দেশের আত্মার সঙ্গে লগ্ন থেকে জাতীয় পতাকা উর্ধ্বে তুলে ধরে শক্ত মাটিতে পা রেখে ভারতের মুসলমানের প্রতিবাদ মিছিলের সামনে দাঁড়াতে পারছে না পুলিশও। এতটাই ভয় পেয়েছে শাসক।
সিএএ, এনআরসি, এনপিআর বিরোধী আন্দোলন মুসলমানরাই শুরু করেছে। যদি বলি এ আন্দোলনে নেতৃত্ব মুসলমানদের হাতে? তা কি বাড়িয়ে বলা হবে? মোটেই না। দেওয়ালের লেখা সঠিকভাবে পড়ে ভারতীয় মুসলমানরা আজ নিজের প্রতিবাদ নিজে করার সঙ্কল্প নিয়ে পথে বেরিয়েছে। ভারতের প্রায় সব ছোট বড় শহরে মানুষ পথে নেমেছে হাজারে হাজারে। লক্ষণীয় গত দু-তিন সপ্তাহে জুম্মার নামাজ শেষ করে হাজারে হাজারে মুসলমান নামাজি পথে বেরিয়ে পড়েছেন মুসলমানকে ‘অপর’ করে দেওয়ার অসাংবিধানিক আইন এবং বিজেপি সরকারের সেই সংক্রান্ত যাবতীয় উদ্যোগ বানচাল করে দেওয়ার জন্য।
সেই প্রতিবাদ মিছিলে বহন করা হচ্ছে বিশাল সব জাতীয় পতাকা। মিছিলে একটাই পতাকা— তেরঙা। তাদের হাতে কোনও দলীয় পতাকা নেই। নেই কোনও দলীয় শ্লোগান। এতেই ভয় পেয়েছে শাসক বিজেপি। ভয় অবশ্য পেয়েছে হিন্দুত্ববাদীরাও। দেশের আত্মার সঙ্গে লগ্ন থেকে জাতীয় পতাকা উর্ধ্বে তুলে ধরে শক্ত মাটিতে পা রেখে ভারতের মুসলমানের এই যে মিছিল, তার সামনে দাঁড়াতে পারছে না পুলিশও। উত্তরপ্রদেশে তাই আড়াল থেকে গুলি চালিয়ে প্রতিবাদীদের খুন করেছে। বাকিদের খুঁজে বেড়াচ্ছে মারবে বলে। শয়ে শয়ে গ্রেফতার করছে। হুলিয়া জারি করেছে সরকার প্রতিবাদীদের ধরার জন্য। পুরস্কার ঘোষণা করেছে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য। এতটাই ভয় পেয়েছে শাসক।
মুসলমানরা বুঝেছে এ লড়াই তাদেরই লড়তে হবে। মুসলমানরাই লড়ছে। তাদের অধিকার রক্ষার লড়াইটা অন্য কেউ লড়ে দেবে, সেই ভরসায় আর বসে নেই মুসলমান। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর থেকে কোনও কিছুতেই মুসলমান যেন নিস্পৃহতা কাটছিল না। মুসলমানের বিরুদ্ধে যাবতীয় অন্যায়ের প্রতিবাদ করার দায় যেন উদার ধর্মনিরপেক্ষ হিন্দুদের। তেমনটাই চলে আসছিল। মুম্বই আর গুজরাটের ভয়াবহ দাঙ্গা, তারও পরে উত্তর প্রদেশের পর পর ঘটে যাওয়া মুসলমান নিধনের ঘটনাগুলোর পরেও তেমন করে প্রতিবাদ করেনি মুসলমান। এমনকী ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া বাবরি মসজিদের ওপর রাম মন্দির নির্মাণের যে ‘অন্যায়’ নির্দেশ সুপ্রিম কোর্ট দিল, তার বিরুদ্ধেও কোনও সোচ্চার প্রতিবাদ মুসলমানদের তরফ থেকে চোখে পড়েনি। গোরক্ষার নামে তুচ্ছ কারণে একটার পর একটা গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। তারও প্রতিবাদ করেনি মুসলমান। বিজেপি নেতারা দিনের পর দিন মুসলিম বিরেধী মন্তব্য করে চলেছেন। এবং নিশ্চিতভাবেই তাতে দলের ওপর মহলের অনুমোদন থাকে। তারও কোনও প্রতিবাদ হয়নি। প্রতিবাদ যা হয়েছে সবই ভারতের উদার হিন্দু বা ধর্মহীন ব্যক্তি বা সংগঠনের উদ্যোগে। ভারতীয় মুসলমান যেন ভুলতে বসেছিল প্রতিবাদের ভাষা। অথচ গত কয়েক বছরে বিভিন্ন সময়ে মুসলমানদের ঠেলতে ঠেলতে খাদের কানায় নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়েছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। হয় তাকে