এক কোটি বছর আগে আফ্রিকার জলবায়ু বদলে যাচ্ছিল। ঘন অরণ্যের আফ্রিকায় তৃণভূমি দেখা দিতে শুরু করল। মানুষের উৎপত্তি যে এপ থেকে, যারা গাছে ও মাটিতে দু জায়গাতেই থাকত, তারা সেই সময়ে মাটিতে অপেক্ষাকৃত বেশি সময় থাকা শুরু করল।
কয়েক লক্ষ বছর ধরে চলল অভিযোজন। ষাট লক্ষ বছর আগে এপ থেকে দুটি শাখা আলাদা হয়ে গেল। একটি হল শিম্পাঞ্জি। অন্যটি হোমিনিড। এই হোমিনিডরা অনেকটা সোজা হয়ে হাঁটল।
ক্রমশ তাদের অনেকের হাতের নানারকম ব্যবহার বাড়ল। বাড়ল মস্তিষ্কের আয়তন। দাঁতের গঠনে পার্থক্য এল। এই নতুন বৈশিষ্ট্যের হোমিনিডদের একটা নাম দেওয়া হয়েছে। অস্ট্রালো পিথেকানস। চল্লিশ লক্ষ বছর আগে তাদের উদ্ভব।
এপ আর মানবজাতি অর্থাৎ স্পিসিস হোমো র মাঝখানে দাঁড়িয়ে এই অস্ট্রালোপিথেকানসরা। এদের বিবর্তনের মধ্যে দিয়েই আলাদা আলাদাভাবে একদিকে চব্বিশ লক্ষ বছর আগে হোমো হ্যাবিলিস, উনিশ লক্ষ বছর আগে হোমো ইরগারস্টার এবং আঠারো লক্ষ বছর আগে দীর্ঘজীবী হোমো ইরেকটাস এর জন্ম হয়।
তিরিশ হাজার বছর আগে বিলুপ্ত হয় হোমো ইরেকটাস। তার আগে সতেরো লক্ষ বছরের বেশি সময় ধরে হোমো ইরেকটাস এর ইতিহাস মানব জাতির সবচেয়ে লম্বা ইতিহাস।
গোটা মানব জাতির অনেক ভাই বোন ছিল। বাকী ভাই বোনেরা এখন প্রয়াত। কেবল বেঁচে আছে হোমো সেপিয়েন্স প্রজাতিটি।
অন্যান্য যে সব প্রজাতি ছিল আমাদের মানব জাতির তার মধ্যে আছে -
১) হোমো হ্যাবিলিস
২) হোমো ইরগাস্টার
৩) হোমো ইরেক্টাস
৪) হোমো ফ্লোরেসিয়েনসিস
৫) হোমো অ্যান্টেসেসর
৬) হোমো হাইডেলবার্গনেসিস
৭) হোমো নিয়ান্ডারথালেনিস
এই সাতটি (এখনো অবধি জানা) প্রজাতির কেউ আর এখন বেঁচে নেই। বেঁচে আছে কেবল
৮) হোমো স্যাপিয়েন্স।
এরকম কিন্তু নয় যে একটি প্রজাতি থেকে আরেকটি প্রজাতি জন্ম নিয়েছে। তারা আলাদা আলাদাভাবেই জন্মেছে এবং অতীতে কোনও কোনও সময় একই সময়কালে পৃথিবীর মাটিতে এইসব মানব প্রজাতি পাশাপাশি থেকেছে। মাত্র বারো হাজার বছর আগে হোমো সেপিয়েন্স এর শেষ ভাই বা বোনটি মারা যায়। এই প্রজাতিটির নাম হল হোমো ফ্লোরেসিয়েনসিস। অর্থাৎ বারো হাজার বছর আগে, মিশরে যখন পিরামিড বানানো শুরু হচ্ছে তার হাজার ছয়েক বছর আগে কোনও হোমো ফ্লোরেসিয়েনসিস প্রজাতির বোন হয়ত আমাদের হোমো সেপিয়েন্স প্রজাতির কোনও ভাইয়ের সাথে বসে বসে গল্প করছিল আগুনের ধারে বসে।
