বিশ শতকের প্রত্যূষলগ্নে, কার্জনের বঙ্গভঙ্গ-এর বিরুদ্ধে বাংলাদেশে যে প্রবল গণ আন্দোলন জন্ম নিয়েছিল, সেই আবহে বিপিনচন্দ্র পাল ইংরেজ সরকারের হিন্দু এবং মুসলিম জনসাধারণের মধ্যে ভেদনীতির সক্রিয় প্রায়োগিক অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে আগামি দিনে যে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির জন্ম দেবে তা এই বাংলাদেশকেও একটা সময় সংক্রমিত করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন : ইংরেজ শাসকদের ‘কুটিল রাজনীতি’ দেশের উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ, আগ্রা অযোধ্যা প্রমুখ প্রদেশে হিন্দু এবং মুসলিমদের মধ্যে যে ‘বিদ্বেষবহ্নি প্রজ্জ্বলিত’ করেছে, ভবিষ্যতে বাংলাদেশেও তারা তাদের এই অপপ্রয়াস কার্যকরী করার জন্যে সক্রিয় উদ্যোগ জারি রাখবে। বিপিনচন্দ্রের সেই আশঙ্কা আমরা লক্ষ্য করেছি বিশ শতকের তিরিশের দশক থেকে চল্লিশ হয়ে পরবর্তী দশকগুলিতে প্রকটভাবে অনুশীলিত হতে। আর ইংরেজদের এই নোংরা কাজে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল হিন্দু মহাসভা এবং আরএসএস। আর এইসময় বাংলাদেশে এই বিভেদের অপরাজনীতি সংঘটনের দায়িত্ব নিয়েছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় স্বয়ং।
ভারতীয় জনতা পার্টি তথা বিজেপি ২০ জুন তারিখটিকে প্রতিবছর ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের জন্মদিবস হিসেবে পালন করে থাকে। আর শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণ দিবসটিকে কাশ্মিরে ৩৭০ ধারার অবসান ঘটানোর এবং কাশ্মির বাঁচাও দিবস হিসেবে পালন করতো। এখন তো বিজেপি সরকারের উদ্যোগে কাশ্মিরে ৩৭০ ধারার অবসান ঘটানো হয়েছে, ফলে সেই দিবসপালন এখন কার্যত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। আর কাশ্মির বাঁচাও দিবস-ও তো আর পালিত হওয়ার কথা নয় যেহেতু হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্তদের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে চলে এসে কাশ্মির এখন একটা সরকারি সন্ত্রাস অধ্যুষিত বিশাল জেলখানায় রূপান্তরিত হয়েছে। কিন্তু ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ পালনের প্রথা বিজেপি সাড়ম্বরে পালন করে চলেছে প্রতিবছর ২০ জুন তারিখে। কারণ ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের এই দিনটিতেই শ্যামাপ্রসাদের প্রত্যক্ষ প্রয়াসে অবিভক্ত বাংলাদেশের দ্বিধাবিভক্তির মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের জন্ম হয়। এই বঙ্গবিভাজনে তাঁর সাফল্যের জন্যে শ্যামাপ্রসাদ রীতিমতো গর্ববোধ করতেন। তাঁর রাজনৈতিক অনুসারীরা এখনও এই বলে প্রচার করে থাকেন যে এই বঙ্গবিভাজনের মধ্যে দিয়ে শ্যামাপ্রসাদ হিন্দুদের ‘রক্ষাকর্তা’র ভূমিকা পালন করেছিলেন! প্রতিবছর এই দিনটি পালনের মধ্যে দিয়ে বিজেপি ও শ্যামাপ্রসাদের অনুগামী হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্তরা হিন্দু এবং মুসলিমদের মধ্যে বাঙালিত্বের বিভাজন ঘটাবার মতো অপকর্মের যাথার্থ্য দান করে থাকে।
স্মরণ থাকতে পারে যে সঙ্ঘপরিবারের ব্রতবদ্ধ সৈনিকদের কাছে শ্যামাপ্রসাদ হচ্ছেন একজন মহান ‘জাতিয়তাবাদী এবং দেশপ্রেমিক’। তিনি জাতির ঐক্যের লক্ষ্যে তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন! আমাদের দেশের বিজেপি সরকারের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তো শ্যামাপ্রসাদকে একজন ‘মহান রাজনীতিবিদ, চিন্তক এবং দেশপ্রেমিক’ হিসেবে আখ্যাত করে বলেছেন যে তিনি জাতীয় সংহতি রক্ষার স্বার্থেই সারাজীবন কাজ করে গিয়েছেন! শ্যামাপ্রসাদকে হিন্দুত্ববাদীরা স্বাধীনতার ‘উপাসক’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছেন যে তিনি ‘নিয়মতান্ত্রিক’ পদ্ধতিতেই দেশের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে ব্রতী হয়েছিলেন! এখানে একটা কথা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে যে স্বাধীনতালাভের লক্ষ্যে শ্যামাপ্রসাদ নিয়মতান্ত্রিক পথকেই বেছে নিয়েছিলেন। তিনি ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে দেশের মুক্তিসংগ্রামীদের সশস্ত্র লড়াইকে মান্যতা দেননি। তিনি নিয়মতান্ত্রিক পথে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমেই দেশের স্বাধীনতালাভের চিন্তাকে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন! এইজন্যেই কি পরাধীন দেশের সরকারি ক্ষমতার রাজনীতিকে তিনি তাঁর হিন্দুত্ববাদী লক্ষ্য সাধনের সোপান করে তুলেছিলেন?
