবণে আটকে রেখেছি। কবির চিন্তনকে জীবনের প্রতি পলে আত্মগত করতে পারিনি। ‘তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি।’ আমাদের নিরুত্তাপ মনোভাব আজকে দেশকে এবং দেশের বহুত্ববাদী সংস্কৃতিকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে। ‘ফুলের মালা দীপের আলো ধূপের ধোঁওয়ার পিছন হতে পাইনে সুযোগ চরণ ছোঁওয়ার’— এই গোছের কাজ করে ফেলছি। রবীন্দ্রনাথের সৃজনশীলতায় বহুমাত্রিক ধারা প্রবাহমান, সুকৌশলে সেখানে আঘাত হানা হচ্ছে। এই অচলাবস্থা কাটুক। শান্তিনিকেতন, বিশ্বভারতী নিজের ছন্দেই বেঁচে থাক। বিশ্বভারতীর পঠনপাঠনের দিকে অধিক গুরুত্ব আরোপিত হোক। শিক্ষা বাঁচুক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়।