পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

ঘোড়া হাসছে

  • 11 June, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 1901 view(s)
  • লিখেছেন : নীহারুল ইসলাম
আমরা বাজারে যাই খালি হাতে। সঙ্গে থলে রাখি না। মাছ-মাংস, সবজি আর যা যা দরকার কিনে আনি প্লাস্টিকের ক্যারি ব্যাগে। জিনিসপত্র বাড়ি পৌঁছলেই সেই ক্যারি ব্যাগ ছুঁড়ে ফেলি বাইরে। বাইরে বাতাস। ক্যারি ব্যাগ বাতাসে উড়ে বেড়ায়। শেষপর্যন্ত তা পশুপক্ষীর গলায় তো বটেই আমাদেরও গলার ফাঁস হয় কিংবা পেটে গিয়ে জমা হয় মৃত্যুর কারণ হিসেবে। আমরা তার হিসেব রাখি না। এত কিছুর পরেও আমরা বাঁচতে চাই। ঘোড়া হাসবে না তো কী! ঘোড়া হাসছে, আমরা কাঁদছি ...

তৃতীয়বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রী পদে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শপথ নিলেন। ভাল কথা। এবারের নির্বাচনে এটাই চেয়েছিলাম। এই চাওয়া নিয়ে গত তিনমাস বেশ উৎকণ্ঠায় ছিলাম। গত ২ মে যখন ফল প্রকাশ হচ্ছিল তার ট্রেণ্ড দেখে ভাই নিরঞ্জনের কাছে পাঁচশো টাকা কেজি মৌরলা মাছ আর দেশি কাতলার মাথা কিনেছিলাম। ধারে। খেয়ে ঢেকুর তুলব বলে। দুপুরে টিভির পর্দায় চোখ রেখে ফলাফলের পরিসংখ্যান দেখতে দেখতে মৌরলা মাছের চচ্চড়ি আর দেশি কাতলা মাছের মাথার মুড়ি ঘণ্ট দিয়ে ভাত খাচ্ছিলাম আয়েশ করে। শেষে একটু আম-চাটনি। আহা! জীবন যাহারে কয়! উপভোগ করেছিলাম। ঢেকুর তোলার কথা মনে ছিল না। তারপর কেউ ‘কেমন আছেন?’ জিজ্ঞেস করলে খুব আনন্দের সঙ্গে বলে আসছিলাম, ‘খুউব ভালো আছি।’

আজ ৫ মে ২০২১, ‘খুউব ভালো আছি’ বলতে পারছি না। বিকেলে এক দাদাকে ফোন করেছিলাম বিশেষ প্রয়োজনে। ফোন ধরে দাদা বললেন, ‘আমি হাসপাতালে। আমার ভাইবউ এইমাত্র মারা গেল কোভিডে।’ তারপরেই এক পত্রিকা সম্পাদকের ফোন এল। তিনি প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন আমি কেমন আছি? বললাম, ‘ভাল।এই প্রথম ‘খুউব ভালো’ বলতে পারলাম না। বরং শোনালাম বেশ কয়েক বছর আগে আমাদের নশিপুরে শিশু মৃত্যুর গল্প। ঠিক এরকম সময়ে সেবার নশিপুর গ্রামে একসঙ্গে অনেক শিশুর মৃত্যু হয়েছিল। রাজ্য, দেশ, পরদেশে খবরটা ছড়িয়ে পড়েছিল। যে যেখান থেকে পেরেছিল, ছুটে এসেছিল। অজানা জ্বরে অনেক শিশুর মৃত্যু। কারণ কী তা জানতে। আমিও গিয়েছিলাম। কে কি রিপোর্ট পেশ করেছিল মনে নেই। তবে নশিপুরবাসী এক বৃদ্ধ আমাকে বলেছিলেন, ‘অজানা ফজানা কিছুই লয় গো বাপ! না খাওয়া ঘরের বালবাচ্চা পোঁহাত (ভোর) হলেই ছুটত লিচুরবাগানে। গাছ থেকে ঝরে পড়া লিচু কুড়িয়ে সারারাতের ভুখ মেটাত। তা লিচু যে গরম ফল অরা কি তা জানত? জানত না। তবে অদের ভুখ মিটত। আর তেড়ে আসত জ্বর। অভাবী বাপ-মা অত কী জানে? ভাবত জ্বর না জ্বর! গাঁয়ের হাতুড়ে ডাক্তার জ্বরের ওষুধ দিত। সারত না। সারবে কী, ভাতের বদলে লিচু খেয়ে জ্বর এলে সে জ্বর যে মরণ জ্বর হয়, একথা না জানি হামরা না জানে হামাদের ডাক্তার না জানে হামাদের সরকার!’