বিজেপি এবং সংঘপারিবারিক ফ্যাসিস্তরা যে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে ‘নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক’ হিশেবে চিহ্নিত করতে চায় তা বাস্তবিক এক নিদারুণ অতিকথা বই কিছু নয়। দেশপ্রেমিক বলতে যদি দেশমুক্তির সক্রিয় সৈনিক হওয়ার কথা বোঝায়, তবে নিঃসন্দেহে শ্যামাপ্রসাদ ছিলেন দেশমুক্তির বিরোধী। তিনি বিদেশি ব্রিটিশ শাসনের নিগড় থেকে মুক্তির লক্ষ্যে দেশবাসীর স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন। তিনি যে শুধুমাত্র দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে সচেতন এবং সুচিন্তিত দূরত্ব বজায় রেখেছিলেন তাই নয়, তিনি সাম্প্রদায়িক বিভাজনের সক্রিয় রাজনীতি করার মধ্যে দিয়ে এদেশের স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার নজির রেখেছিলেন এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে ভাঙন ধরাবার নজির সৃষ্টি করেছিলেন।
প্রাক-সাতচল্লিশ পর্বে শ্যামাপ্রসাদ ছিলেন বিনয় দামোদর সাভারকরের মতো কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতার রাজনৈতিক অনুসারী এবং সাম্প্রদায়িক সংগঠন হিন্দু মহাসভার অগ্রগণ্য নেতা। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৮ অগাস্ট কংগ্রেস যখন ভারত ছাড়ো আন্দোলনের আহ্বান জানায় এবং তার প্রেক্ষিতে ৯ অগাস্ট থেকে এক বিশাল গণআন্দোলনের বিস্ফোরণ ঘটে, তখন সেই আন্দোলন দমন করতে ব্রিটিশ শাসকেরা একদিকে যেমন নির্মম দমন পীড়ন নামিয়ে এনেছিলেন, তেমনই অন্যদিকে এক সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। এইসময় কংগ্রেস নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়, প্রাদেশিক সরকার ভেঙে দেওয়া হয়। সারা ভারত এক বিশাল জেলখানায় পরিণত হয়েছিল সেসময়। ব্রিটিশ সরকারের দমন পীড়নের শিকার হয়ে হাজার হাজার আন্দোলনকারী নিহত এবং কারাবন্দি হয়েছিলেন। এইসময় হিন্দু মহাসভা এবং আরএসএস-এর ‘জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলি’ মুসলিম লিগের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে এই ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিরোধিতায় নেমে পড়ে বিদেশি ব্রিটিশ শাসকদের এই আন্দোলন দমনে মদত যুগিয়েছিল। এইসময় কানপুরে হিন্দু মহাসভার চব্বিশতম অধিবেশনে হিন্দুত্ববাদী নেতা এবং শ্যামাপ্রসাদের রাজনৈতিক গুরু সাভারকার দ্বিধাহীনচিত্তেই ঘোষণা করেছিলেন : ‘প্রায়োগিক রাজনীতির ক্ষেত্রে যৌক্তিক আপসনামাকে মান্যতা দিতে’ তাঁরা (অর্থাৎ হিন্দু মহাসভার নেতৃবর্গ) এতটুকু পিছপা নন। সমকালীন সিন্ধুপ্রদেশে সেখানকার হিন্দু মহাসভার নেতৃত্ব মুসলিম লিগের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কোয়ালিশান সরকার গঠন করেছে। বাংলার ক্ষেত্রে কী হয়েছে তা তো সবারই জানা। সেখানে কংগ্রেসের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে মুসলিম লিগের প্রাগ্রসর নেতৃবর্গ হিন্দু মহাসভার নেতৃত্বের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকার গঠন করেছে। এই কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছিল ফজলুল হকের নেতৃত্বে এবং ‘এই মন্ত্রিসভায় তাঁর সঙ্গে যোগ্য সংগত করেছিলেন আমাদের হিন্দু মহাসভার প্রাজ্ঞ নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় স্বয়ং’। এর ফলে হিন্দু এবং মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষেরা উপকৃত হয়েছেন।