আর আজ থেকে তিরিশ হাজার বছর আগের ছবি যদি কল্পনা করা যায়, তাহলে হোমো সেপিয়েন্স আর হোমো ফ্লোরেসিয়েনসিস প্রজাতির পাশাপাশি কোনও জমায়েতে আরো দুই প্রজাতির উপস্থিতির কথা ভাবা যায়। হোমো ইরেক্টাস এবং হোমো নিয়ান্ডারথালেনসিস। অর্থাৎ আজ থেকে তিরিশ হাজার বছর আগে এই চার প্রজাতির পাশাপাশি বসে গল্পগাছা করা সম্ভব ছিল। অবশ্য মনে রাখতে হবে এরা ভৌগলিকভাবে একই অঞ্চলে ছিল না। যেমন হোমো ফ্লোরেসিয়েনসিস ইন্দোনেশিয়ার ফ্লোরে দ্বীপপুঞ্জের বাইরে সম্ভবত পা রাখে নি। আবার হোমো ইরেক্টাস আফ্রিকায় জন্ম নিয়ে পৃথিবীর নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিল।
মানব জাতির বড়দা বা বড়দি বা সবচেয়ে প্রাচীন প্রজাতি সম্ভবত হোমো হাবিলিস। ২৪ লক্ষ বছর আগে তাদের উদ্ভব। দশ লক্ষ বছর পৃথিবীতে টিঁকে থাকার পর এই প্রজাতিটির মৃত্যু হয়। সে প্রায় আজ থেকে ১৪ লক্ষ বছর আগে।
মেজদা বা মেজদি বলা যায় হোমো ইরগাস্টারকে। আবির্ভাব ১৯ লক্ষ বছর আগে আর লয় ১৫ লক্ষ বছর আগে।
এরপর আবির্ভাব হোমো ইরেক্টাস প্রজাতির। সবচেয়ে দীর্ঘজীবনের অধিকারী এরা। ১৮ লক্ষ বছর আগে তাদের উদ্ভব। মাত্র তিরিশ হাজার বছর আগে তারা বিলুপ্ত হয়ে গেল। সতেরো লক্ষ বছরের বেশি সময়কাল জুড়ে আর কোনও মানব প্রজাতিই টিঁকে থাকে নি।
হোমো অ্যান্টেসেসর এর আবির্ভাব ৮ লক্ষ বছর আগে। লয় ৫ লক্ষ বছর আগে।
হোমো হাইডেলবার্গেনসিস এর আবির্ভাব ৬ লক্ষ বছর আগে। লয় ১ লক্ষ বছর আগে।
হোমো নিয়ানডারথেলেনিস এর আবির্ভাব চার লক্ষ বছর আগে। এরাও বিলুপ্ত হল হোমো ইরেক্টাস যখন বিপুপ্ত হচ্ছে সেই সময়টাতেই। হাজার তিরিশ বছর আগে।
আজ থেকে দু লক্ষ বছর আগে আমাদের প্রজন্ম হোমো স্যাপিয়েন্স এর আবির্ভাব। কিন্তু তার পরেও জন্ম নিয়েছে হোমো ফ্লোরেসিয়েনসিস। এক লক্ষ বছর আগে। সেই মানব প্রজাতির সবচেয়ে কনিষ্ঠ ভাই বা বোন। তার জীবনকালও সবচেয়ে কম। আজ থেকে ১২ হাজার বছর আগে যখন সে মারা যাচ্ছে তখন দেখা যাচ্ছে পৃথিবীতে এই প্রজাতি থেকেছে মাত্র আশি হাজার বছর। এত কম আয়ু আর অন্য কোনও প্রজাতির ছিল না।