সম্পাদক মহাশয় আমার গল্প শুনে দুঃখ প্রকাশ করে ফোন ছাড়লেন। তারপর এইমাত্র ফেসবুক মারফৎ জানলাম, সৌরভ নেই। সৌরভ মুখোপাধ্যায়। না, সৌরভের সঙ্গে আমার আলাপ ছিল না। তবে তাকে আমি জানতাম। সে শুধু সাংস্কৃতিক কর্মী ছিল না, প্রকৃত অর্থে একজন মানবপ্রেমী যুবক ছিল। আপদে বিপদে সবার পাশে গিয়ে দাঁড়াত। তার জন্য খুব কষ্ট হল। কিন্তু এমন কষ্ট তো কতই হয়। হয়েই চলেছে। তা নিয়েই বেঁচে আছি। বাড়ি ফিরে টিভি খুলতেই দেখলাম, নতুন সরকার কোভিড আটকাতে আরও অনেক কিছু বিধির সঙ্গে লোকাল ট্রেন বন্ধের ঘোষণা করেছেন। ঢেকুর নয়, আমার হেঁচকি উঠল। মনে পড়ল সেদিনের মৌরলা মাছের চচ্চড়ি আর কাতলা মাছের মাথার মুড়িঘন্ট দিয়ে আয়েশ করে ভাত খাওয়ার কথা! আগের বারও ট্রেন বন্ধ হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর আচমকা ঘোষনায়। মানুষের কী দুর্ভোগ হয়েছিল, আমরা দেখেছিলাম। কেউ কেঁদেছিলাম। কেউ কবিতা লিখেছিলাম। কেউ গল্প লিখেছিলাম। কেউ ছবি এঁকেছিলাম। কেউ গান বেঁধেছিলাম। ট্রেন হল আমাদের শরীরের ধমনীর মতো। রক্তের সঙ্গে অক্সিজেন বহন করে আমাদের সারা শরীরে ছড়িয়ে দেয়। আমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখে। আমাদের চেতনা দেয়। এখন এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে আমাদের শরীর নেই। ধমনী নেই। অক্সিজেন নেই। আছে বলতে চেতনা। সেই চেতনা, যা নিয়ে আমরা লড়ালড়ি করি, যাদের শুধু ভোট দেবার অধিকার থাকে। আর মরে গেলে আগামীতে যারা ভোট দেবে তাদের কাছে ‘শহীদ’ হিসেবে গণ্য হওয়ার জন্য।

~ঘোড়া হাসছে~

জ্বিনের ভয়ে আমরা আমাদের বাড়ি বা পাড়ার বা গ্রামের কুয়াগুলি বুজিয়ে দিয়েছিলাম অনেক আগেই। খাবার জলের জন্য যে পুকুর ছিল, তা ধংস করেছি তারপর। সেখানে বহুতল ইমারত গড়ে তুলেছি। মাথার আকাশ ঢেকে দিয়েছি। নিরাপদ থাকব বলে।

পানীয় জলের জন্য নিয়ে এসেছিলাম টিউবওয়েল। পাম্প। বানিয়াদের বিজ্ঞাপনের জেরে সেটাও একদিন অস্বাস্থ্যকর হয়ে গেল। এল বোতলের জল। সঙ্গে জল বিশুদ্ধ করার নানা ধরণের কৌশল।

একসময় আমাদের প্রত্যেকের বাড়ির লাছদূয়ারে থাকত একটা করে খাল। আমরা বলতাম সার-গড়হ্যা। বাড়ির যাবতীয় জঞ্জাল থেকে উচ্ছিষ্ট সব ফেলতাম সেখানে। বাড়িতে মুরগি-গোরু-ছাগল-মোষ তো থাকতই, তাদের মলমূত্র গিয়ে পড়ত। বছর ঘুরে চৈত্রমাসে তা হয়ে উঠত উর্বর সার। গোরুর গাড়িতে বয়ে নিয়ে গিয়ে ছড়িয়ে দিতাম চাষের জমিতে। আমাদের জমিগুলি হয়ে উঠত সুজলাসুফলা।

এখন আমাদের সার-গড়হ্যা নেই। মুরগি-গোরু-ছাগল-মোষ নেই। জমি আছে তবে সেখানে বাজার থেকে কিনে আনা রাসায়নিক সার ব্যবহার করি। কীটনাশক ব্যবহার করি। আমাদের ফলানো ফসল আমরা বাজারে বিক্রি করি। আর বাজার থেকে কিনে আনি প্যাকেট-জাত স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য।

তা বাদেও এখন আমরা পোল্ট্রি ডিম খাই। পোল্ট্রি মাংস খাই। চালানি মাছ খাই। দেশি মুরগির ডিম বা মাংস, দেশি মাছ আমাদের অধরা।

আমরা বাজারে যাই খালি হাতে। সঙ্গে থলে রাখি না। মাছ-মাংস, সবজি আর যা যা দরকার কিনে আনি প্লাস্টিকের ক্যারি ব্যাগে। জিনিসপত্র বাড়ি পৌঁছলেই সেই ক্যারি ব্যাগ ছুঁড়ে ফেলি বাইরে। বাইরে বাতাস। ক্যারি ব্যাগ বাতাসে উড়ে বেড়ায়। শেষপর্যন্ত তা পশুপক্ষীর গলায় তো বটেই আমাদেরও গলার ফাঁস হয় কিংবা পেটে গিয়ে জমা হয় মৃত্যুর কারণ হিসেবে। আমরা তার হিসেব রাখি না।

এত কিছুর পরেও আমরা বাঁচতে চাই। ঘোড়া হাসবে না তো কী!

ঘোড়া হাসছে, আমরা কাঁদছি ...

0 Comments

Post Comment