—এইভাবে একদিকে যেমন এই হিন্দু মহাসভাপন্থীরা ক্ষমতার অলিন্দে প্রাসঙ্গিক থাকতে ফজলুল হকের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকার চালানোর পক্ষপাতী ছিল, তেমনই দেশের স্বাধীনতাকামী সাধারণ মানুষের সাধারণ স্বার্থের বিরুদ্ধতা করতে গিয়ে বিদেশি ব্রিটিশ শাসকদের সঙ্গে সহযোগিতার অবস্থান নিয়েছিলেন। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৬ জুলাই সাভারকারের রাজনৈতিক শিষ্য এবং হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ তাঁর ব্রিটিশ প্রভুদের উদ্দেশে লিখেছিলেন : ‘কংগ্রেস এখন তাদের (বিয়াল্লিশের ভারত ছাড়ো) আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে সারা দেশে এক অভূতপূর্ব উত্তেজনাকর পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে। বিশ্বযুদ্ধের এই আবহে যারাই প্রবল গণ আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার চেষ্টা করে চলেছে তাদের বিরুদ্ধেই সরকারের উচিত প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলা!’—এখানেই শ্যামাপ্রসাদ থামেন নি। তিনি ব্রিটিশ সরকারকে একথাও জানিয়েছিলেন যে ফজলুল হকের নেতৃত্বে চলা বাংলা সরকার এবং তার সহযোগী হিন্দু মহাসভা (শ্যামাপ্রসাদ ছিলেন এই সরকারের উপমুখ্যমন্ত্রী) যৌথভাবে এই ভারত ছাড়ো আন্দোলন দমন করতে বিভিন্ন প্রস্তাবও দিতে আগ্রহী। এপ্রসঙ্গে শ্যামাপ্রসাদ লিখেছিলেন : ‘প্রশ্নটা হচ্ছে কীভাবে বাংলায় এই ভারত ছাড়ো আন্দোলন দমন করতে হবে তাই তো?’ বাংলাদেশের সরকারি (ব্রিটিশ) প্রশাসনকে এমন পদ্ধতি অবলম্বন করে তার প্রায়োগিক অনুশীলন করতে হবে যাতে করে ‘কংগ্রেসের আন্দোলন দানা বাঁধতে না পারে’। দেশের মানুষকে একথা বোঝাতে হবে যে তাঁরা কংগ্রেসের মদতে যে স্বাধীনতার কথা বলতে চাইছেন দেশের জনসাধারণের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সরকার গঠন করে ব্রিটিশ সরকার তো সেই কাজটিই করে চলেছে। একথা ঠিক যে কোনও কোনও ক্ষেত্রে তা খুব একটা সফল হয়নি। ‘ভারতীয়দের উচিত দেশকে রক্ষা করার জন্যে ব্রিটিশ সরকারের ওপর আস্থা রাখা’। বাংলার গভার্নর তো সাংবিধানিক প্রধান হিসেবেই বাংলা প্রাদেশিক সরকারকে সুপরামর্শ দান করেন।
হিন্দুত্ববাদী ঐতিহাসিক হিসেবে পরিচিত রমেশচন্দ্র মজুমদারও স্বীকার করেছেন যে শ্যামাপ্রসাদ মনে করতেন যে কংগ্রেসের নেতৃত্বে পরিচালিত ১৯৪২-এর ভারত ছাড়ো আন্দোলন প্রকৃতপক্ষে দেশের অভ্যন্তর বিশৃংখলা সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে এই যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে দেশ এবং ব্রিটিশ সরকারকেই বিপন্ন করবে; ফলে সরকারের উচিত এই আন্দোলনকে প্রতিহত করতে উদ্যোগ নেওয়া। ব্রিটিশ বিরোধী বিয়াল্লিশের গণ আন্দোলনের বিরোধিতা করে সরাসরি সরকারের পক্ষে অবস্থান নেওয়া শ্যামাপ্রসাদ সাতচল্লিশে দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা-বিভাজনে সক্রিয় অংশগ্রহণের সাফল্যে উল্লাস প্রকাশ করেছিলেন। আর এই শ্যামাপ্রসাদই হিন্দুসাম্প্রদায়িকদের কাছে বীরপূজায় নায়ক হয়ে উঠেছেন! বিশ্বাসঘাতকরাই বর্তমান ফ্যাসিস্ত জমানায় হয়ে উঠছেন দেশপ্রেমিক!