পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

শুভমনের গল্প

  • 21 April, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 410 view(s)
  • লিখেছেন : দেবাশিস রায়চৌধুরী
---- দাও, কাগজের প্রথম পাতাটা দাও তো। শুভমনের সেঞ্চুরির খবরটা একবার দেখি। স্বপ্নময়ের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল শুভমন।

প্রথম পাতাটা তার দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে স্বপ্নময় বলল,----  কেন প্রথম পাতায় শুধু শুভমনের সেঞ্চুরি আছে বলেই ওটা চাই? আরও অনেক খবর আছে পড়ার মতো, সেগুলোও দেখ।

---- আরে ছাড়ো তোমার খবর। খবর বলতে তো তুমি শুধু ওই গাজার কথাই বলবে।

---- হ্যাঁ তাতে অসুবিধা কি আছে? এই মুহূর্তে ওখানে কি চলছে তুই জানিস? একদিকে ক্রিকেট উল্লাস, অন্যদিকে হাজার হাজার নিরীহ মানুষ পোকামাকড়ের মতো মারা যাচ্ছে।

---- দেখো একটা যুদ্ধ হলে এরকম হয় দুপক্ষের মানুষই মারা যায়।

---- যুদ্ধ! তুই এটাকে যুদ্ধ বলছিস!

---- হ্যাঁ যুদ্ধই তো। যুদ্ধ ছাড়া আর কী বলব?ইসরাইল মারছে প্যালেস্টাইন মার খাচ্ছে।

---- শুভ, যুদ্ধেরও কিছু নিয়মকানুন থাকে।  হাসপাতালে বোমা ফেলা, বাড়ি ঘরের জ্বলন্ত ধ্বংসস্তূপ ফেলে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে পালাতে থাকা মানুষজনের উপরে বোমা ফেলা, যুদ্ধের কোন আইনে আছে বলত?

 ---- আমি অতশত বুঝি না। সন্ত্রাস তৈরি করলে তার পরিণাম ভোগ করতেই হবে।

--- কী বলছিস! মাথা ঠিকঠাক আছে তো? মানলাম তোর কথা, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই দরকার। কিন্তু সন্ত্রাস দমন করার নামে চলছে গণহত্যা। এটা মানবিক?এটা সন্ত্রাসবাদ নয়?

----  মামা, ভুলে যাচ্ছ হামাস প্রথম আক্রমণ চালিয়েছে। সেই আক্রমণেও অনেক  ধ্বংস ও মৃত্যু হয়েছে। অতর্কিত হামলায় জনরোষ তৈরি হয়েছে। তারা বদলা চাইছে। রাষ্ট্র বদলা নিচ্ছে।

-- আর এই বদলার মানে হল একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলে টানা আটচল্লিশ দিন ধরে মুহুর্মুহ মিসাইল হামলা, চল্লিশ হাজার টন বোমা, চোদ্দহাজার মানুষ মরে যাবে এটাই তো মূল কথা? এটাই তোদের যুক্তি?

---- দেখ মামা তুমি শুধুশুধু উত্তেজিত হচ্ছ? আমি মৃত্যুগুলো সাপোর্ট করিনা। রাষ্ট্রসংঘ আছে তারা ব্যবস্থা নিক।

---- রাষ্ট্রসংঘ! ভালো বলেছিস। তারা তো আমেরিকার হাতের পুতুল। শুভ, আজকাল তোর চিন্তার দীনতা দেখে খুব হতাশ লাগে। ভুলে যাস না তোর ভালো নাম শুভমন।

পরিবেশ হালকা করার চেষ্টা করে শুভমন। হাসতে হাসতে বলে,---- সেইজন্যই তো খেলার খবর পড়তে চাচ্ছি। কাল শুভমন গিল সেঞ্চুরি করেছে। এক শুভমন আর এক শুভমনের খবর না রাখলে চলে? সে খবরের কাগজের উপর ঝুঁকে পড়ে।  

 