প্রবল শক্তিতে নিজের ক্ষমতায় নিরাপদ জায়গায় ফিরতে হবে নয়তো খাদে পড়ে মরতে হবে। এমন একটা জায়গায় পৌঁছে তার প্রতিবাদে গর্জে ওঠা ছাড়া উপায় ছিল না। মুসলমানও বোধহয় ভাবেনি তার এতটাই তাগত। যে আন্দোলন মোদী এবং অমিত সাহকে ভীত সন্ত্রস্ত করে তুলেছে। এতটাই ভীত যে তাঁরা কখন কোন কথাটা বলে ফেলছেন লিজেরাও জানেন না। ফলে পরস্পর বিরোধী বিবৃতি দিয়ে চলেছেন দুই নেতা।
সে প্রতিবাদে এখন গোটা দেশ সামিল। বিশেষত ছাত্র সমাজ। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যেভাবে ছাত্রছাত্রীরা প্রতিবাদের মঞ্চ হিসেবে সমাবর্তন অনুষ্ঠানকে ব্যবহার করছেন তাও অভূতপূর্ব। দেশ এমন দৃশ্য আগে দেখেনি। এই প্রতিবাদ দেখে কেবল বিজেপি নেতা মন্ত্রীরা নন, বহু সাধারণ মানুষও বলতে শুরু করেছে, নতুন সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনে বা এনআরসিতে মুসলমাদের উল্লেখ পর্যন্ত নেই, ‘ওদের’ এত ভয় পাওয়া কি হয়েছে!
নতুন সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বা নাগরিকপঞ্জীর পরিণাম জানার পরেও যদি কেই ভয় না পায় তাহলে তার মনুষত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ যতই বলুন, নতুন সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বা জাতীয় নাগরিকপঞ্জী মুসলমানদের লক্ষ্য করে করা হয়নি, সে আশ্বাস কোনও যুক্তিতেই ধোপে টেকে না। কারণ অমিত সাহ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই বলে চলেছেন, গোটা দেশেই এনআরসি হবে। এ দিকে, নতুন নাগরিকত্ব আইনে ভারতে এই প্রথম নাগরিকত্বের সঙ্গে ধর্মকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এবং তা করা হয়েচে ভারতের সংবিধানের মৌল শর্তগুলো অস্বীকার করে। এবং সেই আইনে কোথাও মুসলমান নেই। সরকারের যুক্তি, প্রতিবেশী তিনটি মুসলিমপ্রধান দেশ থেকে ধর্মীয় কারণে নির্যাতনের শিকার হয়ে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, শিখ, জৈন এবং পারশিরা শরণার্থী হয়ে ভারতে চলে এলে তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। এই আইনের সুরক্ষা পাবে কেবল অমুসলমানেরাই। তাতে মুসলমানদের তো কোনও ক্ষতি হবে না! প্রথমিকভাবে ক্ষতি তো মুসসলমানেরই। তবে একটা কথা মানতেই হবে মুসলমানের ক্ষতি মানেই আমাদের সবার ক্ষতি। প্রতিবেশীকে সরিয়ে রেখে ‘অপর’ করে দিয়ে কোনও আন্দোলন করা যাবে না। কোনও কিছু অর্জনও করা যাবে না।
আন্দোলনে সূত্র ধরেই একটা প্রত্যয় সবার মধ্যে স্থিত হতে শুরু করেছে, ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টার (এনপিআর) হোক বা ন্যাশনাল রেজিস্ট্রেশন অব সিটিজেনশিপ (এনআরসি)— কোনও ক্ষেত্রেই আমরা সরকারকে সহযোগিতা করব না। কোন নথি আমরা জমা দেওয়া বা তা জাচাই করার অনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশিদার হবো না। এটা আন্দোলনের উচ্চতর আরেক পর্যায়। সেই পর্যায় আরও অনেক কঠিন। তবে মত-ধর্ম নির্বিশেষে মানুষ যে ভাবে পথে নামছে তাতে ভরসা হয়— আমার এ দেশ প্রতিবাদ করতে জানে।