আমার ছোটবেলায় পুরোনো বছর শেষ আর নতুন বছর শুরুর সংযোগস্থলে গাজনের শিব তার চ্যালা-চামুন্ডা নিয়ে হাজির হতো। সে শিব আগ-মার্কা,খাঁটি,খেটে-খাওয়া বাঙলার সমাজ থেকে উঠে আসা এক চরিত্র। তার চাল নেই, চুলো নেই, সোনার মুকুট নেই।গরিবস্য গরিব। হিন্দি সিরিয়ালের শিব মহিমার মতো সিক্স-প্যাকও নেই। অ্যাম্বিশন নেই যে,দিকে দিকে ভক্তকুল বাড়াতে হবে।গগনচুম্বী মন্দির বানিয়ে নেওয়ার তাগিদ নেই বলে,মধ্যপ্রদেশ বেড়ে গেছে জেনেও, কপালভাতি করার কোনো চাড় নেই। এ শিবের ফেব্বারিট কাজ হল আড্ডা মারা আর বে-আইনি দিশি নেশা করা। এমনিতে তাকে কেউ পাত্তা দেয় না। কিন্তু সে যখন তার চ্যালাদের নিয়ে গাজন যাত্রায় বেরোয় তখন বোঝা যায় তার তাকত কোথায়! তার তাকত হলো ব্যঙ্গে, রঙ্গ-রসিকতায়। মানে, রাষ্ট্রশক্তি যখন তার দমন ও বিভেদের নীতিকে সভ্যতার মোড়ক দিতে চায়, তখন গাজনের খোলা মাঠে প্রান্তিক শিব প্রান্তজনের মস্করার ভাষায় ক্ষমতার শক্তিকে মাঠের ধুলোতে নামিয়ে এনে তার রক্তচক্ষুকে বুড়ো আঙ্গুল দেখায়। ক্ষমতা হয়ে ওঠে হাসির পাত্র। জনগণকে দুর্বল ভেবে নিয়ে শাসককুল কোন এক নির্দিষ্ট ধর্ম-বর্ণ-জাত-শ্রেণির ওপর শাসনের লাঠি যত বেশিআস্ফালন করে, গাজনের মিছিলের মতো জায়গায় সেই জনগণ -ই শাসককুলকে ততোটাই অপদস্থ করে। বিভিন্ন ভাবে শাসন ব্যবস্থাকে চরম নাকাল করে ছাড়ে।
গত উনিশে ডিসেম্বরের মিছিলে আমরা দুই মূর্তি-আমি আর গুলশন– হাজার পায়ের সঙ্গে যখন তাল মিলিয়ে হাঁটছিলাম, মিছিলের প্রাণশক্তি দেখে এবং অনুভব করে মনে হচ্ছিল গাজনের মিছিলের কথা। রামলীলা ময়দানের শুরুতেই অচেনা মুখের ফাঁকে পুরোনো কিছু চেনা মুখ চোখ মটকে, ফিচেল হাসির কোড-ওয়ার্ডে সম্ভাষণ করে বলল- এসো, এসো বেরাদর! তারপর বাড়তে থাকল আরো মুখের ভিড় আর তার সঙ্গে বাড়তে থাকল প্রতিরোধের মঞ্চে নতুন সংযোগ স্থাপনের আনন্দ, নিজের ক্ষমতা বুঝতে পারার আনন্দ, লালনের বাংলার ওপর বিশ্বাস ফিরে পাবার আনন্দ। ‘আজাদি’র স্লোগানের সঙ্গে গোল হয়ে হাত ধরে ধরে যে নাচা যায়, তা ওই মিছিলে সামিল না হলে দেখার সৌভাগ্য হত বলে মনে হয় না। আর সে কি স্পিরিট! এই যাদবপুরের এক প্রাক্তনী কাঁধে তুলে নিল ফেজ-টুপি মাথায় দেওয়া সালোয়ার-কুর্তায় সাজা প্ল্যাকার্ড হাতের ছ-সাত বছরের এক শিশুকে। “ আজাদ দেশ মে আজাদি”। ঠিক তার পাশেই হেনা করা কাঁচাপাকা দাড়িওয়ালা আরো লম্বা এক ভদ্রলোক জিন্স-জ্যাকেট পরা আর এক শিশুকে কাঁধে তুলে নিয়ে আওয়াজ মেলালেন- ইস পিতৃতন্ত্র সে------ভিড় গর্জন করে উঠল আজাদি। তার কয়েক কদম আগে একদল উলোঝুলো তরুণ-তরুণী বাজনার সুরে তাদের পরিসরে প্রতিবাদের মুর্ছনা তুলছে। কালো জামা, সাদা জামা, টুপি, ক্যাপ, হিজাব, বোরখা, শাড়ি, চুড়িদার, জিন্স, স্কার্ট, পাজামা-পাঞ্জাবি, ধুতি, লুঙ্গি -মানে বিশ্বাস করুন সব রকমের পোষাক পরা ছা-পোষা দেখতে মানুষগুলো হাঁটছেন, স্লোগান দিচ্ছেন, গান গাইছেন। দেশ স্বাধীনের দিনটিতে নিশ্চয় কলকাতার রাস্তা এমন ভাবে স্বতস্ফূর্ত, গর্বিত ভারতীয়দের দেশের পতাকা হাতে হাঁটতে দেখেছিল।