এবার অসহায় ভাবে মাথা নাড়ল স্বপ্নময়। শুভমন তার ভাগ্নে। এখন তার কাছেই থাকছে। এখানে ডিজিটাল প্রিন্টিংয়ের দোকান। মূলত ফ্লেক্স তৈরি করে। বিভিন্ন ক্লাবের অনুষ্ঠান, বিজ্ঞাপন এসবের কাজ করে থাকে তবে রাজনৈতিক দলগুলোর ফ্লেক্স তৈরি করেই তার ব্যবসার বাড়বাড়ন্ত।

স্বপ্নময়ের দিদি জামাইবাবু এক প্রত্যন্ত গ্রামে থাকে। জামাইবাবু চাষাবাদ নিয়ে আছেন। অল্প বয়সে বাবা মাকে হারিয়ে স্বপ্নময় একরকম দিদির বাড়িতেই মানুষ হয়েছে। জামাইবাবু অনেক কষ্ট করে তাকে মাষ্টার ডিগ্রি করিয়েছেন। কলেজের চাকরি পেয়ে সে এখন পুরুলিয়ায় থিতু হয়েছে। কলকাতায় থাকার সময় থেকে অপর্ণার সঙ্গে পরিচয়, প্রেম তারপর বিয়ে। সামাজিকভাবে বিয়ের দেওয়ার ব্যবস্থাও দিদি জামাইবাবু করেছিলেন।

ভাগ্নেটা তার খুব নেওটা। শুভমন নামটা স্বপ্নময়ের দেওয়া। দিদি জামাইবাবু ছেলেকে হাবুল নামে ডাকত। ছোটবেলা থেকে ছেলেটা সরল সাদাসিধা। হাবুলের তখন বছর পাঁচেক বয়স, সেই সময় একদিন দিদি তাকে খুব বকাবকি করছিল।

ব্যাপারটা কী জানতে গিয়ে স্বপ্নময় শোনে যে, হাবুলের নতুন লাল শার্ট দেখে তার বন্ধু গদাইয়ের খুব পছন্দ হয়েছিল। গদাই নাকি তার বাবাকে বলেছিল ওই রকম শার্ট কিনে দিতে, কিন্তু তার বাবা বলেছে হাতে টাকাপয়সা নেই এখন কিনে দিতে পারবে না। এই কথা শুনে হাবুল নিজের শার্ট গদাইয়ের সঙ্গে বদলাবদলি করে নতুন জামার বদলে গদাইয়ের রঙচটা শার্ট পরে বাড়ি ফিরেছে।

শুনে স্বপ্নময় বলেছিল,---- মিছিমিছি ওকে বকাবকি করছিস দিদি। ওর মনটা কত বড় সেটা দেখ। আজ থেকে ওকে আর হাবা, হাবুল বলবি না। ওর নাম আমি দিলাম শুভমন। দেখবি  একদিন সুন্দর মনের মানুষ হয়ে উঠবে।

স্কুলে ভর্তির সময় হাবুলের নাম পাকাপাকিভাবে শুভমন হয়ে গেল।

স্বপ্নময়ের দেওয়া নামকে সার্থক করে তোলার জন্যই যেন তার স্বভাব একদম অন্যরকম হয়ে উঠতে থাকল। পড়াশোনায় স্কুলের একদম প্রথম দিকেই ছিল। শুভমন যখন ক্লাস সিক্সের ছাত্র, তখন স্কুলে 'বাংলা পত্রলিখন ক্লাসে' শিক্ষক হোমওয়ার্ক হিসাবে সবাইকে বিভিন্ন বিষয়ের উপরে চিঠি লিখতে বলেছিলেন। সে সংবাদপত্রে স্থানীয় সমস্যা বিষয়ে একটা চিঠি লেখে। সে লিখেছিল তাদের স্কুলে আসার পথে একটা ছোট খাল পেরিয়ে আসতে হয়। যদিও খালে জল খুব কম থাকে হেঁটেই পার হওয়া যায় তবুও তাদের পায়ে কাদা লেগে যায়, অনেক সময় হাতের বই খাতা জলের মধ্যে পড়ে যায়, সেই জন্য খালের উপরে যদি একটি ব্রিজ তৈরি করে দেওয়া হয় তাহলে ছাত্রছাত্রীদের খুব উপকার হয়। চিঠিটা পড়ে শিক্ষক মহাশয় ক্লাসের সবাইকে পড়ে শোনান।  আনন্দের খবরটা বাড়ি ফিরে সে মামাকে জানায়। চিঠিটা পড়ে স্বপ্নময়ও অবাক হয়ে যায।  সে শুভমনকে বলে চিঠিটা আরও সুন্দর হত যদি সে গ্রামের অসুস্থ মানুষকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার অসুবিধার কথা লিখত। এরপর সে শুভমনকে একটা নামী সংবাদপত্রের সম্পাদকের নামঠিকানা দিয়ে বলে, একটা পোস্ট কার্ডে পুরো চিঠিটা লিখে ফেলতে। স্বপ্নময় শুভমনের পোস্টকার্ডটা ডাকবাক্সে দিয়ে দেয়। কয়েকদিন পরেই চিঠিটা সংবাদপত্রে ছাপা হয়ে যায়।