মানব জাতির অন্যান্য ভাই বোনেরা বেশ কয়েক লক্ষ বছর আগে ধরাধাম থেকে বিদায় নিলেও এই সেদিন মানে তিরিশ হাজার বছর আগে পর্যন্তও যারা টিঁকে ছিল তারা হল - হোমো ইরেক্টাস, হোমো নিয়ান্ডারথালেনসিস, হোমো ফ্লোরেসিয়েনসিস এবং হোমো স্যাপিয়েন্স। এদের মধ্যে হোমো সেপিয়েন্স এখনো ব্যাট করে চলেছে। এখনো সেই একমাত্র নট আউট।
অনেক লক্ষ বছর আগেই যারা বিলুপ্ত হয়ে গেছে, তাদের বিলুপ্তির কারণ খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন। কিন্তু কেন আজ থেকে তিরিশ হাজার বছর আগে দুম করে হোমো ইরেক্টাস, হোমো নিয়ান্ডারথালেনসিস এই দুটি প্রজাতি প্রায় একসাথে বিলুপ্ত হয়ে গেল - সেই বিষয়ে কৌতূহল তৈরি হয়। বড় কোনও ভৌগলিক বিপর্যয় না কোনও মারণ রোগের সংক্রমণ? যার হাত এড়াতে পারে নি এই দুই প্রজাতি?
হোমো ফ্লোরেসিয়েনসিস সে যাত্রায় সম্ভবত টিঁকে গিয়েছিল একটি ছোট দ্বীপপুঞ্জে "লক ডাউন" থাকায় আর হোমো সেপিয়েন্স এর উন্নততর অভিযোজন ক্ষমতাই কি তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল ধ্বংসের হাত থেকে? মস্তিষ্কের বড় আয়তন ও বুদ্ধিবৃত্তিই কি তাকে দিয়েছিল অতিরিক্ত সুবিধা?
অস্ট্রালোপিথেকানসদের মস্তিষ্কের আয়তন ছিল ৪০০ থেকে ৬২৫ সিসি পর্যন্ত।
হোমো হাবিলিস এর ৫০০ থেকে ৬৫০ সিসি। হোমো ইরেকটাস এর মস্তিষ্কের আয়তন তুলনায় অনেক বড় ছিল। ৭৫০ থেকে ১৩০০ সিসি পর্যন্ত।
কাছাকাছি মাপের ছিল হোমো নিয়ানডারথেলনিস এর মস্তিষ্কর আয়তন - ১৪০০ সিসি।
আধুনিক মানুষ হোমো।সেপিয়েন্স এর মস্তিষ্কের আয়তন প্রায় ২০০০ সিসি পর্যন্ত হয়।
মস্তিষ্কের আয়তন বৃদ্ধিকে ধরে নেওয়া হয় চিন্তা ও কাজের সমন্বয়ে প্রগতির মাপকাঠি। বিবর্তনের ধারায় মস্তিষ্কের আয়তন যত বেড়েছে ততই দুর্বিপাকের হাত থেকে বড় মস্তিষ্কের প্রাণী বুদ্ধি করে বাঁচতে পেরেছে। অন্তত বাঁচার লড়াইয়ে এগিয়ে থেকেছে।
আজ থেকে তিরিশ হাজার বছর আগে হোমো ইরেকটাস ও হোমো নিয়ানডারথেলনিস বিলুপ্ত হয়ে গেল কাছাকাছি সময়ে। যাদের মস্তিষ্কের সর্বোচ্চ আয়তন ছিল ১৩০০ থেকে ১৪০০ সিসি পর্যন্ত। টিঁকে গেল ২০০০ সিসির মস্তিষ্কের আয়তন সমৃদ্ধ হোমো সেপিয়েন্স। নানা প্রতিকুলতার বিরুদ্ধে তার লড়াই ও অভিযোজন চলছেই।