এ মিছিল-এর বৈশিষ্ট্য ছিল বিভিন্নতার রং মেশানো বর্ণময়তা।এই যেমন ধরুন আপনি দু-কদম আগে গলা মেলাচ্ছিলেন ‘ইস সঙ্ঘিয়োঁ পে হল্লা বোল্”, এই বার তালে গোলে অম্বলে আপনি আপনার সাথীদের থেকে তেরছা মেরে ডান দিকে যদি বেঁকে যান, গুপী-বাঘার শিষ্যরা আপনাকে দিয়ে ‘ ও রে হাল্লা রাজার সেনা” গাইয়ে নেবে। এবার আপনি দেখলেন দুটি ছোকরা Stand With Jamia প্ল্যাকার্ড পিঠে ঝুলিয়ে জল বিলি করছে। ও দিকে যেতেই আপনি “জয়ভীম, জয়ভীম” বলে মুষ্টিবদ্ধ হাত শীতের রোদ ঝলমল কলকাতার ধোঁয়াটে আকাশের দিকে তুলে ধরলেন। মিছিল যেখানে একটু দাঁড়াল সেখানে দেখলেন, সাতরঙ্গা পতাকার পাশে দাঁড়িয়ে একটা বিস্কুটের প্যাকেট থেকে ভাগাভাগি করে খাওয়া-দাওয়া হচ্ছে। ওই ভাগাভাগির বিস্কুটের দিকে হাত বাড়াতেই কেউ আপনার দিকে ‘ঘুসপইঠি’ বলে ভুরু কঁচকে তাকাল না। বরং একগালহেসে গোটা প্যাকেটটাই আপনার হাতে তুলে দিল। এবার আর আপনি বুঝতে পারছেন না, কে কোথাকার? যাদবপুর, আলিয়া, প্রেসিডেন্সি, নাকি কলকাতা, শহরতলি?সে এক মেলা, -প্রতিবাদী মানুষদের মিলনের মেলা। কার সঙ্গে আপনি পোজ দিয়ে ছবি তুললেন জানেননা। জানতে চানও না। কারণ আপনারা যে মিছিলের মানুষ। সে মিছিলে রাষ্ট্রবাদী ক্ষমতাশীল মুখ কার্টুন ক্যারেক্টার হয়ে গেছে। ডিকটেটরকে নিয়ে ভিড়ের মস্করা আছড়ে পড়ে রাস্তা থেকে ফুটপাথে। আর আপনারা দুজন এক তরুণীর হাতে ধরা পোস্টারের লেখা পড়ে বেদম হেসে বন্ধু হয়ে যান।
সেদিন এসপ্ল্যানেড আসার আগেই জনজোয়ারের চলা থেমে গেল। প্রশাসন মিছিলের মতো স্বাভাবিক যুক্তির সচেতনতায় পরিপক্ক নয়।পুলিশ তাই আর এগোতে দেয়নি মিছিলকে। তাতেই বা কী? রাস্তাতেই মিছিল বসে পড়ল। হাততালি, গান, বক্তৃতা- সব কিছু একসাথে হচ্ছে। কে বলবে যে এই আমরা, এই বিপুল জনতা কোনো নেতা-নেত্রীর আহ্বানে মিছিলে আসিনি। প্রত্যেকে ভারতীয় নাগরিকের দায় ও দায়িত্ব নিজের কাঁধে চাপিয়ে নিয়ে নিজেই এসেছি। তাই অ্যাম্বুলেন্স এলে আপাত বিশৃঙ্খল ভিড় নিমেষে সরে গিয়ে পথ করে দিয়েছে।
আমরা সে দিন ন্যায়-বিচারের দাবিতে মানুষের পথে নামার ইতিহাসকে মনে করেই ভবিষ্যতের জন্য ইতিহাস গড়তে জড়ো হয়েছিলাম। আবার এ ভিড়ের মানুষগুলো দৈনন্দিন-এর সাধারণত্বে নিজেকে লুকিয়ে ফেলবে। কিন্তু জানবেন, প্রয়োজন হলেই , জানবেন প্রয়োজন হলেই কাতারে কাতারে নেমে পড়বে রাস্তায়। নেচে-কুঁদে, হেসে-গেয়ে দৃঢ় ভাষায় জানিয়ে দেবে যে, রাষ্ট্রনেতারাও জনগণের নজরদারিতে ছিলেন, আছেন, থাকবেন।