এরপর একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল। চিঠিটা  এক মন্ত্রীর নজরে পড়ে যায়। একটা ক্লাস সিক্সের বাচ্চার সামাজ সচেতনতায় তিনি মুগ্ধ হন। মন্ত্রীমশাই নির্দিষ্ট দপ্তরকে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। কয়েক মাসের মধ্যেই সেই খালের উপর একটা কংক্রিটের ছোট ব্রিজ তৈরি হয়ে গেল। স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে সে এই কাজের জন্য সংবর্ধনা পেল। গ্রামের লোকের কাছেও খুব প্রিয় হয়ে উঠল। খেলাধুলা তো ছিলই তার সাথে সাথে বন্ধুদের নিয়ে মাঝেমধ্যে পাড়ার রাস্তাঘাট পরিষ্কার করা, জঙ্গল পরিষ্কার করা এসব কাজ শুরু করল। মাধ্যমিক পরীক্ষার দেওয়ার পর সন্ধ্যাবেলায় গ্রামের বয়স্কদের পড়ানোর কাজ শুরু করেছিল। স্কুল থেকে ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত সব সময় বিভিন্ন ধরনের সামাজিক কাজকর্মে যুক্ত থেকেছে।

স্বপ্নময় কোনদিন সক্রিয় রাজনীতি করেনি, তবে বেশ কিছু গণসংগঠনে এখনও যুক্ত আছে। শুভমন কিন্তু ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিল। তারপর কিছুদিন সক্রিয়ভাবে রাজনীতিও করেছিল। রাজনীতি করার সময়  কিছু দলীয় কর্মীর বেআইনি কাজকর্মের প্রতিবাদ করায় দলের বিরাগভাজন হয়। এক সময় বিরোধ চরমে ওঠে। বীতশ্রদ্ধ শুভমন রাজনীতি ছেড়ে দেয়। ঠিক এই সময় প্রায় নিশ্চিত হয়ে থাকা তার একটা চাকরির সম্ভাবনা নষ্ট হয়। প্যানেলের প্রথম দিকে তার নাম থাকা সত্ত্বেও কোন এক অজ্ঞাত কারণে প্যানেলটা বাতিল হয়ে যায়। এরপর হঠাৎ সে সকলের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়, ঘর থেকে বেরনো বন্ধ করে দেয়। কঠিন মানসিক অবসাদে ভুগতে থাকে।

বিপদের দিনে দিদি তাকে ফোন করে। স্বপ্নময় শুভকে তার কাছে নিয়ে আসে। কিছুদিন কাউন্সেলিং এবং অপর্ণার পরিচর্যায় সে সুস্থ হয়ে ওঠে। স্বপ্নময় শুভমনকে একটা দোকান করে দেয়। টাকা পয়সা সে কিছুটা দেয় আর জামাইবাবু কিছু পাঠিয়েছিলেন। শুভমন ব্যবসা করা শুরু করল, কিন্তু তার সেই স্বাভাবিক স্বভাব কেমন যেন বদলে গেল। নিজের কাজ ছাড়া অন্য কোন ধরনের কাজে সে আর উৎসাহ পেত না। লোকজনের সঙ্গেও খুব একটা মেলেমেশা করত না।এখন অবশ্য ব্যবসার প্রয়োজনে অনেকের সঙ্গে কথাবার্তা বলে। স্বপ্নময় লক্ষ্য করেছে শুভর দোকানে শাসক, বিরোধী দু ধরনের রাজনীতির লোকজনই আসে। শুভমন ব্যালেন্স করে চলে। এখন সে যে সমস্ত কথাবার্তা বলে তার অনেকটা ডিপ্লোম্যাটিক।

বাড়িতে আপাতত  তারা দুজনেই আছে। অপর্ণা কয়েকদিনের জন্য টুবাইকে নিয়ে বাপের বাড়ি গেছে।

কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর স্বপ্নময় টিভি খুলল।

টিভির শব্দে শুভমন মুখ তুলল ---- যাই চানটা করে করে নিই। দোকানে বেরোতে হবে।

সে বাথরুমে ঢুকে গেল। স্বপ্নময়ের চোখ আটকে গেল একটা বাংলা চ্যানেলে। একটা গ্রামের ছবি দেখাচ্ছে। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে, একটা বাড়ি নয় অনেকগুলো বাড়ি একসঙ্গে জ্বলছে।রিপোর্টার জনাচ্ছে যে, প্রায় চল্লিশটা বাড়ি, দোকান জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। মহিলা শিশুরা গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। পুরুষদের দেখা যাচ্ছে না। গ্রামটার নাম শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেল স্বপ্নময়। বাবলাতলি। এই গ্রামেই তার দিদির বাড়ি। তৎক্ষণাৎ টিভির সাউন্ড মিউট করে দিল স্বপ্নময়। দিদিকে ফোন করল রিং হয়ে গেল কেউ ধরল না। জামাইবাবুকে ফোন করল সুইচ অফ। ভাগ্নিকে চেষ্টা করল লাইন পাওয়া যাচ্ছে না। চূড়ান্ত অস্থিরতা নিয়ে উঠে পড়ল।  বাথরুমের দরজায় গিয়ে টোকা দিল। ভিতরে জলের শব্দ শোনা যাচ্ছে।

একটু জোরে শব্দ করতে সাড়া দিল,----  কী ব্যাপার দরজা ধাক্কাচ্ছো কেন? পটি?

স্বপ্নময় খুব চাপা গলায় বলল,---- শুভ, তাড়াতাড়ি আয় খুব দরকার। তার গলার স্বরে এমন কিছু ছিল যা  শুনে শুভমন বলল, কী হয়েছে মামা?

---  আয় তারপর বলছি।

 

মাথা মুছতে মুছতে ঘরে ঢুকল শুভমন। স্বপ্নময় তখন টিভির দিকে তাকিয়ে বসে আছে।

ঢুকে বলল,---  কিগো হামাস কি ইসরাইলে মিসাইল ঝেড়েছে?

অত্যন্ত গম্ভীর স্বরে স্বপ্নময় বলল,---  সব সময় ফাজলামি করিস না।

সে স্বপ্নময়ের পাশে বসে পড়ল। টিভির দিকে তাকিয়ে দেখল বাড়ি, ঘর জ্বলছে। মানুষ উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটছে। একদিকে রিপোর্টার কী বলছে শোনা যাচ্ছে না।

সে বলল,--- সাউন্ড বাড়াও।

তখনই স্ক্রিনে ব্রেকিং নিউজ ভেসে উঠল। পরপর লেখা আসছে...

সকালে রাজনৈতিক কর্মী খুন। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই খুনের বদলা হিসেবে একটা গোটা গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হল। জ্বলছে বাবলাতলি গ্রাম। এই পর্যন্ত দেখে শক্ত করে স্বপ্নময়েরর হাত চেপে ধরল শুভমন।

--- এসব কি দেখাচ্ছে মামা? এতো আমাদের গ্রাম।  তাহলে কি আমাদের বাড়িও?  উদভ্রান্তের মতো স্বপ্নময়কে বলল, --- ফোন করো। বাবাকে ফোন করো মামা।

স্বপ্নময় বলল, --- অনেকবার ফোন করেছিরে কিন্তু কাউকেই পাওয়া যাচ্ছে না।

--- তাই আবার হয় নাকি? ছটফট করে সোফা থেকে উঠে পড়ল সে। পাশের ঘরে গিয়ে ফোন নিয়ে এল। অনেকবার চেষ্টা করল, তারপর অসহায় ভাবে বলল,---  কি করব মামা? কাউকে তো পাচ্ছি না।

স্বপ্নময় বলল, --- গ্রামের বন্ধুবান্ধব পরিচিত আর কাউকে পাস কিনা দেখ তো।

--- ঠিক বলেছ মামা। দেখি। আবারও চেষ্টা শুরু করল। তারপর ক্লান্ত হয়ে ফোন রেখে সে এসে টিভির সামনে বসে পড়ল।

টিভিতে দেখাচ্ছে, একটা ধানের গোলাঘর পুড়ে ছাই, একটা বাড়ির রান্নাঘরের ভাতের হাঁড়ি উলটে ভাত ছড়িয়ে আছে। রান্না ঘরের দরমার বেড়া জ্বলছে। একটা দোকান ঘর। রাস্তায় বিস্কুটের, চিপসের, প্যাকেট ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। দোকানটা দেখে শুভমন চিৎকার করে উঠল, --- এটা তো গদাইদের দোকান। তখনই দেখা গেল একজন মহিলা ক্যামেরার সামনে বলছেন, --- ওরা চার-পাঁজজন ছিল। প্রথমে লাঠি দিয়ে সব ভেঙ্গে দিল। ক্যাশ বাক্স তুলে নিয়ে চলে গেল। আমাদের গোয়াল ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।শুভমন বলল, --- কাকিমা, গদাইয়ের মা। আমাদের বাড়িটা দেখাচ্ছে না তো, তার মানে ওখানে কিছু হয়নি, তাই তো মামা? কিন্তু ফোনে কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না কেন? বলতে বলতে শুভমন আবার ফোন করার চেষ্টা করতে থাকে, স্বপ্নময়ও চেষ্টা করে।  দুজনেই ব্যর্থ হয়।

এদিকে টিভি রিপোর্টার তখন গ্রামের ছবি দেখাতে দেখাতে বলে চলেছে...

ঘটনা ঘটে সকাল সকালবেলায়। প্রতিদিনের মতো মর্নিংওয়াক সেরে দীনু শেঠ তার সঙ্গীদের সঙ্গে চায়ের দোকানে বসে ছিলেন। সেই সময় দুজন বাইক থেকে নেমে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে দীনু শেঠকে গুলি করে। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।সকলে হতভম্বভাব কাটিয়ে ওঠার আগেই দুস্কৃতিরা বাইক নিয়ে চম্পট দেয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন দুটো বাইকে মোট চারজন ছিল। সকলের মুখে মাস্ক ছিল। তার মধ্যে একজনকে তারা চিনতে পেরেছেন। তার নাম সাহেব মন্ডল, সে বাবলাতলি গ্রামের বাসিন্দা।ঘটনাস্থল থেকে বাবলাতলি গ্রামের দূরত্ব পাঁচ কিলোমিটার। হত্যাকান্ড ঘটার পর দীনু শেঠের অনুগামীরা দলবদ্ধভাবে বাবলাতলি গ্রামে চড়াও হয়ে নির্বিচারে বোমাবাজি,ভাঙচুর, লুঠতরাজ চালায়।  প্রায় তিরিশ চল্লিশটা বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। দর্শকরা দেখতে পাচ্ছেন চারিদিকে আগুন জ্বলছে।মনে হচ্ছে যুদ্ধবিধ্বস্ত গ্রাম। দু'কিলোমিটার আগে রাস্তা অবরোধ করে দমকলকে আটকে দেওয়া হয়েছে। এই মুহূর্তে গ্রাম পুরুষশূন্য।  এত বড় ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে তিন ঘন্টা অতিক্রান্ত এখনও গ্রামে কোনও পুলিশের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না।

অপর্ণা ফোন করল সে বারবার করে বলে দিল শুভমনকে যেন এই মুহূর্তে গ্রামের দিকে যেতে দেওয়া না হয়। অপর্ণা কালই ফিরে আসছে।

 দুপুর গড়িয়ে গেল স্বপ্নময়, শুভমন দুজনেই টিভির সামনে বসে। কোনও খবরই জোগাড় করা যাচ্ছে না। এখন টিভিতে এক রাজনৈতিক নেতা সাংবাদিকদের মুখোমুখি।তিনি বলছেন,--- এই হত্যা বিরোধীদের কাজ।বিরোধীরা  দীনুর মতো সৎ কর্মীকে হত্যা করেছে।এই ঘৃণ্য ঘটনা যারা ঘটিয়েছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে।

কেউ একজন প্রশ্ন করল,---- গোটা বাবলাতলি গ্রাম জ্বলিয়ে দেওয়া হয়েছে।গ্রামবাসীরা দীনুবাবুর অনুগামীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন।তারা কয়েক জনের নামও বলেছেন।তাদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

তিনি বললেন, ---  প্রকাশ্য রাস্তায় একজন সমাজসেবীকে খুন হতে হল।চোখের সামনে খুন হতে দেখলে মানুষের ক্ষোভ তৈরি হওয়া তো অস্বাভাবিক নয়। যতদূর খবর পেয়েছি ওখানে জনরোষের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

শুভমন অস্ফুটে বলল,--- শালা, জনরোষের গল্প শোনাচ্ছে!

 

প্রশ্ন এল,--- একজন সন্দেহভাজন অভিযুক্ত বাবলাতলি গ্রামে থাকে এই অপরাধে গ্রামটা জ্বালিয়ে দেওয়া হল। বোমাবাজি হল। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সংগঠিত সন্ত্রাস। মারের বদলা মার। এটাই নীতি?

 

---- ভুল ব্যাখ্যা হচ্ছে। মারের বদলে মার একথা  বলিনি।আমি বলেছি জনরোষের কথা।আমাদের পুলিশ আছে। তারা যথেষ্ট এফিশিয়েন্ট। তারা তদন্ত করে  প্রকৃত ঘটনা কী জানার চেষ্টা করবে। কেউ দোষী প্রমাণিত হলে আইনত ব্যবস্থা হবে।

শুভমন চিৎকার করে উঠল,--- পুলিশ করবে! পুলিশ তো দলদাস। হাতের পুতুল।

 

দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল। দুজনের ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া হয়নি। শুভমন বারবার গ্রামে যাওয়ার কথা বলছিল। স্বপ্নময় তাকে অনেক বুঝিয়ে নিরস্ত করেছে।শুভমনের অস্থিরতা কাটছে না। গ্রামের ছবি পাওয়া যাচ্ছে কিন্তু তাদের বাড়িটা দেখানো হচ্ছে না। দুশ্চিন্তা পাহাড়  হয়ে চেপে বসছে। স্বপ্নময়ের একটু বেরোনো দরকার। সন্ধ্যায় একটা মিটিং আছে। সে বেরোনোর জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। হঠৎ শুভমন চিৎকার করে ডাকল,---  মামা শিগগির এসো। আমাদের বাড়িটা দেখাচ্ছে।

প্রায় দৌড়েই টিভির ঘরে ঢুকলো স্বপ্নময়। সত্যিই টিভিতে তার দিদি জামাইবাবুর বাড়ি দেখা যাচ্ছে। বাড়িটা একটা কঙ্কালের মতো দাঁড়িয়ে আছে। স্ক্রিনে দিদি জামাইবাবু শুভমনের বোন সুমিতা তিনজনকেই দেখা যাচ্ছে। সুমিতা ফুঁপিয়ে কাঁদছে। টিভি রিপোর্টার জিজ্ঞাসা করল, ---আপনি কাঁদছেন কেন?

কাঁদতে কাঁদতে সুমিতা জবাব দিল, --- আমার সব শেষ হয়ে গেছে। আমার সমস্ত মার্কশিট, সার্টিফিকেট আর পরশুদিন আমার চাকরির পরীক্ষার এডমিটকার্ড সব পুড়ে ছাই। আমি কীভাবে পরীক্ষা দেব বলুন?আমার চাকরির আশা শেষ। 

--- ঘরের কিছুই বাঁচাতে পারেননি?

এবার দিদি উত্তর দিল, --- কিচ্ছু না। আমরা কোন মতে প্রাণ নিয়ে বেরিয়ে এসেছি। টাকাপয়সা এমনকি মোবাইলগুলো পুড়ে গেছে।  কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না।

জামাইবাবুকে দেখা যাচ্ছে আপন মনে হাসছেন।

স্বপ্নময় শুভকে বলল,--- জামাইবাবুর মাথার গোলমাল মনে হয় আবার বেড়েছে। ওষুধ ঠিক মতো খাচ্ছে তো?

শুভমন উত্তর দিল না। মনে হয় শুনতে পায়নি।

রিপোর্টার  জিজ্ঞেস করল, --- আপনি হাসছেন কেন? এবার হাসিতে পুরো মুখ ভরে গেল জামাইবাবুর। কাঁচাপাকা দাড়ি। সামনের কয়েকটা দাঁত নেই। কীরকম বোকাবোকা আর অসহায় লাগছে তাকে।

জামাইবাবু বলতে থাকলেন,--- হাসতিছি ওই বোকা মাইয়াডারে দেখে। আমার মাইয়াডারে একটু বোঝান তো স্যার, ঘরবাড়ি পোড়াইছে তয় জমিজমা তো আর পোড়াইতে পারে নাই। আমি জমি বেইচ্যা তরে চাকরি কিনা দিমুরে মা। এহন কি আর সাট্টিফিকেট দিয়া চাকরি হয় বোকা মাইয়া? দেখস না চাকরি বিক্কিরি হয়। আমি ট্যাহা দিমু তুই তর পছন্দ মতো চাকরি কিনা লবি। 

রিপোর্টার ক্যামেরা সরিয়ে নিয়ে অন্যদিকে চলে গেল।

স্বপ্নময় দেখল শুভ টেবিলে মাথা গুঁজে বসে আছে। সে শুভমনের কাঁধে হাত রেখে বলল,---  মন খারাপ করিস না। ওরা তো বেঁচে আছে। সব ঠিক হয়ে যাবে। তুই কিছুক্ষণ একা থাকতে পারবি তো? আমাকে একটু বেরোতে হবে।

--- কোথায়? শুভমন জিজ্ঞেস করল। আমাদের একটা পথসভা আছে সন্ধ্যায়।

--- কী বিষয়ে ?

--- ইজরায়েলের অমানবিক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে,সন্ত্রাসমুক্ত পৃথিবীর জন্য। তাছাড়া একটু আগে অঞ্জন ফোন করেছিল আজকের ঘটনাও যুক্ত করা হবে। মানুষের জীবনের অধিকার কেড়ে নেওয়া যাবে না।

--- ঠিক আছে যাও।

 

নিচে নেমে গেট খুলে বেরোনোর সময় স্বপ্নময় শুনল শুভমন ডাকছে, --- মামা।

তাকিয়ে দেখল শুভ দোতলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে।

--- কিছু বলবি?

--- বলছি আমি তোমার সঙ্গে পথসভায় যেতে পারি?

---- অবশ্যই। ঘরে বসে কী করবি ?চলে আয়।

তাহলে একটু দাঁড়াও আমি আসছি।

স্বপ্নময় বাড়ির উল্টো দিকের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকল। দরজা বন্ধ করে কিছুক্ষণের মধ্যেই শুভমন বেরিয়ে এল। ডিসেম্বরের বিকেল দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। কুয়াশা মাখা ছায়ায় শুভমনের মুখ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না।  লনের লাইট জ্বলিয়ে দিতেই আলোকিত হল শুভমন।

স্বপ্নময় রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখছে শুভ আবার পথে নামল।

 

'দিল্লি এক্সপ্রেস' পত্রিকায় প্রকাশিত।

0 Comments

Post Comment